কালো সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটি তিন গলির সঙ্গমে দাঁড়িয়ে, খোঁজার দৃষ্টি নিয়ে এদিক-ওদিক চাইল। তারপর আবার ডানদিকে ঘুরে হনহন করে এগোতে লাগল। আমার কাজ ওকে ফলো করা। গুটিগুটি চলেছি দূরত্ব রেখে।
সন্ধে হয়ে গেছে। বড় রাস্তাগুলোতে আলোর ছড়াছড়ি। কিন্তু কিছু গলিতে বরাবর আলো নেই। বাড়ির জানলা-দরজা দিয়ে যতটুকু আসে তাতেই পথচারীকে চলতে হয়। সেরকম এক উত্তর কলকাতার গলি। এখন সন্ধে সাতটা। মাঝে মাঝে কিছু জানলার একফালি আলো পড়ে আছে পথ দেখার জন্যে। তারপর আবার আলো-আঁধারি। এরকম গলিতে কেন যে কর্পোরেশন ঠিকমত আলো দেয় না কে জানে! কোনও সময় দুই বাড়ির মাঝখানের নর্দমা বা জমি ছিল, এখন একফালি রাস্তা হয়েছে। এখানে রিকশাও যায় না। কিছুদূর পরপরই তিনমাথা-চারমাথার মোড়। গলির মারপ্যাঁচ প্রচুর।
ডানদিকে এগিয়ে হঠাৎ মেয়েটি উধাও। এদিক-ওদিক চাইছি, হঠাৎ পিঠে টোকা।
পিছন ফিরে বুকটা ধড়াস করে উঠল। সামনে কালো সালোয়ার পরা মেয়েটি দাঁড়িয়ে। এই প্রথম সামনাসামনি দেখলাম। চোখে চোখ রেখে। মুখে তাচ্ছিল্য ভাব। মুখ বেঁকিয়ে দাঁত চিপে বলল, ‘কিছু পেলেন?’
একেবারে হোঁচট খাওয়ার মত অবস্থা। একজন সুন্দরী রাস্তায় এরকম প্রশ্ন করছে! মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘অ্যাঁ, আজ্ঞে? আমাকে বলছেন?’
মুচকি মুচকি হাসি ঠোঁটের ফাঁকে রেখে বলল, ‘বলছি আজ সারাদিন তো অনেক পিছন পিছন ঘুরলেন। কিছু পেলেন?’
হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছি। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে মহিলা ঝকঝকে, দারুণ সুন্দরী। আধো-অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে খুবই ফর্সা। দেখে মনে হল, কষ্ট করে নরম দৃষ্টিতে কাঠিন্য আনার চেষ্টা করছে। ছিপছিপে গড়ন। বেশ সপ্রতিভ।
থতমত খেয়ে বললাম, ‘কী যা-তা বলছেন? অদ্ভুত, কে বলেছে আপনাকে অনুসরণ করছি? আমি এদিক দিয়ে শিয়ালদা শর্টকাট করছিলাম।’
হাসিটা লেগে থাকে, ‘তাই? পিছু নেননি তো?’
সরু গলি। দু-একজন তাকাতে তাকাতে গা-ঘেঁষে গেল। বললাম, ‘না।’
‘পিছু নিয়ে কোনও লাভ নেই। আপনি যা জানলে খুশি হতেন, সেটা আপনি পাবেন না।’ একটু দম নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, আপনি এগোন।’ বলে হাত দিয়ে আমাকে এগিয়ে যাবার অনুরোধ করে। এরপর আর পিছু নেওয়া যাবে না অন্ধকার গলিতে কোনও অচেনা মহিলা এরকম বললে। কাল বিশুদার সঙ্গে আগে দেখা করে এই ধরা পড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বলতে হবে। হুড়মুড় করে হেঁটে শিয়ালদা গিয়ে বাসে উঠে পড়লাম।
***
পরদিন যেতেই বিশুদা বলল, ‘তুই একটা গবেট। মাধুরী রায় খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে তোকে আগেই বলেছি না। ওর বাবা আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। জানতে পারলে তুলকালাম করবে বাড়িতে।’ একটু থেমে পেনটা কামড়ে ল্যাপটপের দিকে চেয়ে বলল, ‘তুই আর যাস না, আমি অন্য কাউকে পাঠাব।’ তারপর কী ভেবে বলল, ‘এবার যখন পিছন নিবি তখন নিজেকে লুকিয়ে চলবি। তোকে অন্ধকারেও চিনে রেখেছে। অনেকটা দূরত্ব রেখে চলবি। কোথায় কোথায় যায়, শুধু খবর চাই।’
বিশুদার কথামত মুখে মাস্ক আর টুপি পরে নিয়েছি। আয়নায় নিজেকে দেখেও চিনতে পারছি না। বেশ বইতে পড়া ডিটেকটিভ মনে হচ্ছে। সকাল থেকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যথা। অবশেষে মাধুরী রায় বেরোল। আজ দেখতে আরও সুন্দরী লাগছে। সাধারণ একটা সুতির শাড়িতে লাল ডুরে। শাড়ির সঙ্গে লাল হাতা ব্লাউজ। কপালে কালচে লাল বড় টিপ। গলায় কালো পাথরের মালা। লম্বা, ছিপছিপে চেহারা। লম্বা উঁচু গলা। হেঁটে যাচ্ছে সোজা হয়ে সাদা রাজহাঁসের মত। আজ তিনদিন হয়ে গেল পিছু নিয়েছি। প্রথম চাকরি, তাই পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার নেই। সারাদিন সে কোথায় কোথায় যাচ্ছে, সেটা জানা এবং বসকে জানানো আমার কাজ। বাবার পাখিশিকারের টুপি, সঙ্গে মাস্ক। আজ আমাকে চেনার সাধ্য কোনও বাপের নেই।
বেরিয়েই একটা ট্রামে উঠে পড়ল রাস্তা পার হয়ে। পিছন পিছন আমিও সেকেন্ড ক্লাসে। শ্যামবাজার নেমে প্রথম একটা ফুলের দোকানে দাঁড়াল। কিছু রজনীগন্ধা ফুল কিনে রিকশা নিয়ে চলল। আমিও পিছু পিছু। শ্যামবাজারের একটি গলিতে ঢুকল।
দুপুর গড়িয়েছে। এখনও বেরোয়নি। গাছ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতে পিঁপড়ের কামড় খাচ্ছি। সাতসকালে একটা মধ্যবিত্ত এলাকায় কেউ টুপি আর মাস্ক পরে গাছতলায় দাঁড়িয়ে! দেখে পাগলটাগল ভেবে লোকজন তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে। দুপুর হয়ে এল, সামনের একটা রেস্টুরেন্টে টোস্ট আর অমলেট খেতে ঢুকেছি। সব মুখ নীচু করে পাঁউরুটিতে কামড় বসিয়েছি। আচমকা সামনের সিটে ধপাস করে ব্যাগটা রেখে কে একজন বলল, ‘বসতে পারি?’ মুখটা তুলে দেখি, ওরে বাপস, এ তো সেই! মুখে মুচকি মুচকি বিজয়িনীর হাসি। বলল, ‘তাড়াতাড়ি টুপি আর মাস্কটা পরে ফেলুন, না হলে আমি কিন্তু চিনে ফেলতে পারি।’
অপমানের একশেষ। এরকম অপদস্থ হব ভাবিনি। পাঁউরুটি মুখে চেয়ে আছি। একদম হাতেনাতে ধরা পড়ে হেসে ফেললাম, ‘খাবার সময়?’
মাধুরী রায়ও হাসল খিলখিল করে, ঝকঝকে মুক্তোর মত দাঁতদুপাটি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। হাসিটা সারা মুখেচোখে ছড়িয়ে গেল। চারিদিকের লোকজন একবার মুখ তুলে তাকাল। গলা নামিয়ে বলল, ‘আমাকে কে ফলো করছে সেটা তো আমাকেই খেয়াল রাখতে হবে? বলুন?’ রসিক মহিলা দেখছি।
এর উত্তর আমি কী করে দেই? চেয়ে আছি। সামনে নুনের কৌটোটা নাড়িয়েচারিয়ে বলল, ‘খেয়ে নিন। খেয়ে নিন। আমি বসছি। এখন তো আপনার থেকে আমার দায়িত্ব বেশি।’
দেখলাম হাসলে চোখদুটোও হাসতে থাকে। ছোট্ট একটা টোল পড়ে দুই গালে। পাঁউরুটি খাওয়া অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে। নিজেকেই গালি দিতে ইচ্ছে করছে। বললাম, ‘কী করে জানলেন আমি এখানে টিফিন করছি? কেউ কি আপনাকে বলেছে?’
এবার তার মুখে হাত চেপে শরীর কাঁপিয়ে হাসি উথলে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ হেসে একটু থেমে বলল, ‘এ তো খুব সোজা। আমি যে বাড়িতে ঢুকেছিলাম সেখানে আমি তো বেশ কিছুক্ষণ ছিলাম। তার মানে আপনি ছিলেন দাঁড়িয়ে কষ্ট করে। দুপুর হয়ে এল। এখন কাছাকাছি খাওয়াদাওয়া সেরে আমার ওপর নজর রাখতে এই রেস্টুরেন্টটাই আছে। সুতরাং খুব চান্স এখানেই আছেন ভেবেই ঢুকে পড়েছি। তবে এইরকম প্রশ্ন আপনার থেকে একদম আশা করিনি।’
মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমতি। দেখি আর কী বলে।
গলা নামিয়ে বলল, ‘আপনার দ্বারা এসব কাজ হবে না। বাবা আপনাকে না বুঝেই নিয়োগ করেছে। আপনি ভাল ডিটেকটিভ হতেই পারবেন না কোনওদিন।’
বিশুদা বলেছে, এ লাইনে অপমান গায়ে মাখতে নেই। ওর বাবা আমাকে নিয়োগ করেনি। করেছে আমার বস শ্যামল সান্যালকে। ঝাঁঝালো স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন বলছেন?’
‘প্রথমত আমার খবর নেবার কথা আপনার। আর আমাকেই জিজ্ঞাসা করছেন? বলব নাকি বাবাকে? আমাকেই চোখে-চোখে রাখতে হচ্ছে আপনাকে।’
গা-পিত্তি জ্বলে গেল। রেগে বললাম, ‘আমার কাজ আমাকে করতে দিন। আপনার কাছ থেকে জ্ঞান আমি শুনতে চাই না। আর কোনও প্রমাণ আছে যে, আমি আপনাকে ফলো করছি? একটা রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছি আর আপনি এসে হামলা করছেন?’
‘আচ্ছা, আচ্ছা।’ হাত তুলে একটু সমঝোতার স্বরে বলে, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি আমাকে ফলো করছেন না। শুধু বার বার দেখা হয়ে যাচ্ছে এই যা। কী বলেন?’
দু’কান গরম হলেও মাথাগরম করলে চলবে না। অসম্ভব ধুরন্ধর মেয়ে। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘দু’কাপ চা বলুন, আর আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।’
বেয়ারা সামনেই দাঁড়িয়ে। দু’কাপ চা বলতেই মাধুরী বলে ওঠে, ‘শুনুন, আমার একটা প্রপোজাল আছে।’
আমি খাওয়া শুরু করি। ‘আপনার কোনও প্রপোজাল আমার শুনবার দরকার নেই।’
মুখের হাসি যেন লেগেই আছে। বলল, ‘আমি জানি, বাবা কত দিচ্ছে আপনাকে।’
আমি চুপ করে রইলাম। শপথভঙ্গ করতে পারব না। সে ছাড়নেওয়ালি নহি। ‘আমিও আপনাকে নিয়োগ করতে চাই। বাবা যা দেয়, তার থেকে বেশি আপনাকে আমি দেব।’
‘মানে? অদ্ভুত, কেন আপনার নিয়োগ আমি নেব? আমি একটা চাকরি করি। আর সেটাই করব।’
ঠান্ডা গলায় বলল, ‘নেবেন। একশোবার নেবেন। আপনার এই চাকরিটি বজায় রাখতেই নেবেন।’
‘কীরকম?’
ঠাট্টা করছে? ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। আমার খাওয়া শেষ। ভাবছি, উঠি কী করে।
মাধুরী উদাস হয়ে বলল, ‘ধরে নিন, আপনি ছাড়াও আমাকে কেউ ফলো করছে। সে সত্যি আমার ক্ষতি করতে চায়। এটা জানার পর আপনি পারবেন শুধু ফলো করতে? তারা যদি আমার ক্ষতি করে দেয়, তাহলে আপনার চাকরিটা থাকবে?’
‘অ্যাঁ, আমি ছাড়াও কেউ?’
‘এক্সাক্টলি তাই। আসলে আপনি আসাতে আমার একটু সুবিধাই হয়েছে।’
যথেষ্ট হয়েছে। মেয়েটি সত্যি ধুরন্ধর। বললাম, ‘আমি আপনার কোনও কাজের ব্যাপারে নেই।’ ওর চা খাওয়া হয়ে গিয়েছে। দোকান থেকে বেরিয়ে মাধুরী মুচকি হেসে বলল, ‘এখন আমি বাড়ি যাব। আজকের মত পিছন পিছন আসার আর দরকার নেই। চাইলে কাল আবার শুরু করতে পারেন।’
আমি আবার অপমানিত হয়ে উল্টোদিকে চললাম।
এই ব্যাপারটা বস কে বলা যাবে না। তাহলে আর চাকরিটা থাকবে না। তবে মেয়েটাকে একটা উপযুক্ত শাস্তিও দেওয়া দরকার। কিন্তু যদি সত্যি আরও কেউ ওর ক্ষতি করতে ওকে ওয়াচ করে থাকে, তাহলে তো তাকেও খেয়াল রাখতেই হবে।
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ মাধুরী বের হল দেখলাম। আজ কিন্তু খুব সাধারণ একটা সালোয়ার-কামিজ পরেছে। নরম স্নিগ্ধ চাহনি দেখে মনে হল ভোরের একমুঠো শিউলি। ওর মুখটায় অদ্ভুত নমনীয় স্নিগ্ধতা। এতটুকু মেকআপ নেই মুখে। এই প্রথম অনুভব করলাম যারা সত্যি সুন্দরী তাদের খুব সাধারণ পোশাকে আর একটা খোঁপা করা চুল আর মেকআপ ছাড়াই বেশি সুন্দরী লাগে। ভিতরের সৌন্দর্য্য অনেক বেশি ফুটে বেরোয়। কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই, এত বুদ্ধিমতি। রসবোধও প্রশংসা করার মত।
দূর থেকে দেখছি। মুশকিল হল যখনই ওর পিছনে কোনও একজন বা দুজন মানুষ চলে আসছে, তখনই মনে হচ্ছে এদের কথাই কি বলতে চেয়েছিল গতকাল? উল্টো ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কতগুলো ছেলে রোয়াকে বসে গল্প করছিল। মাধুরী সামনে দিয়ে হেঁটে যাবার পর ওরাও দেখলাম উঠে গল্প করতে করতে পিছু নিয়েছে। এরাই তাহলে সেই ছেলেগুলো যারা ওকে ফলো করছে। দুটো মোড় ঘোরার পর যখন ভাবছি গিয়ে ওদের সামনে তরোয়াল খুলে বলব ‘হারে রেরে রেরে’, দেখলাম ওরা অন্য রাস্তা ধরেছে। আবার হতাশ হয়ে পড়লাম। মাধুরী কিন্তু সেই রহস্যজনক বাড়িতে আবার ঢুকল একবার বাজার আর মন্দির ঘুরে। তারপর বসেই আছি, বসেই আছি। দূর থেকে দেখি বেরোল। বেরিয়ে আলতো করে দরজা বন্ধ করে মাথা নীচু করে ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগল। দু-দুবার পিছন ফিরে সেই পুরনো দোতলা বাড়ির দিকে তাকাল। একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। আজ গিয়ে বসকে জানাতেই হবে। যখন ঢুকল হাসি হাসি মুখে তখন হাতে ফুল, মিষ্টি আর বেরোল বিষণ্ণ মুখে খালিহাতে। নিশ্চয়ই প্রেমিক ঘাপটি মেরে বসে আছে ভিতরে।
পরদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটি চলে যাবার পর সেই রহস্যময় বাড়িটিতে আলতো করে ঠেলে ঢুকলাম। সামনে একটা উঠোন। সেখানে দুটো-তিনটে বাচ্চা ছেলে সাইকেলে বসে। পিছনে বড় কেউ সেটা ঠেলছে। বারান্দায় দুটো ছয়-সাত বছরের মেয়ে হাততালি দিচ্ছে। হাততালি দেওয়াটা আমাদের মত নয়, কখনও দুহাতে তালি পড়ছে কখনও হাত সরে গিয়ে তালি আর পড়ছে না। হাসিটাও অকারণ বেশি। যারা সাইকেলের ওপর বসে তাদের হাসির সঙ্গে মাথাটাও দুলছে অকারণ, অতিরিক্ত।
‘কাকে চান?’ প্রশ্ন শুনে পিছন ঘুরে দেখি একজন বয়স্ক মহিলা। ওদের দিকে আঙুল তুলে কিছু বলবার আগেই বলল, ‘হ্যাঁ, মেন্টালি রিটার্ডেড। কিছু জানতে এসেছেন? ওইদিকে অফিসঘর।’
আমি স্তম্ভিত। ঠিক বাড়িতে ঢুকেছি তো?
বললাম, ‘মাধুরী রায়কে চেনেন?’
এমন সময় দুটো বাচ্চা তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করেছে। ওদের দিকে ছুটে যেতে যেতে বললেন, ‘না, চিনি না। এখনকার কোনও বাচ্চা?
এদিক-ওদিক চেয়ে বললাম, ‘ভুল হয়ে গেছে। অন্য বাড়িতে ঢুকে পড়েছি।’ বলে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। বাইরে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। বুক মুচড়ে একটা কষ্ট হচ্ছে শরীরে। রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে যে এমন কিছু দেখতে হবে ভাবিনি। এইরকম শিশু যাদের আছে তাদের কী সাংঘাতিক কষ্ট। কিছুই বোঝে না। শোনে না। বলতে পারে না। অদ্ভুত আচরণ। তারপরই মাথায় খেলল, ‘মেয়েটা কী ধুরন্ধর। ও জানে আমি পিছন পিছন আসব ঠিক। তাই আমাকে গুলিয়ে দেবার জন্যে ‘ওকে অন্য কেউ অনুসরণ করছে’-র গল্প ফেঁদেছিল। তাই বলে এই স্কুলে এতক্ষণ কী করে কাটায়? রহস্য আরও ঘনিয়ে এল। নিশ্চয়ই ওর প্রেমিক এখানে আসে বা কাজ করে। আবার যে গিয়ে খোঁজ নেব তার সাহস হচ্ছে না। শিশুগুলোর দিকে তাকাতেও বুক মুচড়ে উঠছে। দুঃসহ বিষণ্ণতা গ্রাস করেছে। ভাবলাম যতই বোকাহাবা হই, স্বাভাবিক একটা মানুষ যে হয়েছি এটাই পরমপ্রাপ্তি। নাহলে সারা জীবন অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকতে হত। এই অস্বাভাবিকতাটা আর সহ্য করা গেল না। বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। ফিরে এলাম। মনটা ভারী হয়ে আছে। বিশুদাকে বললাম। বস শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর অন্য লাইনে চলে গেল। বলল, ‘তোকে বলেছিলাম সাংঘাতিক চালাক মেয়ে। স্রেফ বোকা বানিয়েছে। পুরো গুলিয়ে দিয়েছে। হয়তো ওই বাড়িতে ঢুকে পিছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে, তুই জানিস না। ঠিক আছে, আমি দেখি কথা বলি ক্লায়েন্টের সাথে। কী বলেন তিনি?’
মাধুরীকে অনুসরণ করা বন্ধ হল। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। রোজ রোজ এইরকম অপদস্থ হওয়া মোটেই হজম হচ্ছিল না। পেটখারাপ না হলেও মনখারাপ লাগত। রোজ রোজ ধরা পড়া কী লজ্জার, যার হয়েছে সেই জানে। রোজ মনে হত চাকরিটা ছেড়ে দেই। কিন্তু বাড়িতে বেকার বেকার শুনে শুনে প্রথম রোজগারের অর্জন করা টাকা দেখব বলে নিয়ে নিয়েছিলাম। দিন সাতেক বাদে একদিন বিকেলে বস ডাকল ঘরে। গিয়ে দেখি উদাস হয়ে বসে। আমাকে দেখেই বলল, ‘তুই যে মেয়েটির পিছু নিচ্ছিলি তার বাবা আমাদের ফিস মিটিয়ে দেবেন বলেছেন।’ একটু থেমে বলল, ‘তোর সময় আছে? তাহলে বস। ওনার মেয়ের খারাপ ব্যবহারের জন্যে ক্ষমাও চেয়েছেন।’
বললাম, ‘আর কিছু বললেন?’
বিশুদা বলল, ‘উনি বলেছেন, তোর সময়মত একবার ওনার সঙ্গে দেখা করে আসতে।’
‘আবার আমি কেন?’
পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘যা, যা চেকটা তোর হাতেই দিয়ে দেবে। না করিস না।’
বলতেও পারছি না, রাস্তাঘাটে এত অপদস্থ করেছে যে বাড়ি গেলে আবার আরও কত না করে।
***
বাড়িটা বেশ বড় দোতলা। ভদ্রলোক নীচে বসবার ঘরে বসেই ছিলেন। কিছু কাগজপত্র সামনে খোলা। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। মাধুরীর ব্যবহারের জন্যে ক্ষমা চেয়ে বললেন, ‘আপনি কি ওই হোমে গেছিলেন?’
বললাম, ‘একদিন, কিছুক্ষণের জন্যে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতে পারিনি। এত রূঢ় বাস্তব সহ্য করা খুব কঠিন।’
‘ঠিক তাই। আমি যে ক’দিন গেছি সেদিনই রাত্রে ঘুম আসেনি। আমার মত কঠিন লোকেরও ধাতস্থ হতে সময় লেগেছে। আমি চাই না যেতে, কিন্তু ওখানে যে সুকুর স্মৃতি ছড়িয়ে।’
আমি ফ্যাকাসে মুখে চেয়ে আছি দেখে বললেন, ‘বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে তাই তো? তাহলে বসুন, পুরোটাই শুনুন। আজকাল মেয়ে ভীষণ একরোখা, জেদি হয়ে উঠেছে। কিছুদিন যাবৎ আমার সঙ্গে ঝামেলা করে মেয়ে যখন-তখন বেরিয়ে যাচ্ছিল বাড়ি থেকে। অনেকটা সময় বাইরে কাটিয়ে আসত। অনেক প্রশ্ন করেও উত্তর পাইনি। অবিবাহিত ইয়ং মেয়ে চিন্তা তো হয়, কোনও খারাপ সংসর্গে পড়ল কিনা। মেয়ে হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। কথা শুনছে না। এইসব বলে খুব রাগারাগি করতাম আর তাই অনেক ভেবে, বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে আপনাদের অ্যাপয়েন্ট করি।’
বললাম, ‘একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে।’
‘বলুন।’
‘যেই বললাম মাধুরী অনেকটা সময় অমুক মেন্টালি রিটার্ডেড বাচ্চাদের হোমে কাটায়, সঙ্গে সঙ্গে আপনি কেমন মিইয়ে গেলেন। কেন? ও কি সত্যি ওখানে গিয়ে সময় কাটায়, না আমাকে কাটাবার তালে ওখানে ঢুকেছিল?’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘আপনাদের বাকি ফিসের চেকটা নিয়ে যাবেন। তবে আর খোঁজ নেবার দরকার নেই।’
ঠিক বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘কেন স্যার? আমরা কি কিছু ভুল করে ফেলেছি? যা দেখেছি তাই আপনাকে জানিয়েছি।’
মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘না, না, আপনারা আপনাদের কাজ সঠিকই করেছেন।’
‘তাহলে আপনি কেন এরকম বিষণ্ন হয়ে যাচ্ছেন?’
কিছুক্ষণ চুপ করে মাথা নীচু করে এপাশ-ওপাশ চাইলেন। তারপর ভারী গলায় বললেন, ‘জানেন, আমার একটি ছেলে ছিল, নাম সুকান্ত। মাধুরীর থেকে দু’বছরের বড়। কিন্তু জন্ম থেকেই মানসিক প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী শিশু দেখেছেন কখনও?’
বললাম, ‘হ্যাঁ। দেখে এলাম তো তাদের।’
আবার শুরু করলেন, ‘প্রথম দিকে নমিতা আর আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। পরে ভাবলাম ভগবান যখন দিয়েছেন তখন তাকে ভাল করে চিকিৎসা করে সুস্থ করার দায়িত্বও দিয়েছেন। সেটাই ভালভাবে চেষ্টা করি। যত বড় হতে লাগল তত অসুবিধা বাড়তে লাগল। বাড়িতেই থাকে। ভাল বুঝতে পারে না, কথাও জড়িয়ে জড়িয়ে বলে। সবাই বুঝতে পারে না। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, অনেক তাগা, তাবিজ, মাদুলি করে শেষে ফিজিওথেরাপির ওপরই ভরসা করি। যে হোমটায় আপনি গেছিলেন সেটাতেই নিয়ে যেতাম। মাধুরী ওর ভাইকে ভীষণই ভালবাসত। যদিও সুকু কোনও কথাই বুঝতে পারত না, তবু মাধুরী বাড়িতে থাকলে ওর সাথেই অনর্গল কথা বলত। ও একটা খেলার পুতুল ছিল। চুল আঁচড়ে দিত, মুখে পাউডার দিয়ে সাজিয়ে দিত। আমরা কিছুই বুঝতে পারতাম না। মাধুর যখনই কোনও দুঃখ হত ভাইকে জড়িয়ে বসে থাকত।’
জিজ্ঞাসা করলাম, এখন সুকান্ত কোথায়?
অসহায় মুখে বললেন, ‘নেই। নমিতা চলে গেল ক্যানসারে। তার ছয় মাসের মধ্যে সুকুও চলে গেল।’
উনি এমন অবলীলায় বললেন, যেন অন্য কারুর কথা বলছেন। আবার শুরু করলেন, ‘নমিতাই ওর সব ছিল। স্নান করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সবই নমিতা। ইচ্ছে না হলে কিছু করানো অসম্ভব কঠিন। একমাত্র নমিতাই গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে…।’ হঠাৎ হেঁচকি তোলার মত শব্দ করে থেমে গেলেন। একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলেন, ‘যখন গেল, ওর বয়স সতেরো। বয়েস বেড়েছে কিন্তু মানসিক অবস্থা চার-পাঁচ বছরের মত। নমিতা চলে যাবার পর আরও অবুঝ, আরও জেদি হল। কথায় কথায় চিৎকার। অসম্ভব জেদ। রেগে গেলে খাওয়ানো এক যুদ্ধ। শেষে মাথায় খালি হাত দিয়ে বোঝায় যন্ত্রণা। ডাক্তার দেখলাম, ব্রেন ক্যানসার, মাস দুয়েক বাদেই চলে গেল। ডাক্তার বলেছিল, এরকম বাচ্চা যাদের ওপর ভরসা করে চলে তারা সরে গেলে বাচ্চাদের বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়ে। নমিতা যাবার পর যত না খালি লেগেছে, তার থেকে বেশি খালি হয়ে গেল বাড়ি সুকু চলে যাবার পর। নমিতা আর সুকুর চিকিৎসা চলার সময় মাধুর খেয়াল বেশি রাখতে পারিনি। ওর যে কী উথালপাতাল অবস্থা, সেটা আমি দেখিনি। বাড়িটা হঠাৎ করে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর থেকে মাধু আর আমি। বেশ কিছুদিন অনুপস্থিতির বেদনা আর স্তব্ধতার হাহাকার ঘিরে রইল আমাদের। কে কাকে কী বলব? ঝড় থামবার পর দেখি মাধু একদম চুপ। কোনও কথাই বলে না। এমনকি কান্নাও না। অনেক ডাক্তার দেখানো হল। ওকে নিয়ে অনেক জায়গায় বেড়ালাম মনটা হালকা হবে বলে। নিজের বিজনেস দেখব, না মাধুকে সামলাব? এরপর মাধু কলেজ যেতে শুরু করলে আমি বেশি করে আমার বিজনেসে নিজেকে ডুবিয়ে দেই। বাড়িতে কী হচ্ছে, মাধু কী করছে তার খোঁজ রাখতাম না। পুরোপুরি ব্যবসায়ী মানুষ হলে যা হয় আর কী।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ও এখনও ওখানে কেন যায়?’
‘আমার ওপর অভিমান, দুঃখ, সর্বোপরি সুকুকে খুঁজতে। আমার ব্যবহারে যখনই মনখারাপ হয়, ওর সুকুকে চাই। ওই বাচ্চাগুলোর মধ্যে সুকুর ছায়া পায়। ওদের সাথে সময় কাটিয়ে মন হালকা করে ফেরে। তাই আপনারা যখন বললেন যে, ওই হোমটায় যায়, তখনই আমার সব দুশ্চিন্তা দূর হয়।’ এত অবধি বলে চুপ করেন। ঘরে ঢুকে লোকটাকে যতটা কঠিন, গম্ভীর মনে হয়েছিল, এখন আর মনে হচ্ছে না। ওর জন্যে খারাপই লাগল। হঠাৎ বললেন, ‘চা খাবেন?’
বললাম ‘না।’
উনি বললেন, ‘আপনি খেলে আমিও একটু খাই।’ চায়ের কথা চাকরকে ডেকে বলে একটু থেমে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমি তো খুব কঠিন মানুষ, আমার কষ্ট কম। আপনাকে এত কিছু বলে ফেললাম, কেন না আপনি অনেকটাই জেনেছেন, তাই পুরোটাই জানা উচিত। মাধুর কষ্ট দেখে মনে হয় কঠিন মানুষ, খারাপ মানুষ হলে সাংসারিক দুঃখ কষ্টটা অনেক কম হয়।’
আমি বললাম, ‘কেন?’
উনি বললেন, ‘বাহ! জানেন না? খারাপ মানুষ, কঠিন মানুষদের যে কোনও কষ্ট থাকতে নেই।’ ছলছল করে উঠল নিঃসঙ্গ মানুষটার চোখ। মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন।
বললাম, ‘আজ উঠি। আপনার মেয়ে কিন্তু খুব বুদ্ধিমতি আর রসিক।’
মুখটা খুশিতে ভরে উঠল, ‘তাই? জানতাম না তো? আপনি কী করে জানলেন এত সব? আপনি কি ওর সঙ্গে কথা বলেছেন কখনও?’
বললাম, ‘আমাকে তো প্রতিবারই লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।’ পুরো গল্পটা শুনে হা হা করে গলা ফাটিয়ে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘যাক বাবার কিছু গুণ পেয়েছে বলতে হবে। আপনি আমাকে কিছুটা নিশ্চিন্ত করলেন। আবার আসবেন সময় পেলে। কথা বলে ভাল লাগল।’
আমার আর কিছু জানার ছিল না। মাধুরী যদি ওদের মধ্যে থেকে আনন্দ পায়, তাহলে সেই ভাল। বেরিয়ে রাস্তায় নেমে কিছুটা গিয়ে পিছন ফিরে একবার বাড়িটা দেখতে গিয়ে দেখি দূরে বারান্দায় মাধুরী দাঁড়িয়ে। একমাথা ভেজা চুল, একটা হালকা গোলাপি রঙের গাউন পরা। যেন এই ঘুম থেকে উঠেছে। যেন একমুঠো শিউলি। একমুখ হাসি লেগে মুখে। দুহাত নেড়ে দেখাল মাস্কটা পরে নিতে। তাই তো! ঘোরের মধ্যে মাস্ক না পরে বেরিয়ে এসেছি রাস্তায়। হেসে হাত নাড়াই। পকেট থেকে মাস্ক বার করে পরি। মুখ তুলে দেখি মুখে হাত চেপে খিলখিল করে হাসছে। বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে সমর্থন জানাল। অত দূরের হাসির ঢেউ হঠাৎ করে ভেসে এসে সারা মন-শরীর ভিজিয়ে দিয়ে গেল। উন্মুক্ত বারান্দায় গ্রিলের মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলোছায়া পড়েছে মুখে। ওকে কেমন অন্য গ্রহের কেউ মনে হল।