Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ছোটগল্প: বিবেকের টান

প্রী ত ম  স র কা র

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সুদীপের। সে কী স্বপ্ন দেখল এটা! ছোটবেলায় মারা যাওয়া মা তাঁকে কী সব যেন বলছিলেন স্বপ্নের ভিতরে। বিছানা ছেড়ে উঠে পাশে রাখা জলের বোতল থেকে জল খেয়ে স্বপ্নটা মনে করার চেষ্টা করতে লাগল সুদীপ। আবছা আবছা মনে পড়তে লাগল, মা যেন তাকে অন্য চাকরির খোঁজ করতে বলছেন! সুদীপের পরিষ্কার কানের কাছে যেন তখনও বেজে চলেছে, ‘তুই কি শকুন নাকি! ওভাবে মানুষের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলি! যাঁদের পরিবারের মানুষের অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের কথা একবারও চিন্তা হয় না! কী নরপিশাচ হয়েছিস তুই!’ এর বেশি কিছু মনে পড়ছিল না সুদীপের। স্বপ্ন দেখার পরে বিছানায় শুয়েও আর ঘুমোতে পারেনি সে। বারবার কানের কাছে বেজে গিয়েছে মায়ের কণ্ঠস্বর।

আজ সকাল থেকে কাজের যথেষ্ট চাপ গিয়েছে সুদীপের। নিউজ কভার করে সে ক্লান্ত হয়েই রাতে বিছানায় ঘুমিয়েছিল। স্বপ্নটা এসেছে ভোররাতে।

আজ দুপুরের পরে একটা অফিস অ্যাসাইনমেন্টের খবর সংগ্রহ করে সুদীপ যখন বহরমপুরের দিকে বাইক চালিয়ে ফিরছিল, তখনই এক সাংবাদিক-বন্ধু মোবাইল ফোনে খবর দিয়েছিল, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে এক বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই জেলাতে কাজে আসার পর থেকে কোনও খবর যাতে সে মিস্‌ না করে, সেজন্য অন্য কয়েকটি খবরের কাগজ আর দু-একটা টিভি চ্যানেলের রিপোর্টারদের সঙ্গে খবর দেওয়া-নেওয়া চলে তার। এতে দু’পক্ষেরই লাভ থাকায় নিজেদের মধ্যে একটা গোপন বোঝাপড়া চলে এসেছে এতদিন ধরে।

কলকাতার এক নামী সংবাদপত্রের জেলা সাংবাদিক সে। কাজের দায়িত্ব নিয়ে কয়েক বছর আগে বদলি হয়ে এসেছে মুর্শিদাবাদ জেলায়। আজ সকাল থেকে মুর্শিদাবাদের নদী ভাঙনের খবর করতে ক্যামেরাম্যানকে সঙ্গে নিয়ে বাইক চালিয়ে সুদীপ গিয়েছিল সামশেরগঞ্জে। সেখানে ভাগীরথীতে বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে। এখন কয়েক দিন ধরেই ভাঙন ফের বেড়েছে। ভাঙনের খবর অবশ্য সুদীপ এবছরই প্রথম করছে, এমন নয়। গত বেশ কয়েক বছর ধরে ভাঙন মুর্শিদাবাদের খবরের শীর্ষে রয়েছে। সেকারণে এই জেলাতে কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তাকে নদীভাঙন নিয়ে কপি লিখতে হয়েছে। সুদীপের এখন এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, ঘটনাস্থলে না গিয়েও আগে দেখে আসা বা সেখানকার কিছু স্থানীয় মাতব্বরদের মোবাইল ফোন নম্বর মোবাইলে ‘সেভ’ করা থাকায়, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে অনায়াসেই একটা পাঁচশো থেকে হাজার শব্দের ভাঙনের কপি সে নামিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু আজ পরিস্থিতি ছিল অন্য রকমের। আজ যে ভাঙনের খবর সে সংগ্রহ করতে গিয়েছিল, সেটা তার নিজস্ব সোর্স মারফত পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ খবর। এবারের ভাঙনে নাকি বাংলার শেষ নবাব সিরাজদৌল্লাহর সময়ের আগে-পরের একটা মসজিদ নদীগর্ভে তলিয়ে যেতে বসেছে।

খবরটা পাওয়ামাত্রই সুদীপ কলকাতার কাগজের অফিসে নিউজ এডিটরকে ফোনে জানিয়েছিল ঘটনাটি। নিউজ এডিটর শোনামাত্রই তাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন সরেজমিনে ঘটনাস্থল দেখে এসে কপিটা সে লিখে জমা দেয়! সঙ্গে ছবি অবশ্যই চাই!

নিউজ এডিটর সহজে এরকম কথা বলেন না! সুদীপের মনে হয়েছিল, নিউজ এডিটর যখন এতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, তখন খবরটা ঠিকমতো করতে পারলে আগামীকালের কাগজের প্রথম পাতায় তার নাম দিয়ে ছাপা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সকালে ঘুম থেকে উঠে কার না নিজের নাম ছাপার অক্ষরে কাগজের প্রথম পাতায় দেখতে ভাল লাগে!

তাই সকালের কিছু পরেই বাইকের পিছনে ক্যামেরাম্যান উত্তমকে বসিয়ে নিয়ে সুদীপ রওনা দিয়েছিল ঘটনাস্থলের দিকে। অবশ্য রওনা দেওয়ার আগে তার বন্ধু জেলার অন্য সাংবাদিকদের জানিয়েছিল ঘটনাটি। তারা তাকে বলেছে, সুদীপকে ওই খবর নিজেদের গোষ্ঠীর সাংবাদিকদের মধ্যে শেয়ার করতে হবে। বদলে সেদিনের জেলার অন্য ইনসিডেন্টের খবর তাকে দিয়ে সাহায্য করবে অন্য সাংবাদিকরা। এত বড় একটা জেলায় প্রতিটি কাগজ বা টিভি চ্যানেলের একজনমাত্র সাংবাদিক থাকায় এটা যে করতে হয়, সেটা সুদীপের অফিস যে একদম জানে না, তা নয়। পরিস্থিতির খাতিরে তারাও এই বিষয়ে একরকম চোখ বন্ধ করেই থাকে। তবে এই খবরটা যেহেতু সুদীপ আগেই তার খবরের কাগজের অফিসের নিউজ এডিটরকে জানিয়ে দিয়েছিল, তাই অন্য সাংবাদিকদের অনুরোধ করেছিল, তারা যেন এখবরটা একদিন পরে তাদের কাগজ বা টিভিতে প্রকাশ করে। একরকম বাধ্য হয়েই তার গোষ্ঠীর সাংবাদিক বন্ধুরা এই শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।

জেলার টিভি চ্যালেনের সাংবাদিকদের জন্য ভিডিও ফুটেজ আর স্থানীয় বাসিন্দাদের ‘বাইট’ দরকার। সেজন্য ফটোগ্রাফার উত্তমকে সুদীপের জন্য ক্যামেরায় ছবি তোলার পাশাপাশি টিভি সাংবাদিকদের জন্য সব কাজ করতে হবে বলে, উত্তম ভিডিও ক্যামেরা আর দু-তিনটা চ্যানেলের বুমও সঙ্গে নিয়ে এসেছে।

বহরমপুর থেকে মোটরবাইকে সামশেরগঞ্জের দিকে রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমেছিল। দুজনের জন্যই বাইকের ডিকিতে রেনকোট রাখা ছিল বলে বৃষ্টির কবল থেকে রেহাই পেয়েছে। সামশেরগঞ্জ পৌঁছতে পৌঁছতে অবশ্য বৃষ্টি প্রায় ধরে এসেছিল।

প্রায় সারা রাস্তা বৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে তারা সামশেরগঞ্জে পৌঁছে, যে সোর্স ফোনে সুদীপকে খবরটা দিয়েছিল, তাকে মোবাইল ফোনে ধরার চেষ্টা করল সুদীপ। কিন্তু তখনও অল্প অল্প বৃষ্টি হয়ে চলেছে। বাইকটা একটা মোড়ের মাথায় থামিয়ে সেখানকার এক চায়ের দোকানে বসে গরম চা খেতে খেতে কথা বলে চলেছে সুদীপ। সুদীপ এলাকায় পৌঁছে গিয়েছে জেনে খবরের সোর্স লোকটি গায়ে গামছা জড়িয়ে সাইকেল নিয়ে হাজির হয়েছে চায়ের দোকানে।

চায়ের দোকানেই সাইকেল রেখে সুবল নামের লোকটি সহ তিনজন বাইকে বসে রওনা দিল সামশেরগঞ্জের সেই পাড়ের উদ্দেশে, যেখানে সেই কয়েকশো বছরের পুরনো মসজিদটি নদীগর্ভে তলিয়ে যেতে বসেছে, সেটা সরেজমিনে দেখতে। গিয়ে দেখেছিল, একটা পুরনো আমলের সরু ইটের তৈরি ধ্বংসস্তূপ সত্যিই সামশেরগঞ্জের ভাঙনের ফলে জলে চলে যেতে বসেছে।

তাদের দেখে এলাকার কয়েকজন গ্রামবাসী এগিয়ে এসে নদীভাঙন নিয়ে সরকারের উদাসীনতা আর তাদের দুঃখের নানা কথা শোনাচ্ছিল সুদীপকে। ফটোগ্রাফার উত্তম ক্যামেরায় কিছু ছবি নানা দিক থেকে তুলে নিয়েছে। এবার সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে টিভি সাংবাদিকদের জন্য কাজ করতে। সুদীপ গ্রামের লোকজন বা স্থানীয় পঞ্চায়েত অফিসে গিয়ে কথা বলে বুঝতে পারল, তার কপির মালমশলা যোগাড় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওই মসজিদ যে সিরাজদৌল্লাহর আমলের তৈরি, এমন কোনও নজির সে পেল না। গ্রামবাসীদের মধ্যেও সিরাজদৌল্লাহর আমলে মসজিদটি তৈরি হয়েছিল, সেকথা নিয়ে তো রীতিমতো শোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় পঞ্চায়েত অফিসেও সিরাজদৌল্লাহর আমলের তৈরি— এমন কোনও তথ্য কেউ সরকারিভাবে দিতে পারলেন না। কিন্তু একটা পুরনো ইটের তৈরি পোড়ো বাড়ি, সে মন্দির-মসজিদ যাইহোক না কেন, ভাঙনে ভাগিরথীর গর্ভে তলিয়ে যেতে বসেছে, সেটা কপির ক্যাচলাইন ধরে উত্তমকে সঙ্গে নিয়ে ফের বহরমপুরের দিকে বাইক ছোটাল সুদীপ। রওনা দেওয়ার আগে একবার গ্রামের মোড়ের চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে মোবাইল ফোনের ঘড়িতে সময় দেখে সুদীপ হিসাব করে নিয়েছে, রাস্তায় ফের বৃষ্টি না নামলে বহরমপুরে পৌঁছে কপি লিখেও অন্য আরও কপি দেওয়ার সময় থাকবে।

বহরমপুরের থেকে যখন খুব একটা দূরে তারা নেই, সে সময়েই ওই সাংবাদিক-বন্ধুর দেওয়া পথ দুর্ঘটনার খবরটা মোবাইল ফোনে পেয়েছিল সুদীপ।

সুদীপ ভেবে রেখেছিল, সেরকম বড় কোনও ইনসিডেন্টের ঘটনা না হলে আগে জলঙ্গীর এই ভাঙনের কপিটা ঠান্ডা মাথায় লিখে নিয়ে পরে বাকি খবরের খোঁজে অন্য সাংবাদিক-বন্ধুদের ফোন করবে! শর্ত অনুযায়ী অন্যরা তাকে সেদিনের খবর দেবে এবং সেও ভাঙনের খবর আর ছবি তাদেরকে দেবে একদিন পরে তাদের কাগজে প্রকাশ করার জন্য।

কিন্তু জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনার খবর যখন এক সাংবাদিক-বন্ধু ফোন করে তাকে দিয়েছে, তখন বিষয়ের গুরুত্ব বোঝার জন্য ঘুরিয়ে সেই সাংবাদিক-বন্ধুকে কল করল সুদীপ। যা শুনল, তাতে এই ভাঙনের কপি লেখার আগে ওই রোড অ্যাক্সিডেন্টের খোঁজ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ! সেটা বুঝতে পেরেই সোজা সদর হাসপাতালের দিকে বাইক ছোটাল সুদীপ। এখন বহরমপুরে বৃষ্টি নেই। তবে রাস্তাঘাট ভেজা রয়েছে। সাবধানে চালিয়ে হাসপাতালের এমার্জেন্সির সামনে বাইক স্ট্যান্ড করে সুদীপ ফের ফোনে ধরল ওই সাংবাদিক-বন্ধুকে।

—‘কী রে, কোথায় আছিস! আমি তো হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছি!’

ওপার থেকে উত্তর এল, ‘আমরা সবাই মর্গের সামনে ছিলাম। এখন আবার হাসপাতালের এমার্জেন্সির দিকে যাচ্ছি, তুই বরং এমার্জেন্সির সামনে দাঁড়া। আমরা সবাই আসছি!’

একটু পরেই জেলার মোটামুটি সব সাংবাদিকই হাজির হল হাসপাতালের এমার্জেন্সির সামনে। সুদীপ দেখল, এখানে তার নিজের গোষ্ঠীর সাংবাদিকরা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে অন্য সাংবাদিকরাও! এমনিতে সুদীপের সঙ্গে সবার ভাল খাতির থাকলেও খবরের ব্যাপারে নিজের গোষ্ঠীর কয়েকজনের বাইরে খবর দেওয়া-নেওয়া করে না সুদীপ। কিন্তু কী এমন বড় অ্যাক্সিডেন্ট হল যে, একসঙ্গে সবাই হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছে! সুদীপ তার নিজের কাছের এক সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করে শুনল, ‘খুব বড় অ্যাক্সিডেন্ট সুদীপদা! তিনজন স্পটেই শেষ। দুজন এখনও খাবি খাচ্ছে! এই যায় তো সেই যায় অবস্থা! দুজনকে কলকাতায় রেফার করেছে কিছুক্ষণ আগেই!’

—‘কিন্তু কীভাবে হল এত বড় অ্যাক্সিডেন্ট!’ জিজ্ঞাসা করে সুদীপ।

—‘আর বলো কেন! দুপুরের দিকে বহরমপুরে জোরে বৃষ্টি নেমেছিল! বৃষ্টির মধ্যে স্করপিওর সঙ্গে ট্রাকের মুখোমুখি ধাক্কা। স্পটেই ফিনিস্‌ ড্রাইভার সহ দুজন। মোট তিনজন এখন পর্যন্ত মারা গিয়েছে। স্করপিও গাড়িটা একদম গুঁড়িয়ে গিয়েছে! ট্রাকটা স্করপিওর ওপরে উঠে গিয়েছে! এই তো কিছুক্ষণ আগে নীলু ঘটনাস্থলে গিয়ে গাড়ি দুটোর ছবি তুলে এনেছে!’

চঞ্চল নামের অন্য এক সাংবাদিক চা খেতে খেতে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি একটু আগে হাসপাতালের ভিতরে গিয়েছিলাম। আমাকে একজন ডাক্তার তো জানাল, আরও একজন শিওর মারা যাবে!’ বলেই কাগজের চায়ের কাপ মুখে তুলে তার থেকে দুবার চা খেয়ে সেটা পাশে ছুড়ে ফেলল। তার চায়ের কাগজের কাপটা ছুড়ে ফেলার ভঙ্গি চোখে লাগল সুদীপের! যদিও সে মুখে কিছু বলল না। চঞ্চলকে আগে থেকে চিনলেও তার হাবভাব মোটেই পছন্দ নয় সুদীপের। একারণে পারতপক্ষে চঞ্চলকে এড়িয়েই চলতে পছন্দ করে সে।

সুদীপ ওদের উদ্দেশ করে বলল, ‘আমি যাই! আমার হাতে একটা বড় কপি রয়েছে। সেটা লিখে পাঠাতে হবে।’

চায়ের কাপ ছুড়ে ফেলে দিয়ে ততক্ষণে সেই সাংবাদিকের হাতে সিগারেট উঠে এসেছে। হাসপাতালে সিগারেট খাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ! তবে সেই আইন সাধারণ মানুষের জন্য। জেলার এই সাংবাদিকদের জন্য নয়। জেলার সাংবাদিকদের হাসপাতালের সুপার কেন, সি এম ও এইচ পর্যন্ত তুষিয়ে চলেন যে! এই দোষ থেকে সুদীপও বাদ নেই।

চঞ্চল নামের সাংবাদিক-বন্ধুটি সুদীপের দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘চা খাবি না কি!’

সুদীপ আপত্তি করলে সে সিগারেট জ্বালিয়ে বলল, ‘শুনলাম বাইরে গিয়েছিলি খবর করতে!’

সুদীপ তখনও সিগারেটে আগুন জ্বালায়নি! সিগারেট হাতে নিয়েই বলল, ‘আমি যাই, আমাকে একটা খবর করতে হবে! তোরা তো থাকলি এখানে! আমি খবর লেখার আগে তোদের কারও কাছে ফোন করে মৃতদের নাম, বয়স শুনে নেব।’

সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সুদীপকে বাধা দিয়ে ওই সাংবাদিক বলল, ‘আরে! আজ তো এটাই বড় খবর! এর চেয়ে বড় কোনও খবর হয় নাকি! তিনজন অলরেডি টেঁসে গিয়েছে। আরও একজন এক্ষুনি হয়তো টেঁসে যাবে। চারজন মারা গেলে খবরের ওজন কতটা বাড়বে বল তো! কালকেও এর ফলোআপ করতে হবে। চারজন মৃতের বাড়ি গিয়ে ফ্যামিলির লোকজনের রিঅ্যাকশান নিতে হবে। কোথাও যাস না। আমার কাছে পাক্কা খবর আছে, আরও একজন তো বটেই, দুজনও মারা যেতে পারে! আমরা তো সবাই সেজন্যই রয়েছি! তুইও আমাদের সঙ্গে থাক। সবাই নিজের নিজের হাউসে খবর পাঠিয়ে দিয়ে রাতে জমিয়ে পার্টি হবে চিয়ার্স নামের নতুন যে বারটা খুলেছে, সেখানে বড় খবরের জন্য! শালা মাইরি বলছি, চিয়ার্স বার ওপেনিংয়ের দিন নেমন্তন্ন করলেও যেতে পারিনি, বহরমপুরে ছিলাম না বলে! তার ওপর আজ তো আবার আবগারি ওয়েদার!’

রাতে সুদীপের খবর লিখে পাঠাতে পাঠাতে বেশ দেরি হয়েছিল। প্রথমে যথারীতি সামশেরগঞ্জের ভাঙনের খবর লিখেছে। পরে আক্সিডেন্টের খবর। তবে হাসপাতালে সময় নষ্ট না হলে আরও আগে অফিসে পাঠাতে পারত। তিনজন মৃত— এই খবরই অফিসে পাঠাতে হয়েছে সব সাংবাদিককে। ‘বড় খবরের’ পার্টিও হয়নি। সারাদিনের পরিশ্রমের পরে সুদীপ যখন বিছানায় শুয়েছে, তখন ঘুম আসতে দেরি হয়নি।

ভোরে দেখা স্বপ্নে মায়ের কথা শুনে সুদীপ নিজে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করেছে। সে কি এই কাজ করে ভুল করছে! তার কি অন্য কোনও প্রফেশন খুঁজে নেওয়া উচিত! কিন্তু এই বাজারে একটা চাকরি ছেড়ে অন্য একটা চাকরি পাওয়া এক দুরূহ ব্যাপার! কী করবে এই চিন্তা করতে করতে ভোরের স্বপ্নের কথা মনে পড়ল তার। মা স্বপ্নে তাকে নরপিশাচ বলেছেন! আর দেরি না করে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল সুদীপ!

ঘুম থেকে উঠে মুখ না ধুয়েই সাদা কাগজ নিয়ে তার বক্তব্য লিখে অফিসে ফ্যাক্স করে দিল। ফ্যাক্স করা কাগজে লেখা ছিল সুদীপের রেজিগনেশন লেটার।

ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো মায়ের পুরানো সাদা-কালো ছবিটার দিকে তাকিয়ে সুদীপের মনে হল, ছবিতে যেন মা হাসছেন! নিজেও মুচকি হেসে মোবাইল ফোনের সুইচ অফ্‌ করে দিল সুদীপ। মনে যেন নেমে এল এক অদ্ভুত ধরনের শান্তি।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
3.7 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »
নন্দিনী কর চন্দ

স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্দরমহলে: কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি

বিস্মৃতির অতলে প্রায় তলিয়ে যাওয়া এমন কয়েকজন মহিলা কবির কথা আলোচনা করব, যাঁরা তাঁদের কাব্যপ্রতিভার দ্যুতিতে বাংলা কাব্যের ধারাকে উজ্জ্বল ও বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণকামিনী দাসী, মোক্ষদায়িনী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, লজ্জাবতী বসু, জগন্মোহিনী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, হিরণ্ময়ী দেবী, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, সুরবালা ঘোষ প্রমুখ।

Read More »
মোহাম্মদ কাজী মামুন

বালকেরা অচেনা থাকে : এক অবিস্মরণীয় পাঠ অভিজ্ঞতা

ঘাসফুল নদী থেকে প্রকাশিত ‘বালকেরা অচেনা থাকে’ গল্পগ্রন্থটি যতই এগোনো হয়, একটা অনুতাপ ভর করতে থাকে পাঠকের মনে— কেন আগে সন্ধান পায়নি এই অমূল্য রত্নসম্ভারের! হ্যাঁ, রত্নসম্ভারই, কারণ একটা-দুটো নয়, প্রায় দশটি রত্ন, তাও নানা জাতের— লুকিয়ে ছিল গল্পগ্রন্থটির অনাবিষ্কৃত খনিতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসবের শতবর্ষ

কবির প্রয়াণের পরের বছর থেকেই আশ্রমবাসী বাইশে শ্রাবণকে বৃক্ষরোপণ উৎসব বলে স্থির করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনটিই এ-উৎসবের স্থায়ী তারিখ। বাইশের ভোর থেকেই প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় উৎসব। সকালে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বিচিত্রভাবে একটি পালকি চিত্রিত করেন ছবি এঁকে, ফুল, লতাপাতায়। মঙ্গলধ্বনি দিতে দিতে এর পর পালকির ভিতরে টবের মধ্যে একটি চারাগাছকে স্থাপন করা হয়। অতঃপর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গীত-পরিবেশন-সহ আশ্রম-পরিক্রমা।

Read More »