তাঁর আসল নাম মীর নিসার আলি। কিন্তু সকলে তাঁকে তিতু মীর নামে জানেন। এই নামেই তিনি দেশবাসী ও বিদেশিদের কাছে খ্যাত হয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি অসমসাহসী বীরের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি নিজ ক্ষুদ্র শক্তির কথা না ভেবে প্রাণপণে প্রবল প্রতাপশালী অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে একটুও পিছপা হননি। আমাদের দেশে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে এবং দেশের দরিদ্র কৃষক-তাঁতি প্রভৃতি শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষজনেরা শাসকের জুলুম-অত্যাচারে অসহায় জীবনযাপন করছেন। অতিশয় দুঃখের বিষয় হল, তাদের সেইপ্রকার অত্যাচার-কর্মে প্রধান সহায়ক হয়ে উঠেছিল আমাদেরই দেশের ধনীজনেরা ও জমিদারবর্গ। দেশের ধনী শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তি ও জমিদার মিলে নিজের দেশের অসহায়, নিপীড়িত দেশবাসীর ওপর বিদেশি শাসকদের অন্যায়-নিপীড়নকে সর্বশক্তি দিয়ে বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিল। তিতু মীর গ্রামের এক সামান্য কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও এইপ্রকার অপরাধ-কাণ্ড মেনে নিতে পারেননি। তিনি আর কীই বা করতে পারেন প্রবল শক্তিধর শাসক ও তাদের জোরালো সমর্থক দেশশত্রুদের বিরুদ্ধে— এমনটি ভেবে নিশ্চুপ দর্শক হয়ে থাকতে পারেননি। আর সেভাবেই তিনি বিরাট মাপের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
তাঁর ব্যক্তিজীবনের কথা একটু জেনে নেওয়া যাক। তিনি ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়া থানার অন্তর্ভুক্ত হায়দরপুর নামক একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা ও বাবার নাম যথাক্রমে আবেদা রোকেয়া খাতুন ও হাসান আলি। এই দম্পতির দুই পুত্র ও দুই কন্যাসন্তান ছিল। তিতু মীর বাদুড়িয়া থানার অন্তর্গত খালপুর গ্রামের এক কন্যাকে বিয়ে করেন। তাঁর নাম মায়মুনা খাতুন সিদ্দিকা। তাঁদের তিন পুত্রসন্তানের নাম হল— জওহর আলি, তোরাব আলি ও গওহর আলি। তিতু কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে চাষের কাজে ছোট বয়স থেকে অভ্যস্ত হওয়ার ফলে সুঠাম দেহ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হন। তিনি বিদ্যার্জনের সুযোগ সেভাবে না পেলেও আঠারো বছর বয়সে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত পরীক্ষায় পাশ করেন। তিনি শরীর-চর্চা বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে কলকাতায় থেকে কুস্তি-শিক্ষা লাভ করে কুস্তিগীর পালোয়ান হয়ে ওঠেন। তিনি এরপর এক জমিদারের অধীনে চাকরি নিয়ে অন্য জমিদারের বিরুদ্ধে মারামারি করার জন্য কারাবন্দি হন এবং কারামুক্ত হওয়ার পর সে চাকরি ছেড়ে দেন।
১৮২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মক্কায় যান এবং ফিরে আসেন ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে নিজগ্রামে। এই সময়ে তিতুর জীবনধারায় বদল ঘটে। কুস্তিগীর তিতু ধর্মভাবে অনুপ্রাণিত এক ভিন্ন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তিনি শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি অবলম্বন করে ধর্ম-সংস্কারকরূপে কিছু নির্দেশাবলি গ্রামবাসীদের দেন। পীর বা ধর্মগুরু না মানা, টাকা ধার দিয়ে সুদ না নেওয়া, কাছা দিয়ে কাপড় না পরা, কোনও পর্ব-পালন বা বিয়ে ইত্যাদি উৎসবে বাজনা না বাজানো, দাড়ি রাখা ইত্যাদি মত তিনি প্রচার করেন। এর কারণে তিনি কিছু মুসলমান গ্রামবাসীর কাছে যেমন প্রিয় মানুষ হয়ে ওঠেন, তেমন সুবিধাভোগী ধনবানদের কাছে তিনি শত্রু বলে গণ্য হন। জমিদাররা সেই ক্রোধে উসকানি দিয়ে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ধনী ব্যক্তিদের সহায়তা পেয়ে তিতুর প্রবল শত্রুপক্ষ হয়ে ওঠে। কৃষ্ণদেব রায় নামক এক জমিদার এক অদ্ভুত নির্দেশ জারি করল মুসলমান প্রজাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। সে প্রতি ব্যক্তির জন্য দাড়ি-প্রতি আড়াই টাকা কর জারি করে দিল এবং কর না দিলে শাস্তি পেতে হবে তাও প্রচার করল। তিতু মীর এই ব্যবস্থা না মানার জন্য গ্রামবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করে বিদ্রোহের সূচনা করেন। বঞ্চিত শ্রেণির দরিদ্র মানুষদের ওপর যে সমস্ত জমিদারি জোর-জুলুম-অত্যাচার চলছিল সেই সময়ে, তিতু সেসবের বিরুদ্ধে তাঁর সমর্থকদের নিয়ে, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করলেন। বিদ্রোহ দানা বাঁধল তাঁর নেতৃত্বে অত্যাচারিত গ্রামবাসীর পক্ষে এবং অত্যাচারী জমিদার ও ধনী দেশবাসীর বিপক্ষে। গ্রামবাসীদের বিক্ষোভ জোরালো হয়ে ওঠে। অন্যদিকে অত্যাচারী পক্ষও আক্রমণ শানিয়ে তোলে তিতুর সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। বিরোধীপক্ষ তিতু মীরকে দমন করার হীন কৌশল অবলম্বন করে তাঁর বিদ্রোহকে খর্ব করার জন্য তাঁর প্রচেষ্টাকে সাম্প্রদায়িক আন্দোলন বলে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে।
তিতু মীর প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত আরও নানাপ্রকার মিথ্যে অভিযোগের মোকাবিলায় আইনের সাহায্য গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি। অতঃপর কোনওভাবেই সোজা পথে অত্যাচারীবর্গ তাঁদের ন্যায্য অধিকার মানবে না বুঝে নিয়ে তাঁকে আক্রমণের পন্থাই শেষে অবলম্বন করতে হয়েছিল। প্রতিপক্ষ অর্থবান ও প্রবল ক্ষমতাধর ব্রিটিশ শাসক তাদের মদতদাতা। অন্যদিকে তিতু মীরের সমর্থক বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই কেবল দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ও তীব্র মনোবলকে সম্বল করেই লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়। জমিদার-ব্রিটিশ শাসক এবং সেসময়ে গ্রামবাসীদের ওপর নীলকর নামক একপ্রকারের কর চাপায় যে অত্যাচারী গোষ্ঠী— এই তিন গোষ্ঠী মিলে তিতু মীরকে পিছু হঠতে বাধ্য করতে চাইল। ব্রিটিশ সরকার তিতু মীরের সমস্ত শক্তি খর্ব করার জন্য এরপর এগিয়ে এল। তিতুর লড়াই জোর আক্রমণের মুখোমুখি হয়েও হাল ছাড়বার নয়। দেশীয় তির-ধনুক, লাঠি, বর্শা ইত্যাদি নিয়ে লড়াইয়ে জেতা সম্ভব নয় বুঝে অভিনব এক কেল্লা তৈরির কথা ভাবলেন তিনি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ‘বাঁশের কেল্লা’ তৈরি করলেন তিনি। মনে আশা, সেই কেল্লা দিয়েই তিনি শাসকপক্ষকে পরাস্ত করবেন লড়াই জারি হলে।
লড়াই হল। ভয়ংকর লড়াই। শাসকের কামানের গোলা একদিকে, অন্যদিকে বীর তিতু মীরের সাধের বাঁশের কেল্লা। অসম সেই লড়াইয়ে তিতু দমে যাওয়ার কথা ভুলে অমিতপরাক্রমে দেড় ঘণ্টা ধরে তাঁর জিদ বজায় রাখতে পেরেছিলেন দেশ-মায়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার ওপর ভর করে। তারিখটি ছিল ১৮৩১ সালের নভেম্বর ১৯। সেদিনটি ছিল স্বদেশপ্রেমের এক অভূতপূর্ব নিদর্শনের দিন। তিতু শহিদ হন। তাঁর সহযোগী পঞ্চাশজন যোদ্ধা নিহত হন। আহত হন বহু কৃষক-যোদ্ধা। তিনশো পঞ্চাশজনকে বন্দি করা হয় এবং একশো সাতানব্বই জনকে কাঠগড়ায় তোলা হয় বিচারের জন্য। তিতুর প্রধান সহযোগী গোলাম মাসুমকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এই দিনটি তাই স্বর্ণাক্ষরে উজ্জ্বল লেখা হয়ে থাকার কথা ইতিহাসের পৃষ্ঠায়! পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার জন্য এমন আত্মবলিদানের নমুনা সারা পৃথিবীতেই বিরল ঘটনা। তবে, আক্ষেপের বিষয় হল, তিতু মীর আজও একটি উপেক্ষিত নাম। তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে কলঙ্কিত করার ব্রিটিশ শাসক-প্রচেষ্টা যেন আজও কোথাও দাগ রেখে গেছে! সে কারণেই হয়তো পরাধীনতা থেকে দেশ-মুক্তি ঘটানোর লড়াইয়ে প্রথম শহিদ তিতু মীর— এমন দাবি ওঠা সত্ত্বেও সে মর্যাদা প্রাপ্তি তাঁর নির্ভীক প্রাণদানেও ঘটেনি!
তাতে কী আসে যায়। তাঁর অভিনব আবিষ্কার ‘বাঁশের কেল্লা’ অসম-সাহসিকতার প্রতীক হয়ে তাঁকে অমর করে দিয়েছে। দেশপ্রেমিক দেশবাসীরা তাঁকে ভোলেননি। ভোলেননি বাঁশের কেল্লার লড়াইস্থল নারকেলবেড়িয়া এবং তাঁর জন্মস্থান হায়দরপুরের গ্রামবাসীরা। প্রতিবছর তাঁকে স্মরণ করে আটঘরা ‘বিকাশ কেন্দ্র’ ও নারকেলবেড়িয়ার ‘শহীদ তিতুমীর মিশন’।
আসল কথা হল, নিঃস্বার্থ-নির্ভীক আত্মবলিদান কখনও বৃথা হওয়ার নয়!
তথ্যঋণ: বাদুড়িয়ার সেকাল একাল — প্রথম খণ্ড, অসিতবরণ হালদার (প্রধান সম্পাদক); অক্টোবর ২০০২। নিবন্ধ লেখক: অশোক চট্টোপাধ্যায়
তিতুমীর চর্চার জন্য অভিনন্দন ও অভিবাদন। দিদি, আপনাকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।