Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

পুরাণ-ইতিহাস, প্রকৃতি ও স্থাপত্যের বিস্ময়পুরী

সাগর-পাহাড়ের দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত সমুদ্রই জয়ী হল। করোনাকালের দীর্ঘদিনের গৃহবন্দি দশা থেকে মুক্তির আনন্দটা যে এত আলাদা রকম মাত্রা আনবে তা আন্দাজ করতে পারিনি। পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ যে আবার পঞ্চইন্দ্রিয়ের দোসর হবে, লকডাউনে সেই বাসনাতেই দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছে। স্বপ্ন আজ সত্যি। বাঙালির ভ্রমণ-স্টেশন হাওড়া থেকে পুরীর উদ্দেশে রওনা দিলাম। ভোরের সমুদ্র দেখে মন গেয়ে উঠল, ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে।’ কিন্তু মোহ কাটতে বেশি সময় লাগল না। একটু এগিয়ে সাক্ষাৎ দারিদ্রের মুখোমুখি হলাম। তখন ভোর পাঁচটা, শীতটা সবে অল্পস্বল্প পড়তে শুরু করেছে। গায়ে ফিনফিনে এক জামা গায়ে দিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। সামনে নারকেল, তুলসীপাতার পসরা। টানা এক ঘণ্টা বসেছিলাম ওঁর দোকানের সামনে। একজন খরিদ্দারও দেখলাম না। মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল।

সূর্যোদয়ের মুহূর্তে পুরীর সমুদ্র।

পুরী। এই সমুদ্র শহরের জনপ্রিয়তা তীর্থস্থান হিসাবেই সর্বাধিক। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, ভগবান আহার করেন পুরী ধামে, স্নান করেন রামেশ্বরমে, শয়ন করেন দ্বারকায় এবং ধ্যান করেন বদ্রিনাথে। এই চার স্থান চারধাম নামে সুপরিচিত। জীবনধারণের জন্য আহারই যেহেতু সর্বোৎকৃষ্ট, জীবনের মূল চালিকাশক্তি। আর ভগবান এখানে আহার করেন তাই ভক্তদের বিশ্বাস পুরী ধামই শ্রেষ্ঠ ধাম, এখানে না এলে চারধাম যাত্রা সম্পূর্ণ হয় না। এই পূরণ বা সম্পূর্ণতা থেকেই নাকি ‘পুরী’ নামের উৎপত্তি বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের বিশ্বাস।

ঘুমহীন রাতের ক্লান্তি সারা শরীরে নিয়ে আর একদণ্ড দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না আর তখন। এইজন্য আমাকে বসিয়ে রেখে আমার সে গেল হোটেলের খোঁজে। বেশ খানিকক্ষণ সময়। এসময় দেখলাম প্রচুর পুণ্যার্থী সমুদ্রে আসছেন পুজোআচ্চা করতে। লোকমুখে শুনলাম এটি নাকি বৈষ্ণবদের ‘নিয়মসেবার মাস’। পরে পাণ্ডার কাছ থেকে এই মাসের মাহাত্ম্যকথা শুনেছিলাম। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, কৃষ্ণের মাখনচুরিতে যখন প্রতিবেশীরা অতিষ্ঠ তখন যশোদার কাছে বারবার অভিযোগ আসছে। মা যশোদা তখন সহ্য করতে না পেরে কৃষ্ণকে এক বৃহৎ আকৃতির ডম্বরুর সঙ্গে বেঁধে রাখেন। নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টায় একটা সময় শিশুকৃষ্ণ ওই ডম্বরু সহ দুটি গাছের ফাঁকে আটকে পড়েন। এবং তাঁর অসম্ভব শক্তিতে গাছদুটি ভেঙে যায়। বৈষ্ণবদের মতে, এই গাছদুটি স্বর্গের দুই অভিশপ্ত দেবতা। কৃষ্ণের স্পর্শে তাঁদের অভিশপ্ত জীবন শেষ হয় এবং পুনরায় তাঁদের স্বর্গবাস ঘটে। আর এই ঘটনার সময়কাল ছিল কার্তিক মাস। তাই বৈষ্ণবদের বিশ্বাস, এইমাসে তীর্থ করতে এলে তাঁদেরও স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটবে। এই কারণে প্রচুর বৈষ্ণব তীর্থযাত্রী কার্তিক মাসে পুরীধামে আসেন।

বালুকাবেলায় বালুভাস্কর্য।

এবার সৈকত থেকে উঠে পড়লাম। দুজনে হোটেলের খোঁজ শুরু করলাম। হোটেল খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ এসে পড়লাম ফেলুদার ‘হত্যাপুরী’-র ‘নীলাচল’ হোটেলে। ফেলুদার ‘হত্যাপুরী’ প্রিয় হলেও হোটেলটা ঠিক মনোমত হল না। ঘুম জড়িয়ে আসা শরীরটাকে কোনওমতে টানতে টানতে পছন্দমত হোটেলের বিছানায় গিয়ে মিশে গেলাম এক প্রকার। ঘুম ভাঙল সকাল দশ টায়। ঘুম থেকে উঠে পাউরুটি-ডিমটোস্ট খেয়ে স্নান সেরে নিলাম। তারপর বেরিয়ে পড়লাম । সৈকত সংলগ্ন বাজারে ঘোরাঘুরি করে দুপুরের ভোজনের জন্য এলাম ‘পেটে আগুন’ হোটেল। হোটেলের নামটা বেশ আকর্ষণ করার মত। আমার পেটের আগুন নিভল মুরগির ঝোল-ভাতে। দুপুরে আবার বিশ্রাম নিয়ে বিকালে সৈকতে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে The Odisha Tourism Development Corporation (OTDC)-এর টিকিট কাউন্টারে গিয়ে পরের দিনের জন্য চিল্কা ট্যুরের প্যাকেজ টিকিট কাটলাম। তারপর সমুদ্রসন্দর্শন। আমার এবং আমার তাহার এই প্রথম পুরীর সমুদ্রের সঙ্গে দেখা। নীল সায়রে ডুব দিলাম দুজনে নিঃশব্দে সমস্ত কোলাহল ভুলে। মন বলে উঠল, ‘ওরে ও নীলদরিয়া, দে রে দে আমারে ভাসাইয়া।’ কিন্তু জলে পা দিতেই সমস্ত রোমান্টিকতা মুহূর্তে উবে গেল। পুরীর সমুদ্র সৈকত এত ঢালু যে ঢেউ এলে নিজেকে সামলে রাখা দায়। কৌশল শিখে না নিলে বিপদ অবধারিত। এইজন্য কোনওমতে পায়ের পাতা ডোবানো জলে বহুদূর নোনাবালি তীর ঘেঁষে হেঁটে চললাম। দুপুরের ভাত, চিকেন কখন আমার পেটের গহ্বরে হারিয়ে গেছে। তাই সমুদ্রপাড়ে কিছুক্ষণ বসে জলযোগ সেরে নিলাম। চায়ে চুমুক দিয়ে বেশ একটা আমেজ লাগল। নভেম্বরের শুরুতে ঠান্ডার একটা হালকা ছোঁয়া একটু শীতের শিহরণ দিয়ে যায়। এরপর শপিং ফোবিয়া। কেনাকাটা করতে করতে ঘড়ির কাঁটা তখন ন’টা ছুঁইছুঁই। এরপর পুরীর বেশ জনপ্রিয় ‘দাদা-বউদির হোটেল’-এ রাতের খাওয়াদাওয়া সারলাম। খাবার সত্যিই সুস্বাদু। এইজন্য হোটেলে প্রচুর ভিড়। খাওয়াদাওয়া সেরে সাড়ে দশটার মধ্যে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় ওটিডিসি (OTDC)-র বাসে চিল্কা ট্যুর।

চিল্কা যাওয়ার পথে আলারনাথ মন্দির দর্শনের জন্য প্রথম বাস থেকে নামলাম। শোনা যায়, চৈতন্যদেব যখন প্রথম পুরীতে আসেন তখন নাকি মূল জগন্নাথ মন্দির বন্ধ ছিল। দিব্যোন্মত্ত অবস্থায় মহাপ্রভু তখন জগন্নাথের দর্শন না পেয়ে এই মন্দিরে আসেন। কারণ কথিত আছে, পুরীর মূল মন্দির বন্ধ থাকায় জগন্নাথদেব এই মন্দিরে চৈতন্যদেবকে দর্শন দেন। শুনেছি, শ্রীচৈতন্য নাকি এই পুরীতে এসেই গুম হয়ে গিয়েছিলেন। অনেকের দাবি, গুম-খুনও। তবে ভক্তদের বিশ্বাস, তিনি স্বয়ং নীলাচলে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গসন্তান ‘নদের চাঁদ’-কে পরবর্তীকালে ওড়িয়া প্রমাণের চেষ্টাও হয়েছে। তবে সেই বিতর্কিত প্রসঙ্গে আমরা ঢুকছি না। আপাতত মন্দির দর্শন করে আমরা আবার বাসে উঠে পড়লাম। এবার সোজা বাস থামবে চিল্কায়।

আলারনাথ মন্দির।

পুরী থেকে চিল্কার দূরত্ব ৩৭ কিমি। চিল্কা হল এশিয়ার বৃহত্তম নোনাজলের হ্রদ এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপকূলীয় নোনাজলের হ্রদ বা লেগুন। এর আয়তন ১১,০০০ বর্গ মাইল। হ্রদটি লম্বায় ৪০ মাইল। গভীরতা ৪.২ মিটার। হ্রদে মাছ চাষও করা হয়। এই হ্রদটিকে কেন্দ্র করে অন্তত ১,৫০,০০০ মৎস্যজীবীর জীবিকা এবং ১৩২টি গ্রামবসতি গড়ে উঠেছে। অসংখ্য পরিযায়ী পাখি, অবলুপ্তপ্রায় ইরাবতী ডলফিন এই হ্রদে দেখা যায়।

চিল্কার বুকে।

ওটিডিসি-র বাস যখন চিল্কা পৌঁছল তখন সকাল। চিল্কায় নেমে বোট বুকিং করে আমরা নেমে পড়লাম জলবিহারে। সঙ্গে নিলাম কিছু চিপসের প্যাকেট আর জল। সে নিদারুণ রোমাঞ্চ নিয়ে নেমেছিলাম চিল্কায়, সেই প্রত্যাশা চিল্কা রাখতে পারল না। জলের দীর্ঘ বিস্তৃতির সৌন্দর্যকে বাঁশখুঁটির বেড়াজাল যেন ফালাফালা করে দিচ্ছে। একঢালা, ঢলঢলে জলের সে সৌন্দর্য উপভোগ করার বাসনা একেবারে মাঠে মারা গেল। তবে ডলফিনরা হতাশ করল না। তিন-চারটি দেখা দিল। একটা সময় বোট এলে থামল হংসরাজ দ্বীপে। বেজার মন নিয়ে দ্বীপে ঢুকতেই মুগ্ধ হলাম এর সৌন্দর্য। সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যকে সম্পৃক্ত করেছে এখনকার আশ্চর্য নীরবতা। যেন আদিমচারী মানব-মানবী মনে হল নিজেদের। সমুদ্র এখানে আরও নীল। নীলের অপার তৃষ্ণা মিটিয়ে আবার বোটে ফিরলাম। ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়াল। এখানকার হোটেল বা ওটিডিসি কিচেনের এত সুনাম শুনেছি যে খাওয়ার সাহস করলাম না। মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ফিরলাম চিল্কা থেকে।

হংসরাজ দ্বীপের সমুদ্র সৈকত।

হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার দাদা-বউদির হোটেলে রাতের আহার সারলাম। পরদিন আবার পুরীর জগন্নাথ মন্দির দর্শন করার জন্য সকালে উঠতে হবে, তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। রাতেই হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে অগ্রিম একজন পাণ্ডা বুকিং করে রাখলাম।

হংসরাজ দ্বীপের অন্দরে।

সকালে উঠে স্নান সেরে রওনা দিলাম জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দেওয়ার উদ্দেশে। পাণ্ডাকাকুটি বেশ ভাল। প্রায় ২ ঘণ্টা পুরো মন্দির চত্বর ঘুরে দেখালেন। পুজো দিতে গিয়ে তো ভিড়ের চাপে নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার মত অবস্থা। এত ভক্ত সমাগম। এখানে যে জিনিসটা দেখে সবচেয়ে বিস্ময় জাগল তা হল মন্দিরের রন্ধনশালা। শত শত রাঁধুনী, সহযোগী দিয়ে এক দক্ষযজ্ঞের আয়োজন চলছে যেন। উনানের উপর সারি সারি হাঁড়ি সাজিয়ে বাষ্পের তাপে রান্না হয়ে চলেছে অসংখ্য হাঁড়ির।

পুরীর জগন্নাথ মন্দির।

পরদিন আবার ওটিডিসি-র বাসে চেপে রওনা হলাম কোনারক, নন্দনকানন, উদয়গিরি, খণ্ডগিরির উদ্দেশে। প্রথমে গেলাম ওড়িশা সরকারের sand museum-এ। এখানে বিখ্যাত বালুভাস্করদের নানা রকম স্থাপত্যকলার পরিচয় পাওয়া যায় চারদিকে। লাইভ বালুভাস্কর্য প্রদর্শনের সৌভাগ্যও হল। বালুশিল্প দর্শনের পর আবার উঠে পড়লাম বাসে। এক ফাঁকে রাস্তার ধারে ধাবায় প্রাতঃরাশ সেরে নিলাম।

Sand Museum-এ বালুভাস্কর্য।

এরপর যেখানে গেলাম জায়গাটির নাম বালুখণ্ড। সেখানে রয়েছে এক সুপ্রাচীন মন্দির, যার নাম রামচণ্ডী মন্দির। মন্দিরের সামনে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ল তা হল এখানকার শাপলাফুলের পুজোর ডালা। চমৎকার সুন্দর দেখতে এগুলো। এরপর গেলাম ইতিহাসের সম্মুখীন হতে। মন্দিরের পেছনেই আছে এক অপূর্ব দৃশ্য! চন্দ্রভাগা নদী ও বঙ্গোপসাগরের নয়নাভিরাম সঙ্গমস্থল। তবুও এই প্রাকৃতিক দৃশ্যকে ছাপিয়ে গেল ইতিহাস। যখন জানলাম কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত কৃষ্ণপুত্র শাম্ব আরোগ্যলাভের আশায় চন্দ্রভাগা নদীর তীরে এই স্থানেই নাকি তপস্যা করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত কুষ্ঠ থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। শাম্বের রোগমুক্তি ঘটায় প্রতিবছর মাঘ মাসের তিথিতে প্রায় ৬-৭ লক্ষ মানুষ এই নদীতে স্নান করতে আসেন কামনাপূর্তির জন্য। শোনা যায়, সত্যযুগে এই নদীতে সারাবছর জল থাকত না কিন্তু মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমী তিথিতে নদীতে জলের আবির্ভাব ঘটত। এখন মানুষ এত পুণ্যসঞ্চয় করেছে যে নদীতে পাম্প বসিয়ে জল তুলতে হয়।

শাপলাফুলের পুজোর ডালা।

এরপর এলাম ওড়িশার বিখ্যাত জায়গাগুলির অন্যতম কোনারক মন্দিরে। এর অপূর্ব স্থাপত্যকলা দেখে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার মত। প্রায় আধঘণ্টা সময় লাগল পুরো মন্দির প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখতে। যত সুন্দর এর স্থাপত্যকীর্তি, ঠিক ততটাই নৃশংসতার ইতিহাস আছে এই মন্দির নির্মাণের নেপথ্যে। রাজা লাঙ্গুলা নরসিংহদেব এই মন্দির নির্মাণের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বিশু মহারানা নামে এক কারিগরের ওপর এই মন্দির নির্মাণের ভার অর্পণ করেন। প্রায় ১,২০০ শ্রমিক ১২ বছর ধরে এই অসাধারণ স্থাপত্যকীর্তিটি নির্মাণ করেন বিশু মহারানার নেতৃত্বে। কিন্তু মন্দির নির্মাণের কাজটি সম্পূর্ণ হচ্ছিল না যতক্ষণ পর্যন্ত মঙ্গল কলসটি এর চূড়ায় স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছিল। বারোশো শ্রমিক সহ বিশু মহারানা এই কাজটি সম্পন্ন করতে পারছিলেন না কিছুতেই। এই ব্যর্থতায় রাজা নরসিংহদেব প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হন এবং মন্দির নির্মাণে নিযুক্ত সব কারিগরকে হত্যার আদেশ দেন। এই সময় বিশু মহারানার বালকপুত্র ধর্মপদ সেখানে উপস্থিত হয়। এবং মাত্র চারদিনে মন্দিরের চূড়ায় মঙ্গল কলস স্থাপনে সফল হয়। রাজা নরসিংহের নৃশংসতা তাতেও শেষ হয় না। যারা একযুগ ধরে রক্তজল করা পরিশ্রমে মন্দিরটি তিলে তিলে গড়ে তুললেন, শুধুমাত্র মঙ্গল কলস স্থাপনে অসমর্থ হওয়ার জন্য তাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকল। এই মৃত্যুদণ্ডের পেছনে তার যুক্তি এমন থাকতে পারত, ১,২০০ শ্রমিক যে কাজটি করতে অসমর্থ হল, একটা বালক সেইকাজ করে দেখাল, তাও মাত্র চারদিনে। তাহলে ওই বারোশো শ্রমিকের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। রাজার অভিপ্রায় এমন হবে তেমনটা বুঝতে পেরে পিতাসহ তাঁর সহকর্মীদের মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করে ধর্মপদ এবং মন্দিরের চূড়া থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। যারা কোনারকে গেছেন বা যাবেন তারা লক্ষ করেছেন বা করবেন যে মন্দিরের সামনে এখন কোনও সমুদ্র নেই। কিন্তু নির্মাণকালে সমুদ্র মন্দিরের ঠিক সামনেই অবস্থিত ছিল।

অসাধারণ স্থাপত্যকীর্তি কোনারকের সূর্যমন্দির।

এরকম নৃশংস ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে কোনারক মন্দির। যুগে যুগে এই নৃশংসতায় বিক্ষুব্ধ আমার তাই কোনও রাজারাজড়াকে মন্দির বা স্থাপত্যকীর্তির নির্মাতা বলতে ভীষণ আপত্তি। যারা নিজেদের শ্রম-পরিশ্রম দিয়ে এইসব স্থাপত্যকীর্তি নির্মাণ করেন তাদের কোনও নামই ইতিহাস স্মৃতিতে রাখে না। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে কবি ব্রেখটের ‘পড়তে জানে এমন এক মজুরের প্রশ্ন’ কবিতাটির কথা।

মন্দিরের আরাধ্য দেবতা আজ নেই।

কোনারক মন্দিরের আরাধ্য দেবতা ছিলেন সূর্যদেব। কিন্তু বর্তমানে মন্দির শূন্য। মন্দিরের আরাধ্য আর নেই। এই শূন্যতার কারণ হিসাবে দুটি প্রচলিত কাহিনি শুনলাম। প্রথমটি ধর্মপদ মন্দিরের চূড়া থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার পর মন্দিরকে অশুভ বলে চিহ্নিত করেন সবাই। ফলে মন্দিরের পুজোপাঠ বন্ধ হয় এবং সূর্যদেবের মূর্তিকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে স্থানান্তরিত করা হয়। দ্বিতীয় কাহিনি অনুযায়ী, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কারণে মন্দির বন্ধ হয় এবং মূর্তি জগন্নাথ মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। কোনারক মন্দিরে স্থাপত্যশিল্পের অনবদ্য একটি নিদর্শন হল সূর্যঘড়ি। এখানে দেওয়ালে সূর্যঘড়ির অস্তিত্ব সেইযুগের বিজ্ঞানচেতনার নিদর্শন। কীভাবে সূর্যের অবস্থান দেখে সময় নির্ণয় করা হত তা দেখে বিস্মিত হতে হয় বৈকী। এই মন্দিরের আর এক বিস্ময় ছিল মন্দিরের চূড়ার একটি পাথর। এমন এক চৌম্বকীয় শক্তি ছিল এই পাথরের, যা তৎকালে জাহাজ চলাচলের কম্পাসের দিকভুল করে দিত। ফলে অনেকবারই ভিনদেশি নাবিকদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ফলে পরবর্তীতে ইংরেজরা ওই পাথরটিকে মন্দিরের চূড়া থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে। সেই থেকে মন্দিরের চূড়া শূন্য। মন্দিরটি যে পাথর দিয়ে তৈরি করা হয় তা হল বালিপাথর। এই বালিপাথরের অস্তিত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। ফলে মন্দিরটিও বর্তমানে ক্ষয়ের পথে। বিবিধ বৈজ্ঞানিক উপায়ে মন্দিরের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবার চেষ্টা চলছে। ধর্মপাল, বিশু মহারানাদের দীর্ঘশ্বাসকে বুকে নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণ ছাড়লাম।

এর পরের গন্তব্য বৌদ্ধ শান্তি স্তূপ বা ধবল গিরি। এক ইতিহাস পেরিয়ে ইতিহাসের অন্য এক অধ্যায়ে প্রবেশ করলাম। ছোটবেলা থেকে ইতিহাসের সম্রাটদের মধ্যে সম্রাট অশোককে নিয়ে আমার দুর্বলতা ছিল চরমে। চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে উত্তরণের রোমাঞ্চকর ইতিহাস আমার কৈশোরমনে গভীর রেখাপাত করেছিল। আর যেইস্থানে এই উত্তরণের ঘটনাস্থল তাকে চোখের সামনে দেখে মনের মধ্যে শিহরণ জাগল।

বৌদ্ধ শান্তি স্তূপ বা ধবল গিরি।

সেই রক্তনদী, সেই রক্তাক্ত প্রান্তর, যা দেখে দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই সম্রাট অশোক মানবতার গভীর মর্ম, মর্মে মর্মে অনুধাবণ করেছিলেন। সেই কলিঙ্গ যুদ্ধ যেন মানসচক্ষে ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল। চোখের সামনে যেন দেখতে পেলাম রক্তাক্ত তরবারি হাতে নিয়ে সম্রাট অশোক বসে পড়েছেন মাটিতে, চোখে তাঁর অনুতাপের অশ্রু। হঠাৎ যেন রোমাঞ্চ লাগল, গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে উঠল। তখন খুব মনে হচ্ছিল বাবার সঙ্গে যদি এই দৃশ্য একসঙ্গে দেখতে পেতাম। কারণ বাবার সংস্পর্শেই আমার মধ্যে ইতিহাস-সচেতনতা তৈরি হয়েছিল প্রথম।

সেই রক্তনদী।

এই ঐতিহাসিক প্রান্তর, নদীকে স্মরণীয় করে রাখতে ওড়িশা সরকার ও জাপান সরকারের যৌথ উদ্যোগে, অশোকের বৌদ্ধ ধর্মের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে সম্মান জানিয়ে ১৯৭২ সালে তৈরি হয় বৌদ্ধ শান্তি স্তূপ। একরাশ মনকেমন করা অনুভূতি নিয়ে কলিঙ্গ প্রান্তর ছাড়লাম।

সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রান্তর।

পরের গন্তব্য নন্দনকানন। ভারতের ১০৪টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে নন্দনকানন একটি। ৪০০৬ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই উদ্যান। ২৬৬৯টি প্রজাতির প্রাণী এখানে সংরক্ষিত আছে। পুরো ফরেস্ট ঘুরে দেখার জন্য ব্যাটারিচালিত গাড়ির ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া নির্দিষ্ট অংশে পায়ে হেঁটেও দেখা যেতে পারে। এছাড়াও টয়ট্রেন বা রোপওয়ের ব্যবস্থাও আছে। জঙ্গল সাফারির জন্য আছে ওড়িশা টুরিজমের বাস। জীবজন্তু দেখতে খাঁচাবন্দি হয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বেশ রোমাঞ্চকর। এখানে সবচেয়ে বেশি যেটা আমার নজর কেড়েছে সেটা হল এখানকার রংবেরঙের হাঁস ও পাখি। ছবির মত সুন্দর এরা। বেশ কয়েকঘণ্টা ধরে বিচিত্র সব জীবজন্তু প্রদর্শনে কখন যে সময় কেটে গেল বোঝাই গেল না।

নন্দনকাননের বাঘ।

এরপর এলাম পুরনো ভুবনেশ্বরে। গোটা শহর জুড়ে শিব মন্দিরের ছড়াছড়ি। মন্দিরের প্রাচুর্যের জন্য এ পুরনো ভুবনেশ্বরকে ‘মন্দির মালিকা নগরী’-ও বলা হয়। ভুবনেশ্বরের সবচেয়ে পুরনো তথা বৃহত্তম মন্দির হল লিঙ্গরাজ মন্দির। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে এই মন্দিরের প্রচুর মিল পাওয়া যায়। মন্দিরের পূজারীরা বলেন, মন্দিরের মূর্তিটি দিন দিন মাটির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। তার কারণ নাকি পৃথিবীতে মানুষের পাপবৃদ্ধি। যত পাপ বৃদ্ধি পেতে থাকবে তত মূর্তিটি মাটির ভেতরে প্রবেশ করবে। মন্দির দর্শন করে ফেরার পথে যে কুলফি খেলাম, আহা! কী স্বাদ তার, প্রাণ জুড়িয়ে গেল।

নন্দনকাননের জিরাফ।

এরপর এলাম খণ্ডগিরিতে। দিনমণি প্রায় তখন অস্ত যায় যায়। খণ্ডগিরি হস্তিগুম্ফার একটি চমৎকার নিদর্শন। এই হস্তিগুম্ফা শিলালিপি সম্রাট খারবেল কর্তৃক উৎকীর্ণ হয়। হস্তিগুম্ফা নামক ১৪ নম্বর গুহার দেওয়ালে যে লিপি উৎকীর্ণ আছে, তা প্রাকৃত ভাষা ও ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা। এই ব্রাহ্মী লিপি এ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম লিপি। গোধূলির রহস্যময় আলো-আঁধারির খেলায় লিপিগুলোর প্রাচীনতার স্মারক বলে আরও বেশি করে দ্যোতনা দিতে লাগল। এই লিপির প্রথম পাঠোদ্ধার করেন জেমস্ প্রিন্সেপ। পরে আরও অনেকে পাঠোদ্ধার করেন। এই লিপির মূল বিষয়বস্তু চেত বংশের রাজা খারবেলের রাজত্বকালে সংগঠিত নানা ঘটনার বিবরণ।

খণ্ডগিরি হস্তিগুম্ফা।

সন্ধ্যা নামায় এবং সারাদিনের ক্লান্তিমাখা শরীর নিয়ে উদয়গিরিতে ওঠার আর সামর্থ্য হল না। খণ্ডগিরি থেকে উদয়গিরির উচ্চতা বেশি। এইজন্য সমগ্র ভুবনেশ্বরের মধ্যে উদয়গিরিতেই প্রথম সূর্যোদয় দেখা যায়। তাই এই পাহাড়ের নাম উদয়গিরি।

উদয়গিরি থেকে আবার ওটিডিসি বাস রওনা হল আবার পুরীর উদ্দেশে। গাড়ির ভেতর থেকে ছুটন্ত নিউ ভুবনেশ্বর শহরটাকে আলোর সাজে মোহময়ী দেখাচ্ছিল। কলকাতার থেকে কোনও অংশে কম নয় নিউ ভুবনেশ্বর টাউন। রাত আটটায় পুরী নামলাম। এই গোটা পর্যটনটাকে তথ্যসমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন আমাদের ওটিডিসি গাইড মি. মোহান্তি। তাঁর চমৎকার উপস্থাপন ক্ষমতা সবাইকে রীতিমত মুগ্ধ করেছিল।

পুরী সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত।

এতদিন সাইড সিন দেখার পর আজ আমাদের সমুদ্রে নামার পালা। আগেই বলেছি পুরীর সমুদ্র সৈকত প্রচণ্ড ঢালু। একের পর এক ঢেউয়ের তাণ্ডবে আমার তাহার পায়ে চোট লাগল। সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা। ক্রেপ ব্যান্ডেজ, ভোবেরন, ভলিনি স্প্রেতেও ব্যথা সারে না। সেদিন বিকালের পরিকল্পনায় ছিল পুরীর গোল্ডেন বিচ। আর যাওয়া হল না। যাও একটু বেরোলাম পুরোটাই পণ্ড করে দিল বৃষ্টি। হোটেলে ফিরে খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। সকাল সাতটায় চেক আউট। ট্রেন সকাল ১০.২৫-এ। সকালে স্নান সেরে ‘পরিব্রাজক’-কে বিদায় জানিয়ে সি-বিচে এসে প্রাতঃরাশ সারলাম। সমুদ্র যেন আমাদের মুখপানে চেয়ে বলছে ‘না না না।’ তবুও ‘যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়’ শাশ্বত সত্যি। সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে সোজা পুরী স্টেশন। পুরী ভ্রমণে পৌরাণিকতার সঙ্গে ঐতিহাসিকতার হরগৌরী মিলন আমাদের মুগ্ধ করেছে। তাই বাড়িতে ফিরেই আবার পুরী ভ্রমণের পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছি।

মলাটচিত্র: কোনারকের সূর্যমন্দির।

চিত্র: লেখক
4.5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »