জারজ তুমি প্রতিমা
আমার এই মৃগয়াবেশ, এরূপ রণসজ্জা
কেন তা তুমি জানো না অলি, অথচ ধীরেসুস্থে
মরাল গ্রীবা আনত করো, যদি বা তাতে খুঁজতে
কিছুটা গাঢ় শলাকাছাপ, ধোঁয়ানো বনভূমিতে
নিহত কারো ময়াল দেহ, ভয়াল ক্রূর শয্যা
নির্লিপ্ত জড়ানো পড়ে, পুরোনো কালে স্বর্গে
যেভাবে কোনো অশ্বমেধে ধারালো ধাতু খড়্গে
দেহচ্যুত দীপ্তি স্রোত উজান বয়ে মিশত
ততটা শুভাকাঙ্ক্ষী তুমি, নিভনো শিখা ধুনিতে
ঝরনা হয়ে সারাটি বেলা কেবল পরিশিষ্ট
তামাটে খর রৌদ্রদাহে, রশ্মিতেজে দহনে
শিকারী মুখে বিধুরছায়া, মোহিনী এই নগরী
নিবিড় করে বিছোনো জালে, মৃগয়া তার গহনে
ঝলকে বাজে বেদনা ছুঁয়ে, বিশাল তার গতি, মা
নিমেষে বাঁধে শিশুকে এক ধূসর শৃঙ্খলিত
মমতা প্রীতি মৃগয়া স্নেহে, যাতে সে যাবে স্খলিত
চরণে, ভীরু শিথিল ক্ষেপে, নম্র এক জোছনা
ছড়ালে অলি মৃগয়াকালে, শিকারী তার ধনুকে
দেখেছে শুধু কুয়াশা মিহি, না করে অনুশোচনা
তোমাকে কেন আঘাতে ঋজু, জারজ তুমি প্রতিমা!
*
সাবধান তো করোনি তাকে
দিদিমা বুড়ি পানের রসে রাঙিয়ে নিয়ে ঠোঁট
রোজ সন্ধেয় সেই যে কত বলতে রূপকথা
দত্যিদানো রাজপুত্র সেসব কথকতা
কোথায় কবে ফুরিয়ে গেছে, গায়ে ওভারকোট
চাপিয়ে রাজার পুত্তুর তো ভর দুপ্পুরবেলা
ভূতের ঢেলা খেয়ে শিবের মত ত্রিনয়নে
ভস্মটুকু ছড়িয়ে নিল, বহ্নিটুকু জানো
বরফচাপা, রাজকন্যা ঘুমের ঘোরে ঢুলে
স্বপ্ন দেখে কবে যে সেই গোধূলিটুকু ম্লান
আসবে এই হিম পেরিয়ে, তার তো সন্ধানও
ছিল না জানা লক্ষ্মীছাড়ির, শুধু শুধুই চুলে
গুঁজলো কত ফুলের গোছা, মুখ্যু বোকা মেয়ে
জানত না তো ওদিকে কেউ প্রদীপ ঘষে ঘষে
শূন্যে তুলে জ্বরের ঘোরে মিথ্যে কী সব বকে
একরাজ্যি শাপশাপান্তে ধুঁয়োর থেকে কত
শতশত মূর্তি গড়ে বাজের মত স্বরে
বলল ‘এবার ছড়িয়ে পড়ো, ছড়াও অবিরত
সব দুয়ারে, সব আঙিনায়, সবার ঘরে ঘরে’
কোথার থেকে হতচ্ছাড়া আপদগুলো যত
খুলছে খিল গারদঘরের, রাজকন্যে নেয়ে
ধুয়ে উঠে চুল ছড়িয়ে টেলিফোনের পরে
হেলান দিয়ে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে শেষে কাদা
সাবধান তো করোনি তাকে, তুমি একটা যা-তা।
*
সে নৌকো আজ সাতনরী ডিঙা
‘তীব্র গতিতে নীলাঞ্জনার শাড়ির আঁচলে মেঘ’
একটি লাইন লিখেছি মাত্র, হঠাৎ গর্জে ওঠো,
অলীক ওসব রূপকথা ছাড়ো, অসহ্য গতিবেগ
স্পিডোমিটারের কাঁটা মাপে শুধু, ঘরের দুয়ারে ছোট
শিশির বিন্দু কেঁপেছে বাতাসে, যেই নিতে যাব চোখে
অমনি বজ্রপাতের শব্দে কাঁপিয়ে সারাটি ঘর
বেজে ওঠে কারো গম্ভীর স্বর, কী বলবে বলো লোকে
শ্মশানে নিষেধ জলের প্রবেশ, রূপকথাগুলো জ্বর
দগ্ধ শরীরে উঁকিঝুঁকি দেয়, হারানো ছোট্ট নীল
পাখিটা এভাবে আসবে যে ফিরে কখনো ভাবিনি আগে,
কোথা দিয়ে এল লোহার দুর্গে, কে যে খুলে দিল খিল
বুঝতে পারি না, বিপথে ভুলিয়ে ঝুটঝামেলায় পাকে
চক্রে বন্দি যদি করে দেয়, রূপকথাগুলো যত
মিথ্যেয় ভরা আমি তো জেনেছি, (বিজ্ঞানও তাই বলে)
জলার আলেয়া ফালতু গল্প, তবু কেন অবিরত
হিম বৃষ্টিতে পপলার গাছে রাজকন্যার শ্বেত
মুখের আদল, রোদ্দুরে মোড়া হিমের নগরী ছলে
মাথায় পরেছে রশ্মিমুকুট, কিশোরী কৌতূহলে
নিষ্পাপ চোখে ভাসাভাসা চায়, দত্যিদানব প্রেত
শিশুর খেলনা নৌকোর কাছে নত মস্তক রাখে
সে নৌকো আজ সাতনরী ডিঙা, অনুকূল বাতাসের
স্পর্শে মাতাল, সুন্দরী রাজকুমারীও এই ফাঁকে
জাহাজে উঠেই, নীলাঞ্জনাটি, রূপকথাতে কি ছেদ
পড়েছে কখনো, খিড়কির পথে ঘরে ঢুকে আসে ফের।
আহা! কী অসাধারণ তিনটি কবিতা উপহার পেলাম। ধন্যবাদ ভালভাষা, কবিকেও অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। মনের গোপনে কবি তাঁর কবিতার জন্য এমন অনুকরণীয় ভাষাভঙ্গী ও ছন্দের চলন বাঁচিয়ে রেখেছেন; বর্ষীয়ান এই কবি তাই আজও এমন সতেজ সুন্দর সাবলীল