Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বিশ্ব বিরিয়ানি দিবস: উত্তরের প্রবেশদ্বারের দাওয়াত-এ-ইশক

শুরু হয়েছিল একটি বাসমতী চাল প্রস্তুতকারক সংস্থার বিজ্ঞাপনী প্রচারের অংশ হিসাবে, কিন্তু বছর পাঁচেক ধরে জুলাই মাসের প্রথম রবিবার উদযাপিত হয় বিশ্ব বিরিয়ানি দিবস হিসেবে। এই বছর ২ জুলাই ভোজনবিলাসীদের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।

প্রেমাঙ্কুর আতর্থী তাঁর কালজয়ী আত্মজীবনী ‘মহাস্থবির জাতক’-এ ১৯২২ সালে পরিহাসছলে বৃহদারণ্যকের একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে দেখিয়েছিলেন— বেদে বিরিয়ানি জাতীয় খাদ্যের একটি আদিরূপের সন্ধান পাওয়া যায়। ভাগ্যিস কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা এই জাতীয় উদ্ধৃতির খবর রাখেন না! যতই বিরিয়ানিকে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ‘স্টেপল ফুড’ হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন, গবেষকদের মতে, ভারতবর্ষব্যাপী প্রধানত পাঁচ ধরনের বিরিয়ানি রয়েছে। জনপ্রিয়তম হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি, তামিলনাড়ুর চেট্টিনাড বিরিয়ানি, দিল্লির মোগলাই বিরিয়ানি, পাকিস্তান সীমান্তের সিন্ধ অঞ্চলের সিন্ধি বিরিয়ানি, এবং দাক্ষিণাত্যের মালাবার উপকূলের থালাসারি বিরিয়ানি। এই বিবিধের মাঝে মহান মিলন একজায়গাতেই— আসমুদ্রহিমাচল প্রচলিত এই খাদ্যে পেট ভরার সঙ্গে মন ভরার এক চিরকালীন রসায়ন আবহমানকাল থেকে কাজ করে যায়।

পরিসংখ্যান বলছে, মালদার মতো মিশ্র সংস্কৃতির একটি জেলা সদর কার্যত গৌড়বঙ্গের ‘বিরিয়ানি হাব’-এ রূপান্তরিত হয়েছে, যেটা বালুরঘাট বা রায়গঞ্জের ক্ষেত্রে ঘটেনি। তার কারণ, মূলত ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠা এই শহরে আগত বিভিন্ন রুচির মানুষ নির্দিষ্ট দামের মধ্যে পেট ভরা এবং সুস্বাদু খাবার চান। এই প্রাথমিক চাহিদাকে অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। হোটেলগুলিতে মাংস-ভাতের থালি যেখানে ১৩০-১৪০ টাকার কমে পাওয়া যায় না, সেখানে অনায়াসে চিকেন বিরিয়ানি পাওয়া যায় ১০০-র মধ্যে। ভাত, আলু আর মাংসের জমাটি কম্বিনেশন— তার সঙ্গে তৃপ্তির আনন্দ। এটাই এখন মালদার বিরিয়ানি সংস্কৃতির ইউএসপি। এই জেলাশহরে ৬০ টাকার ‘কলেজ বিরিয়ানি’ যেমন পাওয়া যায়, তেমনই সাইকেলের ক্যারিয়ারে লাল শালু মোড়া হাঁড়ি নিয়ে নিম্নবিত্ত মহল্লার অলিতে-গলিতে পৌঁছে যায় ‘দুয়ারে বিরিয়ানি’। হ্যাঁ, এই নামেই সাইকেলবাহিত বিরিয়ানি স্থান করে নিয়েছে জনমানসে। অনলাইন ডেলিভারি অ্যাপের অর্ডার লিস্টের বেতাজ বাদশা বিরিয়ানির গ্রামের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়ার মধ্যে একধরনের গরিবের গণতন্ত্র আছে। রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘আমার কবিতা আমি জানি/ গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী’; রবীন্দ্রনাথ পারেননি— কিন্তু বিরিয়ানি সর্বত্রগামী হতে পেরেছে।

জুলাই মাসের প্রথম রবিবার উদযাপিত হয় বিশ্ব বিরিয়ানি দিবস।

তবে বছরখানেক আগেও ছবিটা এমন ছিল না। শহরের এই বদলে যাওয়া বিরিয়ানি সংস্কৃতি প্রসঙ্গে প্রবীণ ইতিহাসবিদ মো. আতাউল্লাহ স্মৃতিচারণ করে বলেন, বিগত পাঁচ বছরে অদ্ভুতভাবে মালদা শহরে বিরিয়ানির চাহিদা বেড়েছে। এই বিষয়টা নতুন নয়, একটা সময় যেমনভাবে মোগলাই বা দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের চাহিদা তৈরি হয়েছিল, একই রকমভাবে এই সময়ে দাঁড়িয়ে বিরিয়ানির চাহিদা তুঙ্গে। আজ থেকে প্রায় দশ-পনেরো বছর আগে শহরের প্রাণকেন্দ্র কে. জে. সান্যাল রোডের দিকে একটি রোলের দোকানে বিরিয়ানি পাওয়া যেত, তার পরবর্তীতে ইংরেজবাজার থানার বিপরীতে বিরিয়ানির বিক্রি শুরু হয়। কিন্তু এখন শহরের আনাচে-কানাচে অজস্র দোকান। যদিও সমস্ত দোকানে প্রকৃত গুণগত মানের বিরিয়ানি পাওয়া যায় না, তবুও মানুষজন সেই বিরিয়ানি খাচ্ছে। আসলে এর স্বাদ, গন্ধ ও পরিবেশনের রীতিটাই হয়তো মানুষের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।

দীর্ঘদিনের মালদা-বাসের অভিজ্ঞতা থেকে অধ্যাপিকা আইরিন শবনম সরাসরি বলেন— বিরিয়ানিকে ধর্মের সঙ্গে যোগ করার একটা চেষ্টা চলে বটে, তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলছি— এমন একটা সময় ছিল, সচরাচর বাঙালি খাবারের বাইরে বেরিয়ে বহু আগে শুধুমাত্র মুসলিম পরিবারগুলিতেই এই বিরিয়ানি খাওয়ার প্রচলন ছিল। সেক্ষেত্রে রাজ্যের বাইরে থেকেও বহু বাবুর্চি এসে মুসলিম বাড়িগুলিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিরিয়ানি রান্না করতেন, তবে তার সংখ্যা খুব হাতেগোনা। ইদ বা অন্য উপলক্ষে বাধ্যতামূলক বিরিয়ানির চল হয়েছে এই সেদিন। বাঙালি মুসলিমের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে বিরিয়ানি ছিল না… এমনকি, সেভাবে দেখলে মালদা ও দুই দিনাজপুরের রাজবংশীদের মধ্যে রান্নার পদ্ধতিগত একটা মিল আছে, যার কারণ একান্তই সামাজিক।

চাহিদার সঙ্গে যোগানের তাল মেলাতে এই শহর খুঁজে নিয়েছে নতুন পদ্ধতি। গুটিকয়েক দোকান বা রেস্তোরাঁ ছাড়া এখানে আলাদাভাবে বিরিয়ানি বানানো হয় না। শহরের বিরিয়ানির সিংহভাগ তৈরি হয় হরিশ্চন্দ্রপুর, সামসি বা পাশের রাজ্য থেকে আগত বাবুর্চিদের হাতে। তারপর তা পৌঁছে যায় রথবাড়ি, সুকান্ত মোড়, বুলবুলি মোড়, আই টি আই মোড়ের বিপণিগুলিতে। অর্থাৎ, এদের ভূমিকা সার্ভিস আউটলেটের। পরিসংখ্যান বলছে, লকডাউনের সময় শুধুমাত্র মালদা টাউনে সার্ভিস আউটলেটের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। শহরে আসা অসংখ্য মানুষের মুখে একটু দামি লম্বা চালের ভাত, ৬০-৮০ গ্রাম ওজনের একটা মাংসের টুকরো, আধখানা আলু আর বড়জোর একটা ডিমসেদ্ধর সঙ্গে তারা তুলে দেয় একটুকরো আরামের আনন্দ— দমবন্ধ চৈত্রের পর হঠাৎ শ্রাবণ যেমন স্বস্তি নিয়ে আসে। শায়ের কাওসর মুনিরের সেই বিখ্যাত কাওয়ালি গানের মতোই তার আবেদন ঊর্ধ্বমুখী— পেট হয়ে হৃদয়ের দিকে তার যাত্রা— ‘দিল নে দস্তরখান বিছায়া/ দাওয়াত-এ-ইশক হ্যায়!’

আসলে, বিরিয়ানি এই কলকাতা থেকে প্রায় চারশো কিলোমিটার দূরের মফস্বলের কাছে সাধারণের মধ্যে অসাধারণ হয়ে ওঠার আনন্দ। রেস্তোরাঁর সরু কাঠের টেবিলে এক প্লেট থেকে দুই চামচে ভাগ করে খেতে গিয়ে আঙুলে আঙুলে বা হাঁটুতে হাঁটুতে হঠাৎ ছোঁয়া লাগার মতোই যা হঠাৎ চমক জাগায়। চামচ ধরা হাতদুটোর বয়স বাড়ে, বিরিয়ানি ফুরোয় না…

চিত্র: গুগল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »