ক ল্যা ণ সে ন গু প্ত
লালুদা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে লাইব্রেরির দরজা বন্ধ করছিল। বারান্দা থেকে চোখে চোখ পড়ল। ম্লান হাসল। সোমবার বিকেল বিকেল বন্ধ হয়। শনি-রবিবার খোলা। আজ মনে হয় দিলীপ আসেনি। দিলীপ হচ্ছে লালুদার অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমার বাড়ি থেকে কোনাকুনি চারটে বাড়ি ছেড়ে স্মৃতিকণা পাঠাগার। বাসুদেবপুর শহরতলির সবচেয়ে পুরনো পাঠাগার। বাবা, কাকা লালুদা বলত। পাড়ার সবাই এমনকি আমিও লালুদা-ই ডাকি। আসল নাম ললিতেন্দু বিশ্বাস। অনেক বড় হয়ে বাবার কাছে শুনেছি। এখন সত্তর ছুঁই ছুঁই। অকৃতদার মানুষ।
একটু দূরে চৌধুরীদের একটা বাগানবাড়ি। সে বাড়ি সারাবছর খালি থাকে। শুধু বছরের শীতের ক’টা দিন আর চেনাশুনো কারও বিয়ের জন্যে ভাড়া দেয় বিভাস চৌধুরী। সেখানে গেটের সঙ্গে লাগানো এক ঘরের থাকবার জায়গা, সঙ্গে রান্নাঘর, বাথরুম।
লালুদার বাবা পালান একসময় জমিদার সবিতেন্দ্র চৌধুরীর লাঠিয়াল ছিল। এই বাগানবাড়ির রক্ষাকর্তাও ছিল। প্রচুর জমিজায়গা, পুকুর নিয়ে চৌধুরীদের জমিদারি। যেখানে যেখানে চাষিরা কর দিত না, তাদের ওপর লাঠিয়াল পাঠানো হত দঙ্গল বেঁধে। তারা গিয়ে লাঠি দিয়ে পেটাত, ঘরবাড়ি ভেঙে দিত। লালুদা চৌধুরীদের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পড়েছে এইট-নাইন অবধি। সবিতেন্দ্র চৌধুরীর ছোটছেলে বিভাস চৌধুরীর ছায়াসঙ্গী হয়ে ঘুরত মাঠেঘাটে, বাজারে। কখন কী লাগে জমিদারপুত্রের কে জানে! ঘুরতে ঘুরতে সেও লায়েক হয়ে ওঠে। বিভাস চৌধুরীর সঙ্গে গ্রামের কারও অমত হলে তার ওপর চড়াও হওয়া শিখে গেছিল। একবার পাশের গ্রামে যাত্রা দেখে ফেরার সময় কিছু ডাকাত বিভাস চৌধুরীর ওপর আক্রমণ করে। বিভাস চৌধুরী তখন চোদ্দ আর লালুদা পনেরো। জমিদারতনয়কে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাঠি হাতে। বিভাস চৌধুরীকে যখন এক ডাকাত তরোয়ালের কোপ বসাতে যাচ্ছে পিছন থেকে, লালুদা সামনে একটা ইট পড়েছিল, তুলে পিছন থেকে মাথায় বসিয়ে দিল। ব্যাস, এতক্ষণ ডাকাত ছিল, হয়ে গেল নিরীহ গ্রামবাসী। মাথাটা থেঁতলে গেছিল একদিক। পুলিশ এল, লালুদার জেল হল। কেস চলল বহু বছর। প্রমাণের অভাবে সাজা হল ছয় বছর। ছয় বছর বাদে ছাড়া পেল জেল থেকে। মা ছোটবেলায় চলে গেছিল আর ততদিনে বাবা পালানও মারা গেছে। সবিতেন্দ্র চৌধুরী রয়েছেন। বয়স হয়েছে।
পূর্ণযুবক লালুদা এসে দাঁড়াল জমিদারের সামনে। জমিদারির রমরমা তেমন নেই রাজনৈতিক পালাবদলে। সবিতেন্দ্র চৌধুরীর একটা সখ ছিল পুথি, বই কেনার। বিদেশি ইতিহাসের বই, অর্থনৈতিক, সামাজিক বইয়ের সম্ভার ছিল প্রচুর। বিদেশ থেকেও আনাতেন প্রচুর বই। নিজে পড়তেনও খুব। বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকার ইতিহাস আর সামাজিক জীবনের ওপর বই। কলকাতার বিদ্বজ্জনের মাঝে একটা নাম ছিল।
জমিদার মানুষের খেয়ালের শেষ নেই। ছেলে বিভাস বাবার সাথে মিলে করে ফেলল এক লাইব্রেরি। অনেকটা জমি নিয়ে একতলা বাড়ি তুলে ফেলল। জেলফেরত লালুদার আর তখন লাঠিয়াল হবার সখ নেই, সামর্থ্যও নেই।
সবিতেন্দ্র বললেন, ‘তুই এতদিন আমাদের দেখাশুনা করেছিস। এখন আগের দিন নেই। যদি মন চায় এই বইগুলোর দেখাশুনা কর। এই কাজই তোকে দিতে পারি।
কোনও ‘না’ নেই মনিবের কথায়। ছিল লাঠিয়াল, হয়ে গেল লাইব্রেরির দেখভালের কর্তা।
সবিতেন্দ্র আরও বললেন, ‘কেমন কেমন লোকজন আসে খেয়াল রাখবি। আজেবাজে লোককে ঢুকতে দিবি না। বই যেন চুরি না হয়। দরকার হলে লাঠি তুলে নিবি হাতে। লাইব্রেরি সরস্বতীর মন্দির। সব সময় পরিষ্কার রাখতে হয়। ধুলো যেন না জমে। সরস্বতী পাপ দেবে না হলে।
লালুদা মাথা চুলকে বলল, ‘আজ্ঞে, আমি তো বই পড়তে জানি না। আমি কি পারব রক্ষা করতে?’
—‘বই হচ্ছে জ্ঞানের ভাণ্ডার। ভাণ্ডারটা রক্ষা কর। জ্ঞানের ব্যাপারটা দেখছি। আমি বিভাসকে বলব, তোর পড়াশুনার ব্যাপারটা দেখতে।’
বিভাস স্কুলের অনেক মাস্টারকে চেনে। একদিন বিভাস চৌধুরী হাইস্কুলের রামকৃষ্ণবাবুকে নিয়ে এলেন।
লালুদাকে দেখে ভয় পেয়ে বললেন, ‘একে আমি পড়াতে পারব না। এ তো লাঠিয়াল।’
বিভাস বলল, ‘তাতে কী?’
—‘ও কে তো চিনি। একবার বাবাকে জমির খাজনা না দিতে পারায় মারতে এসেছিল। বাড়ির চাল ভেঙে দিয়েছিল। এটা আমি পারব না।’
শুনে লালুদা চলে গেল মাস্টারমশাইয়ের কাছে। বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করুন মাস্টারমশাই। আমি পড়াশুনা শিখতে চাই। আমি করজোড়ে হাঁটু গেড়ে শিখব। আপনার জ্ঞানের আলো আমায় একটু দিন। আমি আর কিছু তো চাইনি।’
—‘এই বয়সে হয় না। শুধু শুধু চেষ্টা। লাঠি ধরা হাতে পেন কাজ করে না।’
লালুদা বলল, ‘একবার দেখুন। কথা দিচ্ছি, আপনাকে হতাশ করব না। আর এছাড়া আমার সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। অনেক প্রলোভন চারিদিকে।’
বিভাসবাবু মাঝখানে ঢুকে মাস্টারমশাইকে বোঝাল, ‘বাবাকে কথা দিয়েছে। আপনি একটু চেষ্টা করুন।’
এবার মাস্টারমশাই নরম হলেন। ‘ঠিক আছে। তোমার বাবা যখন বলেছে, আমি কিছুদিন চেষ্টা করব।’ তারপর লালুদাকে বলল, ‘পড়তে হবে। জানতে হবে। তবে তো লাইব্রেরির দেখাশুনা করতে পারবি। অশিক্ষিত মানুষের লাইব্রেরিতে জায়গা নেই।’
সেই শুরু। লাইব্রেরি বিল্ডিং হল, লালুদার জ্ঞান আহরণও শুরু। বাবু বলেছে, পড়তে হবে। তবেই লাইব্রেরির ভার দেবে। রামকৃষ্ণবাবু যাই দেন ঘরে বসে শিখে ফেলে লালুদা। না পারলে সন্ধেবেলা দৌড়ে আসে বইখাতা নিয়ে। সব সময় সঙ্গে একটা ঝোলা, তাতে বই খাতা পেন্সিল রবার আর বুকের মধ্যে প্রবল ইচ্ছে। ওর তো ক্লাসের পড়া নয়, তাই বই পড়তে শিখে গেলেই এত বইয়ের যা পেল পড়তে শুরু করলে। ভাল লাগা নয়, পড়তে হবে জানতে হবে। কিন্তু যত জানে তত অজানা বেড়ে যায়। তত নিজেকে ক্ষুদ্র লাগে। নিজের ঘরেও বই ছড়ানো-ছেটানো।
রামকৃষ্ণবাবু বললেন, ‘এলোমেলো পড়িস না। এক এক করে পড়বি। শিশু পড়, সহজপাঠ পড়। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম শেষ করে বাংলা ছোটগল্প, কবিতা, ইতিহাস, ভূগোল এসব পড়। একে একে। সবচেয়ে বেশি কাগজ পড় খুঁটিয়ে। ধীরে ধীরে। শুধু পড়লে হবে না। তাকে মনের মধ্যে গেঁথে নিতে হবে। চিন্তায় আনতে হবে কী পড়লাম। বইয়ের নেশায় জানার আগ্রহে লোকটা চলাফেরায় অন্যমনস্ক, খ্যাপার মত হয়ে গেল। হাতে লাঠির বদলে উঠে এল বই, সর্বক্ষণের জন্যে। প্রথম তাগিদ ছিল বাবু বলেছে। পরে হয়ে গেল নতুন নতুন জানার আগ্রহ। বয়েসকালের জ্ঞানের নেশা হাজার নেশার ওপরে।
লাইব্রেরি চালু হল। পুরনো নতুন বইয়ের হাজার হাজার সম্ভার পাগলের মতো করে তুলল। লাইব্রেরিতে সময় নষ্ট করে না। রাত্রে বাড়ি যাবার সময় বই বগলে করে নিয়ে যায়। রাতবিরেতে গেলেও দেখা যেত লালুদার ঘরে আলো জ্বলছে।
বন্ধু শ্যামল, কার্তিক, দিলু এবং আমিও বই বগলদাবা করে ঘরে যাবার পথে জিজ্ঞাসা করতাম ঠাট্টা করে, ‘এত পড়ছ কেন? কী লাভ? পরীক্ষা সামনে?’
লজ্জায় হাসি দিত। বার বার বলত, ‘আমি তো অশিক্ষিত। সময় কমে আসছে।’
জানতে শুরু হবার পর শুরু হল প্রশ্ন। কী, কেন, কোথায়? যে আসে পড়াশুনা করতে, পুরনো পুথি ঘাঁটতে, তাকেই অনন্ত প্রশ্ন। কেউ বিরক্ত হয়, কেউ চেষ্টা করে উত্তর দেয়। আলাদা করে মহাপুরুষদের জীবনী পড়া কিন্তু তাদের পরস্পরের যোগাযোগ আর সম্পর্ক কেমন ছিল, তাই নিয়ে প্রশ্ন। বাংলার ইতিহাস, সামাজিক ব্যবস্থা, আইনি ব্যবস্থা, ধর্মীয় পূজাপার্বণ নিয়ে অনেক পুথি সবিতেন্দ্র চৌধুরী যোগাড় করেছিলেন নিজের জানার জন্যে। সেই পুথিগুলো এখন রিসার্চ ওয়ার্ক-এর মূলধন। কলকাতা থেকে আজকাল ছাত্র, শিক্ষক মাঝেমাঝেই আসে। লালুদার প্রায় সবই কণ্ঠস্থ। কোনটা কার পেলে সুবিধে হয়, দেখে বার করে দেয়। হাতে লেখা পুথি বই আকারে এখনও বেরোয়নি। মাঝেমাঝেই নানা নামকরা প্রকাশক আসে বই আকারে প্রকাশ করতে। কিন্তু বিভাস চৌধুরীর ছেলে অনিমেষ চৌধুরী অনুমতি দেয় না। এই লাইব্রেরির নাম আজকাল লোকে জেনেছে আর জানছে সেটা পুথির জন্যে। বই প্রকাশ করে বেচলে আর আসবেন না তারা।
পুথিগুলো আঠেরো শতাব্দীর প্রথম থেকে উনিশ শতাব্দীর শেষ অবধি বিস্তৃত। গবেষণার কাজে প্রচুর দাম।
লাইব্রেরি বড় হবার পর সঙ্গে একটা ওপেন-এয়ার স্টেজ করা হয়েছে। যেখানে প্রতিবছর শীতকালে প্রচুর গানবাজনা, নাটক ও যাত্রার আয়োজন করে চৌধুরীরা। একতলায় লাইব্রেরি, সঙ্গে বসে পড়ার জায়গা। দোতলায় যোগ ব্যায়াম আর গ্রামের গরিব ছেলেদের বিনে পয়সায় পড়ানোর জায়গা। লালুদার বয়েস হয়েছে, তাই দিলীপ ছাড়া একজন হেল্পার এসেছে। তারা ঘরবারান্দা পরিষ্কার করে। মোছে, আবার সন্ধেবেলা মেম্বারদের বইও খুঁজে দেয় স্টোর থেকে।
বইই জগৎ। তবু বড় মায়া লালুদার বইয়ের ওপর। মাঝে মাঝে ঘরে একা থাকলে পুথিগুলোর ওপর হাত বোলাতে বোলাতে ছোটবেলার গ্রাম, নদীর পাড়, বাবা-মার কথা মনে পড়ে।
সবার আগে আসে, একদম শেষে যায়। বনধের দিনও খোলা রাখে। তিনবার বিভিন্ন দল ওকে মেরেছে। মরে যায়নি। কোনওদিন দেরি হয় না খুলতে।
কোনও একসময় জমিদারদের অনুগত দেহরক্ষী ছিল, তাই উত্তাল নকশাল আন্দোলনের সময় লালুদা জমিদারদের দালাল এরকম প্রচার হতে লাগল। কেননা লাইব্রেরির বাঁধানো জমিতে কোনও গুপ্ত দলের মিটিং করতে দেয়নি। মেন গেটে তালা লাগিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে ছিল। দু-চারজন এসেছে, তর্কবিতর্ক করেছে, কিন্তু মিটিং হয়নি। মন্দির রাজনীতির জায়গা নয়। লাইব্রেরি থেকে বরং কিছু পুরনো বইচুরি ধরে ফেলার পর রাজনৈতিক রং লেগে গেল লালুদার গায়ে। পাড়ার সুকোমলদা কোনও এক নকশালপন্থী নেতা ছিলেন। তিনি কোনওদিন লালুদার লাইব্রেরিতে যেতেন না। সাহিত্যের ছাত্র আসত, যারা উনবিংশ শতাব্দীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে রিসার্চ করছে। সবিতেন্দ্র চৌধুরীর নিজের তৈরি প্রিয় বইয়ের সম্ভার ঘাঁটতেই আসত। উনবিংশ শতাব্দীর ধর্মীয় আচার আর সামাজিক রীতিনীতির আকর ছিল বইগুলো। ওর নিজের লেখা বইও, সে বইগুলি বাজারে পাওয়া যায় না।
সেই নকশাল আমলে এক সন্ধেবেলা সুকোমলবাবুর ছেলে বিনুকে বিরোধী পক্ষের ছেলেরা তুলে নিয়ে যেতে এসেছিল। বিনু কোনও রকমে দৌড়ে লালুদার কাছে এসে আশ্রয় চায়। ওই একবার লালুদা রাজনীতির ছেলেদের কাছে পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওরা যখন এসে বিনুকে চায়, তখন সেই লাঠিয়াল স্বত্বা জেগে ওঠে হিংসার বিরুদ্ধে। লালুদা বলেছিল, ‘এই হাতে অনেক রক্তপাত ঘটিয়েছি। আমায় না মেরে বিনুকে পাবে না। আমার কোনও পিছুটান নেই। আমি চাই না এই বয়সে রক্তের হোলি খেলতে।’ মৃত আগ্নেয়গিরি নতুন করে জেগে উঠুক ওরা চায়নি। পিছিয়ে গেছে। বিনুকে বাড়ি পৌঁছে দেবার পর সুকোমলবাবুর বোধহয় পিতার স্বত্বা জেগে ওঠে। হাত ধরে অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। লালুদা বলেছিল, ‘আপনাদের রাজনীতি বুঝি না। তবে এটা জীবন দিয়ে বুঝেছি, রক্ত ঝরিয়ে একমাত্র স্বাধীনতাই পাওয়া যায় আর বিভেদ পাওয়া যায়। রক্তের রাজনীতি করবেন না।’
সেই লালুদা আর দিলীপ করোনার সময় চৌধুরীদের অনুমতি নিয়ে লাইব্রেরির হলঘর খুলে দিল। সারি সারি বেড পাতা হল। মুমূর্ষু রুগি যাদের অক্সিজেন লাগে, হাসপাতালে জায়গা পায়নি, তাদের জন্যে পরিত্রাতা হয়ে উঠল। ডাক্তার, নার্স, সরঞ্জাম যোগাড় করল বিধায়ক, পাড়ার ছেলেরা। তখন প্রতিদিন পাড়ার এখানে-ওখানে খবর আসছে, অক্সিজেনের অভাবে চেনা মানুষরা মারা যাচ্ছে। লালুদাকে দেখলাম আবার লাঠি হাতে। রাত দিন এক করে জেগে আছে। যেন ওর বাড়িতে কেউ এসেছে চিকিৎসা করতে। নিজের ঘরে অবধি যাওয়া নেই। লাইব্রেরি বন্ধ। মাঝে মাঝে নেশার জন্যে রাত জেগে বই পড়া, পুথি পড়া চলেছে। সারাদিন শুধু ওষুধ, খাবার আর অক্সিজেন যোগাড় করেই কেটেছে। কত লোক যে ভাল হয়ে আশীর্বাদ করতে করতে বাড়ি ফিরে গেল, তার ঠিক নেই। স্নান, খাওয়া ভুলে শুধু সেবা করে গেল মানুষটা। বড্ড মানুষ ভালবাসে।
খাটো ধুতি, একটা হাফ হাতা ফতুয়া, একমুখ পাকা দাড়ি, পায়ে হাওয়াই চটি। সত্তরের কাছাকাছি বয়েস কে বলবে? পেটানো কালো শরীর। এর জ্বর, পেটখারাপ, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু কিছুই হয় না।
এখন সব স্বাভাবিক জীবন ফিরে এসেছে। আবার সেই রোজকার লাইব্রেরি-অন্ত প্রাণ মানুষটা দশটায় দরজা খোলে। সকালের দিকে দুটো-তিনটে ছেলেকে ইউনিভার্সিটির থিসিসের জন্যে পুথি খুঁজে দিতে সময় যায়। রোজ একটু একটু করে নিজে হাতে সহযোগী সহযোগে বই নামিয়ে ধুলো ঝাড় দেয়। বিকেলে লাইব্রেরির বাইরে সিমেন্টের বাঁধানো রকে বসে পরিতৃপ্তির চুমুক দেয় চায়ে, তখন বড় শিশুর মতো লাগে। রাস্তা দিয়ে বাচ্চারা গেলে ডেকে কথা বলে। আদর করে। লালুদা জানে, আমিও জানি, সরকার কী একটা পুরস্কার দেবে ওকে এ মাসের শেষে সাহিত্যে অবদানের কথা ভেবে। সে কথা তুললে লজ্জায় নিজের হাত কপালে ঠেকিয়ে খালি বলে, ‘এটা কেমন হল? আমি তো অশিক্ষিত। এর থেকে কিছু আরও বই দিলে পারত।’
একদিন বললাম, ‘বাসুদেবপুরের স্মৃতিকণা পাঠাগারের নাম বেরোবে কাগজে। তোমার আনন্দ হবে না?’
চকচক করে উঠল চোখ। বলল, ‘হবে বৈকী। বড়বাবু বেঁচে থাকলে কত খুশি হতেন। আমি তো দেখভালের লোক।’
বললাম, ‘তোমায় কিছু বলতে বললে, কী বলবে পুরস্কার নিয়ে। ভেবে রাখো।’
ফিরতি বলল, ‘কী বলব বলত দাদা? আমি তো মূর্খ মানুষ।’
তারপর চোখের কোণটা জলে ভরে উঠল, ‘বুঝলে দাদা, বলব, সরকার আরও যেন কিছু বই দেয়। বই বড় পবিত্র জিনিস। মানুষকে শান্ত করে, শুদ্ধ করে। লাইব্রেরিটা আরও যেন বড় হয়। লোকে যেন বিদ্বান হয়। বল ভাল হবে না?’
আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। মানুষটা ভাগ্যিস বই বোঝে। তাই পুরস্কারের জাঁকজমক ওকে টানে না, ও বোঝেও না। পড়াশুনার লোকেরা ওর কাছে আসে। ও কারও কাছে যায় না লাইব্রেরি ছেড়ে। আশার কথা, মানুষ ডিগ্রি নয়, এখনও জ্ঞানের খোঁজই করে।
অসামান্য