সমুদ্রটা ওদের হয়ে খেলা দেখায়। বছর বারোর যে মেয়েটি মিষ্টির দোকান সামলায়, একুশ বাইশের যে ছেলেটি সন্ধে থেকে ‘ভাত আছে ভাত আছে’ বলে চিৎকার করে, তেত্রিশের যে যুবক সারাদিন হয়তো একশো-দুশো কাপ চা বিক্রি করে, সমুদ্রটা ওদের হয়ে বছরের পর বছর দেখিয়ে যাচ্ছে খেলাটা। বুড়ো হয়েছে, তেমন ভাল খেলা দেখাতে পারে না, শরীর ভেঙে পড়েছে কিছুটা। তবুও হিংস্র, সবসময় এক অদৃশ্য চেনে বাঁধা। সামান্য এদিক-ওদিক হলেই আর নিস্তার নেই। শরীরও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এসেছি প্রায় চার ঘণ্টা হল। অথচ, খেলা দেখতে যাইনি এখনও। মুক্তমঞ্চ। খেলা দেখার জন্য কোনও টিকিট নেই, শুধু আশপাশের মানুষগুলোর দুবেলা পেট চালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে সমুদ্রটা। তবে পৃথিবীতে যেকোনও সম্পর্কই দেওয়া-নেওয়ার। কী ফিরিয়ে দিতে হয় সমুদ্রকে? কতবার কতজনের কাছে এই প্রশ্নটা করে বদলে শুধুমাত্র নীরবতাই পেয়েছি। কেউ কিছু বলতে চায় না। কী যে গোপন করে যেতে চায়, বুঝি না!
সমুদ্রটা পিছিয়ে গেছে অনেকটা। মাঝে দীর্ঘ সাদা বালির চর। এদিকে আর আসতে পারে না। এখানে আসার প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা বাদে ওকে প্রথম দেখলাম। খেলা দেখাতে দেখাতে মাঝেমাঝেই নিজের হাত-পায়ের শিকলগুলো দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। ব্যর্থ হয়ে পিঠের ওপর খেলাচ্ছে আকাশটাকে, মাথার ওপরে গনগনে সূর্যটাকে ভাসিয়ে রাখছে। অদ্ভুত, অলৌকিক এই খেলা।
হোটেলের রেজিস্টারে দুজনের পরিচয় নামক অংশে কী লিখব? আমাদের সম্পর্কের নাম কী? কীভাবে এই একটা ছোট খোপের ভেতর লিখে ফেলা যায়? লিখলাম, সম্পর্ক। হোটেলের মালিক সহজে সহজ কথা বুঝে নিতে চান, আপত্তি করার কোনও জায়গাই দেখলেন না। সস্তার হোটেল ঘরের বিলাস বলতে একটি ছোট ব্যালকনি। তবে, আমাদের বিলাসের প্রয়োজন নেই আপাতত। শুধুমাত্র দুজন দুজনের কাছাকাছি থাকার জন্য যতটা আড়াল প্রয়োজন, তা এখানে রয়েছে। ঘরে ঢুকেই নিভাকে জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে, তখনও দরজাটা ভাল করে বন্ধ করা হয়নি। তারপর সেই দরজার ওপরেই ওকে ঠেসে ধরে গভীর চুমু খেলাম।
চুমু খেতে আমি প্রথম শিখেছি চোদ্দো বছর বয়সে। টিউশন পড়ার ব্যাচে হঠাৎ চলে যাওয়া আলোর প্রশ্রয়ে ঠোঁট চেপে ধরেছিলাম শিখার ঠোঁটে। আহ শিখা, আমার সাহসী কৈশোর। তবে সে চুমু নয়, শুধু একটা ব্যর্থ চেষ্টামাত্র। তারপর ভিন্ন ভিন্ন ঠোঁটের ভেতর দিয়ে আমি যাত্রা করেছি। তার মধ্যে কয়েকজনকে ভেবেছি আমার আশ্রয়দাত্রী, কয়েকজন শুধুই একটা ঠোঁট। একটা ঠোঁট, খুব বেশি হলে একটা জিভ, তার মাঝে থুথুর আদানপ্রদান। এতদিনে চুমু বিষয়ে আমার দক্ষতা এত প্রবল হয়েছে যে, ভুলের সৌন্দর্যটুকু উধাও হয়ে গেছে। নিভার সামনে পোশাক খুলতে অস্বস্তি হওয়ার কোনও কারণ নেই। তবুও মধ্যবিত্ত লজ্জা কেমন শরীরের ভেতর জমে থাকে, কিছুতেই ছাড়তে চায় না। আমার এই পোশাকবিহীন শরীর দেখে নিভার কি অস্বস্তি হয় কোনও? যদিও এসব বিষয় নিয়ে ভাবনার কোনও কারণ নেই আপাতত। এই দীর্ঘ জীবনে একমাত্র নিভার সামনেই সমস্ত পোশাক খুলে ফেলতে সবচেয়ে কম অস্বস্তি হয়।
প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা পর বিরাট জন্তুটাকে দেখতে গেলাম। একমনে খেলা দেখিয়ে চলেছে। তবে দর্শক বিশেষ নেই। ওর হাত-পায়ের শিকলগুলো ঝনঝন করে উঠছে, প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা থেকে পড়ে যাবে সূর্যটা। খেলতে খেলতে পিঠ থেকে সরে যাবে আকাশ। তবে তেমন ক্রুদ্ধ ওকে কখনও দেখলাম না। হেমন্তের প্রাক-বিকেলের এক বিষণ্ণতা ওর চোখেমুখে এসে পড়েছে। অল্প অল্প করে চেটে নিচ্ছে আমাদের পা-গুলো। লালায় লালায় ভিজে যাচ্ছে আঙুল থেকে গোড়ালির ওপর অবধি।
নিভার একটা ছবি তুলে দিতে চাইলাম। আপত্তি করল। ছবি তুলতে মোটেই পছন্দ করে না ও। ওর প্যান্টের কিছুটা ভিজে গেছে লালায়। খিতখিত করছে, তবে যা রোদ শুকিয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। ওর গায়ের যে জামাটা, গড়িয়াহাট থেকে কেনা। কেনার সময় আমি সঙ্গে ছিলাম না, তবুও কীভাবে যে জানি! সমুদ্রের পাশে চায়ের দোকানে এসে বসলাম। তেত্রিশ বছরের যুবক। সারাদিনে হয়তো একশো-দুশো কাপ চা বিক্রি হয়। তখন ওর বউকে দেখিনি, দেখেছি সন্ধেবেলা। চোখদুটো দেখা যাচ্ছে না ওর, বালিতে পড়ে আছে।
—সমুদ্রটা কি পিছিয়ে গেছে অনেকটা?
—হ্যাঁ, স্যার। মাঝে এই চরটা পড়ে জল আর এদিকে আসতে পারে না।
—কখনওই আসে না?
—শুধু কোটালের সময়।
নিভার এই ঝিনুক কুড়োনোটা মোটেই পছন্দ নয় আমার। সমুদ্র থেকে ঝিনুকদের কেউ দূরে নিয়ে যেতে পারে না, একথা কি নিভা বুঝতে পারে না? রাতের বেলা পোশাক খুলে রাখার সময় ঝনঝন করে ওঠে ঝিনুকগুলো। নিভাকে কতদিন পর পেয়েছি। এত কাছে ওকে কেমন স্বপ্নের মত লাগে। নিভার কানে কানে বলি, তোমাকেই কেবল ভালবেসেছি।
তখুনি আচমকা একটা সিগাল পাখি ডেকে উঠল ঘরের ভেতরে। চমকে উঠে কিছুটা দূরে সরে গেলাম। কী হল? কী হল! কিছুই নয়। একটা সিগাল পাখির ডাক আসলে বুকের ভেতর নিয়ে ঘুরছি সেই বিকেল থেকে। নিভা বুকের ভেতর চেপে ধরাতে অন্ধকার হয়ে গেল দিগবিদিক। এক অদ্ভুত নোনা অন্ধকার, কোনও তল পাই না। বুকে হেঁটে কোনওক্রমে যেন পৌঁছলাম নিভার স্তনবৃন্তের কাছে। পিঠ ঠেকিয়ে বসলাম।
সমুদ্রটা রাতের বেলা আর খেলা দেখায় না। এবেলা ওর ছুটি। পিঠ ফিরে শুয়ে থাকে ওদিকে। শুধু মাঝে মাঝে ঘোড়াটির সঙ্গে কিছু কথা বলে। সারাদিন সওয়ারি করে ঘোড়াটা গিয়ে তখন দাঁড়ায় ওর মাথার সামনেটায়। ঘোড়াটি অন্ধ— একথা আমি জানি। ওর গায়ের ওপর একটা পুরোনো আসন। মুখের মধ্যে এক ভৌতিক বিষণ্নতা। ঠিক যেরকম বিষণ্নতা আমি দেখেছিলাম বারো বছর বয়সী মেয়েটির মুখে। মিষ্টির দোকান সামলায় আর টিভি দেখে। স্কুল বন্ধ। কথা বলে একটি বা দুটি। সকালের খাওয়াটা আমি ও নিভা ওখানেই সেরে ফেলি। তারপর একটু এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে আসি হোটেলের ঘরে। দুপুরের রোদে বাইরে থাকাটা অসম্ভব।
কার কাছে চাবি থাকে, সেকথা কিছুতেই মনে থাকে না। দুজনেই ব্যাগ হাতড়াই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর চাবিটা পাওয়া যায় আমার ব্যাগ থেকেই। দুপুরের সময়টা ঘুমোনোর। রাতের বেলা ঘুম হয় না। স্নান করে বিছানার ওপর নিজেকে ছড়িয়ে দিই। কিছুক্ষণ পর একই পথে আসে নিভা। ওর গা থেকে নোনা গন্ধ আসে। এত সতেজ লাগে যে, মনে হয় শুধুই জড়াজড়ি করি। সমুদ্রস্নানের আরাম যেন নিভার শরীরে। আমি নিভার শরীরের ভেতরে সমুদ্রটা দেখতে পাই। ওর হাসির ভেতর দেখি জল আর সূর্যের চিকচিক খেলাটা। ধীরে ধীরে জলে নামি, আরও গভীরে যাই। ঢেউ বাড়ছে আর পায়ের তলা থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে বালি। সেই বালির ভেতরে আমি খুঁজে চলছি একটি আশ্চর্য ঝিনুক। একটি ঝিনুক আমি খুঁজে পেতে চাই নিভার শরীরে। আমি তার ভেতরে লুকিয়ে থাকতে চাই লক্ষ লক্ষ বছর।
২
পৃথিবীর কোথাও বেশিদিন লুকিয়ে থাকা যায় না। আরও কিছুক্ষণ স্নান হলে ভাল হত। জল ছেড়ে উঠে আসতে হয়। অন্ধকার হয়ে গেছে চারিদিক। সমুদ্র এখন খেলাটা বন্ধ করে শোবে পাশ ফিরে। ওকে উত্ত্যক্ত করতে যাওয়া এখন বিপদ হবে। আমি ও নিভা সমুদ্রধার থেকে চলে আসি খাবারের দোকানগুলোর দিকে। আজ সারাদুপুর কিছু খাওয়া হয়নি।
একটি একুশ-বাইশ বছরের ছেলে, শরীর সুপুরি গাছের মতো, মুখ মায়াময়। ওর কাছেই খেতে গেলুম। রাতে কাঁকড়ার ঝোল, দুটো করে রুটি। ভাত খেলাম না। নিভার খিদে ছিল না বেশি। খাওয়ার পর চা— এই আমাদের দুজনেরই অভ্যেস। টোটোওয়ালা বললেন, তার গ্রাম বহু দূরে এক দ্বীপে। বললেন, এখানে পর্যটক বিশেষ নেই। নিভাকে জিজ্ঞেস করলাম, রাতের বেলা যদি খিদে পায়?
তবে, খিদে পেল না। বরং পেটের ভেতর গিয়ে কাঁকড়াটা জীবন্ত হয়ে উঠে হেঁটে বেড়াতে লাগল শরীর জুড়ে। হাঁটুর কিছুটা ছুলে গেছে, সস্তার হোটেল বলে বিছানার গদি তেমন ভাল নয়। নিভা একটা গান ধরল। আমি বাথরুমে নিজের শরীর থেকে বালি পরিষ্কার করতে করতে সে গান শুনছি।
আশ্চর্য! মনে হচ্ছে যেন নিভা নয়, সমুদ্রের ধারের কোনও ট্রানজিস্টার থেকে আসছে এক পুরোনো দিনের গান! মিশে যাচ্ছে বৃদ্ধ সিগাল পাখির ডাকের সঙ্গে, জলের ছলছল শব্দের সঙ্গে। মিশে যাচ্ছে আর আরও উত্থিত হয়ে উঠছে আমার পুরুষাঙ্গ। আমার পুরুষাঙ্গ যেন ওই সমুদ্রটা, যে খেলা দেখায়। বিরাট এক শেকল দিয়ে যাকে বেঁধে রাখা আছে।
কাঁকড়াটিকে নিজের শরীরের ভেতর থেকে বালিতে ফিরিয়ে দিতে রাতে সমুদ্রে গেলাম আমি ও নিভা। কাল আমাদের ফিরে যাওয়ার দিন। রাতের বেলা গিয়ে দেখলাম, সমুদ্র এগিয়ে এসেছে অনেকটাই। পর্যটকশূন্য সাদা বালি মাঝখানে। দেখি সেখানে এসে শুয়েছে বারো বছরের মেয়েটি, যে মিষ্টির দোকান চালায়, একুশ-বাইশ বছরের ছেলেটি, যে কাঁকড়া খাইয়েছিল রাতে। দেখি, তেত্রিশ বছর বয়স্ক চাওয়ালা, যার দিনে একশো-দুশো কাপ চা বিক্রি হয় মোটামুটি, সকলে পাশাপাশি শুয়েছে আর সমুদ্র একে একে ধর্ষণ করছে তাদের। বিরাট জন্তুটার পায়ে শেকল নেই, শরীর অসমর্থ। তবু, একটুও ক্ষীণ হয়নি ওর ধর্ষণক্ষমতা। এই দৃশ্য দেখার জন্য একে একে বেরিয়ে আসছে লাল কাঁকড়ার দল। মুরগির কাটা মুণ্ডুগুলির ওপর দিয়ে তারা আসছে জন্তুটার কাছে। তাকে দেখছে, সম্মান করছে, মাথা নিচু করছে।
আমি ও নিভা জেনে গেছি এই রহস্যটা। বুঝে গেছি দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কটুকু। কাল দুপুরের ট্রেন, নামখানা লোকাল। প্রায় তিন ঘণ্টার পথ পেরিয়ে কলকাতা। তারপর নিজ নিজ বাড়ি। নিভার শরীরে আমার গন্ধটা ফিকে হয়ে যেতে হয়তো আড়াইটা দিন। তারপর একদিন হঠাৎ আমার শরীরের বিভিন্ন ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসবে লক্ষ লক্ষ লাল কাঁকড়ার দল আর দূরে কোথাও হিংস্র জন্তুটা উন্মাদের মত হেসে পাশ ফিরে শোবে।
নিভা আমি দুজনেই জানি, আমাদের শরীরের ভেতর সমুদ্রটা পিছোতে পিছোতে একদিন বহুদূর চলে যাবে। খেলা দেখাবে না আর। আর কেউ ওর ধারে বসে ছুড়ে ছুড়ে ফেলবে না অহেতুক খুচরো পয়সাগুলোকে।
বকখালি গেলেন, আর এতো সুন্দর করে লিখলেন… ভীষণ ভীষণ ভালো লাগলো.. ?