Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

চম্বল: দস্যুদের আপন দেশে

জীবনে দু’বার আমায় চম্বল (Chambal) উপত্যকায় যেতে হয়েছিল। কোনও গবেষণার কাজে বা বেড়ানোর জন্য নয়। প্রথম বার ১৯৭৯ সালে এবং পরের বার ১৯৮২ সালে। তখন আমি তরুণ, আলোকচিত্রী। বয়েস একুশ বছর। কাজ করি তৎকালীন খুব নামকরা সংবাদ পাক্ষিক ‘পরিবর্তন’ পত্রিকায়। হঠাৎই চম্বল যাবার সুযোগ এসে যায়, প্রায় অলৌকিকভাবে।

আমাদের তৎকালীন সম্পাদক ছিলেন ধীরেন দেবনাথ। চম্বল যাবার সূত্র পাওয়া গেছে জেনে একটা টিম করে দিলেন। মৃদুল দাশগুপ্ত ও আমার। চটজলদি রওনা হয়ে গেলাম চম্বলের দিকে। তুফান মেল। গন্তব্য আগ্রা। চম্বল কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট জায়গার নাম নয়। আসলে চম্বল একটা নদী, যা যমুনা নদীর একটি উপনদী। তার অববাহিকার নাম চম্বল ভ্যালি বা উপত্যকা। মূলত তিনটি রাজ্যের মধ্যে দিয়ে এই নদী বয়ে গিয়েছে, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ আর রাজস্থান।

এই উপত্যকা ভৌগোলিক কারণেই অদ্ভুত এবং বলা ভাল দস্যু-স্থান হয়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত। নদী স্বভাবতই তার গতিপথ পরিবর্তন করে। চম্বলও তাই। কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে ভেঙে দিয়ে যায় বিস্তীর্ণ প্রান্তকে। চম্বল অঞ্চলে এই ভাঙা জায়গাটাকে ‘বেহড়’ বলে। বলা যেতে পারে মাটির নিচে পাহাড়। এর গভীরতা কখনও পাঁচশো ফুট, কখনও হাজার ফুট, কখনও বা পাঁচ হাজার ফুট। পথ বলে কিছু নেই। পুরোটাই গোলকধাঁধা।

যাইহোক, আমি আর মৃদুলদা কলকাতা থেকে আগ্রা হয়ে পৌঁছলাম উত্তরপ্রদেশের ‘রছেড়’ গ্রামে। সম্বল বলতে একটা হাতে লেখা চিঠি। কলকাতার এক চম্বলবাসী যিনি আমাদের যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিলেন। ‘রছেড়’ গ্রামে আমাদের অভ্যর্থনা কেমন হয়েছিল তার কাহিনিটিও মজার ও বিস্তৃত। এখানে তা খোলসা করছি না। তবে সেখান থেকে আমরা চললাম চম্বলের কিংবদন্তি, স্থানীয় রবিনহুড মান সিংয়ের (Daku Man Singh) কোঠিতে।

বেহড়ের আশপাশ দিয়ে টানা আট থেকে নয় ঘণ্টা উটের পিঠে চেপে সে এক দুরন্ত অভিজ্ঞতা। ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় এসে পৌঁছনো গেল মান সিংয়ের গ্রাম উত্তরপ্রদেশের আগ্রা জেলার ‘খেরা রাঠোর’। পুলিশের গুলিতে মান সিং মারা গেছেন ছয়ের দশকে। সেই মান সিং, যিনি ১১১২টি ডাকাতি, ১৮৫টি খুন এবং ৩২ জন পুলিশকর্মীকে হত্যা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু যার সঙ্গে দেখা হল তিনিও খুঁখার ডাকু নবাব সিং। মান সিংয়ের বড় ভাই। চম্বলের মানুষ যাকে ‘বড়ে বাবা’ বলে ডাকেন। তখনও চম্বলের জনজীবনে নবাব সিংয়ের নামে মাথা ঝোঁকায় আপামর জনতা।

১৯৭৯ সালে তার বয়েস ছিল ১০৭ বছর। প্রায় ১২০টা খুনের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। ফাঁসির হুকুমও হয়েছিল তার। বিনোবা ভাবের ‘ডাকাতদের হৃদয় পরিবর্তন’ মিশনের জেরে তার শর্তসাপেক্ষে মুক্তি হয়েছিল। তাদের পরমযত্নে ‘খেরা রাঠোর’-এ মান সিং এবং নবাব সিংয়ের বাড়িতে আমরা দু’রাত কাটিয়েছিলাম। সেই স্মৃতি আজও অমলিন। ‘খেরা রাঠোর’ থেকে ‘রছেড়’ ফিরেই আমরা যাই আগ্রায় মান সিংয়ের পুত্র তেহসিলদার সিংয়ের (Tehsildar Singh) বাড়িতে। দেখা হল, কথা হল তার সঙ্গে। মোটা গোঁফের আড়ালে এক সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ। ঠিক যেন আমাদের ঘরের সেই প্রজন্মের জ্যাঠামশাই। তারও ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, বিনোবা ভাবের সৌজন্যে তিনিও মুক্তি পেয়েছিলেন।

তারপর একে একে অনেক ‘চম্বলদস্যু’-র খোঁজই পেয়েছি। দেখা করেছি, ছবি তুলেছি, আড্ডা মেরেছি। যেমন, ডাকু রূপ সিং, ডাকু মোধো সিং, ডাকু জান্ডেল সিং প্রমুখ। উত্তরপ্রদেশ থেকে মধ্যপ্রদেশ হয়ে রাজস্থান চষে বেড়িয়েছি ডাকাতদের সঙ্গে দেখা করব বলে। কখনও সফল হয়েছি, কখনও হইনি। মৃদুলদা আর আমার এই যাত্রা শেষ হয় প্রায় দেড় মাস পরে।

দ্বিতীয়বার চম্বল গিয়েছি ১৯৮২ সালে। ইতিমধ্যে ঘটে গিয়েছে ‘বেহমাই’ কাণ্ড। যে কাণ্ডের পরেই দেশ-বিদেশে নাম ছড়িয়ে পড়ে ফুলনদেবীর (Phoolan Devi)। ‘পরিবর্তন’-এ তখন ধীরেন দেবনাথের জায়গায় সম্পাদক হয়ে এসেছেন ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পার্থদার নির্দেশে আবার চম্বল যেতে হল। এবারের টিমে আমি আর দিব্যজ্যোতি বসু। অ্যাসাইনমেন্ট ফুলন আর মালখান সিং (Malkhan Singh)। ১৯৮২ সালে এরা দু’জনেই আত্মসমর্পণ করেছিলেন পুলিশের কাছে। তারা তখন গোয়ালিয়র জেলে। লখনউ পৌঁছেই খবর পেলাম ফুলনের মেন্টর বাবা ঘনশ্যাম (Baba Ghanshyam) জেল থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বুন্দেলখণ্ডের পাহাড়ি জঙ্গলে। যেভাবেই হোক তার দেখা পেতে হবে। রওনা দিলাম বুন্দেলখণ্ডের দিকে।

সূত্র বা যোগাযোগ বলতে কিছু নেই। ভরসা স্থানীয় মানুষ। কী কষ্ট করে যে দিব্যজ্যোতি আর আমি খুঁজে পেলাম একজনকে, যিনি আমাদের গাইড হয়ে নিয়ে যাবেন বুন্দেলখণ্ডের দুর্ভেদ্য জঙ্গলে। সে কাহিনিও দীর্ঘ। আমরা প্রায় খুঁজে পেয়েছিলাম বাবা ঘনশ্যামকে। কিন্তু একেবারে নাকের ডগা থেকে ফসকে গিয়েছিলেন তিনি। কারণ পুলিশ যে আমাদের ফলো করছে, তা আমরা টের পাবার আগেই ঘনশ্যাম ও তার দলবল বুঝে ফেলেছিলেন। তাই দেখা পেতে পেতেও খালিহাতে ফিরতে হয়েছিল। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বোধহয় সেখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরা।

তখনও ফুলনদেবী আর মালখান সিংয়ের সঙ্গে দেখা করা বাকি। এলাম গোয়ালিয়রে। গোয়ালিয়র জেলে ফুলনদেবী আর মালখান সিংয়ের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাওয়া গেল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। কিন্তু ছবি তোলা নিষেধ। দেখা হল। আগে মালখান সিং, তারপর ফুলন। জেলের সেল, না ফাইভ স্টার হোটেল! মালখান সিংয়ের সেলে অন্তত পাঁচটা টেবিল ফ্যান ঘড়ঘড় শব্দে ঘুরে যাচ্ছে। জেলরক্ষী তার পদসেবা করছেন। নিজের চোখে দেখা। তার ডাকাত হবার কাহিনি শোনা হল। এত সুপুরুষ আমরা আগে দেখেছি বলে মনে হয় না। ফুলনের দেখা পাওয়া গেল জেল প্রাঙ্গণে। তখনও হিংস্র বাঘিনীর মত তার চেহারা। ফুলনের কথাও আপাতত এটুকুই।

আমাদের প্রথমবারের চম্বল সফর প্রায় ৪৩ বছর আগের ঘটনা। দ্বিতীয়বারের ঘটনা তাও চল্লিশ বছর আগেকার। সেসবের ধারাবিবরণী গ্রন্থাকারে বেরচ্ছে। বইটির নাম ‘চম্বল লাইভ’। মৃদুলদা, দিব্যজ্যোতি আর এই প্রতিবেদকের চম্বল কাহিনি সচিত্র আর সবিস্তারে লেখা আছে এই বইতে। উৎসাহী পাঠক যদি চম্বল সম্পর্কে কিছু জানকারি নেবার প্রয়োজন অনুভব করেন, তবে বইটি হাতে তুলে নিতে পারেন।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »