তখনও বাংলা ছিল অখণ্ড। অবিভক্ত বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার প্রচলন ঘটেনি। সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়কালে বাংলায় প্রচলিত ছিল মূলত ৩টি ভাষা: ১. সংস্কৃত, ২. প্রাকৃতের বিভিন্ন রূপ এবং ৩. শৌরসেনী অপভ্রংশ। এরইমধ্যে যে গুটিকতক নাটক আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে তা কালিদাস, ভাস, শূদ্রক প্রমুখের লেখা সংস্কৃত নাটক। কিন্তু চর্যাগীতির ভাষায় সাধারণ মানুষের জন্য লেখা কোনও নাটকের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এরপর বহুকাল ধরে বাংলায় নাটকের চর্চায় পলি জমতে থাকে।
দ্বাদশ শতকে বাঙালি কবি জয়দেব রচনা করেন ‘গীত গোবিন্দম’, যার মধ্যে তৎকালীন লৌকিক নাট্যরূপের অনেকগুলি লক্ষণ স্পষ্ট ছিল। পরবর্তীতে ‘মনসামঙ্গল’, ‘চণ্ডীমঙ্গল’, ‘কালিকামঙ্গল’-এর বিভিন্ন অংশ মঞ্চস্থ হত। তবে তা মূলত নৃত্য সহযোগে গীত হত। এছাড়াও ছিল যাত্রার বহুল চর্চা। প্রতি বছর বর্ষা অবসানের পর যাত্রাপালার দল তাদের নট, গাইয়ে, বাজিয়েদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ত বাংলার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। গ্রামের ভূস্বামীদের অঙ্গনে, মেলায়, বারোয়ারি মণ্ডপে আসর বসত। পালায় বলা হত পুরাণকথা, গাওয়া হত মূলত ভক্তিরসাত্মক গান। তখন পালাগানের মর্মই ছিল ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ। এরপর চৈতন্যযুগে গানের সঙ্গে কিছু সংলাপ সংযোজিত হতে থাকে। বৈষ্ণব ধর্মের প্রচলনের মধ্য দিয়ে থিতিয়ে পড়া প্রাচীন নাট্যসংস্কৃতির পুনর্বিকাশ ঘটতে থাকে। রামযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর নির্মিত হতে থাকে শীতলাযাত্রা, ওলাবিবির যাত্রা। তবে এগুলিকে নাটকের পর্যায়ে ফেলা যায় না।
আরও কিছুকাল পরের কথায় আসা যাক। গ্রামবাংলায় তখন যাত্রা, কীর্তন, লোকনাট্য, ভাঁড়যাত্রাই ছিল বিনোদনের সামগ্রী। এছাড়াও ছৌ, কবির লড়াই, রায়বেশে, অষ্টক, খন, গম্ভীরার মত অজস্র লোক আঙ্গিকে সমৃদ্ধ ছিল বাংলাদেশ। হঠাৎ বাংলায় নেমে আসে এক গভীর সংকট। তমসাচ্ছন্ন যুগ— সংকীর্ণতা, কুসংস্কার, গোড়ামিতে ছেয়ে গেল সমগ্র দেশ। দেখতে দেখতে দেশের শাসনভার হস্তান্তরিত হয় ইংরেজদের হাতে। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে চার্নক সাহেব শহর কলকাতা শহর গোড়াপত্তন করলেন। ক্রমেই কলকাতা শহরের গুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং ১৭৭৪ সালে তা ভারতের রাজধানী হয়ে ওঠে। ঠিক এইসময়েই বাংলার বিষ্ণুপুর, নদীয়া, যশোহর, বর্ধমান, বীরভূম প্রভৃতি অঞ্চলে যাত্রা বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। কলকাতা শহরের সঙ্গে সঙ্গে এক বিত্তবান শ্রেণির উদ্ভব হয় এবং আমোদপ্রমোদের জন্য ডাক পড়ে যাত্রাওয়ালাদের। এছাড়াও শহর কলকাতা তখন দেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র, দেশের নানান প্রান্তের মানুষের রুজিরোজগারের ঘাঁটি। ফলে এই শহরের জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং তাদের বিনোদনের জন্য গ্রাম থেকে শিল্পীরা আসতে থাকেন। মূলত যাত্রা, নাচগানের আসরই বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এমনই এক সময়, বাংলায় আগমন ঘটে এক রাশিয়ান ভাগ্যান্বেষীর। নাম গেরাসিম লেবেদেফ। পুরো নাম গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ। ১৭৮৫ সালে ভারতীয় সংস্কৃতির এই সাধক প্রথমে বসবাস শুরু করেন মাদ্রাজে। তামিল ভাষায় তালিম নিয়ে ভারত ও রাশিয়ার মৈত্রীবন্ধন স্থাপনে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এরপর ১৭৮৭-তে কলকাতায় এসে সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষালাভ করেন। এমনকি বিশিষ্ট পণ্ডিত গোপালনাথ দাস, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, জগমোহন বিদ্যাপঞ্চানন প্রমুখের কাছে বাংলা ভাষা চর্চা করেন এবং যন্ত্রশিল্পী হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
অবশেষে ১৭৯৫-তে তৎকালীন কলকাতার ২৫নং ডুমতলা লেন-এ (যার পরবর্তীতে নামকরণ হয় ৩৭-৩৯ এজরা স্ট্রিট) জগন্নাথ গাঙ্গুলির বাড়ি ভাড়া নিয়ে নির্মাণ করেন একটি নাট্যশালা, যার নাম দেন ‘দ্য বেঙ্গলি থিয়েটার’। যদিও এটিকে একটি গুদামঘরই বলা ঠিক হবে। এটিই ছিল প্রথম বঙ্গীয় নাট্যশালা। বাংলার যাত্রাপালার আদলে মঞ্চনির্মাণ না করে তিনিই প্রথম বিদেশি রঙ্গমঞ্চের আদলে মঞ্চনির্মাণ করেন এবং বিদেশি নাট্যরীতির প্রবর্তন ঘটান। তবে ঈর্ষাপরায়ণ ইংরেজি থিয়েটারের মালিকরা তাঁর নাট্যশালাটি পুড়িয়ে দেয়।
লেবেদেফই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় সাধারণ মানুষের জন্য নাটক মঞ্চস্থ করেন। মাত্র ৩ মাসের মধ্যে নাট্যশালাটি নির্মিত হয়। ‘দ্য ডিসগাইজ’ নামক একটি ইংরেজি নাটকের অনুবাদ করে ৩ মাসের মহলায় মঞ্চস্থ হয় ১৭৯৫-এর ২১-এ মার্চ এই নাট্যশালায়। ‘ক্যালকাটা গেজেট’ সংবাদপত্রে নাট্যাভিনয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। টিকিটের মূল্য ছিল এক স্বর্ণ মোহর। এই প্রথমবার বাংলা রঙ্গমঞ্চে বারবনিতাদের নারীচরিত্রে অভিনয়ের জন্য আনা হয়। এছাড়াও ‘লাভ ইজ দ্য বেস্ট ডক্টর’ নামে আরও একটি নাটকের অনুবাদ করে মঞ্চস্থ করেন। সেই প্রহসনই পরবর্তীকালের বাংলা প্রহসন রচনার প্রেরণাস্থল হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে।
সর্বোপরি, ইংরেজ শাসকের মনোরঞ্জন ব্যতীত আপামর জনসাধারণের বিনোদনের জন্য তাঁর এই প্রয়াস বাংলা নাট্যশালা ও বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে নতুন দিশা দেখায়। যদিও সেইসময়কার বাঙালিরা রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় লেবেদেফের পথ অনুসরণ করে নাট্যপ্রবাহ এগিয়ে যেতে সক্ষম হননি, তবুও তার সৎ প্রয়াসের সুদূরপ্রসারী ফলাফল লক্ষ করা যায় বাংলায় লেবেদেফ-পরবর্তী নাট্যচর্চার মাধ্যমে। বেনিয়া ইংরেজদের চক্রান্তে লেবেদেফের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ বলে মনে হলেও, তাঁর সদিচ্ছাকে বাহবা দিতে হয়।
লেবেদেফ-পরবর্তী সময়ের নাট্যচর্চার ধারা সম্পর্কে আলোচনায় আসার আগে দেখে নেওয়া যাক তৎকালীন সামাজিক অবস্থা। কেটে গেল বহু বছর। ক্রমেই পাশ্চাত্য চিন্তাধারার বাতাস প্রবেশ করে বাঙালি সংস্কৃতিতে। ইংরেজি শিক্ষার জোয়ার আসে সমাজে, উদ্ভব হয় এক নতুন শ্রেণির— নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত পুরোদস্তুর বাঙালি জাতি জন্ম দিল এক নতুন সমাজব্যবস্থার। তৎকালীন সময়ে নবনির্মিত এই বাঙালি জাতিকে নিন্দুকেরা গালমন্দ পেড়েছিল ঠিকই, তবে তাদেরই হাত ধরে বাংলার নাট্যচর্চা পুনরুজ্জীবিত হয়। বাংলা থিয়েটারের আকস্মিক উদ্ভব যা লেবেদেফের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যায়, মধ্যবিত্ত বাঙালিদের হাতেই লেখা হয় তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
ইতিমধ্যে নবজাগরণের ঢেউ এসে লেগেছে বাঙালি মননে। রামমোহনের সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনে উত্তাল বাংলা সহ গোটা ভারত। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উদার বাঙালি সুশীল সমাজ অনুসরণ করছে রামমোহনের দেখানো পথ। হিন্দুধর্মের শুদ্ধিকরণ, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার, নারীশিক্ষার মত একাধিক প্রকল্পে এগিয়ে আসছেন হাজার হাজার মানুষ। কেউ বলছেন, এ মহাপাপ। কেউ আবার গা ভাসিয়েছেন নতুন স্রোতে। নাটকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নতুন মঞ্চ নির্মাণ, মঞ্চভাবনায় আধুনিকতার ছোঁয়া, রঙ্গমঞ্চে বারবনিতাদের প্রবেশ, বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব বাংলার নাট্যপ্রবাহের মোড় পরিবর্তন করে এবং তার বেগকে দ্রুততর করে।
এইসময়কার রঙ্গমঞ্চগুলির মধ্যে বৈষম্যতা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে তখন মূলত দুই শ্রেণির থিয়েটার হাউস নির্মিত হতে থাকে, একটি ইংরেজ দ্বারা নির্মিত প্রসেনিয়াম থিয়েটার হাউস। আর অপর দিকে শখের থিয়েটার বা শৌখিন থিয়েটারের চল দেখা যায়। একক ব্যক্তির উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি রঙ্গমঞ্চ। সেইসময় ইংরেজদের নির্মিত অন্যান্য থিয়েটারগুলির মধ্যে উল্লেখ্য ছিল ১৮০৮ সালে নির্মিত চন্দনগড় থিয়েটার, ১৮১৭ সালে নির্মিত দমদম থিয়েটার। অবশ্য সেসব আজ অতীত। তাদের অধিকাংশই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
১৮৩৫-এর পর থেকেই কলকাতার ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠতে থাকে বহু রঙ্গমঞ্চ। বড় বড় বাড়ির দালানে, উঠোনে, ঘর ভাড়া নিয়ে কিংবা ধনী ব্যক্তিদের আর্থিক অনুদানে নির্মিত রঙ্গমঞ্চে নাট্যাভিনয় হতে থাকে। এইসময়েই বাঙালি ধনী ব্যক্তি ও মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের পৃষ্টপোষকতায় পেশাদারী থিয়েটারের সূচনা হয়। এই থিয়েটারে প্রসেনিয়াম মঞ্চ ছিল। ছিল অঙ্কিত দৃশ্যপটের ব্যবহার, আবার দামি পোশাকের ব্যবহারও লক্ষ করা যায়। পৌরাণিক, সামাজিক নাটকের নিয়মিত অভিনয় শুরু হয়।
বাঙালিদের শৌখিন থিয়েটারের সূচনা ঘটে ১৮৩১ সালে প্রতিষ্ঠিত বাঙালি দ্বারা স্থাপিত প্রথম নাট্যশালার হাত ধরে। উত্তর কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রসন্নকুমার ঠাকুরের উদ্যোগে নির্মিত হয় ‘হিন্দু থিয়েটার’। রঙ্গালয়টি নির্মিত হয় নারকেলডাঙায় তাঁর বাড়ির মধ্যে। ইতিমধ্যে কলকাতায় আগত ইংরেজদের মনোরঞ্জনের জন্য ১৭৫৩-তে লালবাজার অঞ্চলে স্থাপিত হয়েছে ইংরেজদের থিয়েটার ‘প্লে হাউস’। তবে, এই প্রথম বাঙালি থিয়েটারের রঙ্গালয় ইংরেজি রঙ্গালয়ের আদলে নির্মিত হয়।
ভবভূতি রচিত সংস্কৃত নাটক ‘উত্তর রামচরিত’ নাটকটির অংশবিশেষ ইংরেজিতে অনুবাদ করে তা মঞ্চস্থ করা হয়। অনুবাদক ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ ইংরেজ পণ্ডিত এইচ এইচ উইলসন, তিনি নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন। এছাড়াও ইংরেজি নাটক ‘জুলিয়াস সিজার’-এর পঞ্চম অংশ অভিনীত হয়েছিল এই রঙ্গমঞ্চে। হিন্দু কলেজের ছাত্ররা এইসব ইংরেজি নাটকে অভিনয় করার সুযোগ পান।
১৮৩৯-এ ইংরেজ শাসকের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে সা সুচি থিয়েটার। সা সুচি নামটি ফরাসি। পণ্ডিতদের মতে, ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত রঙ্গমঞ্চের ফরাসি নামকরণের মধ্য দিয়ে তাদের হীনমন্যতার মনোভাবটিই ফুটে ওঠে। সে প্রসঙ্গ বরং এখন থাক। এই মঞ্চে অভিনীত হয় উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘ওথেলো’।
প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ‘হিন্দু থিয়েটার’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৩৫ সালে শ্যামবাজারের উচ্চবিত্ত নবীন বসু তাঁর বাড়িতে নির্মাণ করেন আর একটি নাট্যশালা। ইংরেজ আদলে নির্মিত এই মঞ্চে নাট্যাভিনয় হত বাংলা ভাষায়। এই প্রথম কোনও বাঙালির উদ্যোগে বাংলা নাটকের অভিনয়ের নজির মেলে। সেই বছরের ৬ অক্টোবর ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসাগর’ মঞ্চস্থ হয়।
তাঁর উদ্যোগে সর্বপ্রথম বঙ্গীয় নাট্যমঞ্চে মহিলা শিল্পীর প্রবেশ ঘটে। এর পূর্বে নাটকের মহিলা চরিত্রগুলির অভিনয় করতেন অল্পবয়স্ক যুবকরা। নবীন বসুর উদ্যোগে নারীদের বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে প্রবেশের পথ প্রশস্ত হয়। নাটকের মহিলা চরিত্রগুলি অভিনয়ের জন্য মহিলাদের আনা হয়। ক্রমেই তাঁর থিয়েটার অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। শোনা যায়, রাত ১২টায় অভিনয় সমাপ্ত হওয়ার পরবর্তী দিনেই সকাল ৬টায় পুনরায় অভিনয় শুরু হত। তাঁর উদ্যোগেই প্রথমবার তৎকালীন একটি যাত্রাপালা নাটকাকারে অভিনয় করান।
নবীন বসুর থিয়েটার আধুনিক থিয়েটারের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। তাঁর থিয়েটারে প্রথম অনন্য চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটে। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের সঙ্গে অফ প্রসেনিয়ামের এক অভূতপূর্ব মিশেল দেখা যায়। নাটকের অভিনয় হতে শুরু করল তাঁর সমগ্র বাড়িটি জুড়ে। নাটকটির এক অংশ অভিনীত হত বৈঠকখানায়, আবার কখনও বা পুকুরপাড়ে। দর্শক সমস্ত নাটকটির অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে গমন করতেন। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে যা সম্পূর্ণ পথের দিশা দেখায়। এখান থেকেই Journey Theatre-এর ভাবনার উদয় ঘটে। নবীন বসুর থিয়েটার Environment Theatre-এর কনসেপ্টের বিকাশ ঘটায়। একই সঙ্গে কলা ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে মঞ্চে মায়ার সৃষ্টি করতে থাকেন। তার সম্ভাবনা দর্শকদের বিস্মিত করে। আলোর জন্য বিদেশি যন্ত্রপাতি আমদানি করেন এবং বিশেষ কৌশলে মঞ্চে ঝড়বৃষ্টির বাতাবরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
নাট্যচর্চার জোয়ারে গা ভাসিয়েছে তখন গোটা কলকাতা, এমনই এক সময়ে একদল যুবকের উদ্যোগে গড়ে ওঠা শখের থিয়েটার দল প্রথম সাধারণ রঙ্গালয়ে পরিণত হয়। গিরিশ ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফী, রাধামাধব কর, নগেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের মত বন্ধুস্থানীয় বেশ কয়েকজনের তখন শখ হল থিয়েটার করার, কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল অর্থ। মঞ্চসজ্জা ও আর্থিক আনুকূল্য না পেয়ে শেষমেষ গড়লেন একটি যাত্রা দল। নাম হল বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার।
দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ নাট্যাভিনয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হল যাত্রা। ১৮৬৮-র দুর্গাসপ্তমীর রাতে বাগবাজারের প্রাণকৃষ্ণ হালদারের বাড়িতে, আবার ১৮৭০-এ সরস্বতী পুজার রাতে রামপ্রসাদ মিত্র বাহাদুরের বাড়ির প্রাঙ্গণে এই নাটকটির অভিনয় হয়েছে। অবশেষে ১৮৭২ সালে শ্যামবাজারের রাজেন্দ্রলাল পালের বাড়িতে একটি রঙ্গমঞ্চের নির্মাণ হলে বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটারের নাম বদলে হয় ‘শ্যামবাজার অ্যামেচার থিয়েটার’। নামবদলের পালা তখনও শেষ হয়নি। ইতিমধ্যে রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের জন্য ৪০ টাকা ভাড়ায় চিৎপুরের মধুসুদন সান্যালের ঘড়িওয়ালা বাড়ি নামক সুবিশাল অট্টালিকাটি নেওয়া হয়। রঙ্গমঞ্চের অন্যতম রূপকার ধর্মদাস সুর মঞ্চনির্মাণের দায়িত্ব নেন। এবং ‘শ্যামবাজার অ্যামেচার থিয়েটার’-এর নাম বদলে তা ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সেখানে ৭ ডিসেম্বর ‘নীলদর্পণ’ মঞ্চস্থ হয়।
এরপর একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’-এ। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী সকলেই তখন পৌঁছেছেন খ্যাতির শিখরে। পারস্পরিক মনোমালিন্য, প্রযোজকদের সঙ্গে বেড়ে চলা নিত্যকার বিবাদের অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসাবে ১৮৭৩ সালের ৮ মার্চ ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের অভিনয়ের শেষে ন্যাশনাল থিয়েটারের কলাকুশলীরা দর্শকদের কাছ থেকে বিদায় নেন। ন্যাশনাল থিয়েটারের অবসানের পর সকল কুশীলবেরা অন্যান্য থিয়েটার হাউসগুলিতে চলে আসেন।
ন্যাশনাল থিয়েটারের মালিক প্রতাপ জহুরির সঙ্গে কলাকুশলীদের বিবাদ চরমে পৌঁছলে নটী বিনোদিনী, গিরিশ ঘোষ সহ অন্যান্য কুশীলব ন্যাশনাল থিয়েটার ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং ‘ক্যালকাটা স্টার থিয়েটার’ বা ‘স্টার থিয়েটার’ নামে একটি নাটকের দল নির্মাণ করেন। এখন দরকার ছিল একটি থিয়েটার হাউসের। অর্থসংকট প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
সেকালে পেশাদারী থিয়েটারের অর্থ যোগাতেন ব্যবসায়ী বা উচ্চবিত্ত বাঙালিরা। গুরমুখ রায় ছিলেন কলকাতার এক ধনী ব্যবসায়ী। গুরমুখের থিয়েটারে পুঁজি লাগাবার বাসনা ও বিনোদিনী দাসীর প্রতি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে গিরিশ ঘোষ সহ অন্যান্য মহারথীরা তাঁকে একটি থিয়েটার হল নির্মাণের প্রস্তাব দেন। তরুণ গুরমুখও পাল্টা শর্ত দেন, থিয়েটার হাউসের বিনিময়ে বিনোদিনীকে তাঁর সঙ্গে সহবাস করতে হবে। প্রথমে নারাজ হলেও শেষে গুরু গিরিশের অনুরোধে তিনি গুরমুখের প্রস্তাবে সম্মত হন। এরপর ৬৮নং বিডন স্ট্রিটের খালি জমি ইজারা নিয়ে অমৃতলাল দাস, দাশুচরণ নিয়োগী, গিরিশ ঘোষের তত্ত্বাবধানে থিয়েটার হাউস নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
মঞ্চের নামকরণ হওয়ার কথা ছিল ‘বি থিয়েটার’, যদিও সেই বাসনা সফল হয়নি গুরমুখের। বারাঙ্গনার নামে নাট্যমন্দিরের নামকরণ হলে কলকাতার মানুষ তা বর্জন করতে পারেন, এই ভয়ে হলের নাম দেওয়া হয় ‘স্টার থিয়েটার’। তবে হলটির নাম যে স্টার থিয়েটার হতে পারে, একটু খতিয়ে দেখলেই তার প্রমাণ মেলে, নাট্যদলের নাম ‘ক্যালকাটা স্টার থিয়েটার’ রাখার মধ্য দিয়েই তার আভাস পাওয়া যায়। বিনোদিনীর নামে হাউসের নামকরণ হবে, তা আসলে বিনোদিনীকে লালায়িত করার জন্য গিরিশ ঘোষদের একটি টোপ ছিল মাত্র। নামকরণের পেছনে বাংলার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সংস্কৃতিতে নারীদের অবস্থানের দিকটিই প্রকাশ পায়।
গুরমুখ রায় মাত্র ৬ মাস হাউসটির মালিক ছিলেন। পরবর্তীতে শারীরিক অবনতির কারণে স্টার থিয়েটার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। মাত্র ১১ হাজার টাকার বিনিময়ে অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র, হরিপ্রসাদ ও দাশুচরণ নিয়োগীর কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন। গুরমুখ বিনোদিনীকে স্টারের অর্ধেক স্বত্ব দিতে চাইলেও গিরিশ ঘোষ তা নাকচ করে দেন। শোনা যায়, পারিবারিক কারণে বিনোদিনী স্টারের স্বত্ব নিতেও নারাজ ছিলেন, যদিও তাঁর সিদ্ধান্তের পেছনে তাঁকে প্রতারণার অনুশোচনা, দলের সদস্যদের সঙ্গে মনোমালিন্য প্রভৃতি বিষয়াদি যে কাজ করেছিল, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
১৮৮৩ সালে ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটকের অভিনয় দিয়ে স্টারের যাত্রারম্ভ হয়, তবে তার স্থায়িত্ব বেশিদিনের ছিল না। স্টারের নামকরণ ও পরবর্তীতে তার স্বত্ব নিয়ে বিনোদিনীর সঙ্গে দলের ক্ষমতাশালীদের অন্তর্কলহ, সহকর্মীদের দুর্ব্যবহার ও গিরিশ ঘোষের সঙ্গে মনোমালিন্য ক্রমেই বাড়তে থাকে, যার ফলশ্রুতি হিসাবে ‘কমলেকামিনী’, ‘অভিমন্যুবধ’ ও ১৮৮৪ সালে ‘চৈতন্যলীলা’ মঞ্চস্থ হওয়ার পর পরই বিনোদিনী স্টার থিয়েটার ত্যাগ করেন এবং তাঁর থিয়েটার জীবনে ইতি দেন। স্টার মুখ থুবড়ে পড়ে।
এরইমধ্যে ধনকুবের মতিলাল শীলের নাতি গোপাললাল শীল কৌশলে ৩০ হাজার টাকায় স্টারের জমি কিনে নিয়ে সেখানে ‘এমারেল্ড থিয়েটার’ চালু করেন। ‘ক্যালকাটা স্টার থিয়েটার’-এর শিল্পীরা ‘স্টার’ নামেই উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে নতুন থিয়েটার হাউস নির্মাণ করেন। এভাবেই মাত্র ৫ বছরের মধ্যে উজ্জ্বল স্টারের অবসান ঘটে।
গুরমুখের স্টার থিয়েটার নিলামে বসলে বিত্তশালী মতিলাল শীলের নাতি গোপাললাল শীল থিয়েটার করার শখে বাড়িটি কিনে নেন এবং বাড়ির নাম বদলে ‘এমারেল্ড থিয়েটার’ করেন। গোপাললাল শীল বাড়িটির সংস্কার বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। কেদার চৌধুরী ছিলেন একাধারে হাউসের ম্যানেজার, নাট্যকার, পরিচালক। এছাড়াও অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফী, ধর্মদাস সুর, মতিলাল সুর প্রমুখ অভিনেতা হিসেবে কাজ করতেন।
পূর্বে প্রদীপের আলোয় কিংবা মশাল জ্বালিয়ে অভিনয় হত। দর্শক আসন আলোকিত হত ছোট ছোট মোমবাতির আলোয়। এরফলে অঘটন ঘটত অনিবার্যভাবে। নাটক চলাকালীন নাট্যমঞ্চ সহ বহু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের গায়ে আগুন লাগবার ঘটনা শোনা যায়। গোপাললাল শীল তার এমারেল্ড থিয়েটার হাউসে বাংলায় প্রথম বিজলিবাতির ব্যবহার করলেন। ডায়নামো দিয়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়, যা মঞ্চের আলোকসম্পাতে বিবর্তন আনে। তৎকালীন পেশাদারী রঙ্গালয় হলেও, সুন্দর রঙ্গালয়, নাটকে বিজলি আলোর ব্যবহারে এমারেল্ড এক উল্লেখযোগ্য বঙ্গীয় রঙ্গালয়ে পরিণত হয়েছিল।
বাংলা নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে প্রথমবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’-এর মঞ্চায়ন হয় এই এমারেল্ড থিয়েটার হাউসে। উক্ত উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘রাজা বসন্ত রায়’ অভিনীত হয় ১৮৮৭ সালের ২৬ অক্টোবর। এইসময় গোপাললাল শীল গিরিশ ঘোষকে তাঁর থিয়েটারে আনার জন্য নানা প্রচেষ্টা করতে থাকেন। অবশেষে ২০ হাজার টাকার নগদ বোনাস ও মাসিক ৩৫০ টাকার বিনিময়ে ৫ বছরের জন্য তিনি এমারেল্ড থিয়েটারে কাজ করার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হন। তবে তার থেকে ১৬০০০ টাকা তিনি স্টার থিয়েটারকে দিয়ে দেন। গিরিশ ঘোষ ম্যানেজার থাকাকালীন হাউসে ‘সীতার বনবাস’, ‘সীতাহরণ’, ‘মায়াতরু’-র মত মঞ্চসফল নাটকগুলি অভিনীত হয়। এইসময়েই গিরিশ ঘোষ এবং এমারেল্ড থিয়েটার উভয়েই খ্যাতির শিখরে। এমারেল্ড থিয়েটারেই গিরিশ ঘোষের নাট্যকার ও পরিচালকসত্ত্বার বিকাশ ঘটে এবং পরবর্তীতে বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে স্থায়ী আসন করে নেন তিনি।
১৮৮৯-এর ৩ ফেব্রুয়ারি গোপাললাল শীল এমারেল্ডের লিজ মতিলাল সুর প্রমুখের হাতে দিয়ে দিলে গিরিশ ঘোষের সঙ্গে গোপাললালের চুক্তি ভেঙে যায়, তিনি পুনরায় স্টার থিয়েটারে ফিরে আসেন। কিন্তু নতুন অদক্ষ মালিকগোষ্ঠীর পক্ষে এমারেল্ড চালানো কঠিন হয়ে উঠলে গোপাললাল পুনরায় দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এভাবেই বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এমারেল্ড তার অবস্থানরক্ষার উদ্যোগী হলেও শেষরক্ষা হয়নি। অবশেষে ‘কপালকুণ্ডলা’ এবং ১৮৯৭-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না’ মঞ্চায়নের পর এমারেল্ডে থিয়েটারচর্চার সমাপ্তি ঘটে।
ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর কেটে গেছিল প্রায় ২৫টা বছর। বাংলার রঙ্গালয়গুলির জীর্ণপ্রায় দশা। মিনার্ভা থিয়েটার হাউস নিলামে ওঠার মুখে। স্টার থিয়েটারের হালও প্রায় একই। উনিশ শতকের শেষের ২৫ বছর বাংলার দর্শকের সম্মুখে অভিনীত হয়ে চলেছে একের পর এক ঐতিহাসিক, পৌরাণিক নাটক। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানুষের চাহিদার থেকে শত ক্রোশ দূরে গিয়ে প্রাচীন অভিনয় পদ্ধতি এবং অনুন্নত আনুষঙ্গিকের প্রয়োগের মাধ্যমে থিয়েটার হাউসগুলি চলছিল। পুরনো অভিনেতাদের পাশাপাশি একই অভিনয় দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত।
ঠিক সেই সময় ১৮৯৭ সালের ১৬ এপ্রিল গুড ফ্রাইডের দিন অমরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রতিষ্ঠিত ‘ক্লাসিক থিয়েটার’-এর উদ্বোধন হল। ৬৮নং বিডন স্ট্রিটের গোপাললাল শীলের এমারেল্ড থিয়েটার হাউসটির লিজ নিয়ে ১২০০ টাকা অগ্রিম এবং মাসিক ২৫০ টাকার চুক্তিতে সেখানে ‘ক্লাসিক থিয়েটার’-এর পত্তন হয়। একদিকে তারাসুন্দরী, সতীশ চট্টোপাধ্যায়ের মত অভিজ্ঞ নাট্যকর্মী, অপরদিকে প্রমথনাথ দাস, কুসুমকুমারী, নয়নতারাদের মত তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রীকে সঙ্গে করে অমরেন্দ্রনাথ নির্মাণ করলেন ‘ক্লাসিক থিয়েট্রিকাল কম্পানী’।
উদ্বোধনের রাতে মহাসমারোহে ‘নলদময়ন্তী’ নাটক অভিনীত হল। ‘নল’-এর চরিত্রে স্বয়ং অমরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ‘দময়ন্তী’ চরিত্রে তারাসুন্দরীর অভিনয় কেড়েছিল অসংখ্য দর্শকহৃদয়। এভাবেই ক্লাসিকের পথচলা শুরু। অল্পদিনের অন্তরে মঞ্চস্থ হল ‘বাল্লিকবাজার’ প্রহসন। ওই একই বছরে অভিনীত হল ক্লাসিকের অন্যতম সেরা প্রযোজনা ‘আলিবাবা’। প্রায় ২২০০ টাকার টিকিট বিক্রি হত প্রতিরাতে, সর্বমোট লক্ষাধিক টাকা লাভ হয় সেই আমলে এই থিয়েটার হাউসে, যা বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে আজও বিরলতম ঘটনা বলে মানা হয়।
অমরেন্দ্রনাথের আধুনিক চিন্তাভাবনা, উন্নত কলাকৌশল তাঁর নাটককে দর্শক মনোগ্রাহী করে তুলেছিল। মঞ্চভাবনা, আলো, দৃশ্যপট, অভিনয়রীতি, নাটকের বিষয়বস্তু সমস্ত দিকেই তাঁর অবাধ বিচরণের নজির মেলে। জীর্ণ এমারেল্ডকে নতুন রূপ দেন অমরেন্দ্রনাথ দত্ত। প্রেক্ষাগৃহের অন্দরসজ্জার পরিবর্তন ঘটিয়ে দর্শকের কাছে তা আকর্ষণীয় করে তোলেন। দর্শকাসনের সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটানো হয়। মঞ্চব্যবস্থাকে তিনি ঢলে সাজান। দৃশ্যপট ও সাজসজ্জায় তিনি নতুনত্বের রং আনেন। পুরনো ধ্যানধারণাকে বিসর্জন দিয়ে কার্টেন, উইংস— প্রসেনিয়ামের ব্যবহার শুরু করলেন। দর্শকের চমৎকারিত্ব সৃষ্টিতে এই নতুন ব্যবস্থার জুড়ি ছিল না। বাংলা থিয়েটারে তাঁরই হাত ধরে প্রথম কার্টেনের ব্যবহার শুরু হয়।
ইতিপূর্বে এমারেল্ডে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ অভিনীত হয়েছিল। অমরেন্দ্রনাথ ভিন্নভাবে এর নাট্যরূপ দিয়ে ‘ভ্রমর’ নামকরণ করেন। পূর্বে মঞ্চসজ্জা ছিল অতি সাধারণ। কাপড়ের গায়ে বিভিন্ন চিত্র একে তা ঝুলিয়ে দেওয়া হত। সেখানে গাছপালা, বড় বড় খিলান, গম্বুজ, দেওয়াল ঘড়ি অঙ্কিত হত। এই অঙ্কিত চিত্রপটের দ্বারাই মঞ্চ হয়ে উঠত বৈঠকখানা, বাগান, আবার কখনও বা বিচারসভা। অঙ্কিত চিত্রপটের রীতির বদল ঘটিয়ে ‘ভ্রমর’ নাটকে তিনি প্রথম চূড়ান্ত রিয়ালিস্টিক সেটের ব্যবহার করলেন। নাটকটিতে আসল খাট, আলমারি, সোফা সেটের ব্যবহার দেখা গিয়েছিল। এমনকি, পুকুর, উদ্যানবাটী, বাঁধানো ঘাট প্রভৃতির দৃশ্যসজ্জাও ছিল অত্যন্ত বাস্তবসম্মত।
দর্শককে তাক লাগিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গিমিকের ব্যবহার শুরু করেন অমরেন্দ্রনাথ। গিমিক হিসাবে জীবন্ত পশুপাখি, এমনকি ফোয়ারার ব্যবহারও দেখা গিয়েছিল তাঁর নাটকে! এছাড়াও নানান স্টান্টের ব্যবহার শুরু হয় থিয়েটারে। অনেকক্ষেত্রে নাটক ব্যতিরেকে স্টান্ট হলেও দর্শক তাতেই আনন্দিত হতেন। নাটকের একটি দৃশ্যে দেখানো হত, রোহিনীকে জল থেকে উদ্ধার করে গোবিন্দলাল পুকুর থেকে উঠে আসে। এই দৃশ্যটিতে উভয়েই সম্পূর্ণ ভিজে থাকতেন। আর একটি দৃশ্যে গোবিন্দলালের চরিত্রাভিনেতা অমরেন্দ্রনাথ দত্ত ঘোড়ায় চেপে মঞ্চে প্রবেশ করতেন। হাউসের দর্শকরা উচ্ছ্বসিত হতেন। তিনি থিয়েটারে বিদ্যুৎ আলোর ব্যবহারের সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৯৯-তে কলকাতায় বিদ্যুৎ চলে আসার পর, তিনি মঞ্চে আলো ব্যবহার শুরু করে দিয়েছিলেন।
নাটকের বিজ্ঞাপন ও প্রচারের ক্ষেত্রে দর্শকদের আকৃষ্ট করতে অমরেন্দ্রনাথ নতুন নতুন পন্থা আমদানি করেন। নাট্যানুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন আকর্ষণীয় করে তুলতে তিনি হাতপাখা, এমনকি মুদিখানার ঠোঙাতেও বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে দেওয়া শুরু করেন। দর্শক বাড়ানোর ক্ষেত্রে অভিনব পন্থার ব্যবহার দেখা যায় তাঁর আমলেই। নাটক শুরুর আগে প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশকালে দর্শকদের হাতে পাখা ও ছবি উপহার হিসাবে দেওয়া শুরু করেন। এরফলে তাঁর নাটকে লোক উপচে পড়তে থাকে। নাটকের বিষয়বস্তু, নাটকের অভিনয়, গিমিকের ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে নাটকের প্রচার ও বিজ্ঞাপনের অঙ্গটির দিকে তিনি নজর দিয়েছিলেন, যা তাঁর নাটককে অনন্য উচ্চতা দান করে।
১৭৮০-তে হিকি সাহেবের ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশের মাধ্যমে সংবাদপত্রের ধারণা পায় বাঙালি। তারপর আরও বেশ কিছু সংবাদ সাময়িকীর জন্ম হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতা থেকে প্রকাশিত সব পত্রপত্রিকাই ছিল ইংরেজি ভাষায় এবং সাহেবদের দ্বারা সম্পাদিত ও পরিচালিত। রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় বাংলায় সংবাদপত্র ও সাময়িকীর আত্মপ্রকাশ, যা বাঙালি মননে ঢেউ তোলে। বিভিন্ন বাংলা সংবাদপত্র নাটকের বিজ্ঞাপন এবং রিভিউ প্রকাশিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন কাগজে সেইসময়কার উঠতি কবি, সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশিত হত। সেসবের মধ্যে নাটক একঘরে হয়ে থাকবে, তা কি মানা যায়! সেইকারণে বাঙালি নাট্যকর্মীরা একটি থিয়েটারের পত্রিকা প্রকাশের তাগিদ অনুভব করেন। অমৃতলাল দত্তের ভূমিকা এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। তিনিই সর্বপ্রথম নাট্যপ্রেমীদের উদ্দেশে ‘সৌরভ’, ‘রঙ্গালয়’ ও ‘নাট্যমন্দির’ নামে ৩টি নাট্যপত্রিকা প্রকাশ করেন। এগুলিই ছিল বাংলা থিয়েটার বিষয়ক প্রথম প্রকাশিত নাট্যপত্রিকা।
গিরিশ ঘোষ, অমরেন্দ্রনাথের পর বাংলা থিয়েটারে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল প্রায় ২০ বছরের ব্যবধানে। আবির্ভাব ঘটল বাংলার রঙ্গমঞ্চের সম্রাট আলমগীরের, নাম শিশিরকুমার ভাদুড়ী! ১৯২৫-এ যোগেশ চৌধুরীর ‘সীতা’ নাটক নিয়ে তিনি গড়ে তুললেন ‘নাট্যমন্দির’। তাঁর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা থিয়েটারের অভিনয়রীতি, মঞ্চায়নে নতুনত্বের ছোঁয়া আনে। তিনিই ছিলেন বাংলা থিয়েটারের প্রকৃতার্থে পরিচালক।
নাটকের নাচ-গানের অংশ কমিয়ে ক্রমেই অভিনয়ের অংশ বাড়ানো হয়। মূল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের গলায় গান না বসিয়ে আলাদা করে সখীর দল গঠন করেন। তিনিই প্রথম ন্যাচারালিস্টিক অ্যাকটিংয়ের প্রবর্তন করেন। ক্রমে নাট্য প্রযোজনাগুলির মধ্যেও বাস্তব অনুকরণের দিকে ঝুঁকছিলেন। বিশিষ্ট নাট্যশিল্পী শম্ভু মিত্র অভিনয়ের এই ধারা ও বিষয়বস্তুর বিবর্তন প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘নকল ছাদ লাগানো বাক্স সেট চালু হল, দৃশ্যপরিবর্তনের সুবিধার জন্য ঘূর্ণক্ষম রঙ্গমঞ্চ এল, নাটকের বিষয়বস্তু নির্বাচনেও সামাজিক প্রসঙ্গের চেয়ে পারিবারিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হল। তার মানে এই নয় সামাজিক বিষয় নিয়ে একেবারেই নাটক লেখা হয়নি।’
মঞ্চবিন্যাসে ও দৃশ্য পরিকল্পনায় শিশিরকুমারের সূক্ষ্মতার ছাপ মেলে, অভিনবত্বের ছোঁয়া পাওয়া যায়। ১৯২৮-এর ‘দিগ্বিজয়ী’ নাটকে অনন্য মঞ্চভাবনা লক্ষ করা যায়। শম্ভু মিত্র তাঁর ‘সন্মার্গ সপর্যা’ গ্রন্থে শিশিরকুমারের মঞ্চভাবনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘শ্রী শ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া’র একটি দৃশ্য সাজানো হত মঞ্চের তিন-চতুর্থাংশে, আর বাঁ দিকে খানিকটা ফাঁকা অংশ পড়ে থাকত। সেখান দিয়ে ভেসে আসছে উন্মাদিনীপ্রায় সচীর কণ্ঠস্বর। তিনি পুত্রবধূ বিষ্ণুপ্রিয়ার হাত ধরে নগরের পথে পথে আর্তকণ্ঠে ‘নিমাই নিমাই’ বলে হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ঐ অসাধারণ অন্ধকার ফাঁকাটা না থাকলে মঞ্চের দৃশ্যে আমি হয়তো এতোটা বিচলিত হতাম না।’’