Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ছোটগল্প: ত্যাগদর্শন

সা মি রু ল  হ ক

মফস্বল কলেজের দর্শনের অধ্যাপক অসীমবাবু। বয়স চল্লিশের কোঠা ছুঁই ছুঁই হলেও চেহারার মধ্যে একটা লাবণ্য আছে। তবে ক’দিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ তার মুখের শ্রী কিছুটা হলেও কেড়ে নিয়েছে। তার মাথার ওপর উঁকি মারছে চক্‌চকে ফর্সা টাক।

টেবিলের ওপর ডাঁই করা রয়েছে একগাদা পরীক্ষার খাতা। সময়ের অভাবে আর কুঁড়েমিতে দেখা হয়নি। এখন একসঙ্গে এত খাতা দেখবেন কী করে! এই চিন্তায় চিন্তায় তিনি অকালে বুড়িয়ে যেতে বসেছেন। তার ওপরে শিক্ষা বিভাগের নম্বর উদ্ধারকারী কর্মীদের তাড়া তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এ যেন গোদের উপর বিষফোড়া।

তাই রোববার সকালের মিঠে ঘুম মাটি করে অগত্যা খাতা নিয়ে বসেছেন তিনি। অথচ এই রোববারটির সদ্ব্যবহারের জন্য গিন্নির সাথে কত না আগাম প্রোগ্রাম করা ছিল। সব ভেস্তে গেল। অবশেষে বাতিল করতে হল রোববারের মাস্টার প্রোগ্রামটা। এখন তার আর গিন্নির মাঝখানে এক অশান্তির ব্যারিকেড গড়ে তুলেছে ওই পরীক্ষার খাতাগুলো।

না। আর ভাবতে পারছেন না অসীমবাবু। তাই সীমাহীন বিরক্তি নিয়ে পরীক্ষার খাতার মধ্যে ডুবে গেলেন তিনি। অপটু হাতে লেখা, অপরিচ্ছন্ন উত্তরপত্রের ওপর অতি দ্রুততার সাথে নম্বর পড়তে থাকে। অনন্ত তিতিক্ষা নিয়ে তিনি শঙ্করের মায়াবাদের প্রশ্নে গড় নম্বর দিয়ে যেতে লাগলেন। আর-একটু অবোধগম্য উত্তরগুলো কষ্ট করে বোধগম্য না করে লাল কালির আঁচড়ে একেবারে ফতে করে দিতে লাগলেন তিনি।

এমন সময় সমস্ত নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিয়ে হঠাৎ পাখির ডাক ডেকে কলিংবেলটা বেজে উঠল। এক অসহ্য বিরক্তিতে তার সারাটা শরীর রি-রি করে জ্বলে উঠল। তবু তাকে উঠতে হল। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে তিনি দরজাটা খুলে দিলেন।

—‘ও! সিরাজ, এসো এসো। তারপর হঠাৎ কী মনে করে?’

—‘মানে স্যার, ওই বাকি থাকা টিউশন ফি-টা দিতে এলাম।’

অসময়ে আগন্তুক ছাত্রের মুখ থেকে কিঞ্চিৎ অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা তাকে কিছুটা হলেও পুলকিত করল। চোখের তারায় একটা দুর্বোধ্য প্যাঁচ কযে মিটিমিটি হাসলেন তিনি। মাথার অবশিষ্ট চুলগুলো বারকয়েক খচরমচর করে চুলকে বললেন, ‘বোসো।’

স্যারের ঠিক সামনের চেয়ারটায় বসতে গিয়ে সিরাজের চোখ তো একেবারে ছানাবড়া! নভেম্বরে রেজাল্ট বেরনোর কথা। অথচ অক্টোবর তো যাই যাই করছে। আর স্যার এখনও খাতা দেখাই শেষ করেননি। হায় আল্লা! কবে যে রেজাল্ট বেরবে কে জানে?

—‘কীরে সিরাজ, হঠাৎ যে থ মেরে গেলি!’

—‘আসলে স্যার ভাবছি, এখনও তো পরীক্ষার খাতা দেখাই শেষ হয়নি। অথচ এদিকে কাগজে খবর বেরিয়েছে যে, নভেম্বরেই আমাদের রেজাল্ট পাবলিশ হবে।’

—‘বাদ দাও তো ওদের কথা। সংবাদের নামে যা এখন চলছে, তাকে ইয়েলো জার্নালিজম ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়!’

—‘কিন্তু স্যার, যথাযথভাবে উত্তরপত্রের মূল্যায়ন করে খাতা জমা দেওয়ার দায়িত্ব তো পরীক্ষকদের। হাজার হাজার ছেলেমেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কোনও অধিকার তাঁদের নেই।’

সীমাহীন বিস্ময়ে অসীমবাবু কয়েক মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে গেলেন। তার মুখের পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠল। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ফেটে পড়তে গিয়েও শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। অধ্যাপকসুলভ গাম্ভীর্য মুখে এনে চিবিয়ে চিবিয়ে তিনি বললেন, ‘অশান্ত ছাত্রসমাজ যে কোথায় চলেছে তার জ্বলন্ত নিদর্শন স্বয়ং তুমি।’

—‘কেন, কেন স্যার?’

—‘ছাত্রসুলভ একাগ্রতা, শিক্ষাগুরুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, নিষ্ঠা, ত্যাগ— এসবের বিন্দুমাত্র আজ আর ছাত্রদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই।’

—‘স্যার, এসবের জন্য কি শুধু আমরাই দায়ী?’

—‘অযথা তর্ক কোরো না তো। আসলে, এই ভোগী সমাজের পাঁকে পড়ে ভারতবর্ষের শাশ্বত ত্যাগদর্শনকে তোমরা ভুলতে বসেছ।’

—‘কিন্তু স্যার, ভারতবর্ষ ত্যাগশূন্য হয়েছে বলাটা বোধহয় মস্ত বড় ভুল হবে।’

—‘কেন কেন?’

—‘স্যার, আজও ভারতবর্ষের প্রতিটি জনপদে, নগরে-বন্দরে ত্যাগদর্শনে বিশ্বাসী কোটি কোটি ভারতবাসী মুষ্টিমেয় ভোগী দেবতাদের মুখে জীবনসমুদ্র মন্থন করা অমৃত তুলে দিয়ে অর্ধাহারে, অনাহারে অচিকিৎসায় মরছে।’

—‘রাজনৈতিক লেকচারবাজি বলো তো দেখি— বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, ক্ষুদিরামের দেশে আজকের শিক্ষিত যুবশক্তি জাতিরজন্য কোন ত্যাগটা করছে?’

—‘স্যার, ত্যাগের কথা বলছেন! অবহেলা, লাঞ্ছনা আর বেকারত্বের পেরেসানিতে শিক্ষিত যুবশক্তি জীবনের সব রস ত্যাগ করে যে শুকিয়ে যাচ্ছে!’

—‘তুমি আমাকে ত্যাগ শেখাচ্ছ?’

—‘না, মানে স্যার…।’

—‘আচ্ছা, ত্যাগের কথাই যখন উঠল, তখন একটা গল্প বলি শোনো।’

—‘কী গল্প, স্যার।’

—‘আরুণির গুরুভক্তির গল্প।’

—‘জানি স্যার।’

—‘জানো! কিন্তু গুরু-শিষ্যের এই মধুর সম্পর্ক আজ বিরল। এই ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করতে না পারলে জাতির উন্নতির কোনও আশা নেই।’

—‘স্যার, যে জন্য এসেছিলাম সেই ব্যাপারটা কিন্তু একদম ভুলে গেছি। এই নিন স্যার।’

সিরাজ টেবিলের ওপর দুটো পাঁচশো টাকার নোট রাখল। অসীমবাবু নোটদুটো পকেটস্থ করে একগাল হেসে বললেন, ‘শুধু নেই নেই করে জীবনকে দুর্বিষহ কোরো না। মহান ভারতবর্ষের মহৎ ত্যাগদর্শনকে আগে জানো৷ দেখবে তখন সবকিছু তোমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে।’

—‘আজ এই পর্যন্ত থাক স্যার। না হলে ত্যাগদর্শনের মহাকর্ষণে নির্ঘাত আমি পাগল হয়ে যাব। আজ আমি উঠছি স্যার।’

কথা ক’টা বলেই সিরাজ দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। চাপা ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে অসীমবাবুও উঠে পড়লেন। ক্রোধ প্রদর্শনের কোনও জায়গা খুঁজে না পেয়ে তিনি দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিলেন।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

কাজী তানভীর হোসেন

ধানমন্ডিতে পলাশী, ৫-ই আগস্ট ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কয়েকদিন ধরে যা ঘটেছিল, তা শুরু থেকেই গণআন্দোলনের চরিত্র হারিয়ে একটা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে পরিণত হয়েছিল। আজ আমরা কার্যক্রম দেখেই চিনে যাই ঘটনাটি কারা ঘটাচ্ছে। আগুন আর অস্ত্র নিয়ে রাজনীতি করার স্বভাব রয়েছে বিএনপি-জামাত ও রোহিঙ্গাদের। তারা যুক্তিবুদ্ধির তোয়াক্কা করে না।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

আমরা বিধানচন্দ্র রায়ের মতো মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছিলাম, যাঁকে খুব সঙ্গত কারণেই ‘পশ্চিমবঙ্গের রূপকার’ বলা হয়। পেয়েছি প্রফুল্লচন্দ্র সেন ও অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বার্থত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী। এবং জ্যোতি বসুর মতো সম্ভ্রান্ত, বিজ্ঞ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখর কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ। কিন্তু তাঁদের সকলের চেয়ে অধিক ছিলেন বুদ্ধদেব। কেননা তাঁর মতো সংস্কৃতিমনা, দেশবিদেশের শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র নাটক সম্পর্কে সর্বদা অবহিত, এককথায় এক আধুনিক বিশ্বনাগরিক মানুষ পাইনি। এখানেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনন্যতা।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »