Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

রম্যগদ্য : ব্যস্ততার পুজো, পুজোর ব্যস্ততা

ত ন্ম য়  চ ট্টো পা ধ্যা য়

আকাশে মেঘবদলের পালা সবে শেষ হয়েছে। এককথায়, অনেক কান্নাকাটির পর শরৎবাবু অবশেষে সেই বিখ্যাত কোলগেট স্মাইল বের করতে পেরেছেন। হাওয়া অফিসের অধিকর্তাও বত্রিশ পাটি বের করে বলেছেন, পাঁজির শরৎ নয় দাদা, আসল শরৎ এসেছে, বিদায় নিয়েছে বর্ষাসুর।

বর্ষাসুরের বিদায় মানে মহিষাসুরের আগমন। সঙ্গে মা আসবেন আর তার ছেলেমেয়েরা। এই পুজো মানেই একটা আলাদা তোড়জোড়। আমাদের পুজো তো আর ঠিক পুজো নয়, পুজো মানে ফেস্টিভ্যাল। একটা হইহই ব্যাপার। সব জায়গায় ব্যস্ততা। একটা গুঁতোগুঁতির মতো ব্যাপার। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ব্যস্ততা, ঘরে ঘরে ব্যস্ততা, ব্যস্ততা দোকানে বাজারে।

কেনাকাটা ছাড়া পুজো বেমানান। তাই সরগরম বাজার দোকান। দক্ষিণের লোকজন গড়িয়াহাট চেনে উত্তরের লোকের হাতিবাগান। পুজোর বাজারে সেই হাতিবাগানে হাতি তো দুরস্থান মশা গলার জায়গা পর্যন্ত পাওয়া ভার। গিন্নিরা সারা বছর না হলেও বছরের এই সময়টায় গৃহকর্তার প্রতি ভালবাসা ফিরে পান। জামদানি, বালুচরির বাজারে তুমি সহচর আমি সহচরী। তাই ঢাকির পিছু পিছু ঢুলির মতো ব্যস্ত গিন্নিদের পিছনে গৃহকর্তাদের হাঁটতে দেখা যায় দোকানের পথে। ব্যস্ত বস্ত্র বিপণীর পাশে কান পাতলে আবদারের ঢের আবোলতাবোল টের পাওয়া যাবে।

—‘এটা কিন্তু আপনাকে বেশ মানাবে দিদি, এ সিজেনে এই রানি কালার ২০ পিস বিক্রি করেছি, আর মোটে একটা পড়ে আছে।’ দিদিরানি দেখে নাক কুঁচকে বলবেন, ‘আরে না না, ঠিক এই রানি নয়, পেঁয়াজের দুনম্বর খোসা ছাড়ালে যে রানি কালারটা আসে, সেই কালারটা দেখান।’ বিক্রেতার তো মাথায় হাত, মহার্ঘ পেঁয়াজের একনম্বর খোসা অতি সন্তর্পণে ছাড়িয়েই দীর্ঘকাল খেয়ে যাচ্ছেন, সেখানে দুনম্বর লেয়ারের নীচের রূপ!

ঠিক তখনি কেউ আবার ওপার থেকে বলছেন, ‘না না, আপনি ঠিক বুঝছেন না, এই হলুদটা চাইছি না, এটা তো কল্কে ফুলের মতো, আপনি ম্যাগির প্যাকেটের সেই টকটকে হলুদটা দেখান।’ আবদার আসছে, জেব্রার ডোরার মতো খয়েরি পাড়ের, কড়াইশুঁটির মতো সবুজ বডির সাথে বার্গেন্ডি রঙের কুঁচির। কারও দাবি, সবুজ-মেরুনের কম্বিনেশন, কেউ আবার খুঁজছেন লাল-হলুদ।

সিমিলি-মেটাফর আর ব্যস্ততার ঠ্যালায় দোকানের কর্মচারীর প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। তিনি বড় বেচারা মানুষ, নয়তো এই ভ্যারাইটি কুঁচি খুঁজে ঘর্মাক্ত না হয়ে ‘নিকুচি করেছে তোর চাকরির’ বলে মুক্তকচ্ছ হয়ে মা গঙ্গার হাওয়া সেবনে বের হতেন।

সাজুগুজু ছাড়া আবার পুজো কী! তাই ব্যস্ততা পার্লারে পার্লারে। নিশ্বাস একদিন বাদে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু পার্লার ভ্রমণ মাস্ট। কোনও সংসারেই গৃহকর্তার প্রতিবাদ এক্ষেত্রে ঠিকঠাক কাজ করে না। গিন্নির সরব প্রতিবাদ ভেসে আসবেই, ‘আমি মহিষাসুরের মত ভ্রু নিয়ে ঠাকুর দেখতে যেতে পারব না।’

কিন্তু শুধুই কি ভ্রুতে সাজগোজ ব্রেক কসবে? না। সাজুগুজু এক্সপার্ট মেয়েটি ভ্রু মেরামতি করতে করতে একটা ভোক্যাল ডোজ ছাড়বেন। বলবেন, মুখের এই অবস্থা কী করে করলেন দিদি, পুরো রাজকাপুরের ‘মেরা নাম জোকার’-এর বিজ্ঞাপন হয়ে গেছে যে!

এই কমপ্লিমেন্টের আলাদা এফেক্ট হবেই! শুরু হবে ফ্রুট কিংবা গোল্ড ফেসিয়াল। অগণিত অপেক্ষমাণ কাস্টমারের দিকে তাকিয়ে সেই এক্সপার্ট কন্যা হাত চালাবেন ম্যাজিসিয়ানের কায়দায়। অনেকটা নারকেল ছোবড়া দিয়ে মেঝে থেকে শ্যাওলা তোলার কায়দায় ফেসিয়াল চলবে ব্যস্ত হাতে আর কাস্টমার ভাববেন জোকার থেকে মানুষ হচ্ছি, একটু ব্যথা তো হবেই!

দর্জির দোকানেও ঢের ব্যস্ততা। হু হু করে সেলাই মেশিন চলছে, রেডিওয় চলছে অরিজিৎ সিং। বত্রিশ পাটি বের করে শেষবেলায় যিনি ছিট কাপড় হাতে হাজির হচ্ছেন, তাকে ধমকে দিচ্ছেন দর্জিদাদা— ‘এতকাল কি ঘুমাচ্ছিলেন নাকি, দাদা?’

এই প্রশ্নের মুখে সেই দাদা অফিসে লেট অ্যারাইভ্যাল-এর কেরানির মতো হাত কচলাচ্ছেন। মুখের ভঙ্গিতে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মত বিনয় নিয়ে বলছেন— ‘দেখুন না, একটু চেষ্টা করে।’

গোঁ ধরে দর্জি দাদা বলছেন, ‘এ বছর পুরনো পরে সামলে দিন, আসছে বছর বরং নতুনটা পরবেন।’ কাস্টমার নাছোড়বান্দা। অনেক সাধ্যসাধনার পর অবশেষে নবমীর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় নতুন জামাকাপড়ের আশ্বাস মিলছে। তাতেই বত্রিশ পাটি বের করে বাড়ি ফিরছেন দীর্ঘসূত্রী দাদা।

শহুরে ব্যস্ততা আরও হাজার কিসিমের। বাড়িতে গিন্নি বলে রেখেছেন, টিভির পুজো পরিক্রমায় ব্যস্ত থাকলে চায়ের আবদার মঞ্জুর হবে না। ঠাকুরমশাই পুজো সম্পাদককে বলছেন, মন্ত্র আমি পড়ব কিন্তু ফুল ছোড়ার কাজটা তন্ত্রধারকের হাতে দিন। এত চাপ নেওয়া যাচ্ছে না। ব্যস্ত চাঁদা পার্টির দল সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘দ্বিতীয়বার তাগদায় আসা সম্ভব নয়, বিল নিন ক্যাশ দিন, নয়তো ঝামেলা আছে।’

ব্যস্ততা কুমোরঠুলির শিল্পীর তুলির টানে, ব্যস্ততা ক্লাব সেক্রেটারির সিগারেটের টানে, ব্যস্ততা প্যান্ডেলওয়ালার, ব্যস্ত প্রেমিকের বাইক বাহন, ডাক্তার উকিল পর্যন্ত বলছেন, সংক্ষেপে সারুন, সাতকাহন শোনার সময় নেই।

সে যাই হোক, পুজো শুরু হলে কিন্তু আমার আপনার ব্যস্ততাকে এক ধমকে থামিয়ে দেবে আমাদের সাধের মহানগর। চন্দ্রযান-এর এসকেপ ভেলোসিটির গর্বে আপনি যতই গর্বিত হোন না কেন, মহানগরে ট্র্যাফিক কিন্তু এগোবে সেই শম্বুক গতিতে। আর হ্যাঁ, শ্রীভূমিতে সপ্তমীতে প্রবেশ করলে সময় তো লাগবেই, প্যান্ডেল থেকে বের হতে দশমীও হয়ে যেতে পারে।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
3 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »
নন্দিনী কর চন্দ

স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্দরমহলে: কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি

বিস্মৃতির অতলে প্রায় তলিয়ে যাওয়া এমন কয়েকজন মহিলা কবির কথা আলোচনা করব, যাঁরা তাঁদের কাব্যপ্রতিভার দ্যুতিতে বাংলা কাব্যের ধারাকে উজ্জ্বল ও বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণকামিনী দাসী, মোক্ষদায়িনী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, লজ্জাবতী বসু, জগন্মোহিনী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, হিরণ্ময়ী দেবী, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, সুরবালা ঘোষ প্রমুখ।

Read More »
মোহাম্মদ কাজী মামুন

বালকেরা অচেনা থাকে : এক অবিস্মরণীয় পাঠ অভিজ্ঞতা

ঘাসফুল নদী থেকে প্রকাশিত ‘বালকেরা অচেনা থাকে’ গল্পগ্রন্থটি যতই এগোনো হয়, একটা অনুতাপ ভর করতে থাকে পাঠকের মনে— কেন আগে সন্ধান পায়নি এই অমূল্য রত্নসম্ভারের! হ্যাঁ, রত্নসম্ভারই, কারণ একটা-দুটো নয়, প্রায় দশটি রত্ন, তাও নানা জাতের— লুকিয়ে ছিল গল্পগ্রন্থটির অনাবিষ্কৃত খনিতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসবের শতবর্ষ

কবির প্রয়াণের পরের বছর থেকেই আশ্রমবাসী বাইশে শ্রাবণকে বৃক্ষরোপণ উৎসব বলে স্থির করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনটিই এ-উৎসবের স্থায়ী তারিখ। বাইশের ভোর থেকেই প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় উৎসব। সকালে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বিচিত্রভাবে একটি পালকি চিত্রিত করেন ছবি এঁকে, ফুল, লতাপাতায়। মঙ্গলধ্বনি দিতে দিতে এর পর পালকির ভিতরে টবের মধ্যে একটি চারাগাছকে স্থাপন করা হয়। অতঃপর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গীত-পরিবেশন-সহ আশ্রম-পরিক্রমা।

Read More »