Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ক্যানসার সম্পর্কে প্রচলিত মিথ

ক্যানসার সম্পর্কে যে অসংখ্য মিথ (তর্কাতীত এবং অবিচলিত আস্থা) আমজনতার মনের গহনে সেঁধিয়ে গেছে, সেই মিথগুলি আকাশ থেকে পড়েনি বা স্বয়মেব মানুষের মনে জন্ম নেয়নি। বাস্তবিকতা হল ক্যানসার দুনিয়ার রথী-মহারথীদের শ্রীমুখ-নির্গত সেই ধারণাগুলি বিজ্ঞাপন-নির্ভর মিডিয়া বাহিত হয়ে বেদবাক্যতুল্য মান্যতা পেয়েছে জনমনে। আসুন, তার কয়েকটিকে নিয়ে প্রামাণিক পরিসংখ্যানের নিরিখে দেখা যাক, এই ধরনের প্রতিটি মিথকে সম্মানপূর্বক কবরস্থ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ কি না।

আজ প্রমাণিত যে, ক্যানসার হবার জন্য কোনও ‘কারণ’-এর দরকার পড়ে না। ‘ক্যানসার ইজ কজলেস’, এই তাত্ত্বিক অবধারণাটি, যা ১৯৭৩ সালে মনু কোঠারি এবং লোপা মেহতার আকর গ্রন্থ ‘The Nature of CANCER’-এ লিখে গেছেন, আজ পাঁচ দশক পরে ক্যানসার-দুনিয়ায় অন্যতম প্রধান বিচার্য হিসেবে মান্যতা অর্জন করেছে যে, ‘Cancer is cureless because it’s causeless’। তাঁদের প্রায় হাজার পাতার বইটিতে ছয় হাজারেরও বেশি তথ্যসূত্র উল্লেখ করে মনু-লোপা যে মিথ বা কল্পকথাগুলোর অসারতা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছিলেন, ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের বাইবেল মর্যাদাপ্রাপ্ত অবশ্যপঠনীয় পুস্তক, সম্মানীয় প্রতিটি মেডিক্যাল জার্নালে, তাঁদের নাম উল্লেখ না করেই নিজেদের উপলব্ধি হিসেবে পেশ করে চলেছে। একদম হালের উদাহরণটি দেখুন।

ড. মনু কোঠারি।

১৯৭৩ সালে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন জাগানোর ঠিক ৩৮ বছর পরে সিদ্ধার্থ মুখার্জির ‘Emperor of All Maladies: A Biography of Cancer’ (২০১১) প্রকাশিত হল। অসাধারণ, সুললিত ইংরেজিতে লেখা ওই বইটির জন্য অত্যন্ত সম্মানীয় পুলিৎজার পুরস্কার পেলেন সিদ্ধার্থ। মিডিয়া হাইপ তুঙ্গে। আমাদের পরিচিত, সৎ, জনদরদী চিকিৎসকদের একজনও সিদ্ধার্থের প্রায় ছয়শো পাতার, অতিক্ষুদ্র অক্ষরে লেখা বইটি পড়েছেন কিনা আমার জানা নেই। তাঁদের ক্যানসার সম্পর্কিত ক্লিশে, শতাব্দীপ্রাচীন ধ্যানধারণাগুলো শুনে মনে হয় বইটির নাম শুনলেও, তাঁদের কেউই বইটি দেখার সময় বার করতে পারেননি। এক যুগ আগে প্রকাশিত গ্রন্থে সিদ্ধার্থ ক্যানসার-যুদ্ধে অসফলতার কারণ সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তা হল: ‘Cancer, we have discovered is stitched into our genome.’ (পৃ. ৪৬২)। সহজ ভাষায়, ‘ক্যানসারটা আমাদের জিন-সজ্জায় সেলাই করে রাখা আছে’ বলেই তাকে নিকেশ করা অসম্ভব। আরও চার পাতা পেরিয়ে উনি খুল্লামখুল্লা স্বীকার করে নিচ্ছেন: ‘But with cancer, where no simple, Universal, or definitive cure is in sight— and never likely to be— the past is constantly conversing with the future.’ (পৃ. ৪৬৬)।

যাঁরা মনু-লোপার যুগান্তকারী ক্যানসার বিষয়ক পুস্তকটির অস্তিত্বের কথা শ্রদ্ধেয় স্থবির দাশগুপ্ত-কৃত ওঁদের আদিগ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের (২০০৭, ২০১৮) কারণেই শুনে থাকবেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে এই ক্যানসার সত্যটির উল্লেখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, ১৯৭৩ সালে ঐতিহাসিকভাবে যে অমূল্য তাত্ত্বিক বীক্ষার রত্নসম্ভার আমাদের দুই প্রাজ্ঞ ক্যানসার গবেষক সুস্পষ্টভাবে পরিভাষিত করেছেন সিদ্ধার্থ মুখার্জির মতো পশ্চিমা মাতব্বররা সেই ধারণাটিকেই নিজেদের আবিষ্কার বলে চালাবার অপচেষ্টা করছেন মাত্র! ক্যানসার সম্পর্কে প্রচলিত মিথ এবং মিথ্যাচারের কারণেই একদিকে ক্যানসার প্রসঙ্গে জেনেশুনে আতঙ্ক প্রচার অভিযান চালানো অব্যাহত আছে আর অন্যদিকে, আজকাল তো প্রায়ই মাসিক এক কোটি ডলারের ‘সিওর টু কিওর’ ‘ম্যাজিক বুলেট’ বাজারজাতকরণের বিজ্ঞাপন ফলাও করে ছাপা হচ্ছে।

মনু কোঠারি এবং লোপা মেহতার আকর গ্রন্থ।

ক্যানসার হবার পেছনে কোনও না কোনও বস্তু, পদার্থ বা এমনকি ভাইরাসকে নিশ্চয়ই থাকতেই হবে। এই সূর্যালোকিত বিশ্বে স্বয়ং সূর্য থেকে বেলাভূমিতে কোথায় নেই ক্যানসার সৃষ্টির এই খলনায়করা? মেডিক্যাল শব্দাবলিতে এদের কার্সিনোজেন বা ক্যানসারোজেন বলা হয়ে থাকে। আজ্ঞে না, এর একটিকেও খলনায়ক সিদ্ধ করা অসম্ভব। যখন আমাদের জানাই নেই কেন হয় ক্যানসার, আমরা কাল্পনিক অজানা, অদৃশ্য শত্রু হিসেবে ক্যানসার কারকের বা ‘কজালিটি অফ ক্যানসার’-এর লম্বাচওড়া লিস্টি জারি করতেই পারি। তার প্রামাণিকতা সিদ্ধ করতে পারি না। সেই লিস্টে সাম্প্রতিক সংযোজন হল পুরুষের বীর্য। মহিলাদের জরায়ু মুখের ক্যানসারের কারণ নাকি ‘হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস’, যা পুরুষের বীর্য বহন করে! লিটিগেটিং সোসাইটির নবাগতারা, তাদের জরায়ুমুখের ক্যানসার সৃষ্টির জন্য বয়ফ্রেন্ড, প্রাক্তন বা বর্তমান পতিদেবকে কোর্টে টেনে নিয়ে গেলে আগামী দিনে আশ্চর্যচকিত হবেন না।

এরই সঙ্গে ‘ক্যানসার কি তাহলে জীবাণুবাহিত’, অর্থাৎ সংক্রামক রোগ— এই মান্যতা পেয়ে যাবে না?

অত্যন্ত হাস্যকর এবং নিপাট সরলরৈখিক এই প্রতিপাদ্যটিকে যুক্তির কষ্টিপাথরে একটু ঘষামাজা করলেই এর অসারতা একজন সাধারণ মানুষের বুঝতে অসুবিধে হবে না। ধূমপান করতে থাকলে লাংসে ক্যানসারের বিপদ প্রায় অবধারিত! তাই কি? আসুন গাণিতিক ছাঁচে ফেলে দেখা যাক। ‘ক’ থেকে যদি ‘খ’ ক্যানসার হয়, তাহলে ‘ক’ ছাড়াও ‘খ’ কেন হয় এবং কেনইবা ‘ক’–তে বুঁদ অধিকাংশেরই ‘খ’ ক্যানসার হয় না?

১. ধূমপানের মৌতাতে বুঁদ মানুষদের মধ্যে লাং ক্যানসার প্রবণতার হার কতটা?

২. জীবনে কখনও ওই ‘ব্যাড হ্যাবিট’-এর শিকার ছিলেন না এমন মানুষদের লাং ক্যানসার হয় কেন?

প্রশ্ন দুটোই WHO-এর রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করেছেন বহু বিশেষজ্ঞ। আসলে, বিশ্বখ্যাত সম্মানিত ক্যানসার সংস্থান সেই ১৯৬২ সালেই তাদের অনুসন্ধান রিপোর্ট পেশ করেছিল যে, প্রতি ৭৪০ জন ধূমপানকারীর মাত্র একজনকেই লাং ক্যানসারে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে!

মার্ক্সবাদীদের ডিভ্যালুশন-এর কারণে উপরুল্লিখিত পরিসংখ্যান প্রচারের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠন বা বিখ্যাত ব্রিটিশ ক্যানসার সংস্থানটিকে ‘টোব্যাকো লবির দালাল’ বলে ‘ক্যানসারের কারণ তত্ত্ব’-এর রামধুন গাইতে থাকলে, ডিজিটাল দুনিয়ার পাঠকদের সামনে ল্যাজেগোবরে হবার বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না।

মনু-লোপার ক্যানসার বিষয়ক পুস্তক।

ক্যানসার গবেষণার বর্শামুখ প্রসঙ্গে ভাবতে বসলে ভীষণ অবাক লাগে। প্রতি ৭৪০ জন সিগারেটপ্রেমীর মাত্র একজনেরই বা ক্যানসার কেন হবে, তা নিয়ে গবে(ট)ষণা চলছে তো চলছেই। বাকি ৭৩৯ জনকে ক্যানসার কেন রেয়াত করে চলেছে, গবেষণার বর্শামুখ সেদিকে ঘোরানোয় ঘোর আপত্তি ড্রাগ লবির ড্রাগনদের।

আমাদের প্রত্যেকেই ভেবে দেখতে অভ্যস্ত নই যে, অন্তত হাজার খানেক পরিচিত আত্মীয়পরিজন, পাড়াপ্রতিবেশী, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, কর্মক্ষেত্রের ধূমপায়ী সহকর্মীদের, যাদের আমরা দীর্ঘদিন ধরে চিনি-জানি, তাদের ক’জনকে ফুসফুসের ক্যানসারে মরতে দেখেছি? ওই ৭৪০-এর মধ্যে একজনের বেশি কি? সুগ্রীবের মতো ‘এক লাফে সাগর পার’-মার্কা ‘মিথ’-বিশ্বাসী নই বটে আমরা। কিন্তু অপ-‘বিজ্ঞান’-এর মোড়কে বস্তাপচা মিথগুলি আমরা হেলায় ‘জনচেতনা’ প্রসারের অমূল্য সম্পদ ভেবে হেব্বি জোস নিয়ে সামিল হতে গর্ববোধ করি। বিজ্ঞানবিশ্বাসী (?) অন্ধভক্তদের সংখ্যা নেহাত কম নয়! আমরা একবারের জন্যও বিজ্ঞানের মোড়কে ঢাকা ‘মিথ’ প্রচারক জ্যাঠামশাইদের ভুলেও প্রশ্ন করি না যে, শতাব্দীব্যাপী সিগারেটের মৌতাতে বুঁদ জাপানিদের লাং ক্যানসার সবচেয়ে কম কেন হয়, আর কেনই বা তামাকু সেবন বিবর্জিতা চিনের মহিলাদের লাং ক্যানসার হবার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি? জ্যাঠামশাইদের অজানা থাকার কথা নয় এই পরিসংখ্যানের প্রচারক স্বয়ং WHO।

এর পরে WHO প্রচারে নেমেছিল ‘প্যাসিভ স্মোকিং’ বা নিষ্ক্রিয় ধূমপান নাকি আসল কালপ্রিট। সিগারেট না খেলেও নাকি নিস্তার নেই।

প্যাসিভ স্মোকিং নামক অনুমানভিত্তিক তত্ত্বটি তিন তিন বার মুখ থুবড়ে পড়েছে। শ্রদ্ধেয় বন্ধুবর স্থবির দাশগুপ্ত ‘তামাকু সেবনের কেচ্ছাকাহিনি’ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত, তথ্যসমৃদ্ধ লেখা তাঁর কয়েকটি পুস্তকে, নিবন্ধে লিখেছেন। জ্যাঠামশাইদের এর বিরোধিতা করে কলম ধরার সাহস কখনও চোখে পড়েনি। যদিও এদের কেউ কেউ পেছনে তাঁর সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ হুল ফোটানোর অজ্ঞতাজনিত ঈর্ষা প্রকট করার অভ্যাস বদলাতে পারেন না। যাইহোক, বিলিয়ন ডলারের প্যাসিভ স্মোকিংয়ের তাত্ত্বিক বাগাড়ম্বর ডাস্টবিনের সামগ্রী এখন। এ প্রসঙ্গে এই তথ্যটি স্মরণ রাখলে আমরা লাভবান হব যে, খাঁচায় বন্দি কয়েকশো ইঁদুরের ওপর তামাকের ধোঁয়া ভরে, বদ্ধ ঘরে খাঁচাটিকে রেখে দিয়েও উপরুল্লিখিত অনুমানভিত্তিক তত্ত্বটি কোনও সাফল্যের আভাসটুকুও দেখাতে পারেনি। ইঁদুরদের লাং ক্যানসার উৎপাদন করে দেখানো যায়নি।

স্থবির দাশগুপ্ত অনূদিত গ্রন্থ।

আর একটা কথা না বললেই নয়। বিহারের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে, ‘চারবাহা’ বলে পরিচিত দলিত (শিডিউল কাস্ট/ ট্রাইব) ছেলেমেয়েরা পাঁচ বছর বয়সেই পশু চরানোর কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে। খৈনি খাওয়া তাদের একটি বদভ্যাস। আজীবন এই অভ্যাস সত্ত্বেও মুখগহ্বর বা ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্তের হার এদের মধ্যে ঠিক কতটা ভয়াবহ?

দয়া করে, তামাকু লবির এজেন্ট দাগিয়ে, প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাবার কুচেষ্টা করবেন না!

ধরা যাক, কার্সিনোজেন বা ক্যানসারোজেন আমাদের শরীরে এই ‘মারক’, ‘খুনি’ রোগটির উৎপত্তির কারণ। এই অদ্ভুতুড়ে সিদ্ধান্ত থেকেই আকাশকুসুম ফতোয়ার জন্ম: ক্যানসার সৃষ্টির জন্য দায়ী ওই আপদগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে পারলেই তো কেল্লাফতে! যেমনটি ইতিমধ্যে আপনারা সিদ্ধার্থ মুখার্জির সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি শুনেছেন, তার সারকথা হল, রোগটি ভবিষ্যতেও কখনও নিরাময় হবে সেটা আশা না করাই ভাল; গত একশো বছরের পরিসংখ্যানও সেটাই বলছে। ক্যানসার সৃষ্টির কারণগুলোর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে ক্যানসার মৃতকের সংখ্যাও ধীরে হলেও বেড়েই চলেছে। আগেই উল্লেখ করেছি, স্বাস্থ্যপাগল বিত্তবান আমেরিকানদের প্রতি ক্যানসারের কৃপাদৃষ্টি সবচেয়ে বেশি। ‘কর্কটসহবাস’ শীর্ষক পুস্তকটির লেখক মহোদয়ের ‘শেষ কথা’-র ঠিক বিপরীত উন্নত দেশগুলিতে, বিশেষ করে সবচেয়ে বিত্তবান আমেরিকার মানুষদের প্রতি ক্যানসারের কৃপাদৃষ্টি সবচেয়ে বেশি কেন— লেখক অজয় গুপ্ত মহাশয়, আশাকরি একটু ভেবে দেখবেন।

আসুন, সেই ইতিহাসটা একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

১৯৭৬ সালের ৪ জুলাইয়ে আমেরিকার জন্মের দ্বিশততম বর্ষ উদযাপিত হবে ‘ক্যানসারমুক্ত’ নতুন আমেরিকায়। ঘোষণা করলেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। সেই লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে ‘ন্যাশনাল ক্যানসার অ্যাক্ট’-এ হস্তাক্ষর করে নিক্সনের দাম্ভিক ঘোষণার সারকথা ছিল মার্কিনী মেধা আর ধীশক্তির সামনে ক্যানসার তো তুচ্ছ। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত আমেরিকার বেস্ট সেলার বইটিতে আমরা দেখলাম, মার্কিনী মেধাবীদের মুখে ঝামা ঘষে ক্যানসার পুনরায় তার অপরাজেয়তার জয়ধ্বজা উড্ডীন রাখতে সক্ষম হয়েছে। লেখক জানালেন, ‘The most brilliant scientific minds were charged with unraveling the mysteries of CANCER and, since 1971, over 35 billion dollars has been invested in cancer research.’… ‘As the country was celebrating the Bicentennial in 1976, …a pattern emerged in the research. More people had cancer or were hobbled by chronic illnesses than the year before.’

‘ক্যানসার-বিরোধী প্রতিটি যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে প্রতিবারই ক্যানসার হেলায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করবেই।’ নিক্সনের ‘ক্যানসারমুক্ত’ বাগাড়ম্বর মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য, এই চ্যালেঞ্জটি ভারতীয় দুই প্রাজ্ঞ ক্যানসার গবেষক, অধ্যাপক, বিশিষ্ট চিকিৎসক মনু কোঠারি এবং লোপা মেহতা তাঁদের প্রায় হাজার পৃষ্ঠার আকর গ্রন্থ ‘The Nature of Cancer’-এর মাধ্যমে তাবড় ক্যানসার মহারথীদের সামনে ছুড়ে দিয়েছিলেন (১৯৭৩) এবং ঘোষণা করেছিলেন আগামী হাজারো বছর ব্যাপী প্রতিবারই এমনটাই ঘটবে।

পাঠক, স্মরণ করুন। চতুর সিদ্ধার্থ মুখার্জি, নিজের উপলব্ধি বলে ঠিক এই কথাগুলিই চালিয়ে দেবার অপচেষ্টা করেছেন। আগেই সেটা উল্লেখ করেছি।

রোগটি নিয়ে এই সময়ে বহু মতামত, নানান ধ্যানধারণার কথা, বিজ্ঞাপন-নির্ভর নামী প্রিন্ট অথবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জানার সুযোগ নেই। একথা, কমবেশি আমরা সবাই জানি। সোশ্যাল মিডিয়ায়, কিছু লিটল ম্যাগাজিনে, ক্যানসার যে ঠিক তেমনটা নয়, যেমনটা কিনা মেনস্ট্রিম মিডিয়ায় বলা হয়ে থাকে, প্রায়ই চর্চায় উঠে আসে। এপ্রিল ২০০৭ সালে ‘শুভমনকথা’-র সম্পাদকীয়তে ‘বিশ্বায়ন, শ্রেষ্ঠীসমাজ, চিকিৎসক, বৈজ্ঞানিক, রাজনীতিক প্রমুখের এক বহুমাত্রিক জালে কীভাবে সাধারণ মানুষ সঠিক চিকিৎসার নাগাল পেতে পারেন’ সেই প্রসঙ্গে লিখেছিল, বিশ্বময় বিতত বিতংস বা ছড়ানো ফাঁদে আমরা সবাই আবদ্ধ। তবু তারই মাঝে জনসিংহকে জাল কেটে মুক্তি দিতে বন্ধু মূষিক সহায়ক হয়। আপনার কম্পিউটারের মূষিক বন্ধু(মাউস)টির সাহায্যে পৌঁছে যান www.cancerfundamentaltruth. in ওয়েবসাইটে। জেনে নিন ক্যানসার সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য।’

অথচ আমাদের ‘এক নম্বর’ যে দৈনিকটি না পড়লে নাকি পস্তাতে হয়, শ্রদ্ধেয় উৎপল দত্ত যার নামকরণ করে গেছেন ‘দুঃখবাজার’, সেই আ-নন্দ-বাজারে এই ওয়েবসাইটের খবরটা লুকোনোর সচেতন প্রয়াসটা লক্ষ্য করুন। নভেম্বর ২০১৪-তে সদ্যপ্র‍য়াত বিশিষ্ট ক্যানসার-বিদ্বেতা মনু কোঠারি স্মারক সংখ্যা ‘একক মাত্রা’-তে ‘ক্যানসারের মিডিয়াপ্যাথী’ শীর্ষকে এই অধমের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই লেখাতে, ২০১৪ সালের ১৫ অগাস্টের আ-নন্দ-বাজারে ‘মানছি না’ শীর্ষক ক্রোড়পত্রটির ভূমিকা বাঁধা হয়েছিল এই বলে: ‘জগদ্দল পাথরের মতো ধারণাগুলোকে বয়ে নিয়ে চলা সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে যাঁরা নিজের কথা বলেন ও কলম ধরেন, তাঁদের কুর্নিশ।’ সত্যিটা যে তার সম্পূর্ণ বিপরীত, সেটা ক্যানসার-বিশেষজ্ঞ মনু কোঠারি এবং লোপা মেহতার নাম এবং তাঁদের ক্যানসার ধারণাটা লুকোনোর জন্য, তাঁদের ধারণাভিত্তিক ওয়েবসাইট (যার উল্লেখ ২০০৭ সালে প্রকাশিত মনু-লোপা’র বইটি পড়ে শুভমনকথা-র সম্পাদকীয়তে অত্যন্ত সম্মানপূর্বক পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল) সেকথা যাতে ‘এক নম্বর’ দৈনিকের পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে না যায়, সে জন্য কতটা নীচতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল, সবিস্তারে লিখেছিলাম। সাংবাদিকার লেখাটি পড়েই বোঝা যাচ্ছিল যে, তিনি স্থবির দাশগুপ্ত এবং শাঁওলি মিত্র অনূদিত মনু-লোপার বইটি পড়েই লেখাটি লিখেছেন। শাঁওলি মিত্র তাঁর ভূমিকায় আমাদের ওয়েবসাইট, ফোন নম্বর পর্যন্ত উল্লেখ করা সত্ত্বেও বহুলপঠিত ‘এক নম্বর’ দৈনিকটি, বিজ্ঞাপন-নির্ভরতার কারণেই ‘জগদ্দল পাথরের মতো’ প্রচলিত ক্যানসার চিকিৎসাটিকেই তার পাঠকদের মনের গহনে সেঁধিয়ে দেবার জন্য তাদের দায়বদ্ধতার নজির প্রস্তুত করতে বাধ্য হয়েছিল। এই অসততার আশ্রয় নেবার জন্য সরাসরি সাংবাদিকাকে দায়ী করার বদলে এর পেছনে ‘উপরওয়ালাদের অদৃশ্য হাত’ কাজ করে থাকতে পারে, সেটাও লিখেছিলাম।

যাইহোক, ক্যানসার প্রসঙ্গে সবচেয়ে জবরদস্ত যে ‘মিথ’-টি জনমনে ‘জগদ্দল পাথরের মতো’ প্রোথিত করার কাজটি গত একশো বছর ধরে চলছে তো চলছেই, তার গালভরা নাম হল DATE (ডায়াগনোস অ্যান্ড ট্রিট আর্লি)। ছড়ার রূপ দিয়ে বলতে পারেন, শুরুতে যদি পড়ে গো ধরা, ক্যানসার তো যাবেই মারা। আসলে, ‘নয় মণ তেলও পুড়বে না রাধাও নাচবে না’, বহুল আলোচিত এই মিথ্যাশ্রয়ী অজুহাতটা নিয়ে বিস্তারিত বিতর্ক সর্বস্তরে শুরু করা একান্ত কাম্য কেন, সেকথা বলেই লেখাটি শেষ করব।

শতাধিক ক্যানসার এবং ব্লাড ক্যানসারের মধ্যে স্তন ক্যানসারের দ্বৈতটা বুঝলে, অন্য ক্যানসারগুলিকে বুঝতে অনেক সুবিধা হবে। তাই এই ক্যানসারটিকে বিশেষভাবে বোঝা, জানা দরকার। প্রথমত, এই ক্যানসারটিকে উন্নত দেশগুলিতে ‘ডেড্রেড’ বা অত্যন্ত ভয়াবহ মনে করা হয়। অন্যদিকে, অত্যন্ত আশাবাদী এই ধারণাটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয় যে, একটু সতর্ক থাকলে, স্বয়ং এর বাহক মহিলারা রোগটির উপস্থিতির আভাস পেতে পারেন। এই ‘সেল্ফ এগজামিনেশন’-এর সারকথা হল, মহিলারা নিজেদের স্তনে দলা বা গাঁট (ইংরেজিতে যাকে লাম্প বলা হয়)-এর উপস্থিতি টের পেতেই পারেন। তার পর তো রোগটিকে সনাক্তকরণের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা, অবশেষে বায়োপসির পালা। আজকাল তো প্রযুক্তির ছড়াছড়ি। ক্যানসার ধরাও পড়ে। কিন্তু ক্যানসার কিওর রেট কি এর ফলে বাড়ে? সে বিষয়ে অভিজ্ঞ ক্যানসার-বিশেষজ্ঞ মহোদয়দের স্বীকারোক্তি আদপেই ইতিবাচক নয়। তাঁদের সুস্পষ্ট অভিমত হল, শল্য চিকিৎসার অবিশ্বাস্য উন্নতি, রেডিওথেরাপির অগ্রগতি এবং মহার্ঘ নিত্যনতুন কেমোথেরাপি চিকিৎসার ফলে বিগত পাঁচ দশকে স্তন ক্যানসারে মৃত্যুহার বেড়েছে। কমেনি। অন্য যেকোনও ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষদের ক্ষেত্রেও কথাটা সমানভাবে সত্য। উন্নত দেশের মানুষ জানেন যে, প্রতি দশ বছর অন্তর সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে এটাই স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে যে, উন্নত দেশগুলোর মধ্যমণি আমেরিকাতে সব ধরনের ক্যানসারকে একত্রে রেখে দেখা যাচ্ছে, দশবছর আগে প্রতি এক লক্ষ আমেরিকাবাসীর ১৬৩ জন মারা গেছেন। বর্তমানে সেই সংখ্যাটা ১৯৪-তে পৌঁছে গেছে।

যেকোনও ক্যানসারই হোক না কেন, তার শুরু কিন্তু আমাদের শরীরের সুস্থ কোষ থেকেই। অর্থাৎ সুস্থ কোষগুলিই ক্যানসার কোষে রূপান্তরিত হয়। ক্যানসারের প্রচলিত চিকিৎসার সারকথা হল, রূপান্তরিত এই কোষগুলোকে নিকেশ করা। কোনও ক্যানসার-বিশেষজ্ঞের পক্ষেই একথা বলা সম্ভব নয় যে, এই চিকিৎসার ফলে ঠিক কত দিন রুগি ক্যানসার-মুক্ত থাকবেন। শুধু তাই নয়, ক্যানসার-মুক্ত বলে ঘোষিত রোগীদের শরীরে ক্যানসার যে আবারও, বার বার পুনরায় দেখা দেবে না, সেই নিশ্চয়তা প্রদানে কোনও বিশেষজ্ঞ মহোদয় গ্যারান্টি দিতে পারবেন না। এই ক্যানসার নিকেশ অভিযানের ফলে রুগির বেঁচে থাকার চেহারাটা কেমন হবে, অর্থাৎ ‘কোয়ালিটি অফ লাইফ’ কি ‘লাইফলেস’ বেঁচে থাকার সমতুল্য হয়ে দাঁড়াবে না? প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই দেখা দেবে যে, প্রচলিত ক্যানসার-বিজয় অভিযান পরিহার করলে রুগির মৃত্যু কি ত্বরান্বিত হত?

এর কোনও সদুত্তর ক্যানসার-বিশেষজ্ঞ মহোদয়ের জানা নেই। তাঁদের এটাও জানা নেই যে, কেন ঘোর ক্যানসার অজ্ঞ থেকে ক্যানসার সর্বজ্ঞদের অধিকাংশের ক্যানসার একদম শেষ অবস্থায় পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত তাদের বাহকদের সামান্যতম বিব্রত করে না। ভারত সহ এই বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের, বিশেষ করে আমেরিকার মতো উন্নত দেশের ক্যানসার-বিশেষজ্ঞদের লিস্ট হাজির করে সঙ্গত এই প্রশ্নের সদুত্তর চাওয়া আমাদের মৌলিক অধিকার কেন বিচার্য হিসেবে স্বীকৃত হবে না! ক্যানসার-মুক্তির চাবিকাঠি হল, একদম শুরুতেই তার উপস্থিতি টের পাওয়া, এই প্রচার অভিযানের মুখ্য উদ্দেশ্য হল, চিকিৎসা-বিপর্যয়ের জন্য রুগি এবং তাদের পরিজনের ঘাড়ে দোষ চাপানোর অছিলা মাত্র। ‘শুরুতে যদি দেয় গো ধরা, ক্যানসার কে যাবেই মারা’, আসলে একটা মিথ মাত্র। আসুন, সম্মানপূর্বক এই মিথটিকে কবরস্থ করার আয়োজন করা যাক।

অবশ্যপঠনীয় মেডিক্যাল পুস্তক এবং বিশ্বচর্চিত মেডিক্যাল জার্নালগুলি খুঁটিয়ে পড়লে এই প্রশ্ন ভাবায় যে, ক্যানসারের প্রথাসিদ্ধ চিকিৎসাগুলি পরিহার করলে কি রুগির মৃত্যু ত্বরান্বিত হবেই, এবং সেই মৃত্যু কি অধিক যন্ত্রণাদায়ক হতে বাধ্য? অত্যন্ত সম্মানীয় সূত্রকে সামনে রেখে বিশিষ্ট ক্যানসার-বিদ্বেতাদের বিভিন্ন মন্তব্যের সারসংক্ষেপ করলে বিষয়টা বুঝতে সুবিধে হবে। কল্পনা করুন, পিঠোপিঠি দুই বোনের স্তন ক্যানসার সনাক্তকরণের পর তাদের একজন দ্রুত চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নেবার পর, চার বছর বেঁচে ছিলেন। দ্বিতীয় জনা প্রায় তিন বছর চিকিৎসা এড়িয়ে যাবার পর ব্যথা এবং অন্য সমস্যার কারণে চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নেবার পর মাত্র বছর আড়াই বেঁচে ছিলেন।

আপাতদৃষ্টিতে দ্রুত চিকিৎসার ফলে প্রথমজন বেশি সময় (৪ বছর) জীবিত ছিলেন কিন্তু দ্বিতীয়জন মাত্র আড়াই বছরের বেশি বাঁচেননি। বাস্তবিকতা কিন্তু ঠিক তার বিপরীত সাক্ষ্য প্রস্তুত করে। কেননা তিনি তিন বছর চিকিৎসা পরিহার করার পর আরও আড়াই বছর বেঁচে ছিলেন বা মোট ৩+২.৫= সাড়ে পাঁচ বছর বেঁচেছিলেন। আমাদের পরিচিত বিত্তবান পরিবারের এক মহিলা তাঁর স্তন ক্যানসারের কোনও চিকিৎসা না করে বছর আটেক দিব্বি ছিলেন। তারপর টিউমারের সাইজ অনেকটা বেড়ে যাবার পর, শ্রদ্ধেয় মনু কোঠারির পরামর্শে কেবল অপারেশন করিয়েছিলেন। এর পর তিনি প্রায় আড়াই বছর বাঁচলেও নিরন্তর ‘ক্যানসারকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচুন’— প্রচার করে গেছেন। তিনি নিজের সেই অভিজ্ঞতা আমাদের লিখিতভাবে পাঠানোর পর আমরা বই আকারে তা ছেপেওছি। শ্রদ্ধেয় মনু-লোপার ক্যানসার চিকিৎসা নীতি সিদ্ধান্তের সারটা স্পষ্ট: Do not trouble your troule unless it troubles you and trouble to that trouble to the extent It’s troubling YOU and don’t go far. মোদ্দা কথা, ক্যানসার যদি কোনও সমস্যার সৃষ্টি না করে, তাহলে তাকে ঘাঁটাবার বা তার বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’-র প্রশ্নই ওঠে না। আমরা যারা খুব কাছ থেকে মনু-লোপাকে প্রায় ২৫ বছরেরও বেশি সময় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের রোগীর চিকিৎসা করতে দেখেছি, বা তাঁদের লেখা ‘ক্যানসারের অন্য পরিচয়’ বইটিতে লিপিবদ্ধ কেস রিপোর্টগুলো পড়েছি, তারা এটা জানি তাঁরা কখনও ক্যানসার চিকিৎসায় তাঁদের নীতি সিদ্ধান্ত থেকে তিলার্ধ বিচ্যুত হননি। আমাদের ওয়েবসাইট নির্মাতা প্রধান ব্যক্তিত্ব অভিজিৎ মুখার্জি তাঁদের অবদানের অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ প্রস্তুত করেছেন। অবশ্যই সাইটটি দেখুন।

অনুমান করতে পারি, এই প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নটি ধেয়ে আসবে, আমরা কি তাহলে ক্যানসারের প্রথাসিদ্ধ চিকিৎসা বয়কট বা পরিহার করার কথাই বলতে চাইছি? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আমাদের প্রতি-প্রশ্নটা স্পষ্টভাবে বলা দরকার। প্রশ্নটা অনেকে করেছেনও। ক্যানসার দুনিয়ার রথী-মহারথী হিসেবে তাঁরা প্রণম্য পথপ্রদর্শক। প্রথাগত, মহার্ঘ, চালু ‘বীভৎস চিকিৎসা সত্ত্বেও মুষ্টিমেয় কিছু’ মানুষ কেন বেঁচে যান? মনু কোঠারি-লোপা মেহতার বহুচর্চিত ‘The Nature of Cancer’ (১৯৭৩) নামক বইটিতে সবিস্তারে তার উল্লেখ আছে। ছয় হাজারেরও বেশি অত্যন্ত সম্মানীয় তথ্যসূত্রে সমৃদ্ধ সেই বইটি বলুন, অথবা বিদেশে (জার্মান, ডাচ ভাষায়, আমেরিকা এবং ব্রিটেনে স্বভাবতই ইংরেজিতে) এবং বাংলা সহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বইটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণে (The Other Face of Cancer) স্পষ্টভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। উল্লিখিত তাঁদের দুটি বই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট মেডিক্যাল জার্নালের অভিমত উল্লেখ করব, কেননা বিষয়টি পাঠকদের জানার পূর্ণ অধিকার আছে।

অ-সুখ (Dis-ease)-এর অর্থ হল সুখের অভাব (lack of easeness)। অর্থাৎ, রোগটির কোনও বিশেষ উপসর্গ (Symptom) রোগী বা তাঁর পরিজনদের চোখে পড়ে না। বিভিন্ন ক্যানসারের ক্ষেত্রে এটা দেখা গেছে, পাঁচ থেকে পনেরো বছর সে তার বাহকদের সামান্যতম কষ্টের কারণ বা সমস্যার সৃষ্টি করে না। একমাত্র যে ক্যানসারটি রোগীর শরীরে দ্রুত (আড়াই থেকে তিন বছরের মধ্যে) দেখা দেয় তা হল ভীষণ ক্ষতিকর ফুসফুসের (Lung) ক্যানসার। স্তনের ক্যানসার সবচেয়ে দেরিতে তার উপস্থিতি জানান দেয়। বারো থেকে সাড়ে সতেরো বছর পরে। এ প্রসঙ্গে, প্রচলিত ভুল ধারণা হল, এটা নাকি ক্যানসারের লীন সময় (Latency period)। বাস্তবিকতা হল এটাই তার স্বভাবধর্ম। সাধারণত ক্যানসার তার বাহকের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী।

বুঝতে অসুবিধে নেই যে, ‘শুরুতে সনাক্ত হওয়াটাই ক্যানসার ঠিক হবার চাবিকাঠি’ (Early detection is the key to cure cancer) কথাটি সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার। মানবসমাজের ইতিহাসে এর আগে আর কখনও এতকাল ধরে এত অসংখ্য মানুষের প্রাণ এবং এত সুবিপুল অর্থের অপচয়ের বিনিময়ে, এত অসত্যভাষণ, এত অল্পসংখ্যক লোকের দ্বারা এত বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি।

আমরা ক্যানসারের প্রথাসিদ্ধ চিকিৎসা বয়কট বা পরিহার করার ওকালতি করছি কি না সে প্রসঙ্গে আমাদের প্রতি-প্রশ্নগুলি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, ডাক্তারি পেশা একটি অমলিন, আন্তরিক যত্নশাস্ত্র। যেকোনও রোগীই প্রথমত তার কষ্টের লাঘব চান এবং সেই সূত্রে চান মমত্বময় যত্ন। যে রোগী জানেন যে, তার ইহলীলা সাঙ্গ অনিবার্য, রোগের নিরাময়ের কোনও প্রশ্নই নেই, তিনিও যত্নের আকাঙ্ক্ষাই পোষণ করেন। এই যত্নের যথোচিত ব্যবস্থাই উপশমকারী চিকিৎসার প্রাণভোমরা। রোগীর ওপর সার্জারি, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি ইত্যাদি চিকিৎসাগুলি সফল বা সম্ভব হোক অথবা না-হোক, উপশমের জন্য চিকিৎসা সর্বত্র এবং সর্বক্ষণই একান্ত কাম্য। এই যত্নশাস্ত্রের অপব্যাখ্যার বিপদ সম্পর্কে সতর্কতা তাই ক্যানসার-বিশেষজ্ঞদের বিশেষভাবে মাথায় রাখা দরকার। সবচেয়ে জরুরি কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে, ক্যানসার যদি কোনও কষ্টের কারণ না হয়, তাকে কষ্ট দেওয়া কেন!

তাদের বক্তব্য থেকে যদি এই ভুল ধারণা জনমনে ঢুকে যায় যে, প্রচলিত বা প্রথাসিদ্ধ ক্যানসার চিকিৎসার কুফলগুলিকে প্রশমিত করাই বোধহয় উপশমকারী চিকিৎসা, সেটা সর্বৈব ভুল এবং সর্বনেশে। তাই, ‘রোগী যখন শেষ অবস্থায় পৌঁছে যায়… তখন রোগটির নির্দ্দিষ্ট চিকিৎসা দেওয়া আর সম্ভব হয় না, সেই সময় দরকার হয় উপশমকারী চিকিৎসা’— এমন মন্তব্য করার আগে, এর অপব্যাখ্যা এবং অপব্যবহারের বিপদটা মাথায় রাখা দরকার।

[মতামত লেখকের নিজস্ব]

চিত্রণ: মুনির হোসেন
5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

কাজী তানভীর হোসেন

ধানমন্ডিতে পলাশী, ৫-ই আগস্ট ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কয়েকদিন ধরে যা ঘটেছিল, তা শুরু থেকেই গণআন্দোলনের চরিত্র হারিয়ে একটা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে পরিণত হয়েছিল। আজ আমরা কার্যক্রম দেখেই চিনে যাই ঘটনাটি কারা ঘটাচ্ছে। আগুন আর অস্ত্র নিয়ে রাজনীতি করার স্বভাব রয়েছে বিএনপি-জামাত ও রোহিঙ্গাদের। তারা যুক্তিবুদ্ধির তোয়াক্কা করে না।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

আমরা বিধানচন্দ্র রায়ের মতো মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছিলাম, যাঁকে খুব সঙ্গত কারণেই ‘পশ্চিমবঙ্গের রূপকার’ বলা হয়। পেয়েছি প্রফুল্লচন্দ্র সেন ও অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বার্থত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী। এবং জ্যোতি বসুর মতো সম্ভ্রান্ত, বিজ্ঞ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখর কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ। কিন্তু তাঁদের সকলের চেয়ে অধিক ছিলেন বুদ্ধদেব। কেননা তাঁর মতো সংস্কৃতিমনা, দেশবিদেশের শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র নাটক সম্পর্কে সর্বদা অবহিত, এককথায় এক আধুনিক বিশ্বনাগরিক মানুষ পাইনি। এখানেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনন্যতা।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »