ভাষা না হলে মানুষের, সমাজের কাঙ্ক্ষিত বিকাশ ঘটত না। প্রতিদিন ভোরে আমরা যখন চোখ মেলি, তখন আমাদের দৃষ্টির সীমানায় মানুষ ছাড়াও ধরা দেয় বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি তথা বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি জগৎ। একটু সচেতন হলেই আমরা শুনতে পাব মানুষ ও প্রকৃতি জগতের বিচিত্র ভাষা। আসলে ভাষা মানুষের অস্তিত্বে যেমন বিরাজমান, তেমনই বিরাজমান প্রকৃতির অস্তিত্বেও। তাই তো সবাই নিজের মতো করে কথা বলে বিচিত্র ভঙ্গিমায়, নানা ইশারায়। বলা হয়, ভাষা আছে বলেই পৃথিবী এত প্রাণচঞ্চল ও আনন্দময়। এই পৃথিবীতে অনেকের কাছেই অনেক সম্পদ নেই, কিন্তু একটি সম্পদ আছে সবার কাছে— সেই সম্পদের নাম ‘মাতৃভাষা’। প্রতিটি জাতির মাতৃভাষা সে জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। মাতৃভাষার স্থান আমাদের হৃদয়ের গভীরে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১১ জন শহিদ হন। সারাবিশ্বের বাঙালিদের জন্য এ এক গর্বের ইতিহাস। উনিশে মে’র ১১ জন ভাষাশহিদ সমগ্র বিশ্বের মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষের গর্ব ও অহংকার।
দেশভাগের পর আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে গড়ে ওঠে বাঙালি জনপদ। তাদের মুখের ভাষা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির বাহন হিসেবে বাংলা ভাষা আসামের সমাজ ও রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৫০ সালে আসামে একসময় গড়ে ওঠে ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলন। এর নেতৃত্ব দেয় উগ্রবাদী অসমিয়া সম্প্রদায়। অসমিয়া জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি এবং অসমিয়া ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমে ও সরকারি ভাষারূপে প্রতিষ্ঠার ইন্ধন যোগাতে ব্রিটিশ ও মার্কিনদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। ১৯৪৮ সালের মে মাসে গুয়াহাটি শহরে তারা বাঙালিদের ওপর আগ্রাসন চালায়। ১৯৬০ সালের ৩ মার্চ আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা চালিহা বিধানসভায় অসমিয়াকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হবে বলে জানান। ওই ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৬০ সালে ১৬ এপ্রিল শিলচরে বাংলা ভাষাভাষী বাঙালিরা এক নাগরিক সভা আহ্বান করেন। সরকারি ভাষা-প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক নির্বচিত হন অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ। এ ছাড়া শিলচরে ২ ও ৩ জুলাই চপলাকন্তের সভাপতিত্বে ‘নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’ নামে ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয় এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার’ গানটি গেয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়।
১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর আসাম রাজ্যের সর্বত্র অসমিয়া ভাষা প্রয়োগের জন্য বিধানসভায় ভাষা বিল উত্থাপন ও পাস হয়। এভাবে আসমের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ লক্ষ লক্ষ বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে সরকারি ভাষা করার মৌলিক অধিকারের দাবি অগ্রাহ্য করা হয়। এ আইনের প্রতিবাদে বাংলা ভাষার সপক্ষ শক্তি আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। এই আইনের প্রতিবাদে পণ্ডিত রাজমোহন নাথের সভাপতিত্বে ১৮, ১৯, ও ২০ নভেম্বর শিলচরে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল সম্মেলন। সম্মেলনে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে বলা হয়, ‘যদি এ আইন করে বাংলা ভাষাকে অসমিয় ভাষার সমমর্যাদা দেয়া না হয়, তবে বাঙালি সমাজের মৌলিক অধিকার ও মাতৃভাষা রক্ষার্থে আসামের বাংলা ভাষা-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর বৃহত্তর আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া অপরিহার্য হয়ে পড়বে।’ পরে শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে সরকারকে চরমপত্র দেওয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৬১ সালের ১৯ মে থেকে সমগ্র কাছাড়ে বাংলাকে সরকারি ভাষা করার দাবিতে অহিংস অসহযোগ গণআন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে। পূর্ব সিদ্ধান্তমতো ১৯৬১ সালের ১৮ মে রাত ১২টার পর থেকে প্রায় ১০ হাজার তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ শিলচর রেলস্টেশনে অহিংস অবস্থান ধর্মঘট করার জন্য সমবেত হতে থাকেন।
অবশেষে আসে ১৯ মে। শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। উত্তেজিত জনতার প্রতিরোধ সরকারের বাহিনী ট্রেন চালাতে ব্যর্থ হন। ১৯ মে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পুলিশ এঁদের অনেককেই গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। দফায় দফায় লঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে, বেলা আড়াইটার দিকে রেলস্টেশনে কর্তব্যরত বিএসএফের সদস্যরা হঠাৎ গেরিলা-ভঙ্গিতে গুলিবর্ষণ আরম্ভ করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ শহিদ হন নয়জন। তাঁরা হলেন— সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হিতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র পাল, কমলা ভট্টাচার্য ও কানাই নিয়োগী। পরদিন স্টেশনের পাশের পুকুর থেকে সত্যেন্দ্রকুমার দেবের বুলেট বিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়। রাতে হাসপাতালে মারা যান বীরেন্দ্র সূত্রধর। মোট ভাষাশহিদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১। গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে। কিন্তু এতেও ক্ষান্ত হননি আন্দোলনকারীরা। তাঁদের রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ওই অঞ্চলের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রশাসনিক স্বীকৃতি দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হন। ১১ জন ভাষাশহিদের রক্তের বিনিময়ে অবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রদত্ত সূত্রের ওপর ভিত্তি করে গৃহীত সংশোধনী আইনে কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়। এভাবেই আসাম রাজ্যে ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে এবং বাংলা ভাষা বিধানসভায় স্বীকৃতি পায়।
খুব সহজভাবে বললে, যে ভাষা আমরা জন্মসূত্রে বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাই, যে ভাষায় আমাদের প্রথম মা বুলি ফোটে, তাই আমাদের মাতৃভাষা। আর এই মাতৃভাষার জন্য আজও ১৯-এ মে-র চিরজাগরূক লড়াই। মাতৃভাষা বাংলার অস্তিত্বরক্ষার দাবিতে শিলচর রেলস্টেশনেই ভাষার বেদিমূলে আত্মহুতি দিয়েছিলেন একাদশ শহিদ বোন-ভাইয়েরা। যে কারণেই শহিদদের সম্মানার্থে শিলচর রেলস্টেশনের নাম ‘ভাষা শহিদ স্টেশন শিলচর’ রাখার দাবিতে বিগত কয়েক বছর ধরেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও রেলমন্ত্রককে আবেদন-নিবেদন করা হয়ে আসছে। ‘ভাষা শহিদ স্টেশন স্মরণ সমিতি’-র সাধারণ সম্পাদক ড. রাজীব করের কথায় জানতে পারি, ‘২০১৬ সালে ভারত সরকার নাম পরিবর্তনের অনুমোদন দিলেও, আসাম সরকার এখনও পর্যন্ত নাম পরিবর্তন করেনি।’
আসামে বাঙালি জাতিসত্তার এই সংকট-মুহূর্তে, বাঙালি পরিচয়ের ঘোর দুর্দিনে একমাত্র উনিশের চেতনাই আপামর বাঙালিকে সকল অমঙ্গলের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।