Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

আমার আর কখনওই ৫৯ নম্বর পাম এভিনিউতে যাওয়া হবে না। কখনও যাইওনি, যদিও আহ্বান ছিল। সে কথায় পরে আসছি। আগে বলে নিই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দেখার প্রথম স্মৃতি। সাল ১৯৭৭। বামফ্রন্ট সরকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিধানসভায় বসতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পালাবদলের মাহেন্দ্রক্ষণ। ইন্দিরা গান্ধীর সেই কুখ্যাত জরুরি অবস্থার অবসান-অন্তে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস তথা তিনি নিজে ধরাশায়ী। কেন্দ্রে ক্ষমতায় এই প্রথম অকংগ্রেসি রাজনৈতিক দল, জনতা! যে-ক’টি রাজ্যের বিধানসভায় কংগ্রেসের প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়নি, কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন নীতি অনুযায়ী সেসব রাজ্যের বিধানসভা ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের বিধান দেওয়া হল। দিয়েছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বি ডি জাত্তি (জাটি)। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৪-ই জুন। প্রায় দুকোটি ষাট লাখ ভোটদাতা। ভোট দেন ৫৬.১৫% মানুষ।

১৯৬৪-তে আদর্শগত কারণে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত। ১৯৭৭-এ সিপিআইএম নির্বাচনে লড়ে সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লক, মার্ক্সবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল, ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলা কংগ্রেস,— এদের নিয়ে। নিরোধিতায় ছিল জনতা, কংগ্রেস, সিপিআই-সহ অনেকে, মায় মুসলিম লিগ, গোর্খালিগ। বিস্ময়কর ফলাফল! তিনশোটি আসনের মধ্যে বামফ্রন্ট পেয়েছিল দুশো নব্বইটি আসন, যা এমনকি তারাও কল্পনা করতে পারেনি। উল্লেখ্য, সেবার ত্রিপুরার নির্বাচনে নৃপেন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে যে নির্বাচন হয়, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির সাফল্য আরও বেশি,— ষাটটি আসনের মধ্যে ছাপ্পান্নোটি আসন তাদের দখলে যায়।

কলকাতা-সহ সারা পশ্চিমবঙ্গ সেদিন উত্তাল, বামফ্রন্টের এই বিপুল সাফল্যে। এর আগে দীর্ঘ দশ-বারো বছর ধরে এখানকার রাজনীতিতে যে টানাপোড়েন চলছিল, তা থেকে মুক্ত হল রাজ্যটি, এল স্বস্তির অনুকূল বাতাস। এ-রাজ্যের মানুষ বরাবর ব্যাপক অংশে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন। উদ্বাস্তু আন্দোলন, ১৯৫৪-এর শিক্ষক আন্দোলন, ১৯৬৫-র খাদ্য আন্দোলন, যাতে শহিদ হয়েছিলেন বসিরহাটের নূরুল ইসলাম, বা ওই সময়ের-ই ছাত্র বিক্ষোভ, যাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে গড়িয়া দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কলেজের ছাত্র মারা যান— ভূদেব সেন। কলেজ-চত্বরে তাঁর মূর্তিও রয়েছে, যেমন আছে নূরুলের মূর্তি, বসিরহাটের সরণিতে। বাসভাড়াবৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজপথগুলি মিছিলে মিছিলে মুখর ছিল সর্বদা। নয়া-উপনিবেশিকবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার নেতা ও সাধারণ মানুষ। কেরালায় কমিউনিস্ট সরকারকে ভেঙে দিলেন নেহরু, প্রতিবাদে গর্জে উঠল রাজনৈতিক নেতৃ থেকে ছাত্রসমাজ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর্বে তো স্লোগান-ই তৈরি হয়, ‘তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম’! আমাদের হাতে হাতে তখন ফিরত ভ্যান ট্রয়, চে গুয়েভারার ডায়েরি, মাও সে তুঙ-এর রেড বুক। এজন্য রাজনীতি করার দরকার হত না, কেবল সমসময়, যুগকে জানার এষণায়। আন্তর্জাতিক যেকোনও প্রশ্নে বামপন্থীরা পথে নেমেছেন। জনগণকে শিখিয়েছেন প্রতিবাদী হতে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়েও এক-ই সহমর্মিতা দেখা গেছে। এরপর ইন্দিরা গান্ধীর কালান্তক জরুরি অবস্থা ঘোষণাতেও বামপন্থীরা সোচ্চার। সেই বামপন্থা আজ বিজয়ীর আসনে, তা জনতার জোয়ার বাঁধ ভাঙবে না, উত্তাল হবে না খুশির আবেগ?

সেই আবেগ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল বিজয়গড় মাঠে। বহরে নিতান্ত ছোট নয় সে মাঠ, দু-দুটি ফুটবল গ্রাউন্ড আছে সেখানে। মাঠের উত্তরদিকে বিশাল বিল্ডিং, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার আ্যাংলো-মার্কিন সেনানিবাস, যা সেসময়ে বিজয়গড় কলেজের ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহৃত হত। সেই মাঠে জনসভা। গিয়ে দেখি, কানায় কানায় পরিপূর্ণ সে-মাঠ। আক্ষরিক অর্থেই তিলধারণের জায়গা নেই। তার প্রমাণ একটু বাদেই দিচ্ছি। জনতার আগমন ক্রমশ বাড়ছে তো বাড়ছেই। মাঠের পাশে যে-সমস্ত বাড়িঘর, তাতেও থিকথিক করছে জনতা, আর মাঠের পুব ও দক্ষিণদিকের রাস্তাও জনতায় পরিপূর্ণ। এত মানুষের আগমনের হেতু নানাবিধ। বিজয়মিছিলে সামিল হওয়া, তদুপরি এক শ্রদ্ধেয় কমিউনিস্ট নেতাকে দেখার সুযোগ হাতছাড়া হতে না দেওয়া। কে তিনি?

তাঁর নাম নাম্বুদিরিপাদ। পুরো নাম এর্লামকুলাম মানাক্কাল শঙ্করণ নাম্বুদিরিপাদ। সর্বভারতীয় বামপন্থী আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্র। বামফ্রন্টের এই ঐতিহাসিক বিজয়ে তাঁর মতো একজন সর্বমান্য মানুষের আবির্ভাব ঘটবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরাও মিলিত হয়েছি, অনেকাংশেই এই ইতিহাস-পুরুষকে দেখব বলে, তাঁর মুখনিঃসৃত কথা শুনব বলে। বস্তুত তাঁর এবং তাঁর মতো ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ সেসময় আমাদের উচ্চতম শ্রদ্ধার আসনে বিরাজ করতেন। শ্রীপাদ ডাঙ্গে, রণদিভে, পি সি যোশী, হরকিষেন সিং সুরজিত, জ্যোতি বসু, মুজফফর আহমেদ, মনসুর হাবিবুল্লাহ, নৃপেন চক্রবর্তী ছিলেন আদর্শগত কারণে শ্রদ্ধার পাত্র। পরবর্তীকালে তাঁদের স্থান নেন সীতারাম ইয়েচুরি, প্রশান্ত শূর, প্রকাশ কারাত, বৃন্দা কারাত এবং অতি অবশ্যই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রমুখ। তাঁদের একজন, এক বিরল ব্যক্তিত্ব আমাদের সামনে আসবেন, এই মহালগনকে বৃথা যেতে দেওয়া যায়?

সমস্যা। মহাসমাবেশ এতটাই নিশ্ছিদ্র যে তাঁকে সভামঞ্চে নিয়ে আসাটাই কিছুতে সম্ভব হচ্ছিল না! পিঁপড়ে গলবার ফাঁক নেই, এমন অবস্থা। বেগতিক দেখে একটা বুদ্ধি বের করা হল। নাম্বুদিরিকে একটি মাচায় বসিয়ে বেশ কয়েকজন বাহক মিলে তাঁকে নিয়ে আসা হল মঞ্চে। মাচার আগে-পিছে বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমি। এমন দৃশ্য চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা জীবনে একবার-ই হয়। তা-ও সকলের নয়, কারও কারও।

জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ছে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরমুহূর্ত থেকেই এই উৎসাহ উদ্দীপনা। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে এ ওর গায়ে লাল আবীর মাখিয়ে দিচ্ছে, লাইটপোস্টগুলোকে পর্যন্ত লাল রঙে রাঙানো হয়েছে। শুরু হল সভা।

সেদিন কারা কারা উপস্থিত ছিলেন, মনে নেই। মনে আছে নাম্বুদিরির পরিশীলিত উচ্চারণে ইংরেজিতে দেওয়া বক্তৃতা, আর তাৎক্ষণিকভাবে তার বাংলা অনুবাদ করে পরিবেশন। এটা করছিলেন ড. পীযূষ দাশগুপ্ত, যিনি নেতাজীনগর কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, ছিলেন কার্ল মার্ক্সের ‘Das Kapital’ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদক।

আর ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শুভ্র বসন, কান্তিময় চেহারা, চাহনিতে প্রজ্ঞা আর মায়া একধরনের। কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে অনুপুঙ্খভাবে নজর করে দেখবার অবকাশ হয়েছিল। আর তাঁর তেজোদ্দীপ্ত কথা, মুহূর্তে মুহূর্তে ঝলসে ওঠা আশাবাদ ও প্রতিজ্ঞা, বিজয়কে ধরে রাখার সর্বস্ব পণ ও যত্নপরতার যে বার্তা তিনি দিয়েছিলেন, তার সুর মন থেকে মিলিয়ে যায়নি আজ-ও।

সেবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রথমবারের মতো বিধায়ক হন, কাশীপুর কেন্দ্র থেকে দাঁড়িয়ে। তেত্রিশ বছরের তরুণ তুর্কি, ঐতিহ্যশালী পরিবারের সন্তান, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কলেজ থেকে বেরিয়ে কিছুকাল দমদমের শেঠবাগান স্কুলে পড়িয়ে তারপর রাজনীতিকেই একমাত্র আশ্রয় করবেন বলে মাস্টারি ছেড়ে দেন। জ্যোতি বসুর যেমন ১৯৪৬, বুদ্ধদেবের তেমনি ১৯৭৭। এর মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ও বিশ্ব দিয়ে কতই না পরিবর্তন ঘটে গেছে! সেগুলোর সালতামামি না নিলে বুদ্ধদেবের জীবন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বোঝা যাবে না। তাঁর জীবন ও কর্ম ভারতীয় তথা বিশ্ব কমিউনিস্ট গতি-প্রগতির সঙ্গে সমরেখায় স্থাপিত।

সেদিন যিনি মুখ্য বক্তা, অর্থাৎ নাম্বুদিরিপাদকে দেখেছি, তিনি নিজেই ততদিনে ইতিহাসপুরুষ! ১৯৫৭-তে কেরালায় ভারতে সর্বপ্রথম কমিউনিস্ট দল ক্ষমতায় আসে। তিনি হন দেশের প্রথম কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী। ভারতের নিতান্ত ছোট্ট একটি প্রদেশ, সেখানে এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে ১৯১৭-র রুশ বিপ্লবের পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ও পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হয়েছিল। আরও তাজ্জব ব্যাপার, সান মারিনোর মতো ইতালি-লাগোয়া নিতান্তই ক্ষুদ্র একটি দেশ, মাত্র হাজার বিশেক যার জনসংখ্যা, সে-ও বৃত হল কমিউনিজমে! এসবের প্রতিক্রিয়া ভারতের রাজনীতিতে প্রবলভাবে পড়েছিল।

কেরলে নেহরুর হস্তক্ষেপে নাম্বুদিরি সরকারের পতন, ১৯৫৯-এ। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী নেহরু ইন্দিরার পরামর্শে এ কাজ করেছেন বলে ঐতিহাসিকদের মত। নেহরু, যিনি ১৯২৭-এ বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ‘লীগ এগেনস্ট ফ্যাসিজম’-এ যোগ দিয়েছিলেন পিতা মতিলাল নেহরুর সঙ্গে! সেখানে সেবার হো চি মিন-ও উপস্থিত।

কেরালার ঘটনা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিপুল প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। আসলে দেশ ও বিশ্বের যাবতীয় ঘরানায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সচেতনতা ছিল তুমুল।

একুশ শতক থেকে পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্ব, যা এগারো বছর স্থায়ী ছিল। তার আগে তিনি রাজ্যের নানা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ তার মধ্যে অন্যতম। এসময়েই তাঁর উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি গঠিত হয়, ১৯৮৪-তে। শ্রদ্ধেয় অন্নদাশঙ্কর রায়কে তিনি-ই আকাদেমির সভাপতির পদে বসান।

১৯৪৭-২০০০ পর্বে আমরা বিধানচন্দ্র রায়ের মতো মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছিলাম, যাঁকে খুব সঙ্গত কারণেই ‘পশ্চিমবঙ্গের রূপকার’ বলা হয়। পেয়েছি প্রফুল্লচন্দ্র সেন ও অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বার্থত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী। এবং জ্যোতি বসুর মতো সম্ভ্রান্ত, বিজ্ঞ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখর কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ। কিন্তু তাঁদের সকলের চেয়ে অধিক ছিলেন বুদ্ধদেব। কেননা তাঁর মতো সংস্কৃতিমনা, দেশবিদেশের শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র নাটক সম্পর্কে সর্বদা অবহিত, এককথায় এক আধুনিক বিশ্বনাগরিক মানুষ পাইনি। এখানেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনন্যতা। তাঁর সঙ্গে কলকাতা বইমেলার স্টলগুলিতে স্বচ্ছন্দে পাশাপাশি হেঁটেছি, দু-একটি সরস প্রশ্ন করেছি, এবং তিনি সহাস্যে তার উত্তর-ও দিয়েছেন। হ্যাঁ, তিনি কিন্তু সবসেরা সুদর্শন মুখ্যমন্ত্রীও! শুভ্র কেশ, শুভ্র বেশ, সাদা অ্যাম্বাসেডার তাঁকে রুচিবান ও নান্দনিক করে রেখেছিল।

তিনি তথ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়। বাংলাদেশের ঢাকা থেকে পাক্ষিক ‘শৈলী’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রদ্ধেয় কবি কায়সুল হক আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অধ্যাপিকা শিরীন কাদের-ও পত্রিকার পক্ষ থেকে ঢাকা থেকে এসে আমার সঙ্গে সেই সাক্ষাৎকার নিতে উপস্থিত ছিলেন। আমার অত্যন্ত সুপরিচিত ও সজ্জন লোক ‘নন্দন’-এর তৎকালীন কর্মকর্তা অংশু শূর সাক্ষাৎকারটির সময় ও স্থান ঠিক করে দেন। বাংলা আকাদেমির একতলার একটি কক্ষে কোনও এক সন্ধ্যায় এটি নিয়েছিলাম। মন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বাংলা আকাদেমির সচিব অনুনয় চট্টোপাধ্যায়। কথা ছিল আধা ঘণ্টা সময় দেবেন। কিন্তু কথায় কথায় কখন যে দেড়ঘণ্টা অতিবাহিত হল, তা টের পাওয়া যায়নি। তিনি নিজেই সোৎসাহে প্রশ্রয় দিচ্ছিলেন আমাদের। সে-রাতে তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজনের মোলাকাতের সময় নির্দিষ্ট ছিল। তাঁরা অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে আরও বেশ কিছুক্ষণ আলোচনায় মশগুল রইলেন। এক পর্যায়ে তাঁর কন্যা সুচেতনাও এসে উপস্থিত হন।

কথা হয়েছিল নানান বিষয়ে, সাহিত্য, বিশ্বসংস্কৃতি, তাঁর কলেজজীবনের অধ্যাপকপ্রসঙ্গ, দেশের অর্থনীতি, কেন্দ্র বনাম রাজ্য, চলচ্চিত্র ও নাটক, এসব নিয়ে। আশ্চর্য লাগছিল, প্রশ্ন শোনামাত্র অস্বাভাবিক দ্রুততায় তিনি উত্তর দিচ্ছিলেন। যেন প্রশ্নপত্র তাঁর কাছে ফাঁস হয়েই আছে! আলাপচারিতার সব এখন আর মনে নেই। ১৯৯৮-এর কথা, ছাব্বিশ বছর আগের।

এক পর্যায়ে আলাপচারিতাকে লঘু সুরে বওয়াতে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, আচ্ছা, এই যে মন্ত্রিত্বের ধড়াচুড়ো পরে থাকতে হয় সবসময়, স্বাভাবিক জীবনযাপনের অনেক কিছু মিস করেন না? ঝটিতি তাঁর জবাব, ‘করি না আবার! রকে বসে যখন তখন আড্ডা দিতে পারি না, রাস্তার পাশে তেলেভাজার দোকান দেখলে গাড়ি থেকে নেমে কিনে খেতে পারি না, চাইলেই হাজারদুয়ারী বা বিষ্ণুপুর বেড়াতে যেতে পারি না!’ বুঝলাম, রাজা হওয়া কেবল সুখের-ই নয়, রীতিমতো সীমাবদ্ধতার-ও। সদ্য হাজারদুয়ারী ঘুরে এসেছি, এ কথা জানাতেই উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলেন, ‘ওখানে ঢোকার ঠিক আগে একটা চপ-কাটলেটের দোকান আছে না? খেয়েছেন?’ এ এক অন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সহজ, আটপৌরে, জীবনমুখী, অন্তরঙ্গ এবং ‘আড্ডিক’!

অন্তিমে প্রশ্ন ছিল, ধরুন, এমুহূর্তে সক্রেটিস আপনার সামনে এসে উপস্থিত। তাঁর কাছে কী প্রার্থনা থাকবে আপনার? প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফারিত চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘তাঁর কাছে চাইব, আজকের পৃথিবীর সভ্যতার সঙ্গে আপনার যুগের প্রজ্ঞা আপনি মিলিয়ে দিন’! কী ধীমান উত্তর! মনে হয় না অন্য কোনও মহত্তর প্রার্থনা তাঁর মতো মহান দার্শনিকের কাছে জানানো সম্ভব।

দুঃখের বিষয়, বিস্তৃত সে সাক্ষাৎকারটি ‘শৈলী’ ছাপেনি, কেননা পত্রিকার মালিক কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ইন্টারভিউ প্রকাশে অরাজি! এর আগে আমার নেওয়া অন্নদাশঙ্কর রায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এবং সুমন চট্টোপাধ্যায়ের মোলাকাত যদিও ছেপেছিল পত্রিকাটি।

নানা জায়গায় নানান উপলক্ষ্যে দেখা হত, সৌজন্যমূলকভাবে মৃদু হাসতেন। তাঁর সঙ্গে নিবিড় পরিচয় ছিল না। তবে মুখচেনা ছিল। নন্দন-এ নিয়মিত যেতেন। ওটা ছিল ওঁর আত্মার শান্তির জায়গা। দেখা হত অন্নদাশঙ্কর রায়ের জন্মদিনে, প্রায় প্রতিবছর তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর বাড়িতে আসতেন যখন। সেখানে বহুবার দেখেছি, দেখেছি কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়। ১৯৯৭-তে বইমেলায় আগুন লাগল। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব সেবার পাঁচদিনের মাথায় ফের মেলার পুনর্জাগরণ ঘটালেন।

বিশেষভাবে ফের পরিচয় হল লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। প্রতিবছর লিটল ম্যাগাজিনের অসাধারণত্বের জন্য পুরস্কার দেবার ব্যবস্থা করা হয় তাঁর-ই উদ্যোগে, অনুষ্ঠিত হয় লিটল ম্যাগাজিন মেলা। বাংলা আকাদেমি চত্বর জুড়ে। সেবার ‘পরিকথা’ বলে একটি পত্রিকা পুরস্কৃত হয়েছিল। সে-পত্রিকায় আমার একটি লেখা ছিল। পত্রিকার সম্পাদক দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়। পঁচিশজন পূর্বসূরী পত্রিকার সম্পাদকদের নিয়ে পঁচিশটি প্রবন্ধ। আমি লিখেছিলাম সাগরময় ঘোষকে নিয়ে। পুরস্কার বিতরণী-শেষে তাঁর কাছে গিয়ে অনুরোধ করলাম, আমার লেখাটি যেন পড়েন। তৎক্ষণাৎ প্রতিশ্রুতি দিলেন পড়বার। আমার লেখালেখি নিয়ে জানতে চাইলেন। লিখতে বললেন ‘নন্দন’, ‘যুবমানস’, ‘গণশক্তি’-তে। লিখেছি ‘গণশক্তি’-তে, অশ্বিনীকুমার দত্তকে নিয়ে দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ। দুটি সংখ্যা জুড়ে প্রকাশিত হয়েছিল।

প্রতিশ্রুতি যে সত্যিসত্যি-ই রক্ষা করবেন, ভাবিনি সত্যি-ই। কথা রাখেন কেউ কেউ। প্রমাণ পেলাম কিছুদিন বাদে, শান্তিনিকেতনে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে।

সেবার কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে কী একটা অনুষ্ঠান। আমি তখন প্রায়-ই সময় পেলে শান্তিনিকেতন যাই। সে সময়তেও উপস্থিত। সম্ভবত ১৯৯৭ বা ‘৯৮। সেসময় তিনিও এসেছেন। মনে পড়ছে না সঠিক, সরকারি কোনও অনুষ্ঠান ছিল কি না। সম্ভবত ছিল, তা না হলে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আসবেন কেন?

নাতিদীর্ঘ অনুষ্ঠান। কাছে গেলাম তাঁর। তাঁর সামনে যেতেই বললেন, ‘অসম্ভব তথ্যবহুল আর গভীর হয়েছে সাগরময়কে নিয়ে আপনার লেখাটা। তবে একটা তথ্য বাদ পড়ে গেছে আপনার লেখায়। সাগরময় কিছুদিন সিটি কলেজে অধ্যাপনাও করেছেন।’ জানতাম না সত্যি। কিন্তু তাঁর মতো লোক সব ব্যস্ততার মধ্যেও আমার লেখাটি পড়েছেন, এতে স্বভাবতই কৃতজ্ঞচিত্ত না হয়ে পারিনি। তখন একটি পত্রিকা বের করেছি। সবে প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছে। এক কপি তাঁর হাতে দিলাম। নেড়েচেড়ে দেখলেন। বললেন, ‘ট্রেনে ফেরার পথে পড়বার একটা রসদ হল’। উত্তরবঙ্গ থেকে এসেছেন সম্প্রতি। আমার বন্ধু পুণ্যশ্লেকের মুখে শুনেছিলাম, উনি একবার ওদের বাড়িতে রাত্রিযাপন করেছিলেন। বহু আগে। মনে আছে কি না জানতে চাইলাম। খুব মনে আছে। ‘ভাল কবিতা লেখে। ওর মা খুব যত্ন করে খাইয়েছিলেন। পার্টির কাজে গিয়েছিলাম। ও আমাকে ধরে নিয়ে যায়। তখন ইয়াং, পঁচিশ টচিশ হবে। চিঠি লিখত। উত্তর-ও দিয়েছি। কেমন আছে? ওর মা অসাধারণ রাঁধেন। ডিমের একটা প্রিপারেশন, ও ভুলব না!’

নানারূপে নানাস্থলে দেখা হয়েছে। আলিমুদ্দীন স্ট্রিটে একবার, হরকিষেণ সিং সুরজিত ভাষণ দিতে এসেছিলেন, তখন। বইমেলায় একবার ‘আজকাল’-এর স্টলে তো পরেই ‘নন্দন’-এর। সেখানে আর এক কমরেড বিপ্লব দাশগুপ্তের সঙ্গে আড্ডারত তিনি। ঐতিহাসিক ত্রিমূর্তির দেখা মিলেছিল একবার তাঁর-ই বদান্যতায়, নন্দন-এ। উদয়শঙ্করের পরিচালিত ছবি ‘কল্পনা’-র বিশেষ প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে। কারা? সত্যজিৎ রায়, রবিশঙ্কর এবং শম্ভু মিত্র। তাই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলতে আমার কাছে কেবল একটি ব্যক্তিমানুষ নন, একটি যুগ এবং তার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সব বোঝায়।

ছয় ও সাতের দশক ছিল পশ্চিমবঙ্গ, সারা ভারত, এবং এক-ই সঙ্গে বিশ্ব ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য কাল। আর সমগ্র কাল জুড়েই রয়েছে পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের টানাপোড়েন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংঘাত-বিরোধ আর মতাদর্শের লড়াই। বুদ্ধদেবের গঠনপর্ব এখানেই অনুসন্ধেয়। ইন্দিরা-কর্তৃক টাকার অবমূল্যায়ন, প্যারিসের ছাত্র আন্দোলন, চীন-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বোপরি ভিয়েতনাম যুদ্ধ, প্রতিটি ঘটনায় বুদ্ধদেব যেমন, তেমনি তাঁর দলের প্রতিক্রিয়া ছিল অনুধাবনীয়। তার সঙ্গে যুক্ত করে নিতে হবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অস্থিরতা, নকশাল আন্দোলন, বিধানসভা ভেঙে দেওয়া, আর সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি।

সমস্ত কিছুর কেন্দ্রে দু-দশক ধরে চলতে থাকা ভিয়েতনাম যুদ্ধ, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে আলোড়ন-সৃষ্টিকারী ঘটনা, কিউবা বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও দীর্ঘ, ঘটনাবহুল, নরঘাতী, আদর্শগত সংঘাতময় ও ভয়াবহ।’ নিজের বুকের রক্তে নক্ষত্রের উজ্জ্বল অক্ষরে/ লিখে রেখো নাম/ কালের রাখাল তুমি/ তুমি ভিয়েতনাম’, কবি কৃষ্ণ ধর এভাবেই চিহ্নিত করে গেছেন ভিয়েতনামকে।

বুদ্ধদেব এবং ভিয়েতনাম, একটি অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে। বিশ্ববাসীর সঙ্গে বাঙালির আবেগ মিশে আছে ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের দীর্ঘ ইতিহাসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যাবতীয় দুর্যোগের, নরহত্যা ও পাশবিকতার, নিষ্ঠুরতম মানবিকতা-লঙ্ঘনের নিকৃষ্টতম নজির গড়েছে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যের পৈশাচিকতা আর ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন, দুদশক জুড়ে। পাঁচ লক্ষ মার্কিন সৈন্য ভিয়েতনামে জড়ো হয়েছিল, আর আমেরিকা ব্যয় করেছে ৬৯ হাজার কোটি ডলার। এবং ফলাফল শূন্য। খোদ মার্কিন জনগণ-ই প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যেমন ছিল মার্কিন সরকারের ইরাক-নীতি বা আফগান-নীতির বিরুদ্ধে।

এই ভিয়েতনামে যাবেন বুদ্ধদেব, যাবেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গী হয়ে। সে-প্রসঙ্গে আসব যথাসময়ে। হো, ভিয়েতনামবাসী যাকে শ্রদ্ধা আর আদরে মিশিয়ে ডাকেন কমরেড নয়, আঙ্কল, চাচা হো, তিনিও একাধিকবার আসবেন কলকাতায়, ভারতে। ভিয়েতনাম তখন নাড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের চেতনা আর শুভবোধকে, তিরিশ লাখ ভিয়েতনামীর মৃত্যু রচনা করেছে মার্কিনের প্রতি বিশ্ববাসীর ঘৃণা, ভিয়েতনামবাসীর প্রতি সহানুভূতি ও মানবিক বোধ। ঋত্বিক লিখছেন, ‘কেমন করে জানি মনে হচ্ছে, ভিয়েতনাম পৃথিবীটাকে একটা মোড় ঘুরিয়ে দেবে’। দিয়েছিল। নাপাম বোমার নৃশংসতা-ভয়াবহতা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়েও শেষ জয় ছিনিয়ে নিতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট কেনেডির স্বকপোলকল্পনা, ভিয়েতনামীরা অরণ্যের আড়ালে থেকে লড়াই করে। গেরিলা যুদ্ধ। অতএব সেখানকার সব অরণ্য জ্বালিয়ে দিতে হবে। সেজন্যই নাপাম বোমার জন্ম, যা বর্ষিত হওয়ামাত্র আগুন ধরে যায় গৃহে ও অরণ্যে, আর মুহূর্তে তার উত্তাপ পৌঁছে যায় এক হাজার ডিগ্রিতে!

এই ভয়াবহতা বিশ্ববাসীকে না ছুঁয়ে পারেনি। হত্যা আর নাপাম বোমা-ই নয় কেবল, এই যুদ্ধ পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে হাজার হাজার ওয়ার চাইল্ড, যুদ্ধশিশু। আবিশ্ব তাই ভিয়েতনামে নতজানু ও বাক্যহীন! ঋত্বিক নিজ দেশের মানুষকেও এক-ই সঙ্গে বিপন্ন, পর্যুদস্ত, অসহায়, দিশেহারা ও দুর্ভাগা হিসেবে দেখছেন, ‘ভিয়েতনামের লড়াই এখানকারও লড়াই। সে-লড়াই এখানেও চললে আজকের জগতে যেখানে সবকিছু শোষণ, ভিয়েতনাম তার-ই বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক’ (ঋত্বিকের বক্তব্যগুলো পশ্চিমবঙ্গ যুব উৎসব উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ ১৯৬৮ থেকে নেওয়া)। ভিয়েতনামের জন্য তো একাধিক বাঙালি শহিদ-ও হয়েছেন। জানি ক’জন? বলা হবে তা-ও।

ঋত্বিক পারেননি, কিন্তু ভিয়েতনাম নিয়ে একটি নয়, ট্রিলজি বানিয়ে ফেললেন অলিভার স্টোন, Platoon (1984), Born on the Fourth of July (1989), আর ‘Heaven and Earth’ (1993)। ছবি করেছেন কত জন! মার্টিন স্করসেসি/রবার্ট ডি নিরো (Taxi Driver, 1976), The Deer Hunter, অভিনয়ে রবার্ট ডি নিরো, ক্রিস্টোফার ওয়াকেন আর মেরিল স্ট্রিপ।

[ক্রমশ]

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

ভূতের একটি বাজে গল্প

দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিতেই প্রথমে যেটি চোখে পড়ল, সেটি সেই লাল-হলুদ মাফলার, খাটের পাশে ঝোলানো। তাহলে সিড়িঙ্গেবাবু নিশ্চয়ই এই ঘরেই অধিষ্ঠান করেন, তালা দিয়ে কোথাও বেরিয়েছেন। হঠাৎ আমি ভূতগ্রস্তের মত করিডর ধরে হাঁটছি আর এক-একটা করে ঘরের দরজা ঠেলে ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছি। কী আশ্চর্য, প্রতিটি ঘরেই কোথাও না কোথাও দেখছি একটা করে ওই লাল-হলুদ মাফলার ঝুলছে। যত দ্রুত পারি দোতলায় ঘরগুলোর দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। সবখানেই এক ছবি।

Read More »
সুজিত বসু

কবিতা: জীবনের নানা দিক

ট্রেনের জানালা থেকে চোখে পড়ে ঘাসের গালিচা/ কোমল রোদের স্নেহে ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চল শান্তির নিদ্রায়/ সমুদ্রে দ্বীপের মতো ছোট ছোট বাড়িগুলি ঘাসের শয্যায়/ অতি দ্রুত বদলে যায় দৃশ্যাবলি, ট্রেন থামে ব্রাসেলস স্টেশনে/ বেলজিয়ামের মোহ দূরে রেখে ট্রেন চলে স্থির নিশানায়/ অভ্রান্ত লক্ষ্যের দিকে, আমস্টারডাম ডাকে কুহকী মায়ায়/ নগরে পৌঁছেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, সুন্দরী ট্রামেরা/ হাতছানি দিয়ে ডাকে, বহু বহুদিন পরে প্রিয় বাহনের/ ডাকে সাড়া দিয়ে আমি পৌঁছে যাই মহার্ঘ নিবাসে

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »