Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

সনেটগুচ্ছ

আ মরি বাংলা ভাষা!

সব ভাষাতেই থাকে কৌতুকাভিনেতা
আয়ুবের মত। নেই অলরাউন্ডার,
বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রণেতা
একটি সুঠাম মানচিত্র আর শাশ্বত ভাষার।
এমন কি কোনো ভাষা জানা আছে, শোণিতেই যার
মাতৃভাষা— অক্ষরসমূহে নক্ষত্রের দ‍্যুতি? সেই
পৃথিবী-মন্থিত ভাষা বঙ্গভাষাতেই
সিংহাসন কবিদের, রাজ‍্যপাট,— সে-ও কবিদের,
সেই এক ভাষা পৃথিবীতে, অশ্রুমাখা, অনুপম!
দোয়েল মাধবী রূপকথা বিশ্বকবি জন্ম দেয়
যে-ভাষায়, দেখেশুনে যতেক অন‍্যায়
রুখে দাঁড়ালেন কবি, বিদ্রোহী ও যম!
বিশ্বে এ কী ভাষা! একাকী, বিরল, যে ভাষায় জিদ
করে তার প্রতিষ্ঠায় দধীচিরা হয়েছে শহিদ।

*

স্বপ্ন

দিবাস্বপ্ন দেখো তুমি, দেখো বা রাতের
তারার রোশনচৌকি যখন আকাশে।
অথবা শিশির পড়ে সকালের ঘাসে।
স্বপ্ন যে স্বপ্ন-ই শুধু, ছবি আপাতের।
স্বপ্ন জলরং, তার আপাদমস্তক
যতই আনাম সুখ-শান্তি মনে হোক,—
ছেঁড়া কাগজের গায়ে আদরা শোলোক।
স্বপ্ন ভেঙে গেলে তাই করিয়ো না শোক।

স্বপ্নভঙ্গ হলে সেই যাদু-কুজ্ঝটিকা
দুর্বিষহ মনে হয়। মনে হয়, কেন
স্বপ্নলোক থেকে এক মহামরীচিকা
শাদা পর্দায় দোলে ছায়াছবি— হেন
স্বপ্নের রাত হোক যতই রঙিন,
দুচোখের দৃশ‍্যাদৃশ‍্য দেখায় তো দিন!

*আনাম= আস্ত, গোটা। আদরা= নকশা।

*

কেন

কেন কাকশালিখের ছড়াছড়ি, আর
গোলাপবাগান সারে ও জলে উঠোনে
কারো কারো, অন‍্যে নিদ্রাহীন দিন গোনে
ছিন্নকন্থা গায়ে, রাতে জোটে না আহার?
তুমি বিশ্বপিতা, বলো অগণ‍্য আতুর
অন্ধ ও বধির করে জন্ম দাও কেন?
সৎমা-কে জানি, তুমি মনে হয় যেন
সৎপিতা, দেখি যত দুঃখভারাতুর।
কণ্ঠে সাতনরী হার, হীরের গহনা
আটটি প্রহর কেন বৈভবে বিলাসে
কারো কারো বসবাস মর্ত‍্যের কৈলাসে
কেউ দিন গুজরায়? ঈশ্বর, কহো না!
ধনীর জাহাজ, তুমি, গরিবের নাও
সমদ্বিখণ্ডিত করে এক করে দাও।

*

জানি, জানি না তো!

নীলাকাশ কখনো যে পায় ধূসরতা।
সবুজ গাছের পাতা বাসন্তী হাওয়ায়
পর্ণমোচনের আগে হলুদ দেখায়।
সুগন্ধী বকুলে দ্বিপ্রহরে স্নানরতা,
তারপর কেশপাশে ফুল কর্ণিকার,
বেসর বাহারি তিল বাক‍্যহীন যার
আধূত অধর, দেহ কাঁপে বারবার,
স্মৃতি শুধু, স্মৃতি আজ শান্ত বিধবার!
বর্ণ গন্ধ অর্থ ঢেউ কেবল আপাত।
ঘোলা ভাগীরথীজল সমুদ্রে সুনীল।
সেই জল বাষ্প হয়, কী আশ্চর্য! আর
হিমালয়ে সেই বারি সুশুভ্র তুষার!
আহা কী নিরর্থ আর অলীক নিখিল!
জানি, তবু মনে হয় কই, জানি না তো!

*

ছিল না, এখন আছে

বঙ্গে না আইলে ইখতিয়ার উদ্দীন
কাগজ কলম বিনে কাটত যে দিন।
আমাদের মাতা ছিল, বাবা ছিল না তো,
স্বরগ নরক ছিল, ছিল না জান্নাত।
আদালত কই ছিল, কোথায় মিনার?
দাদা দাদী ভাই বিনে শূন‍্য এ সংসার!
মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর
আগমনে প্রচলন আরবি-ফার্সির।
একাদশী ছিল, তবে দালান দরোজা
ছিল না যে, বেহাজির নামাজ ও রোজা।
হিসাব কিতাব বাদশা বেগম বেবাক
সেতার না ছিল, তবে ছিল জয়ঢাক।
ছিল জন্মজন্মান্তর, সন্ধ‍্যা ও প্রভাত,
আইল দোজখ, বেহেস্ত, আইল আখেরাত।

*

আহ্বান

তোমার দুচোখ শুকতারাটির মত
স্বপ্ন দেখায় সুদূর সমুদ্দুরের,
তোমার আনত চোখে হই সন্নত
চুম্বন গাই মেঘমল্লার সুরে।
নীলপদ্ম কি তোমার পায়ের পাতা?
হাতের আঙুলে আলেপ্পি-কারুকাজ,
ওষ্ঠ অধর এখনো অনাঘ্রাতা?
সেখানে দ্রাক্ষা-আসবের মত ঝাঁঝ?
চলো, হাত ধরো, অরণ‍্যে ঝর্নায়
নিশীথিনী জুড়ে আমরা বেড়াব শুধু
দিন কাটে খালি বৃথা ঘরকরনায়
ভোরের আলোয় দেখব কেবল ধূ ধূ
সীমাহীন মেরুজ‍্যোতির সন্নিধান
যেতে হবে আজ ভুলে গিয়ে পিছুটান।

*

তুমি

তোমার একটি চোখে বয় ঝর্নাধারা,
কত মানুষের স্নান সে নির্ঝরিণীতে,
তোমার অপর চোখে মুদ্রিত সাহারা,
পাথরের চোখ শিরাহীন ধমনীতে।
তোমার হৃদয় জুড়ে মুদিত গোলাপ,
তোমার দক্ষিণ হাতে মৌন বরাভয়!
তোমার ভ্রু-মধ‍্যে এ কী! সুপ্ত কালসাপ
নিশীথে ছোবল মারে, শান্তি নয়ছয়!
তবু তুমি বৃক্ষতলে আনত দাঁড়াও,
তবু তুমি মূর্ছা যাও রাত্রি ভালবেসে,
তবু তুমি ঝঞ্ঝারাতে ভগ্ন খেয়া বাও,
অরুণোদয়ের আভা মেখে কালোকেশে।
নদীর এপারে তুমি, একা, একলাটি,
ওপারে তোমার ছদ, হেতালের লাঠি।

*

আমরা পুতুল

আমরা তো আজীবন পুতুলের প্রতিশব্দ, কত
ভাঙাগড়া আমাদের, দিনরাত অন্দর সদর,
যা খেলি জানি না খেলা গড়ে কে নেপথ‍্য কারিগর।
আজ রাজসিংহাসনে, কাল হয় মুহূর্তে পতন।
মন্বন্তরে মরি না তো, সাপ বাঘ নিয়ে খেলা করি,
চাল নেই চুলো নেই, তবু চড়ি সোনার সাম্পান,
স্বপ্নে কত জর্দা চুন ছাড়া খাই ভুলরঙা পান।
অলীক জীবনটাকে কে বাঁচায়, কোন ধন্বন্তরী?
জন্মদাতা পিতামাতা, ভাইবোন পুতুল, পুতুল!
প্রেমিকার ওষ্ঠে মধু, বুকে মধুরতরতা জানি,
তার ঋতুমতী নদীটিকে ঘিরে আমি মহাজন
মহান মূর্খের শাহজাদা, নিজেকেই বলি, ‘শোন,
প্রাণপাখি উড়ে গেলে থাকবে কেবল খাঁচাখানি,
সেইদিন দেখা দেবে পুতুলনির্মাতা নির্ভুল।’

*

পিরামিড, না কাঁটাতার

মানুষ আসবে বলে ধরিত্রীমাতার
কোটি কোটি বছরের তপস‍্যা ও ক্লেশ।
পৃথিবী, সমুদ্র, নদী, দেশ-মহাদেশ
গড়েছে, বিস্মিত তার যত্নপরতার!
মানুষ আসবে বলে ফুলে ফুলে মধু,
সন্ধ‍্যামণি, টিউলিপ, হীরক প্রবাল,
ময়ূরপেখম, মৃগনাভি, হরিয়াল,
হীরক, কাঞ্চন রেখে তার মর্মমূলে।
অবশেষে মানুষের শুভ আবির্ভাব।
প‍্যাপিরাস, মোনালিসা, আল হামরার,
বুদ্ধ যিশু অজন্তা ও জেন্দ আবেস্তার
সমলয়ে কেন আজ এটিলা-স্বভাব?
কিছুই বুঝি না, কেউ আছে বোঝাবার,—
পিরামিড সত‍্য, না কি সত‍্য কাঁটাতার?

*

খোয়াব

সারমেয়, চন্দ্রবোড়া, বৃশ্চিক, ভ্রমরা
বাস্তবে না দংশিলেও স্বপনে দংশায়।
খোয়াবে লাইলা দেখো, জাগ্রতে তোমরা
বেতো কানা দন্তরোগী সেবো, হায় হায়!
বাড়িতে তো পোড়া পিঠা, দুধচিনিহীন,
অর্ধদগ্ধ কাঁচকলা গলিত মাছের
অস্বাদ কুস্বাদময় ভোজ রাত্রিদিন
স্বপ্নে পায়সান্নে গন্ধ খেজুরগুড়ের!
তোমাদের আছে স্বর্গ, আছে রাজপ্রাসাদ,
ঝরোখায় ঝরোখায় হুর পরী মেম,
পেটিকায় সোনা, পান্না, বেশুমার হীরা,
মাণিক‍্যের পানপাত্রে রঙিন মদিরা।
বিশ্বের সুন্দরী এনে ভরেছ হারেম,
স্বপ্নেই কেবল গড়ো স্ফটিকের চাঁদ।

*

জীবনতরঙ্গ

জীবনতরঙ্গ আর মৃত‍্যুর স্তব্ধতা,
এর মাঝে সুখ দুঃখ মুক্তি বেড়াজাল,
স্বাধীন ও পরাধীন। খাঁটি ও ভেজাল।
খেয়ে, রোজা একাদশী রেখে, কথকতা
শুনে অবিরাম শুধু দিন গুজরান।
শত্রুতা মিত্রতা আছে, কালব‍্যাধি আছে
গৃহস্থালি অথবা সন্ন‍্যাস। বারোমাস
কেউ কেউ এ-জীবনময় হা-হুতাশ
করেই কাটায়, কেউ বঞ্চিতের কাছে
পরমবন্ধুর মত, সূর্যের আলোক!
অন্ধের যষ্টির চেয়ে কিঞ্চিৎ অধিক,
যে-আলোয় পথ দেখে বিপন্ন পথিক।
তার বরাভয় ‘সকলের ভাল হোক’।
পৃথিবীতে বেয়াকুব কারো জন্ম, আর
কারো জন্ম বিকাশিতে সুপ্ত প্রতিভার।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ‍্যায়
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

স্বামী বিবেকানন্দ : প্রয়াণদিনে স্মরণ

বিবেকানন্দই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক বাঙালি তথা ভারতীয়। রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ১৯১২-পর্বে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় যাওয়ার পর, এবং তার পরের বছর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। কিন্তু এর প্রায় কুড়ি বছর পূর্বেই বিবেকানন্দ শিকাগো-বক্তৃতা ও আমেরিকা-ইয়োরোপে এক নাগাড়ে প্রথম দফায় চার বছর থাকার সুবাদে আমেরিকার বিদ্বজ্জনমহলে যেমন, তেমনই জার্মানির মাক্সমুলার, ফ্রান্সের রোমাঁ রোলাঁ, রাশিয়ার টলস্টয় প্রমুখের শ্রদ্ধা এবং মনোযোগ আদায় করেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

প্রফুল্ল রায়: ব্রাত্য সময়ের কথাকার

প্রফুল্ল রায় নাকি অতীশ দীপঙ্করের বংশের। দেশভাগের অভিশাপেই দেশছাড়া হতে হয় তাঁকে, ১৯৫০-এ। একটা বিধুর বিষয় আমরা লক্ষ্য না করে পারি না। দেশভাগ সুনীল-শ্যামল-মহাশ্বেতা-শীর্ষেন্দু-অতীনদের কেবল ভূমিচ্যুত করেই ছাড়ল না, এমনকি তাঁদের কারুবাসনাকেও অন্যতর রূপ দেওয়ালো। দেশভাগ না হলে আমরা সুনীলের হাতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীণ’ বা প্রফুল্ল রায়ের ‘পূর্বপার্বতী’ পেতাম না, যেমন পেতাম না শওকত ওসমানের ‘কর্ণফুলি’ বা হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি।’

Read More »
শৌনক দত্ত

মন্দ মেয়ে ভদ্র অভিনেত্রী: সুকুমারী দত্ত

বিনোদিনী দাসীর বর্ণময় জীবনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া এই ‘তারকা অভিনেত্রী’-র বহুমাত্রিক জীবনটিও কম রঙিন নয় বরং বিস্মৃত নক্ষত্র এক, যিনি ১২৮২ বঙ্গাব্দের ৩ শ্রাবণ (১৮৭৫ খ্রি., মূল্য ছিল ১ টাকা) ‘অপূর্ব্বসতী’ নাটকটি লিখে বাংলা নাট্যাতিহাসের প্রথম নারী নাট্যকার হিসেবে সুবিদিত হয়ে আছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »