সাদা কাপড়ের আড়াল থেকে বাড়িয়ে দেওয়া কড়ে আঙুলের ডগাটুকু। বড়জোর ঘামেভেজা কপালের রসকলি আর একঝলক ভীরু, কাজলকালো চোখ… এই নিয়েই একসময় আলোড়ন পড়েছে রামকেলি মেলা প্রাঙ্গণ থেকে সারা বাংলায়। বছর বছর জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তিতে মালদায় রামকেলি মেলার সময় আসে। উদ্দাম ডিজে-র তালে ‘বান্ধবী ললিতা’-র আড়ালে হারিয়েই যেতে থাকেন রামকেলি মেলার পাঁচসিকের বোষ্টমীরা।
মালদা শহর থেকে বেরিয়ে মহদিপুর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ ধরে ১৩ কিলোমিটার মতো দূরে পিয়াসবাড়ি গ্রাম। সেই গ্রামের মোড় থেকে ডানদিকে আরও এক কিলোমিটারের একটু বেশি গেলে চোখে পড়বে রামকেলির মদনমোহন জিউ মন্দির। পাশেই বিস্তৃত রয়েছে বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ। ষোড়শ শতাব্দীতে ধর্মজাগরণের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের যে কাজ চৈতন্যদেব শুরু করেন, তার সূত্রেই তিনি নবদ্বীপ থেকে পায়ে হেঁটে বৃন্দাবনের উদ্দেশে রওনা দেন। আনুমানিক ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তির আগের দিন তিনি গৌড়ভূমিতে উপস্থিত হন। তাঁর গৌড়ে স্থায়িত্ব ছিল তিনদিন। সেই সময় গৌড়ের শাসক ছিলেন নবাব হুসেন শাহ। নবাবের মন্ত্রীপরিষদের অন্যতম দুই সদস্য ছিলেন সাকর মল্লিক ও দবির খাস। তাঁরা দুজনেই চৈতন্যদেবের সংস্পর্শে এসে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন। রামকেলিতে একটি তমাল গাছের নিচে তাঁদেরকে দীক্ষা দান করেন চৈতন্যদেব। দীক্ষাদানের পরবর্তী সময়ে সাকর মল্লিক সনাতন ও দবির খাস রূপ গোস্বামী নামে খ্যাত হন। পরবর্তীকালে তাঁরা সেই তমাল গাছের নিচেই একটি মন্দির নির্মাণ করান। চৈতন্যদেবের গৌড়ে আগমন উপলক্ষে রামকেলিতে মেলার সূচনা করেন নিত্যানন্দ গোস্বামী বংশের গুরুগোঁসাই অটলবিহারী দেবানন্দ প্রভুপাদ। তাঁর প্রবর্তিত মেলাই আজকের রামকেলি মেলার চেহারা নিয়েছে। ৫০৯ বছরেও এই ঐতিহ্য অটুট।
ইতিহাস বলে, ১৫৭৪-এর প্লেগে গৌড় নগরী জনশূন্য হওয়ার পর দীর্ঘকাল এই রামকেলি উৎসব ও মেলা বন্ধ থাকে। তারপর যখন চালু হয়, তখন থেকেই এই বৈষ্ণব গণবিবাহের রমরমা। বাউল, খুশিবিশ্বাসী, তিলকদাসী, দরবেশ, সাহেবধনী, বলাহাড়ি— মেলায় আগত সব সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবদের মধ্যে এ প্রথা চালু ছিল। অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর বাউলবিষয়ক কালজয়ী গ্রন্থ ‘গভীর নির্জন পথে’-তে এই বৈষ্ণব গণবিবাহের ইতিহাস বলতে গিয়ে বলা হয়েছে— এই প্রথা ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে চৈতন্যদেবের মৃত্যুর দশ বছরের মধ্যেই বিভিন্ন মঠের প্রধান বা গোস্বামীদের হাতে পড়ে সর্বজনীনতার মূল সত্য থেকে সরে আসে।
পাতলা সাদা কাপড়ের একদিকে একেবারে বুক পর্যন্ত ঘোমটা টেনে দাঁড়াতেন বৈষ্ণবীরা। কাপড়ে ছোট ছোট ছিদ্র করে কনিষ্ঠা আঙুল বাড়িয়ে দেওয়া হত। পাঁচসিকে বা চার আনার বিনিময়ে সেই আঙুল দেখেই বৈষ্ণব বেছে নিতেন তার ‘মনের মানুষ’-কে। তারপর ওই কড়ে আঙুল ধরে বাইরে এনে ঘোমটা খুলিয়ে চারচক্ষুর মিলন, কণ্ঠীবদল— অনেকক্ষেত্রে মালাচন্দন করে আনুষ্ঠানিক বিবাহ। কিন্তু বৈষ্ণবী পছন্দ না হলে তাৎক্ষণিক বিচ্ছেদ। গলার কণ্ঠী নিষ্ঠুরভাবে ছিঁড়ে ফেলে, শেষবারের মতো একবার দইচিঁড়ে খাইয়ে বিদায়। সেই পরিত্যক্ত বোষ্টমীর দিকে ফিরেও তাকাত না কেউ। কবি গীতা চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বেদানাদাসীর আশ্চর্যচরিত’ কবিতায় কণ্ঠীছেঁড়া বৈষ্ণবীর এই বুকভাঙা কান্নাকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখেছেন।
মালদার প্রাচীন মানুষেরা বলেন, এই অসহায় মেয়েরা অনেকক্ষেত্রেই লালসার শিকার হতেন। মেলাকে কেন্দ্র করে অস্থায়ী পতিতাপল্লির বিস্তারের কথাও অনেকে বলেছেন। তথ্য বলে, ১৯১২ পরবর্তী সময়ে গৌড়দূত সম্পাদক লালবিহারী মজুমদারের ধারাবাহিক প্রতিবেদন ও তৎকালীন জেলাশাসক জে. এন. রায়ের তৎপরতায় এই প্রথার সরকারি মতে অবলুপ্তি ঘটে। তবে লুকিয়েচুরিয়ে কিছু আসরের খবর তার পরবর্তী সময়েও পাওয়া যায়। চারের দশকে অধুনালুপ্ত ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এমন একটি আসরের উল্লেখ পাওয়া যায়।
তবে আবার হারাতে হারাতেও হারায় না অনেক কিছু। বর্ধমান খণ্ডঘোষের কানাই ঘোষ ও হরিভামিনী, কলকাতার বাগুইআটির প্রসাদ বোষ্টম ও ললিতা বোষ্টমী, বীরভূম নলহাটির রূপচাঁদ ও কৃষ্ণভামিনী যেমন এসেছেন ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধানে। তাঁরা কণ্ঠীবদলের এই বিশেষ রীতির কথা ভালভাবেই জানেন। তাই মালদা টাউন স্টেশন থেকে নেমে রামকেলি যাওয়ার আগে তাঁরা একটা আড়াল খোঁজেন। সে আড়াল হতেই পারে পুরাতন মালদা বা গাজোলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনও বৈষ্ণব পাঠবাড়ি বা আখড়া। সেখানে হয়তো আড়াআড়ি টাঙানো কোনও সাদা থানের ওপার থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে দুটি কাজলপরা উৎসুক কালো চোখ… বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালের রসকলির ওপর। তাঁর সারা শরীরে চন্দনগন্ধ… তুমুল হরিধ্বনির মধ্যে কণ্ঠীবদল। বয়স বা শরীর কোনও বাধা নয়— মন মেনে নিলে হাতে হাত রেখে ভিতরের ঘরে চলে যাওয়া। আর মেনে না নিলে শুধু একটা ছবি হোয়াটসঅ্যাপ করা। কিছু সময়ের মধ্যেই কালো কাচঢাকা স্করপিও চলে আসবে আশ্রমের বাইরে। এরকম কত শুরুর কোনও শেষ থাকে না; কত শেষের শুরুর তলটাই খুঁজে পাওয়া যায় না— ‘ও মন, কখন শুরু কখন যে শেষ কে জানে/ এ যে বাজিকরের খেলা রে মন যার খেলা হয় সে জানে!’ বলিউডের কোনও ৪৯ বছর বয়সী নায়ক ২১ বছরের নায়িকাকে পর্দায় তীব্রভাবে ভালবেসেছেন, তাই নিয়ে সমাজমাধ্যমে তোলপাড়… এ জগৎ তার থেকে খুব দূরে নয়। বা, স্থানগত ব্যবধান আছে— ভাবগত ব্যবধান তেমন নেই।
শরৎচন্দ্রের কালজয়ী উপন্যাসে শ্রীকান্তকে ঘরছাড়ার আহ্বান জানিয়ে বৈষ্ণবী কমললতা বলেছিল, ‘চলো ঠাকুর— বেরিয়ে পড়ি’। দেহসাধনা নিয়ে শ্রীকান্তের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে এই কণ্ঠীছেঁড়া বোষ্টমী বলেছিল— এ পথ সত্যি যাদের জন্য নয়, তাদের সাধনা চিরকাল জলের ধারাপথে শুকনো বালির মতো আলগা থেকে যায়, কোনোদিন জমাট বাঁধে না। মেয়েরা দুঃখকে ভয় পায় না— আবার চোখের জলকেও এড়াতে চায় না। দ্বারিকাদাসের আখড়ায় এই চিরসত্য খুঁজে পেয়েছিলেন শ্রীকান্তরূপী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়— আর রামকেলির মেলায় সেই অসহায় বৈষ্ণবীদের দীর্ঘশ্বাস আজও পাকিয়ে ওঠে জ্যৈষ্ঠের তপ্ত হাওয়ায়। ওয়েবসিরিজে শ্রীকান্ত দেখা প্রজন্ম আদৌ তার হদিশ পায় কি?