স্মৃতিতে সুজাতা
সুজাতা তোমার পায়ে
আগুনের গোলা ধরে উত্তাপে পুড়েছে আমার হাত
তুষারে গিয়েছি জুড়োতে সে জ্বালা, সেই হাত জমে শীতে
বাগান করার স্বপ্নে কেটেছে কত বিনিদ্র রাত
সুজাতা আমার ঘর আজ ভরা কাঁটালতা উদ্ভিদে
বলোনি মাটিতে কী রত্ন ছিল, বহুদিন ধরে খুঁড়ছি
পাতালে নামার গর্ত গভীর, হঠাৎ বেরোয় সিন্দুক
ভিতরে রয়েছে ছলনায় ক্রূর সাপিনীর প্রতিমূর্তি
ভালবাসা যদি বলো একে তুমি বিশ্বের সেরা মিথ্যুক
আমার চোখের মণি নয় প্রেম প্রতীকের নীল পদ্ম
অনেক সয়েছে ঘৃণা বিদ্যুৎ, আজ দিতে পারি উপড়ে
কলঙ্কী শিরা উপশিরাগুলো অভিমান মদে মত্ত
অনেক হয়েছে, আমি মরে গেলে জমা করে দিয়ো লুভরে
তুবড়ির খোলে আগুনের কত স্ফুলিঙ্গ কণা বিন্দু
নিভৃতে ছিল, কত মিলিয়ন মেগাওয়াটের শক্তি
দেহের প্রতিটি রক্তকণায় তোমার জন্য, কিন্তু
তুমি তা নিলে না, পরমাণু ফেটে শরীরে রক্তারক্তি
শতচ্ছিন্ন শরীর নিয়েও বেঁচে আজও কেন আছি
অগ্নিকুণ্ড সমুখে আমার, তাতে শুধু ঘৃতাহুতি
দিলেই শান্তি জ্বালা বেদনার, কেউ নেই কাছাকাছি
দূর থেকে শুধু অপমান ধুলো ছুড়ে দিয়ো এক মুঠি
গোধূলির এই অবেলায় আমি জীবনকে বহুবার
বলেছি তাসের ঘর ভেঙে গেছে, তোমার এ হরতন
রাজা বিকোবে না এই দুর্দিনে, সুজাতা তবু তোমার
পায়ে নতজানু হয়ে বসে আছে অবাধ্য এ জীবন।
ব্যারিকেড থেকে সুজাতাকে
না না যাচ্ছি না বলে ধূপজ্বালা ঘরে
বেশ তো ছিলাম, পরে
কী হল সে এক অদ্ভুত ইতিহাস
রাস্তায় কত বুলেট বারুদ, পড়ে গেল কত লাশ
আমার ভায়েরা নিহত সুজাতা, বোনগুলো ধর্ষিতা
তোমার টিভিতে পড়েনি প্রতিচ্ছবি
ভিডিও ক্যামেরা কোথায় যখন গাঁথে ওরা বঁড়শিটা
আমাদের বুকে, সিডিতে বাজেনি যুদ্ধের ভৈরবী
সুজাতা তোমার কোনো প্রশ্নের আজ কোনো উত্তর
দিতে পারব না, তরুণের জ্বলে চিতা
এখনও আমার দেওয়া হয়নি তো আবদুলকেও গোর
টমাস কফিনে, এসির আরামে তুমি জমে থাকো সীতা
ক্র্যাকারের বুম, মেশিনগানের একটানা কটকট
ধূপ নিভে গেছে ঝড়ে
সুজাতা আমার বড় দুর্দিন, নিদারুণ সংকট
বন্দুক থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, বারুদ গন্ধ ঘরে
না না আজ কোনো অহিংসা নয়, গান্ধী বুদ্ধ যিশু
মাথায় থাকুন, বন্ধুরা পাতে বুলেটের মুখে বুক
অকালবোধনে চোখে যেন থাকে বহ্নির বন্দুক
টিভিতে দেখোনি ফুটপাথে শুয়ে নিষ্পাপ মৃত শিশু!
রাস্তার মোডে ব্যারিকেড, তার ওদিকে ধনের রাশি
পাউন্ড ডলার ইউরো টাকার স্তূপ
এদিকে আমরা অনেক বন্ধু দাঁড়িয়েছি পাশাপাশি
হাতের আড়ালে জ্বালাই নিভানো ধূপ
দু-পা ভেঙে গেছে, চলতে পারে না, বাঁহাতেও ফ্র্যাকচার
যোদ্ধার ডান হাতে রাইফেল ধরা কোনোমতে, তবু
সুজাতা তুমি তো প্রতিবাদে নও কেন যেন সোচ্চার
তুমি ক্রীতদাসী, স্টিরিও ভিডিও ফ্রিজই তোমার প্রভু
বেয়নেটগুলো ঝলসে উঠছে ভাড়া করা কালো হাতে
ব্যারিকেডে আরো লোক চাই, আরো অন্ন বস্ত্র জল
ঝলমলে সোনা অনেক পরেছ, অনেক উঠেছ জাতে
প্রতীকচিহ্ন আজ হোক শুধু ঝকঝকে পিস্তল
আকাশ ভরেছে ভস্মে ধোঁয়ায়, দেবতারা অভিমানে
কেঁদে অস্থির, ধরা পড়ে গেছে ভণ্ডামি জোচ্চুরি
পুরোহিত আর মৌলবিদের, তুমি আসবে না মানে!
এসো না সুজাতা গুলি না হলেও একরাশ ঘৃণা ছুড়ি
ব্যারিকেডে বসে প্রেমের কবিতা কী করে যে লিখি বলো
জ্যোৎস্নারা সব নিভে গেছে আজ, নিষ্প্রাণ বনবীথি
বুলেট শব্দে বারুদ ছন্দে কবিতার মতো জ্বলো
সিঁদুরে অনেক রাঙিয়েছ, আজ রক্তে রাঙাও সিঁথি।
*
ঘরের দ্বীপে
তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে
জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে
চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে
যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ
রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে
শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ
তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা
অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা
যুবতী তার খোঁপায় আর রাখে না ফুলমালা
ওষ্ঠাধরে নখরে তার রক্তলিপি লেখা
পক্ষীরাজ ওড়ে না আর, কাটা গিয়েছে ডানা
ময়ূর একা বাজায় সুর আর্তনাদে কেকা
নারীকে মনে আলিঙ্গনে হয় না কাছে টানা
ঘরের দ্বীপে মলিন ক্ষীণ আশার দীপ জ্বালা।
অনেক দিন পর সুজিত বসু্র দুটি কবিতা ভালভাষায় পেলাম। দীর্ঘ কবিতা “স্মৃতিতে সুজাতা” যেন দীর্ঘ পরিক্রমণ। এই ভাঙাচোরা সময়ে ‘সিঁদুরে অনেক রাঙিয়েছ, আজ রক্তে রাঙাও সিঁথি’ এমন পংক্তি অন্য মাত্রা এনে দেয়। “ঘরের দ্বীপে” চতুর্দশপদী। অসাধারণ এক ছন্দের চলন পাঠককে কেমন দ্রুত পদচারণায় এগিয়ে নিয়ে যায় কোন এক নিঃসঙ্গতায়।