[লেখাটি গত জুলাইয়ের বিশ তারিখের। বাংলাদেশের সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন আর নেই। সেখানকার সুপ্রিম কোর্টের গত একুশে জুলাই তারিখের রায় অনুসারেই আন্দোলন চালানোর কারণ শেষ হয়ে যায়। তবে বহুজাতিক পুঁজির পছন্দসই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজ তাঁবেদার সরকার গড়ার টানাপোড়েন এখনও শেষ হয়নি। মালিকদের ও পেয়াদাদের মধ্যে দর কষাকষি চলছে। ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা থাকায় এবং ভাল প্রকাশন খুঁজে না পাওয়ায় প্রকাশ করা হয়নি। শেখ হাসিনার পদত্যাগ-পূর্ব বাংলাদেশ ও পদত্যাগের পরের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বদলেছে। কাজেই লেখাটি এখন প্রকাশের আগে অনেক ক্ষেত্রে সংশোধন করা হয়েছে।]
আক্রান্ত বাংলাদেশ: স্লোগান সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার, কাজ রাস্তায় বেসরকারি হিংসা ও একটি ক্যুদেতা, লক্ষ্য বাংলাদেশের ও তার চারপাশের প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পদ লুট
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা প্রমাণ হয়নি, তবে সমাজে সক্রিয় সহিংস ষড়যন্ত্রকারীদের ও তাদের সামনে ঠেলে দিয়ে পিছনে থাকা বহুজাতিক পুঁজির মালিকদের আসল লক্ষ্য প্রকাশ পেয়েছে।
সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক খবরে প্রায়ই উল্লেখ করা হচ্ছিল যে, “বাংলাদেশের সরকারি চাকরির কোটা পদ্ধতির সংস্কার করার আন্দোলন সারা বিশ্বকে ভাবাচ্ছে”, “ভারতের কয়েকটি ছাত্র সংগঠন এবং নানান দেশে অবস্থিত বাঙালিরাও এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন”, “কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আন্দোলনকারীদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে”।
প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করার এই কোটা পদ্ধতির কোনও সীমাবদ্ধতা নেই, যা আছে তার সবটাই সহিংস আন্দোলনের ষড়যন্ত্রকারী নেতাদের দুর্বুদ্ধি। আমি চাই এই বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা হোক, তাই এই কথাগুলি লিখছি।
আগেকার কথা
উনিশ শতকের শেষে, শিল্পবিকাশের গতিপথে পণ্য উৎপাদনী ব্যবস্থায় এত বেশি পণ্য উৎপাদন হয়েছিল যে, ১৮৮০ সালের শেষ দিকে পণ্যগুলো শেষ পর্যন্ত অচল শ্রমের স্তূপে পরিণত হয়েছিল। যে হারে পণ্য পুনরুৎপাদন করার প্রয়োজন লোপ পেয়েছিল, সেই হারে কারখানাগুলোতে শুরু হয়েছিল শ্রমিক ছাঁটাই। শিল্পোন্নত বিশ্বের বাজার এমন এক সময়ের মুখোমুখি হয়েছিল যেখানে বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার রয়েছে ও দালানকোঠা রয়েছে, কারখানায় উৎপাদনের মেশিনগুলোতে জং ধরে যাচ্ছে, ঘরে ঘরে দক্ষ ও শিক্ষিত বেকার লোক, নিম্ন মজুরি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, সস্তা শ্রমিক হিসেবে চাকরির বাজারে নারী ও শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা গোটা শিল্পোন্নত বিশ্বে একটি গুরুতর সমস্যারূপে উঠে আসে। প্রায়ই শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা যেত এবং এর আংশিক সমাধান হত পুলিশের সহিংস লাঠিচার্জের মধ্য দিয়ে। শেষ পর্যন্ত পুঁজির মালিক বুর্জোয়াদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবং তারা একে অপরের মজুতকৃত সম্পদ ধ্বংস করে বাজারে পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করেছিল, ফলে নিজেদের অচল হয়ে পড়া মেশিন সচল করার একটা উপায় তৈরি হয়েছিল। এর ফলে কিছু মাত্রায় বেকারত্বের সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়েছিল। যুদ্ধে সৈন্য হিসেবে শ্রমিক হত্যা করে শেষ পর্যন্ত চাকরির বাজারের ভারসাম্য প্রায় পুরোপুরি ও কিছুকালের জন্য রক্ষা করা হয়েছিল। এই ঘটনাকে আমরা বলি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এর কয়েক বছর পর পর্যাবৃত্তভাবে সমস্যাটি আবারও দেখা দিয়েছিল এবং সেই সমস্যাটির মোকাবিলায় বুর্জোয়ারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত করেছিল।
তবে যা কখনও ঘটতে দেখা যায়নি তা হল উৎপাদিত পণ্যের সুষম বণ্টন। পণ্যের সুষম বণ্টনই পারে বিশ্বযুদ্ধ থামাতে, প্রতিযোগিতার স্থলে সহযোগিতামূলক সমাজ নির্মাণ করতে। মালিক বুর্জোয়ারা এজন্য উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে রাজি নয়। বুর্জোয়াদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব রয়েছে, তাই কোনও পুঁজির মালিক যদি তার পণ্যের সুষম বণ্টন করে তাহলে সে শোষণমুক্ত সমাজ পাবে না, বরঞ্চ সে একটি চাকরি পাবে অন্য কোনও পুঁজির মালিকের প্রতিষ্ঠানে। তাই সদিচ্ছা থাকলেও কোনও পুঁজিপতি পণ্যের সুষম বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। পণ্যের সুষম বণ্টনের অভাবে গত দুই দশক ধরে পণ্য উৎপাদনী ব্যবস্থার পর্যাবৃত্ত সংকটের সমস্যাটি সারা বিশ্বে লক্ষণীয়ভাবে বিপজ্জনক সীমায় পৌঁছেছে। দেশে দেশে শ্রমিকরা সমস্যাগুলোর ভারে জর্জরিত হচ্ছেন, বিক্ষুব্ধ হচ্ছেন এবং বিক্ষোভ প্রকাশের পথ খুঁজছেন। এই সব সমস্যার সমাধান কীভাবে হতে পারে তা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ বুঝে উঠতে পারেন না। সারা দুনিয়া জুড়ে সেই সমাধানের রাস্তা খোঁজার লক্ষ্যে নিবেদিত সম্পত্তির ও পুঁজির মালিকানার ব্যাপারে সাধারণ স্বত্ববাদী চিন্তাবিদদের কয়েকটি গোষ্ঠী ও দল উনিশ শতক থেকে কাজ করছে, বারে বারে ব্যর্থ হচ্ছে, আর আবারও চেষ্টা করছে। তবে শ্রমিকরা প্রায়ই এই চিন্তাবিদদের কথাবার্তা বোঝার সময়-সুযোগ পান না, আর তাই এই দলগুলো প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পায় না। এই সীমাবদ্ধতার কারণে এইসব চিন্তা কোথাও একটি নির্ধারক শক্তিতে পরিণত হতে পারছে না এবং পুঁজির দাপটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। শ্রমিক শ্রেণিকে বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার রাজনীতিতে নিয়ে আসার জন্য আমরা কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করি। এজন্য আমরা সারা দুনিয়ার বিজ্ঞান, মানববিদ্যা ও সাহিত্য চর্চা করি। আমরা আমাদের রাজনৈতিক ধারার চর্চার স্বার্থেই দেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তিসমূহকে স্বাগত জানাই। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের শাসনের অধীনে সুস্থ, স্বাধীন, সৃজনশীন চিন্তাভাবনার চর্চা করার কোনও সুযোগ থাকে না।
আমাদের গণসম্পৃক্ততা অতি সীমাবদ্ধ, এবং এই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়েছে বর্তমান পণ্য উৎপাদনকারী ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকেরা। তারা তাদের অধীন শাসকদের ডান অংশ দিয়ে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাম অংশ দিয়ে শ্রমিক শ্রেণিকে বিভ্রান্ত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে বলশেভিক পার্টি নামে রাশিয়ার দুমার বা সংসদের একটি বামপন্থী দল সাধারণ স্বত্ব সম্পর্কে মার্ক্সের তত্ত্বকে বিকৃত করেছিল। তারা ক্ষমতা দখল করার ফলে শেষ পর্যন্ত সেখানকার শ্রমিক শ্রেণি পুঁজি ও অন্যান্য সম্পদ বণ্টনের যে ব্যবস্থার কবলে পড়েছিল তা বলশেভিকদের স্বৈরাচারী রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনস্থ ছিল। আগে পুঁজির মালিক ছিল ব্যক্তিবিশেষ, আর পরে মালিক করা হয় রাষ্ট্রকে। সুষম বণ্টনের নামে রাশিয়ার বলশেভিক পার্টি রাষ্ট্রীয় পুঁজিতন্ত্রের পরিচালক একটা রাষ্ট্র গঠন করেছিল। এটি আসলে তৎকালীন পৃথিবীর পুঁজির সেই রণনীতিরই একটি অংশ ছিল, যা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির একতা গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। সম্পত্তির সামাজিক মালিকানার লক্ষ্যে সারা দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণির একটি প্ল্যাটফর্মে একতাবদ্ধ হওয়ার প্রধানতম শর্ত হল, শ্রমিক শ্রেণির তরফে তার নিজস্ব শ্রেণিস্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হওয়া। এই কাজে আজও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেইসব ছোট ছোট রাজনৈতিক দল যারা বলশেভিকদের ধারায় রাজনীতি করে। বলশেভিক পার্টির নেতারা যদি রাশিয়ার রাষ্ট্রের ও সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক পদ্ধতি গ্রহণ না করতেন, তাহলে তৎকালে শিল্পোন্নত দেশগুলোর একতাবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণি বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে শ্রেণিসচেতনভাবে সম্পদের সুষম বণ্টন করতেন, ফলে আজকের বিশ্ববাজারের যে সমস্যা তা হয়তো তৈরি হতে পারত না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩১ সালের ৩১-এ জুলাই তারিখে তাঁর মেয়ের ঘরের নাতি ও সেই সময়ে ছাত্র হিসেবে জার্মানিতে প্রবাসী নীতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে পাঠানো একটি চিঠিতে লেখেন:
“…জার্মানিতে ব্যাভেরিয়ার ভাবগতিক ভালো লাগচে না। যেখানে দারিদ্রে মানুষ দুর্ব্বল সেখানেই যেমন মারী মড়ক জোর পায় তেমনি আজকালকার য়ুরোপে দুর্ভিক্ষ যতই ছড়িয়ে পড়েচে, ততই ফ্যাসিজ্ম এবং বলশেভিজ্ম জোর পেয়ে উঠচে। দুটোই অস্বাস্থ্যের লক্ষণ। মানুষের স্বাধীনবুদ্ধিকে জোর করে মেরে তার উপকার করা যায় এ সব কথা সুস্থচিত্ত লোকে মনে ভাবতেই পারেনা। পেটের জ্বালা বাড়লে তখনই যত দুর্ব্বুদ্ধি মানুষকে পেয়ে বসে। বলশেভিজ্ম ভারতে ছড়াবে বলে আশঙ্কা হয়—কেননা অন্নকষ্ট অত্যন্ত বেড়ে উঠেছে—মরণদশা যখন ঘনিয়ে আসে তখন এরা যমের দূত হয়ে দেখা দেয়। মানুষের পক্ষে মানুষ যে কি ভয়ঙ্কর তা দেখলে শরীর শিউরে ওঠে—মারের প্রতিযোগিতায় কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে সেই চেষ্টায় আজ সমস্ত পৃথিবী কোমর বেঁধেচে—মানুষের হাত থেকে বাঁচবার জন্যেই মানুষ কেবলি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠচে—এর আর শেষ নেই—খুনোখুনির ঘুর্ণিপাক চলল।
“আর যাই করিস, খবরদার এই মানুষখেকো দলের সঙ্গে মিশিস্ নে। য়ুরোপ আজ নিজের মহত্ত্বকে সব দিকেই প্রতিবাদ করতে বসেচে। আমাদের দেশের লোক—বিশেষ বাঙালী—আর কিছু না পারুক, নকল করতে পারে—তাদের অনেকে আজ য়ুরোপের ব্যামোর নকল করতে লেগেচে।এই নকল মড়কের ছোঁয়াচ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলিস। নিশ্চয় তোদের ওখানে এই সমস্ত দানোয়-পাওয়া ভারতবাসী অনেক আছে, তাদের কাছে ভিড়িস নে, আপনমনে কাজ করে যাস।” [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র, চতুর্থ খণ্ড (পৌষ ১৩৫০/ডিসেম্বর-জানুয়ারি ১৯৪৪ ),পৃ. ১৭৯-১৮০; কলিকাতা: বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়।]
সারা বিশ্বের শ্রমিকদের সংগ্রাম তখন বলশেভিকদের তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, যা আদতে একটি মিলিটারি ক্যু ছাড়া আর কিছু ছিল না। চীনে, ভিয়েতনামে, কিউবায়, মিয়ানমারে এবং আরও অনেক দেশে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার বিপরীতে রুশপন্থীরা স্থানীয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল, কিন্তু পুঁজির আধিপত্যের রাজনৈতিক অর্থব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখারই কাজ করেছিল।
অবিভক্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রেও ঘটেছিল অনুরূপ ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে তুলতে পাকিস্তান রাষ্ট্র শোষণকে সম্প্রসারিত করেছিল, ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি প্রধানত দেশটির শ্রমিক শ্রেণি বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। জনবিক্ষোভ দমনে পাকিস্তান সরকার জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চেয়েছিল, তাই তারা উৎসাহ দিয়ে হিন্দু-মুসলমানকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় নামিয়ে ছিল। দাঙ্গায় পাকিস্তানের সরকার মুসলমানদের পক্ষ নিয়েছিল, কেননা মুসলমানরা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। আওয়ামী লীগ তখন বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং দলটির জনপ্রিয় নেতা ছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন (!) প্রধানমন্ত্রীর পিতা শেখ মুজিব। শেখ মুজিব সোভিয়েত অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁর নিজের যুক্তিবুদ্ধি অনুসারে বাংলাদেশকে একটি শোষণহীন ও অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর পার্টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন দেশের অধিকাংশ শ্রমিক। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র বিভক্ত হয়ে একটি নতুন সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশের গঠনতন্ত্রের মূলনীতি ছিল জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্র অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পুঁজিতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র। রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদও পুঁজিবাদের একটি শাখামাত্র, কাজেই চীন-সোভিয়েতের মতো বাংলাদেশের সংবিধানও পুঁজিবাদী চরিত্রকে অতিক্রম করে যেতে পারেনি। অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র হল অধিকাংশ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত; সেই মতামত সেক্যুলারিজমের বিরুদ্ধে যায় না। কাজেই আওয়ামী লীগের ইতিহাস হল বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম চর্চার ও বিকাশের ইতিহাস।
আমরা যারা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সম্প্রসারিত করার জন্য কাজ করি, তারা সেক্যুলারিজমের চর্চা করি এবং নারীদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে সংযুক্ত করি। ফলে আমাদের বিকাশের জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থায় সেক্যুলারিজমের ধারা অব্যাহত রাখা আবশ্যক। তবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের শিক্ষিত ও চিন্তাশীল মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহত্তর অংশকে পাকিস্তানের আর্মি হত্যা করে এবং বাকি বেশিরভাগ যোদ্ধা দেশের অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করার জন্য লেখাপড়া করার ও দক্ষতা অর্জন করার উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। ফলে বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের চর্চা ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে আওয়ামী লীগের মূলধারা সংকুচিত হতে শুরু করেছিল এবং ব্যাপক পরিসরে সাম্প্রদায়িক ও নৈরাজ্যবাদী দাঙ্গাবাজ রাজনৈতিক ধারাগুলো প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। এই সুযোগে এমন অনেক ধারার লোক বাংলাদেশে তাদের ধারার সংগঠন বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল, যারা অসাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সাহায্য করেছিল। আমরা তাদেরকে রাজাকার বলি। এই বিষয়ে দেখুন:
https://bn.banglapedia.org/index.php/%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0
এখনকার কথা
বর্তমানে বাংলাদেশের বহু মানুষ রাজাকারদের আদর্শে প্রভাবিত হয়ে সাংগঠনিকভাবে সেই ধারার চর্চা করছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এবং একাত্তরের অসাম্প্রদায়িক যোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততিরা সেক্যুলারিজমের আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল এবং আমরা যারা বুদ্ধিবৃত্তির প্রেরণায় রাজনীতি করি, তারা নানা যৌক্তিক প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে যোগ দিই। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংগঠনিক কাজের সূত্রে ও পৈতৃক উত্তরাধিকরের সূত্রে সেক্যুলারিজমের চেতনায় প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তিনি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করেছেন। সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা ২০১৩ সালে রাজধানী ঢাকায় রাজাকারদের বিচারের দাবিতে এক বিশাল সমাবেশ করি। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বিগত বছরগুলোতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এরই অংশ হিসেবে পাঠ্যপুস্তক সংস্কার করে বিজ্ঞানভিত্তিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এবং নারীদেরকে ব্যাপকমাত্রায় শিক্ষা ও কর্মমুখী করে তোলা হচ্ছিল, যার প্রভাব মাদ্রাসাগুলোতে গভীরভাবে পড়েছে। বাংলাদেশ সরকারের অসাম্প্রদায়িক নীতিগুলি ইসলামি শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়েছিল এবং প্রায়ই মাদ্রাসার ছাত্ররা আন্দোলনে নেমে “মানি না, মানি না” বলে স্লোগান দিত। একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, সেখানে দেখা যায় একজন সাংবাদিক আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “আপনারা আসলে কী মানেন না?” প্রত্যুত্তরে সেই সব মাদ্রাসার ছাত্ররা বলেছিল, “জানি না”। এভাবে তৈরি করা ডজন ডজন উগ্রবাদী ইসলামি দল প্রায়ই বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি-র সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরকার-বিরোধী এক বৃহত্তর জোটে পরিণত হয়। তাদের প্রতিবাদের ভাষা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে আগুন দেওয়া, গাড়িতে আগুন দেওয়া, বোমা নিক্ষেপ করা, নানান দেশীয় অস্ত্র দিয়ে পুলিশকে হত্যা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়াও এরা আলাপের ক্ষেত্রে খুব একটা ভাল নন, দুই-এক মিনিট আলাপের পরই অপ্রাসঙ্গিক আলাপ শুরু করে দেন এবং ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন।
“আওয়ামী-ফ্যাসিজম” কাকে বলে?
আমরা যারা সেক্যুলারিজমের চর্চা করি তাদের একারণে প্রায়ই একটি আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। এর আগেও আমাদের ফোরামের অনেক সদস্যকে ছুরিকাঘাতে এবং পিস্তল দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা আমাদের মতপ্রকাশ কিছুকালের জন্য বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম এবং অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র ব্যাহত হতে শুরু করেছিল। শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই সক্রিয়তাকেই সাম্প্রদায়িকতাবাদী গোষ্ঠীগুলি “আওয়ামী-ফ্যাসিজম” বলে। এই শব্দটি সারা বিশ্বের মিডিয়াগুলো চর্চা করছে। গত কয়েকদিনে সারা বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় “আওয়ামী ফ্যাসিজমের” যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের পরিস্থিতির একাংশ। অপর অংশে বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে রাজাকারের চিন্তাধারার লোকেরা যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে এসেছে তা দুনিয়ার গণমাধ্যমে অনুপস্থিত। কাজেই এখানে “আওয়ামী লীগের ফ্যাসিজম” কি অন্যায়, নাকি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তা বোঝা বহির্বিশ্বের মানুষের জন্য সহজ নয়। সাড়ে চার লাইন বুঝে বহির্বিশ্বের মানুষদের এদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে যেকোনও একটা অংশকে সমর্থন করা অনধিকার চর্চার সামিল। এই অনধিকার চর্চা বাড়তে বাড়তে গত ৫-ই আগস্টের ক্যুদেতাকেও গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে গলা ফাটাচ্ছে। শুনেছি ইংরেজরা নাকি তাদের লেখায় ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের প্রহসনকেও বাংলার বিপ্লব বলে চালাত। এখন আমেরিকানরা ও তাদের হাতে তামাক খাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে পড়া আমাদের কুবুদ্ধিজীবী ও নির্বুদ্ধিজীবীরাও ধানমন্ডিতে দ্বিতীয় পলাশীর যাত্রাপালা লিখছেন।
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর যেকোনও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মতোই কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাস্তা অবরোধ করে যানবাহনে ও শতাধিক সরকারি ভবনে আগুন দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ বাধা দিতে গেলে পুলিশকে তারা আক্রমণ করেছিল। এসব ঘটনা বিএনপি-জামাতের পূর্ব-পরিকল্পনার সাথে মিলে যায়, যেগুলো তারা বিভিন্ন সময় বলে ও করে থাকে।
এই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রায় দুই মাস আগে ঘটনাচক্রে তাদের শিবিরের একটা গোপন মিটিংয়ে গিয়েছিলাম, সেখানে তারা তাদের পরিকল্পনা স্পষ্ট করেছিল। জানলাম তাদের অর্থের যোগান দেবেন বিরোধী দলের নেতা তারেক রহমান এবং তারা সারা দেশে ছাত্রদের আন্দোলন নামিয়ে দেবে। আন্দোলনে তারা দুইশ জন পুলিশ হত্যা করে বাংলাদেশ সরকারকে ভয় ধরিয়ে দেবে এবং শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনবে। এটি শুধুমাত্র একটি ফোরামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নয়, এটি পুরো সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল। আমি মিটিং থেকে বের হয়ে ট্রেনে করে এক শহর থেকে অপর শহরে যাচ্ছিলাম। আমার পাশের সিটে একজন আইনজীবী বসেছিলেন, তিনি নিজেকে বিএনপি-র নেতা বলে দাবি করেন। ওর সাথে আমার টানা তিন ঘণ্টা রাজনৈতিক আলাপ হয়। আলাপের এক পর্যায়ে তিনি আমার ফোন নাম্বার রেখেছিলেন এবং তিনি আমাকে তাঁর দলে যোগদান করার অনুরোধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁর মেয়ে লন্ডনে তারেক জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ওঁর ফোন থেকে সেই মেয়ের একটা ছবির সাথে তারেক জিয়ার একটা ছবিও আমাকে দেখান। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “শীঘ্রই শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। আমরা যথেষ্ট অস্ত্র নিয়ে নামব এবং সামনে ছাত্রদেরকে নামাব যাতে আমরা বহির্বিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ না হই। আমাদের প্রথম টার্গেট দুইশ জন পুলিশ হত্যা করা।”
এর একদিন পর দুপুরে আমি একটা হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসেছিলাম, সেখানে একজন রোহিঙ্গা ব্যক্তিও ছিলেন। তিনি আমাকে শুরুতে আমার নাম জিজ্ঞেস করেন। আমি বললাম “__”। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “অমুক__?” বললাম, “হ্যাঁ”। তারপর তিনি একটা বড় গামছা বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে আমাকেও নামাজ পড়তে অনুরোধ করেন। আমি ওর সাথে যোহরের নামাজ পড়ার পর দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়। মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া গণহত্যার বিষয়ে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি আমাকে বলেন, “বিধর্মীদের দ্বারা আমরা নির্যাতিত এবং এর একটা প্রতিশোধ নিতে চাই। এজন্য আমরা যারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছি তারা প্ল্যানমতো অগ্রসর হচ্ছি। আমরা বাংলাদেশকে একটি শতভাগ ইসলামি দেশ হিসেবে দেখতে চাই, যাতে এই দেশকে দিয়ে মিয়ানমারের গণহত্যার একটা পাল্টা জবাব দিতে পারি। এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই আমাদের অনেকগুলো টিম বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছে এবং এদেশের ইসলামি সংগঠনসমূহকে সহায়তা করছে। দেশে দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেই কেবলমাত্র আমরা স্থির হতে পারি— এর আগে নয়।”
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর পনেরো ঘণ্টার মধ্যেই আমরা বাংলাদেশে এমন এক পরিস্থিতির সাক্ষী হয়েছি, যা বিএনপি-জামাত ও রোহিঙ্গাদের পরিকল্পনার সাথে মিলে যায়। বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া, যিনি দুর্নীতির দায়ে কারাগারে ছিলেন, তাঁকে ও তাঁর সহযোগী বন্দি সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী আসামিদের কারামুক্ত করা হয়েছে। একই থানায় একসঙ্গে ১৩ জন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে, পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও সারাদেশে এ পর্যন্ত কত পুলিশকে যে হত্যা করা হয়েছে, তার সঠিক হিসেব জানা নেই। শোনা যাচ্ছে, বেশ কয়েকশো ছাড়িয়ে গেছে। হত্যা করে ফ্লাইওভারে ও গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সারাদেশে হিন্দুদের ও বাউলদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হচ্ছে। বাজারে, মার্কেটে ও থানায় আগুন দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের লাশ উদ্ধার হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে যখন প্রথমবার ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন আমি বামপন্থী আন্দোলন সংগঠিত করতে কাজ করেছিলাম। একটি গণদাবি হিসেবে আমিও কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে প্রথমে ঢাকায় এবং পরে চট্টগ্রামে সক্রিয় ছিলাম। কিন্তু ঘটনাবশত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন একজন ছাত্র আন্দোলনটির প্রধান নেতায় পরিণত হন, যিনি গভীরভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। গণআন্দোলনে সাম্প্রদায়িক শক্তি বাড়ছে টের পেয়ে আমি কোটা সংস্কার আন্দোলন নামের সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের মঞ্চ থেকে সরে এসেছিলাম। অনেক পরে আন্দোলনটি শিথিল হয়েছিল। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কয়েকদিন ধরে যা ঘটেছিল, তা শুরু থেকেই গণআন্দোলনের চরিত্র হারিয়ে একটা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে পরিণত হয়েছিল। আজ আমরা কার্যক্রম দেখেই চিনে যাই ঘটনাটি কারা ঘটাচ্ছে। আগুন আর অস্ত্র নিয়ে রাজনীতি করার স্বভাব রয়েছে বিএনপি-জামাত ও রোহিঙ্গাদের। তারা যুক্তিবুদ্ধির তোয়াক্কা করে না। বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু রায় দেওয়ার ব্যাপারটি কোর্টের আয়ত্তাধীন; সেই প্রক্রিয়া অনেকগুলো বৈঠকের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়। এর জন্য যথেষ্ট সময় প্রয়োজন। কিন্তু এর মধ্যেই জামাত-বিএনপি-রাজাকার ও রোহিঙ্গারা একতাবদ্ধ হয়ে রাস্তা অবরোধ, বিভিন্ন স্থাপত্য, বাড়ি ও গাড়ি ভাঙচুর, আগুন দেওয়া, পুলিশের ওপর হামলা, প্রধানমন্ত্রীর ছবি বিকৃত করা, গালাগালি করা অব্যাহত রেখেছিল। পুরো ব্যাপারটি গণসন্ত্রাসে পরিণত হয়েছিল। দেশের খেটেখাওয়া মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল। দেশের কোটি কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। শেষপর্যন্ত এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে দমন করতে প্রশাসন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং এই সক্রিয়তার খবর সারবিশ্বে পৌঁছে গিয়েছিল। বহির্বিশ্বের গণমাধ্যমগুলি বাংলাদেশের প্রশাসনের কার্যক্রমের নিন্দা করেছে এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলির সন্ত্রাসী কার্যক্রমে উৎসাহ দিয়েছে। এভাবে বহির্বিশ্বের আচরণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে দিয়েছে। আসলে এই সন্ত্রাসীরা ঠিক কী কারণে আন্দোলন করছে তা বহির্বিশ্বের কাছে যেমন স্পষ্ট নয়, তেমন আন্দোলনকারীদের একাংশের কাছেও অস্পষ্ট। আমি এই আন্দোলনের কারণ স্পষ্ট করার জন্যই লিখছি।
কোটা
বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকেই সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারা কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করে। প্রথমে নির্ধারিত যোগ্যতাসাপেক্ষে চাকরিপ্রার্থী ব্যক্তিকে চাকরির জন্য আবেদন করতে হয়। তারপর তাদের একটি লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এভাবে চাকরির বিভিন্ন পদগুলির জন্য যোগ্য প্রার্থী সিলেকশন হয়; কিন্তু যদি একটি শূন্যপদে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকেন, সেক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারা ভিন্ন একটা কায়দায় কর্মী নিয়োগ করেন। নিয়োগকর্তারা প্রথমে খোঁজেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্ততিদের, যেহেতু তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনা দ্বারা উদ্ধুদ্ধ, তাই সরকারের সেকুলার নিয়মগুলি বুঝে ও মেনে চলবেন বলে আশা করা হয়। দ্বিতীয়ত খোঁজেন নারীদের; সরকার মনে করে যে, তাঁদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজের অংশীদার করলে তাঁরা ধর্মীয় গোড়ামির ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে পারবেন। তারপর খোঁজেন প্রতিবন্ধীদের; তাঁরা সমাজে অবহেলিত এবং খুব বেশি শারীরিক শ্রম দেওয়ার সামর্থ্য তাঁদের নেই। মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও প্রতিবন্ধীদের চাকরিতে প্রাধান্য দেওয়ার এই সিস্টেমকে বলা হয় কোটা সিস্টেম। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসন্ততিদের এভাবে চাকরি দেওয়াটাকে বলা হয় “মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি”। পদ্ধতিটির সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কিন্তু আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, “মেধার ভিত্তিতে নয়, চাকরি দেওয়া হয় কোটার ভিত্তিতে”। আসলে বক্তব্যটি অসত্য, যেহেতু নিয়োগের ব্যাপারে কোটাধারী ব্যক্তির এবং কোটাহীন ব্যক্তির একই শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে। আন্দোলনকারীদের আরও অভিযোগ রয়েছে, “মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্ততিরা চাকরির বাজার দখল করলে দেশের বাকি মানুষ সুবিধা বঞ্চিত হয়”। আসলে এই বক্তব্যটি বিভ্রান্তিমূলক, যেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-সন্ততিরা এদেশেরই মানুষ, অতএব চাকরির বাজারে এদেশের মানুষ সুবিধাবঞ্চিত হয় না। কাজেই কোটা সিস্টেমের কোনও সীমাবদ্ধতা নেই, যা আছে তা হল তার ওপর ভিত্তিহীন ও ব্যাপকমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ। আসলে, কোটা পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা প্রমাণ করার বিপরীতে আন্দোলনকারীরা নিজেদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই প্রকাশ করেছে। মূলত, রাজাকারদের প্রচারের প্রভাবে বাংলাদেশ একটা অন্ধ উন্মাদদের দেশে পরিণত হয়েছে।
এই আন্দোলনের সামনে আছে একদল অন্ধ উন্মাদ শিক্ষার্থী। যাদের বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার কোনও মিল নেই। এরা চায়, এই আন্দোলনকে সরকার-বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করে সেক্যুলারিজমের চর্চাকে প্রতিহত করতে। আরেকটা অংশ রয়েছে, যারা চায় ইসলামের নামে পুঁজির শোষণের অংশীদার হতে। বামপন্থী দলগুলোও এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে রাস্তায় থেকেছে। আন্দোলনের ক্ষেত্রে বামপন্থীদের যুক্তি হল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যক্তি যা চায়, বামপন্থীরাও তা চায়। বামপন্থীরা গণতন্ত্র বোঝে, সেক্যুলারিজম বোঝে না। ফলে বামপন্থী সংগ্রাম সাম্প্রদায়িক শক্তি বিএনপি-জামাতকে সমর্থন করে। তারা পুঁজিবাদ-বিরোধী নির্ধারক শক্তিতে পরিণত হওয়ার বিপরীতে শেখ হাসিনা-বিরোধী শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তারা ‘পুঁজির শাসনের বিলোপ চাই’ বলার বিপরীতে বলছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাই। তারা ‘চাকরি ব্যবস্থা বিলোপ চাই’ বলার বিপরীতে বলছে বাজারে চাকরি চাই। তারা সরকার ব্যবস্থার বিলোপের বিপরীতে বলছে “সমাজতান্ত্রিক” সরকার চাই। তারা রাষ্ট্রের বিলোপ চাই বলার বিপরীতে বলছে “সমাজতান্ত্রিক” রাষ্ট্র চাই। এই দাবিগুলো বাস্তবতা বিবর্জিত, বিগতকালের দিকে তাকিয়ে থাকা সেন্টিমেন্টাল দাবি। এইসব দাবি অতীতেও শ্রমজীবী শ্রেণিগুলির আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করেছিল, শ্রমিকদের আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হয়েছিল এবং রাজনীতিতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যাপারে শ্রমিকরা নিরুৎসাহিত হয়েছিল। শেষপর্যন্ত এসব কর্মকাণ্ড পণ্য উৎপাদনী ব্যবস্থাকেই স্থায়ী করেছিল।
সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনও কিছুর যৌক্তিকতা বিচারের মানদণ্ড হওয়াটা যুক্তিসঙ্গত নয়। গত কয়েকদিন ধরে লক্ষাধিক সাম্প্রদায়িক লোক একটি অন্যায্য দাবির ভিত্তিতে সারা বাংলাদেশ ব্লক করছে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে বাংলাদেশ সরকার প্রথমে দেশবাসীকে অনুরোধ করেছে। কিন্তু বাংলা ব্লককারীরা সরকারের অনুরোধ গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশ সরকার এক কঠোর প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে নিজেদের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ারগ্যাস শেল ও বুলেট নিক্ষেপ করেছে। আর সাম্প্রদায়িক দলসমূহের অতি উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থী বুলেটের সামনে এসে আত্মহত্যা করেছে। প্রকৃতপক্ষে, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সাথে যা ঘটেছিল তা তাদের নিজেদের অতিরিক্ত আবেগের অনিবার্য পরিণতি।
আন্দোলনকারীরা গর্বভরে স্লোগান দিয়েছিল: “তুমি কে, আমি কে— রাজাকার, রাজাকার”। চলমান হিংসা কারা, কেন ঘটিয়েছে তা আমাদের কাছে এখন বেশ স্পষ্ট। অতএব এটি আরও স্পষ্ট, কেন কোটা সিস্টেম আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে। আমাদের কাছে এখন খুব স্পষ্ট যে, একাত্তর সালে যারা একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পরাজিত হয়েছিল তারা সেই দুঃখ এখনও ভুলতে পারেনি। তারা এজন্য বাংলাদেশকে নতুন করে আফগানিস্তানে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন মূলত বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার একটা প্রচেষ্টা মাত্র। আমরা চাই না রাজাকাররা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো নিয়ে সেখানে মূলধারার বাইরের চিন্তাচর্চা করুক। আমরা চাই না বিএনপি-জামাত এদেশে একটি সাধারণ ইস্যুকে ঘিরে তাদের আদর্শ ও মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করুক। আমরা চাই না অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আফগানিস্তানে পরিণত হোক। শেষ পর্যন্ত, কোটা বিরোধী আন্দোলন সরকারের কাছে শুধুমাত্র একটি অযৌক্তিক বিশৃঙ্খলার রূপ নিল। আমরা এখন আইনত এবং নৈতিক বিচারে সারাদেশে ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারি বিরোধী দলের কাছে। পাশাপাশি আমি বহির্বিশ্বকে বলব, সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আন্দোলনের ন্যায্যতা বিবেচনা করা ন্যায্য নয়। সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিকর আদর্শিক স্রোত “সাম্প্রদায়িকতা” নির্মূলে আওয়ামী লীগ কঠোর হয়েছে, কিন্তু এর আগে এই জঙ্গিরা নির্বিচারে মুক্তচিন্তকদেরকে হত্যা করেছিল। পাঠ্যবইয়ে বিবর্তনতত্ত্ব রাখার বিরুদ্ধে তারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে। তারা প্রায়ই এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা করে। হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। বাউলদের ঘর ভেঙে দেয়। সময় এসেছে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে একটা কঠোর জবাব দেওয়ার। সালাফি জঙ্গিবাদ যখন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়, তখন তাকে ঠেকানো যৌক্তিক হয়ে ওঠে। সরকার যদি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অন্যায় বন্ধ না করে তাহলে এর সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়বে এদেশের মানুষের ওপর। অতএব, বাংলাদেশ সরকার ও প্রশাসনের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে জনস্বার্থে সংঘটিত হয়েছে। যারা মনে করেন যে আওয়ামী লীগ অন্যায় করেছে, তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, “আওয়ামী লীগ অন্যায় করেনি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে”।
কেউ বলছে না আওয়ামী লীগ সুফি-সন্ত আর আউল-বাউলে ভর্তি। তেমন মানুষেরা কখনও কোথাও সরকার চালায় না। তবে আমাদের ঘরের পাশেই উদাহরণ আছে, সেকুলার শাসকদের ওপরে রাগ করে সাম্প্রদায়িক রাজা-উজিরদের সিংহাসনে বসালে ফল কী হয়। আমাদের বামপন্থীরা সরকারের বিকল্প হিসেবে নির্ধারক শক্তিতে পরিণত হতে পারেনি। তাই তাদের করা সরকার-বিরোধী আন্দোলন বিএনপি-জামাতকে সমর্থন করে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক জোট বিএনপি-জামাতকে যারা আওয়ামী লীগের বিকল্প মনে করেন, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন: “বিএনপিকে সাধু চরিত্রের সার্টিফিকেট কে দিয়েছে?” ৫-ই আগস্টের ক্যুদেতার পর উত্তর এখন পরিষ্কার: বহুজাতিক পুঁজি।
বহুজাতিক পুঁজির লক্ষ্য বাংলাদেশের ও তার চারপাশের প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পদ লুট করা
এর মধ্যে আল-জাজিরা কেন প্রায়ই মিথ্যা গল্প সাজিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় এটি একটা সময় পর্যন্ত আমার কাছে বেশ রহস্যের ব্যাপার ছিল। কয়েক দিন আগে মার্ক্স চর্চায় ও দক্ষিণ এশিয়ার সমাজগুলির ব্যাপারে কৌতূহলী কোনও মানুষের সাথে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি। সেই আলোচনা আমাকে একটি নতুন অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করেছে, আমাদের ক্যুদেতার ঝালার আগে, বন্দিশ হিসেবে কোটা আন্দোলনের মুখড়ার ও দ্রুত লয়ে আলাপের ব্যাপারে। আন্দোলনের কোনও যৌক্তিকতা ছাড়াই আল-জাজিরার সমর্থনের সুবাদে বাংলাদেশের কুবুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সেবা করার ও বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পেয়ে যায়। অন্যদেশে তাদের কুবাক্যজীবী ভাই-বন্ধুরাও সাহেবদের হাতালি পাওয়ার আশায় সেই ঘোলাজলে লাফ দিয়ে পড়ে। বাংলাদেশের চলমান আন্দোলন হয়তো সমিতিবদ্ধ বহুজাতিক পুঁজির দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার একটা ফল, যেটি শুরু হতে না হতেই বিশ্ব মিডিয়ার হেডলাইনগুলো দখলে নিয়েছিল এবং বাংলাদেশের দুর্বুদ্ধিজীবীদের সাক্ষাৎকার প্রচার করে আল-জাজিরার মতো অনেকগুলো মিডিয়া বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা বাড়িয়ে দিয়েছিল। এর পরপর বহির্বিশ্বে অনেকে কোটা আন্দোলনের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিল এবং বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করেছিল। আজ বহির্বিশ্বের পুঁজির তাঁবেদার গণমাধ্যমগুলি কেন কোটা আন্দোলন ও বাংলাদেশে নিয়ে এত সরব তার একটা ইঙ্গিত পাওয়ার জন্য বঙ্গোপসাগরের ও তার চারপাশের এলাকার প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পদের হিসাব-নিকাশ করা খুবই জরুরি।
বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত ও মিয়ানমারের জল ও মাটির নিচের খনিজ তেল ও মূল্যবান আকরিক সম্পদের ওপর দখলদারির জন্য আমেরিকার, সৌদির ও পারস্য উপসাগরের চারপাশের রাষ্ট্রগুলিতে সমিতিবদ্ধ বহুজাতিক পুঁজির দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা থাকা স্বাভাবিক। বাংলাদেশের জন্মের পরের বছরে, ১৯৭২ সালে প্রকাশিত মাইকেল হাডসন রচিত ‘সুপার ইম্পিরিয়ালিজম: দি ইকনমিক স্ট্র্যাটেজি অব আমেরিকান এম্পায়ার’ বইটি দিয়ে এই বিষয়টির চর্চা শুরু করা যায়।
***
কাজী তানভীর হোসেন, মতামত কলামিস্ট ও কমিউনিস্ট আন্দোলন পুনর্গঠনের সংগঠক
শুদ্ধলেখ তৈরি করায় ব্যাপারে সহায়তায়: কার্ল মার্ক্সের কোনও কোনও রচনার অনুবাদক ও সম্পাদক প্রদীপ বকশি