শুরুতে রক্ত নিয়ে দু-চার কথা বলে নিতে চাই! রক্ত, ইংরেজিতে যা ব্লাড, এই দুটি শব্দের সঙ্গে রয়েছে আমাদের সকলের পরিচয়। এমন কেউ নেই, যিনি শোনেননি রক্তের কথা। শুধু কী রক্ত? ‘হিমোগ্লোবিন’ (heamoglobin)-এর কথাটিও প্রায় সকলেরই শোনা। ব্লাড-টেস্ট বা রক্তপরীক্ষা করানোর সময়, ‘হিমোগ্লোব্লিন’ কত আছে, কম না বেশি— এসব কথা তো হামেশাই বলতে হয় আমাদের। তাছাড়া, হিমোগ্লোব্লিন–এর জন্যেই যে আমাদের রক্তের লাল রং— সেকথা তো আমরা স্কুলের বইয়েই পড়েছি। ‘হিম’ আর ‘গ্লোবিউলিন’ যুক্ত হয়ে হয় ‘হিমোগ্লোবিউলিন’। এই হিম শব্দটি গ্রিক haima থেকে এসেছে, যার মানে হল ‘রক্ত’। এই ‘হিম গ্রুপ’-এর মধ্যে থাকে ‘আয়রন’ বা লোহা। আর গ্লোবিউলিন হল বিশেষ এক ধরনের প্রোটিন। হিমোগ্লোব্লিন আসলে এক ধরনের প্রোটিন অণু, যা রক্তকোষের (রেড ব্লাড সেল বা RBC বা ইরিথ্রোসাইট) অন্তর্গত একটি অতীব প্রয়োজনীয় উপাদান। আমাদের দেহের মোট রক্তের আয়তনের প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ হল ‘রেড ব্লাড সেল’। এই রেড ব্লাড সেল আমাদের ‘বোনম্যারো’-র মধ্যে স্টেমসেল-এ নিরন্তর তৈরি হয়ে চলেছে। সেকেন্ডে প্রায় ২০ থেকে ৩০ লক্ষ রেড ব্লাড সেল তৈরি হয়ে থাকে!

আমাদের শরীরে ঠিক কী কাজ এই হিমোগ্লোবিনের? সাধারণভাবে দু-এক কথায় তা জানার চেষ্টা করব।
ব্লাড আর ব্রিদিং (শ্বাস-প্রশ্বাস)— এই দুটি শব্দের সম্পর্কও খুব কাছের। বস্তুত, হিমোগ্লোবিনের প্রধান কাজ হল, ফুসফুসের মাধ্যমে অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যাওয়া (ট্রান্সপোর্ট) এবং সেই সঙ্গে রক্তকোষের মাধ্যমে তা আমাদের শরীরের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে (টিস্যু) পৌঁছে দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ। হিমোগ্লোবিন একদিকে আমাদের শরীরের কোষে কোষে যেমন অক্সিজেন এবং নিউট্রিয়েন্টস সরবরাহের কাজ করে, পাশাপাশি দূষিত বা বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড সহ অ্যামোনিয়া ও অন্যান্য বর্জ্যকে বের করে দেওয়ার যে কাজ, তা রক্তের মধ্যেকার এই হিমোগ্লোবিন-ই করে। হিমোগ্লোবিনের মতো রক্তের মধ্যে আরও অসংখ্য উপাদান রয়েছে, তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব কাজ রয়েছে। প্রত্যেকটি উপাদানের গুরুত্বও অপরিসীম। সে সব প্রসঙ্গে এখানে আমরা ঢুকতে চাই না। আমরা এখানে শুধু রক্তের হিমোগ্লোবিন অণুর কথাতেই থাকব।

আমাদের শরীরে অক্সিজেন সরবরাহকারী হিমোগ্লোবিন নামের গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রোটিনের অস্তিত্ব জানা গিয়েছিল ১৮৪০ সালেই। কিন্তু শুধু অস্তিত্ত্ব জানতে পারা এক জিনিস, আর তা কেমনভাবে কাজ করে থাকে তা জানা আর-একটা দিক। কেমনভাবে কাজ করে সেই অনুপুঙ্খ মেকানিজম, জানার আগে হিমোগ্লোবিনের আণবিক গঠন কেমন, তা জানা জরুরি। আণবিক গঠন জানা থাকলে, সংশ্লিষ্ট অণুগুলি কেমন করে কাজ করে তা বোঝা যায়। আর এই বোঝার মধ্যে দিয়ে জীবনের রহস্য অনুধাবনের কাজ অনেকখানি সহজ হয়। এখানে একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই, ১৯৫০-এর প্রথম দিকেও হিমোগ্লোবিনের আণবিক গঠন জানা ছিল না।

যে বিজ্ঞানী রক্তের হিমোগ্লোবিন অণুর গঠন সংক্রান্ত গবেষণায় সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তাঁর নাম ম্যাক্স ফার্দিনান্দ পেরুৎজ (Max Ferdinand Perutz, ১৯১৪-২০০২)। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা-তে জন্মানো এই ব্রিটিশ মলিক্যুলার বায়োলজিস্ট-ই, রক্তের হিমোগ্লোবিন অণুর গঠন জানার যুগান্তকারী কাজে সফল হন। তিনি তখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করছেন, সেখানেই হিমোগ্লোবিলিনের ত্রিমাত্রিক আণবিক গঠন জানতে পারেন। এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি-র সাহায্যে ১৯৫৯ সালে আবিষ্কৃত হয় এই কাজ। একই সঙ্গে মায়োগ্লোবিন নামক আর-একটি প্রোটিনের গঠনও আবিষ্কৃত হয়েছে।

কেমন ছিল পেরুৎজের ছেলেবেলা?
পেরুৎজের বাবা-মা দুজনের পরিবারই বয়নশিল্প উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যান্ত্রিক সুতাকল (স্পিনিং মিল) আমদানি এবং অস্ট্রিয়ান রাজাদের বস্ত্রবয়নের কাজে যুক্ত হতে পারায় তাঁদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছিল। তাঁরা ভাল স্কুলেই ভর্তি করালেন ছেলেকে। বাবা-মা চেয়েছিলেন ছেলে আইন পড়ে আইনজ্ঞ হয়ে তাঁদের পরিবারের ব্যবসা সামলাক। তবে একজন বিচক্ষণ স্কুলশিক্ষক কেমিস্ট্রিতে পেরুৎজের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেন। ভাগ্যিস তা করেছিলেন। সেই শিক্ষকই পেরুৎজের বাবা-মাকে বোঝান যে, পেরুৎজের কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়া উচিত। ওতেই পেরুৎজের আগ্রহ বেশি।
ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হলেন পেরুৎজ। জৈব রসায়ন বিশেষত প্রাণ রসায়নের কোর্সে তাঁর কৌতূহল আর আগ্রহ বাড়তে লাগল। তখনই তিনি ঠিক করে নিলেন যে, কেমব্রিজে পিএইচ ডি-র গবেষণা করবেন। এরপর কেমব্রিজে ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে কমিউনিস্ট আদর্শবাদী চিন্তক এবং কিংবদন্তি বিজ্ঞানী জে ডি বার্নলের তত্ত্বাবধানে গবেষণার সুযোগ পেলেন।

হিটলার যখন অস্ট্রিয়া এবং চেকস্লোভেকিয়া আক্রমণ করেন সেসময় পেরুৎজের বাবা-মায়ের পারিবারিক ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যায় এবং তাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে পড়েন। পরিবার থেকে যে অর্থসাহায্য আসত তা বন্ধ হয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে সেই সময় স্যার উইলিয়াম ল্যরেন্স ব্রাগের অধীনে রকেফেলার ফাউন্ডেশনের অর্থানুকূল্যে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিযুক্ত হন পেরুৎজ। একদিকে জন্মসূত্রে ইহুদি এবং অন্যদিকে ভিনদেশি পেরুৎজের কেমব্রিজের অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর ছিল না। তবে এইসময় লরেন্স ব্রাগ পরমাত্মীয়ের মতো পেরুৎজের পরিবারের পাশেও দাঁড়িয়েছিলেন। তখন আবার শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এসব নানা কারণে বেশ কয়েকবার অনুদান আসা বন্ধ হয়ে পড়ে। এইসব প্রতিকূলতার মধ্যেই ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ অবধি কাটে। এরপরে ইম্পেরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের ফেলোশিপ পেলেন পেরুৎজ।
পেরুৎজ হিমোগ্লোবিন অণুর গঠন জানার গবেষণা শুরু করেছিলেন ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে থাকাকালীন। পরে বার্নলের ল্যাবরেটরিতে আসার পরে সেখানে এক্স-রে আলোকচিত্র তোলার পদ্ধতি এবং সেই ছবি থেকে কীভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে হয়, তাও শিখলেন। এইসময় হিমোগ্লোবিন এবং কাইমোট্রিপসিন অণুর ক্রিস্টালের এক্স-রে ডিফ্রাকশন সংক্রান্ত তাঁর কাজ সুবিখ্যাত নেচার গবেষণাপত্রে [Nature, 141 (1938) 523] প্রকাশিত হয়।
হিমোগ্লোবিনের আণবিক গঠন জানতে তাঁর লেগেছে বাইশ বছর। বুঝতে অসুবিধা হয় না কত কঠিন আর নিরলস সাধনার শেষে এরকম একটি আবিষ্কার সম্ভব। আর এই যাত্রাপথের মাঝখানে কত ভুল ফলাফল, ভুল ব্যাখ্যা, ভুল সিদ্ধান্তের অভিজ্ঞতার শেষে ১৯৫৯ সালে এসেছিল কাঙ্ক্ষিত ফল।

পেরুৎজের কাজ একদিকে প্রোটিন কেমিস্ট্রি অন্যদিকে এক্স-রে ক্রিস্টাল ডিফ্রাকশন— বায়োলজি এবং ফিজিক্সের মধ্যবর্তী যে ফাঁক, তা ভরাট করতে সাহায্য করেছে। এইভাবেই, প্রথম বায়োলজিক্যাল অণুর ত্রিমাত্রিক গঠন জানা সম্ভব হয়েছে পেরুৎজ-এর হাত ধরে। প্রোটিন কেমিস্ট্রি গবেষণায় তথা আণবিক জীববিদ্যায় তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কার নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। সেই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬২ সালে রসায়ন বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান পেরুৎজ। পেরুৎজের সঙ্গে নোবেল পুরস্কার পান তাঁর সহযোগী গবেষক ব্রিটিশ বায়োকেমিস্ট জন কেন্ড্রু-ও (John C. Kendrew)। প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক আণবিক গঠন আবিষ্কারের ফলেই পরবর্তী সময়ে প্রোটিনের একাধিক কার্যকারিতা জানা সম্ভব হয়েছে। নোবেল বক্তৃতায় পেরুৎজ বলেন: “I think we pushed knowledge of living matter down to the atomic level and this enormously increased our depths of understanding of the nature of life.”
শুধু বিজ্ঞান-গবেষকই নন, তিনি ছিলেন একজন নির্ভীক পর্বতারোহী। এছাড়াও বলতে হয় তাঁর সাহিত্যচর্চার কথাও। লিখেছেন অসাধারণ প্রাঞ্জল ভাষায় কয়েকটি বই। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বইয়ের নাম— ‘‘I Wish I’d Made You Angry Earlier’’, ‘Is Science Necessary?’, ‘Science is not a Quite Life’ ইত্যাদি। ‘আণবিক জীববিদ্যার জনক’ হিসেবে মান্যতা পেয়েছেন পেরুৎজ। ১৯ মে ম্যাক্স ফার্দিনান্দ পেরুৎজের জন্মদিন। এই কিংবদন্তি বিজ্ঞানীকে আমাদের শ্রদ্ধা।
Excellent article!!
Thank you Sanjit
অনবদ্য! নমস্য ব্যক্তি! এই বিজ্ঞানীদের হাত ধরেই কত অজানা তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে, যার সুফল পাচ্ছে সারা পৃথিবী। 🙏🙏🙏🌹🌹🌹আপনার লেখা পড়ে কত অজানা তথ্য জানতে পেরে সমৃদ্ধ হচ্ছি! অশেষ ধন্যবাদ!
কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ ও সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাই।