হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজাপার্বণ দুভাবে পালিত হয়। তিথি-অনুসারে, যেমন দুর্গা, লক্ষ্মী, কালী, শিব, সরস্বতী পুজো। আবার বাংলা মাসের সংক্রান্তিতেও অনুষ্ঠিত হয় কোনও কোনও পুজো। শারদ কোজাগরী পূর্ণিমা তিথি ছাড়াও যেমন আষাঢ় মাসের সংক্রান্তিতেও লক্ষ্মীপুজোর বিধান আছে। শ্রাবণ, ভাদ্র, কার্তিক, পৌষ ও চৈত্র-সংক্রান্তিতে যথাক্রমে মনসা, বিশ্বকর্মা, কার্তিকেয়, মকর এবং চড়কপুজো হয়।
ভাদ্রসংক্রান্তি, অর্থাৎ ভাদ্র মাসের শেষ দিন। এই দিনটি বিশ্বকর্মার আরাধনা-দিবস। এই দেবতা হচ্ছেন স্থাপত্যের দেবতা। কথিত আছে, দ্বারকানগরী, শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শনচক্র, দেবতাদের বাহন ইত্যাদির নির্মাতা তিনি।
পূজাপার্বণের মতো ব্রতপালনের মধ্যে দিয়েও হিন্দুরা তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। ব্রতকথার রয়েছে বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ঐতিহ্য।
আবহমান কাল থেকে ব্রতকথার চল। মেয়েরাই বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন ব্রতকথা বলে লৌকিক দেবদেবী ও প্রকৃতির আরাধনা করে। মাঘ মাসে মাঘমণ্ডলের ব্রত, কার্তিকে তারার ব্রত। এরকম কুলুইচণ্ডী, থুরপল, শ্রীপঞ্চমী, যমবুড়ি, সুবচনীর ব্রত ইত্যাদি বহু ব্রতকথার প্রচলন রয়েছে আজ-ও, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে। ‘পথের পাঁচালী’-তে অপুর দিদি দুর্গাকেও ব্রতপালনরত দেখেছি আমরা।
বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে। বাহারি সব নাম-ও আছে সেসব ঘুড়ির,– চাপটাস, তেরঙা, কালকেউটে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি বিশ্বকর্মার চার হাতের একটিতেও একটি ঘুড়ি দেবার চল হয়েছে ইদানীং।
কেবল কলকারখানাতেই নয়, গৃহস্থ বাড়িতেও বিশ্বকর্মা পুজো হয়। ঘরদোর পরিষ্কার করা, গোবর দিয়ে মোছা (এখন দালানকোঠা বলে তা আর হয় না), দরজায় মঙ্গলচিহ্ন হিসেবে বসুধারা দেওয়া ও মঙ্গলঘট স্থাপনের পর স্নানান্তে বাড়ির বয়স্কা সধবা মহিলারা এই ব্রতকথা মুখেমুখে বলেন। প্রতিবেশী এয়োস্ত্রীরা এসে জড়ো হন শুনতে। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে প্রতিবছর ভাদ্র সংক্রান্তিতে আমার মায়ের মুখে এই ব্রতকথা শুনে শুনে মনে গেঁথে আছে। সেই ব্রতকথাটি পরিবেশন করি আজকের পাঠকের কাছে।
বিশ্বকর্মার ব্রতকথা বা চিল-চিলৈনীর কাহিনি
ধনপতি সওদাগর বিপুল বাণিজ্যদ্রব্য নিয়ে দেশে ফিরছেন। বিদেশে নিয়ে গিয়ে জিনিস বিক্রি করে লাভ হয়েছে প্রচুর। আর সেই লাভ থেকে যেসব জিনিস কিনেছেন, তা স্বদেশে বিক্রি করলে লাভ হবে আরও। ছেলে লক্ষপতির বিয়েটা বেশ জাঁকজমক করেই দেওয়া যাবে। মনেমনে এসব ভাবার সময় তাঁর দৃষ্টি গেল নদীপারে দূরের এক তালগাছের দিকে। এগিয়ে এসে দেখেন, এক পরমাসুন্দরী কেশবতী কন্যা। তালগাছের ওপরে বসা, আর তার চুল নেমে এসেছে মাটি পর্যন্ত। সওদাগর তাকেই নিজ পুত্রবধূ করবেন ঠিক করলেন।
পরিচয় জানতে চাইলেন সওদাগর। মেয়েটি তাতে কেঁদে সারা! বাপ ছিল তার গরীব। বছর বছর তার মেয়ে হত। এবার মেয়ে হলে নদীর জলে ভাসিয়ে দেবেন, এই ছিল বাপের পণ। তা এবার-ও মেয়েই হল। আর অমনি তাকে ভাসিয়ে দেওয়া হল কলার ভেলায়। নদীর পারে এক তালগাছ। তার ওপর চিল-চিলৈনীর বাস। মেয়েটিকে দেখে তাদের দয়া হল। নদী থেকে এনে নিজেদের কাছে এনে তাকে মানুষ করলেন। শেখালেন চৌষট্টি কলা।
ধনপতি বললেন, ‘এইবার থেকে আর তোমার কষ্ট হবে না মা’। বাড়ি এনে নিজপুত্র লক্ষপতির সঙ্গে মহা ধুমধামে বিয়ে দিলেন তার। রোশনচৌকি, সাতদিন আমোদ-আহ্লাদ, হৈচৈ কত! মেয়েটি সুখের মুখ দেখল।
বাড়ির অন্য বউরা একে দেখে তো ঈর্ষাকাতর! এ-মেয়েকে যে সবাই মাথায় করে রাখে, এমন কী গুণ আছে তার? না জানে রান্নাবান্না, না জানে সহবত, তবে? তার ওপর বাপের বাড়ি তালগাছে, বাপ রে! শুনলেই গা ঘিনঘিন! তাকে তাই শাস্তি দেবার জন্য ধনপতির অন্য পুত্রবধূরা সবাই তাদের আত্মীয়-কুটুমদের খাওয়ার নিমন্ত্রণ দিল। লক্ষপতির বউকে দিল রাঁধতে। কেমন জব্দ!
এদিকে নিজের ঘরের জানালায় সুতো বেঁধে রেখেছিল ধনপতির বউ। সুতোর অপর প্রান্ত বাঁধা সেই তালগাছে। সেখানেই তো থাকে চিল-চিলৈনী, তাকে যারা পালন করেছে। সুতোয় টান পড়তেই তারা বুঝল, তাদের মেয়ের কিছু একটা হয়েছে। অমনি চিলৈনী তার ঘরে এসে হাজির। সমস্যা শুনে বলল, ‘মেয়ে, রাঁধতে জানিস নে তো কী হয়েছে? তুই এক একটা রান্নার জিনিস উনুনে চড়াবি, আর বিশ্বকর্মাকে স্মরণ করবি। দেখবি, স-অ-ব রান্না উৎরে যাবে।’
সত্যি সত্যি হল-ও তাই। অতিথিরা তো খেয়ে ধন্য ধন্য! অন্যদিকে বউয়েরা আরও ক্ষুব্ধ।
একদিন তারা দেখে, রাতে ঘুম থেকে উঠে লক্ষপতির বউ সুতোয় টান মারছে, আর অমনি চিলৈনী এসে হাজির। তাদের মধ্যে সারারাত ক-ত সুখ-দুঃখের কথা! বউয়েরা এই দেখে গজর গজর করতে করতে ভাবল, ‘এই তবে কাণ্ড! দেখাচ্ছি মজা!’
পরদিন রাতে তারাই সুতো ধরে টানল। আর তৎক্ষণাৎ, আজ আবার চিল-সহ চিলৈনী এসে হাজির। অমনি বউয়েরা মিলে তাদের ধরে কেটে ফেললে। লক্ষপতির বউকে তার মাংস রেঁধে খেতে দিলে। আর ওদের হাড়গোড় রাখলে বাড়ির পেছনের উঠোনে গর্ত করে। লক্ষপতির বউ তো খেতে বসে মাংসের মধ্য থেকে তার বাপ-মা চিল-চিলৈনীর গন্ধ পায়! কান্নায় তার গলা বুজে আসে। কিচ্ছুটি না খেয়ে হাত ধুয়ে এসে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাকে তখন তারা স্বপ্ন দেখায়, ‘শোন! তোর বাড়ির বউয়েরা আমাদের মেরে ফেলেছে। তুই এখন থেকে স্নান করে শুদ্ধ কাপড় পরে বিশ্বকর্মার ঘট বাড়িয়ে (নতুন ঘট স্থাপন করে) একমনে বিশ্বকর্মাকে ডাকবি। তারপর ঘটের জল আমাদের হাড়গোড়ে ছিটিয়ে দিবি।’ ঘুম থেকে উঠে বউ তা করতেই চিল-চিলৈনীর নবজন্ম! উড়ে যাওয়ার আগে তারা মেয়েকে বলে গেল, ‘এখন আর আমাদের সুতো ধরে টানবার দরকার নেই। তোর যা মনোবাসনা, বিশ্বকর্মাকে জানালেই হবে।
সেই থেকে বিশ্বকর্মার প্রতিষ্ঠা। মজা লাগে ভাবতে, চিল= Kite. আবার Kite মনে ঘুড়ি। বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি ওড়ানোর সঙ্গে মিলটা বড় অদ্ভুত!