উঠেই জানলার ধারে একটা সিট পেয়ে বসে পড়েছি। যাব সোনারপুর। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়বে। প্লাটফর্মের ভিড় থেকে হন্তদন্ত হয়ে একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কি লক্ষ্মী?’
কিছু বুঝতে না পেরে আমি পাশের সহযাত্রীর দিকে তাকিয়েছি। তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ।’
পরে তিনিই আমাকে বোঝালেন, ‘উনি জানতে চাইছেন, এটা কি লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল?’
এতবড় নাম আর কে বলে! লক্ষ্মীকান্তপুরের লক্ষ্মীই যথেষ্ট। শিয়ালদা সাউথে ডায়মন্ড হারবার তাই ডায়মন্ড-এই সীমায়িত। কে জানে, এমন আরও কত মিনি নাম আছে। পোশাকি নাম থেকে উদ্ভূত এ কোনও স্বতন্ত্র নাম নয়। এ নেহাতই পোশাকি নামের সংক্ষিপ্ত রূপ। পোশাকি নাম থেকে যেমন তৈরি হয় ডাকনাম— রবি হয় রবে, শিবরাম থেকে শিবে কিংবা বিশ্বনাথ থেকে বিশে বা বিশু, জায়গার নামেও ডাকনামে বলার রেওয়াজ ভূরি ভূরি আছে। সেখানে চালতাবেড়িয়া হয় চালতাবেড়ে, চাকদহ হয় চাকদা, নদীয়া হয় নদে, আবার চুঁচুড়া হয় চুঁচড়ো।
চুঁচুড়া নামটা আসতেই গৌরদার কথা মনে পড়ে গেল। আমাদের সহকর্মী গৌরদা বলত, চুঁজরো। চাইলেও চুঁচুড়া বা চুঁচড়ো বলতে পারত না। গৌরদা বলত, ‘চাগরির জন্যে পাঁজ বছর ধরে সাঁদরাগাছি থেকে কাঁজরাপাড়া ডেলি প্যাসেঞ্জারি করিচি, ভাবতে পারো!’
সত্যিই আমরা ভাবতে পারতাম না। সাঁতরাগাছি থেকে কাঁচরাপাড়া অব্দি পাঁচ বছর ধরে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছে চাকরিসূত্রে— এই বাক্য পরিবেশনের এহেন রূপ ভাবতে পারাও বেশ কঠিন।
গৌরদার কথা থাক। আমরা যারা গৌরদার উচ্চারণ নিয়ে হাসাহাসি করতাম, তারাই কি স্মার্টনেস দেখানোর অছিলায় কম ভুল করি! এস্টেটকে বলি স্টেট, এসপ্ল্যানেড বলি না, পাছে কেউ গাঁইয়া ভাবে। আহা, কী যে শহুরে বাহাদুরি!
নামটা হায়দ্রাবাদ নয়, হায়দরাবাদ— বলেছিলেন ইতিহাসের শিক্ষক সুরেন স্যার। বুঝিয়েছিলেন, আবাদ মানে বসতি। কোনও একজনের নাম জুড়ে আছে অনেক বসতি বা আবাদের সঙ্গে। মুর্শিদাবাদের সঙ্গে যেমন মুর্শিদ, ফিরোজাবাদের সঙ্গে যেমন ফিরোজ, জাহানারাবাদের সঙ্গে তেমনই জাহানারা নাম। সুরেন স্যারের কাছেই প্রথম শুনেছিলাম ইসলামাবাদ এবং এলাহাবাদে জড়িয়ে আছে ইসলাম ও আল্লাহ্। ইসলামাবাদের ইসলাম বোঝা গেল কিন্তু এলাহাবাদে আল্লাহ কোথায়! এ নিয়ে জানতে চাওয়ায় ওনার সেদিনের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যাটি আজও মনে আছে। বলেছিলেন, ভগবানপুরের মত এলাহাবাদ নামকরণের ব্যাখ্যাও একইরকম। ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে বোঝালেন, ভগবানপুর = ভগবান + পুর, একইভাবে Allahabad = Allah + Abad. সত্যি-মিথ্যে জানি না। সেই কবে নাইনের ইতিহাস ক্লাসে সুরেন স্যার বলেছিলেন। তবে শেষকথা কিন্তু বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন।
ওগুলো পড়াশুনোর কথা। ভাল লাগার কথা নয়। তাছাড়া এলাহাবাদই হোক অথবা ইসলামাবাদ, সে অনেক দূরের কথাও। বরং আমাদের আশপাশের জায়গাগুলোর নাম নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। একটা জায়গা, তার একটা নাম। কোন কালে গঞ্জ ছিল, আজ সে প্রেসটিজিয়াস শহর। তাতে কী! বালিগঞ্জ টালিগঞ্জে কিন্তু সেই গঞ্জ আজও টিকে আছে নামে। নবাবগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ রাণীগঞ্জ তুফানগঞ্জ রায়গঞ্জ স্বরূপগঞ্জ এরাও নামমাহাত্ম্যে একই সারিভুক্ত। শুধু কি গঞ্জ! শহর নেই? কাছেই আছে হালিশহর। প্রাচীন নাম হালিসহর। নগরও আছে। অশোকনগর কৃষ্ণনগর শ্যামনগর দুর্গানগর জয়নগর ঠাকুরনগর কয়েকটা উদাহরণ মাত্র। পুকুর বুজিয়ে দেদার প্রোমোটিং হচ্ছে যেখানে শহর ও শহরতলি জুড়ে, তখন কলকাতার বুকেই মুরারিপুকুর, মনোহরপুকুর, পদ্মপুকুর, ঝামাপুকুর অথবা দত্তপুকুর নামগুলিতেই অনেক স্বস্তি পাওয়া যায়।
আমাদের নামের সঙ্গে নাথ, চন্দ্র, কান্ত, কুমার যেমন অলঙ্কারের মত সেঁটে থাকে, জায়গার নামেও সেরকম পুর বেড়িয়া গাছি দহ এক-একটি অলঙ্কার। আলিপুর ভবানীপুর শিবপুর দুর্গাপুর জঙ্গীপুর কাশীপুর বহরমপুর মছলন্দপুর উলুবেড়িয়া ফুলবেড়িয়া সামতাবেড়িয়া কচুবেড়িয়া সাতগাছি বামনগাছি সোনাগাছি সাঁতরাগাছি মালদহ চাকদহ মাকড়দহ শিয়ালদহ এমন অজস্র নাম খুঁজে পেতে বেশি দূর যেতে হবে না। হাট-হাটা-হাটিতে মাঝেরহাট বানারহাট রাজারহাট দাঁইহাট আদহাটা চিংড়িহাটা গড়িয়াহাটা পানিহাটি রানিহাটি মীরহাটি। চক দিয়ে দেখুন— বালিচক মল্লিকচক মানিকচক রায়চক কল্যাণচক। ডাঙায় আসুন— গোবরডাঙা, আমডাঙা, রাজডাঙা, শিয়ালডাঙা পায়রাডাঙা ঘুঘুডাঙা উল্টোডাঙা… বোলপুর যাবার পথে তো তিনটি ঢাল পেরিয়ে যেতে হয়। রেল স্টেশনগুলির নাম যথাক্রমে নওদার ঢাল, পিচকুড়ির ঢাল আর ঝাপটের ঢাল। গুড়ি সহযোগে যা আছে সে সবই উত্তরে— শিলিগুড়ি ময়নাগুড়ি ধূপগুড়ি। দক্ষিণেও নেই সেই গ্যারান্টি কে দেবে?
বিচিত্র সব নাম। নামের সঙ্গে বিচিত্র সব গল্প। নামের নেপথ্যে কোনও কারণ থাকলেও থাকতে পারে, তা বলে সমস্ত জায়গার নামটির সুস্পষ্ট একটি অর্থ থাকবে তার কোনও মানে নেই। পটলের পাতাকে পলতা বলে। পলতা পাতার ঝোল পেটের রোগীর নাকি অব্যর্থ পথ্য। অনেকেই জানেন বারাকপুর লাগোয়া একটি রেলস্টেশনের নাম পলতা। কিন্তু ফলতা? সেটি কী? বেশ, ফলতার কথা বাদ দিলাম, দমদম ক্যান্টনমেন্টে একটি অঞ্চলের নাম নলতা, তার মানে? এইসব গলতাগুলোর লুকনো গল্পগুলি বোধকরি চিরদিনই অশ্রুত থেকে যাবে। দমদম বলতেই প্রশ্ন জাগল, কী মানে দমদম কিংবা বজবজ নামদুটির? অর্থহীন হোক, তবু মানা যায়, এই পশ্চিমবঙ্গেই কিছু জায়গা আছে যেগুলোর নাম নিয়ে সংকুচিত থাকে সেখানকার বাসিন্দারা। তেমন কিছু জায়গার নামবদলের প্রস্তাবও করা হয়েছে, অনেকেই জানেন। মাটিগাড়া বালি কাদাপাড়া।
বেশ কিছুদিন আগে বিবিসি বাংলার ফেসবুক পোস্ট থেকে একটি মজার নাম পাওয়া গেল— বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলার নীলফামারীতে একটি স্কুলের নাম ‘মানুষ-গড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। ভাবছেন এতে চমক কোথায়! আসলে এটি এখনকার পরিবর্তিত নাম। কয়েক বছর আগেও এই স্কুলের নাম ছিল ‘মানুষ-মারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। বিবিসির সূত্র ধরেই বাংলাদেশের এমন কিছু জায়গার নাম পাচ্ছি যা বেশ বিড়ম্বনার।
কয়েকটা বলি— নওগাঁর পত্নীতলা, রাঙ্গামাটির চুমাচুমি, ঝিনাইদহের চুলকানি বাজার, চাঁদপুরের ল্যাংটার হাট, পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা ইত্যাদি। এপারে এমন আজব নামও কি নেই? ওপারের ঢাকার ‘ভূতের গলি’ শুনে যদি হাসেন, এপারে বারাকপুরের ‘গাঁজা গলি’ শুনে কী বলবেন? ঠনঠনিয়া কোনও জায়গার নাম হতে পারে এপার-ওপার সব পারের লোকেরাই মাথায় হাত দিয়ে ভাববে। অথচ ঠনঠনিয়া খোদ কলকাতার কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের একটা জায়গা। ওপারে ‘মানুষমারা’ ছিল তো এপারে এখনও আছে ‘গরুমারা’।
ওপার বলে এড়িয়ে গেলেও এপারে কিছু জায়গার নাম শ্রোতার ঔৎসুক্য জাগাবার পক্ষে এত অভিনব যে প্রথম-শোনাতেই একটা ‘জোর কা ঝটকা ধীরে সে’ লাগবে। যেমন রাজাভাতখাওয়া, যেমন বাছুরডোবা, যেমন ফাঁসিদেওয়া, যেমন ভাতার, যেমন ডিহিভুরসুট, যেমন ডিহিমেদনমল্ল…
এর তালিকাও সুদীর্ঘ, যার অতি সামান্যই জানি, বেশিটাই এখনও অজানা। আমি নিশ্চিত, আপনারা আরও বেশি জানেন। আমি শুধু নতুন এক একটা শুনি আর নিজের সংগ্রহের ঝুলিটাকে সমৃদ্ধ করি।
এখন গ্রাম আর গ্রাম থাকতে চাইছে না। গাইঘাটা আড়ংঘাটা নিজেকে বেলেঘাটায় উন্নীত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। আদি সপ্তগ্রাম চাইছে সায়েন্স সিটির মত নাগরিক সমস্ত সুযোগ-সুবিধে। সেই চাহিদার জেরে পশুপাখির আস্তানা আজ বিপর্যস্ত। তারা শুধু টিকে আছে জায়গার নামে। ঘুঘুডাঙা কাকদ্বীপ বকদ্বীপ শেয়ালদা পায়রাডাঙা ময়নাগুড়ি হাতিবাগান বীরসিংহ মহিষপোতা হরিণঘাটা প্রভৃতি জায়গার নাম থেকে পশুপাখিরা উধাও হয়ে যাবে, সেরকম কোনও সম্ভাবনা নেই ভেবে খানিক স্বস্তি, এই যা।
আহা! নামের কি জাদু!
এতো তথ্য সমৃদ্ধ অথচ মজাদার লেখা!… খুবই উপভোগ্য❤️