ঘটনাস্থল অসমের শিলচর। ১৯ মে, ১৯৬১। বাংলাভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন ১১ জন বাঙালি। যদিও একদিনে আসেনি করুণ এই দিনটি। ইংরেজ শাসিত রাজ্যের আর্থিক ঘাটতি পূরণের জন্য বাংলা ভাষাভাষী তিন জেলাকে (শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি) অসমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। শিক্ষায় অগ্রসর অসমের বাঙালি-বিদ্বেষের জন্ম সেখান থেকেই।
একটু বিস্তৃত করে বলা যাক। ১৯৩১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী অসমে জনসংখ্যা ছিল:
১. সুরমা উপত্যকা (সিলেট ও কাছাড়)
বাংলাভাষী— ২৮,৪৮,৪৫৪
অসমিয়াভাষী— ৩,৬৯২
২. ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা (নেফা ও পার্বত্য জেলাসমূহ)
অসমিয়াভাষী— ১৯,৭৮, ৮২৩
বাংলাভাষী— ১১,০৫,৫৮১
পার্বত্য— ১২,৫৩,৫৮১
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির ১৬ বছর আগেই অসমে বাংলাভাষীর সংখ্যা দ্বিগুণ ছিল। সমতল কাছাড়ের অধিবাসীদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। অন্যদিকে, সেই সপ্তদশ শতক থেকে কাছাড়ের সরকারি ভাষা বাংলাই। অসমিয়া চিন্তানায়করা জানতেন, ভবিষ্যতে দেশ স্বাধীন হলে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় অসমের শাসন চলে যাবে বাংলা ভাষাভাষীদের হাতে। তাই বাঙালি খেদাও, তাদের ভাষাকেও খেদাও। ব্যস, শুরু হল রাজনীতি। শুরু হল বিষ ছড়ানো।
এই মুহূর্তে মনে পড়ছে একটি লোকসুর— ‘চল মিনি আসাম যাব/ দ্যাশে বড় দুখ রে/ আসাম দ্যাশে রে মিনি/ চা-বাগান ভরিয়া…’ এই গান কেন? স্বাধীনতার সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করার সময় শ্রীহট্টের অঙ্গচ্ছেদ ঘটে গেল। মুসলিম অধ্যুষিত সিলেট জেলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। বহু মানুষ আশার খোঁজে তখন। বাঁচার আশা। বড়বাবু আশা দেন। চাকরি মিলবে অসমের চা-বাগানে। কিন্তু সে কথা যে কেবল কথার কথা ছিল, তা বোঝা গেল কিছুদিনেই। ‘সর্দার বলে কাম কাম/ বাবু বলে ধইরা আন/ আর সাহিব বুলে লিব পিঠের চাম/ রে যদুরাম/ ফাঁকি দিয়া পঠাইলি আসাম!’ এই ছিল অত্যাচারের ইতিকথা। প্রায় ৩ লক্ষ চা-বাগান শ্রমিক, তাঁরা পড়লেন ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’র দলে। উদ্বাস্তু হতে হল লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু বাঙালিকে।
বাঙালি যেন স্বরাষ্ট্রেই ‘বিদেশি’ তখন। ‘অসম শুধু অসমিয়াদের জন্য’— এহেন সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে বাঙালির অধিকারহরণের চেষ্টা চলতে থাকল নিরন্তর। এমনকী বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে নির্দেশ মেনে পরিকল্পিতভাবে অসমিয়াকরণের প্রয়াসও চলতে থাকল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১— এই সময়ের মধ্যে ২৫০টি বাংলামাধ্যমের স্কুলের মধ্যে ২৪৭টি স্কুলই বন্ধ হয়ে গেল। কতদিন এই নির্বিচার সইবে বাঙালি? দানা বাঁধছিল বাঙালির শপথ। তবে সিধে আঙুলে ঘি না উঠলে?
বাঙালির মনে যে বিদ্রোহের বীজ বোনা শুরু হয়েছিল, তা আন্দাজ করেছিল বড় মহল। তাই আবার ব্যারিকেড। ১৯৫৪ সাল, খুবড়ি। অসমিয়াভাষাকে সরকারি ভাষা করবার দাবির আন্দোলন ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনে পরিণত হল। ১৯৬০ সালে গোটা অসমে উত্তেজনাকর মুহূর্তের সৃষ্টি হল। যার রেশ চলল ৪ জুলাই থেকে ১০ দিন। বাজেট বক্তৃতায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা প্রকাশ করলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ফকরুদ্দিন আলি আহমদ। যা ছেপে বেরোল ‘অসম ট্রিবিউন’ সংবাদপত্রে। বোঝাই যাচ্ছে, বাঙালিরা টার্গেট গ্রুপে পরিণত হয়েছিল। ওই বছরই ২৪ অক্টোবর অসম বিধানসভায় যে ‘একক অসমিয়া বিল’ পাস হয়, সেখানে বিপুল সংখ্যক পার্বত্য জনজাতির কথা বিবেচিতই হয়নি। আর বাংলাভাষা যে সেখানে চরম উপেক্ষা ও অবহেলা পায়, সে-কথা বলাই বাহুল্য।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের যে সুপারিশ, তার সামান্য মর্যাদাও সেখানে রক্ষিত হয়নি (State Reorganization Commission, Report, Page 211, Sec- 733, Para graph-719). ঘোষণা করা হল— ‘রাজ্যভাষা বিরোধী কাছাড়কে অসমের মানচিত্র থেকে অপসারিত করতে হবে।’ পরিস্থিতি যখন আরও ঘোলাটে, তখন রাজনীতির বাঘমামারা গুছিয়ে সান্ত্বনাও দিলেন— ‘বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে হবে।’ কারও অনুকম্পার ভিখিরি হয়ে কি বাংলাভাষাকে বাঁচতে হবে কেন? বাংলাভাষা কি এতটাই অসহায় হয়ে পড়েছে? বোঝাই যাচ্ছে, এরমধ্যে কিন্তু স্পষ্ট ভাষা-সাম্রাজ্য বিস্তারকারী মনোভাব।
১৯৬১-র ৫ ফেব্রুয়ারি, এক কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে আহুত হয় ‘কাছাড় জেলা সম্মেলন’। বাঙালি ভাই-বোনেরা এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। তারপর এল সেই সন্ধিক্ষণ। ১৯৬১, ১৯ মে। দিনটিতে শিলচর রেলস্টেশনের সামনে রেললাইন অবরোধের জন্য বিনা প্ররোচনায় বেলা ২টো ৩৫ মিনিটে গুলি চলে। ১১ জন বাঙালি এই ঘটনায় শহিদ হন। শহিদদের আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে এই ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। এক মাস ধরে এই আন্দোলন চলে। সরকার নতিস্বীকারে বাধ্য হয়। কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলায় বাংলাভাষা সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃত হয়।
শিলচরের বাংলাভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং ত্রিসপ্তক সহযোদ্ধা মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা ঋষিণ মিত্রের সঙ্গে একসময় এই বিষয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। তিনি উনিশে মে নিয়ে বহু কাজ করেছেন। তিনি এক সময় বলেছিলেন বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের আত্মাহুতি বৃথা যাবে হয়তো। বাঙালিরা আর কিছু না পারুক, তাঁদের ঐতিহ্য এবং ইতিহাসকে সুনিপুণভাবে অবহেলা করার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত।
আজ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের বাংলা ভাষাভাষী প্রতিটি মানুষের কাছে একটাই প্রশ্ন, কমলা ভট্টাচার্য, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, শচীন্দ্রচন্দ্র পাল, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, কানাইলাল নিয়োগী, কুমুদ দাস, তরণী দেবনাথ, হিতেশ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর দে-র ১৯৬১-র ১৯ মে-র আত্মদান কি বৃথা যাবে? বৃথা যাবে কি ১৬ আগস্ট ১৯৭২-এ করিমগঞ্জে বিজন চক্রবর্তীর আত্মোৎসর্গ? বৃথাই কি ১৯৮৬-র ২৬ জুলাই করিমগঞ্জে জগন্ময় দেব, দিব্যেন্দু দাসের আত্মাহুতি?
ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট ম্যাচ হলে দু’দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজার সময় বিশেষ করে বাঙালিরা গদগদ হয়ে ওঠেন। দু’দেশের জাতীয় সঙ্গীত রচনা খাস বাঙালি কবির। তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্টের ছড়াছড়ি হয়। তার জন্য তখন কত্ত আহা-উহু-কুহুকুহু! অথচ দেখুন, বাংলাভাষা নিয়ে আন্দোলনের কথা উঠলেই একুশে ফেব্রুয়ারির কথাই ওঠে। ক’জনই বা খোঁজ রাখেন একষট্টির ভাষা আন্দোলনের কথা? মনে রাখতে হবে, ১৯ মে ১৯৬১-তে ভারতভূমে বাংলাভাষার জন্য শহিদ হয়েছিলেন ১১ জন বাঙালি।