Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ম্যুরসো-মারির সম্পর্ক অবলম্বনে আলবেয়ার কামুর অস্তিত্বচিন্তা

আলবেয়ার কামুর (১৯১৩-৬০) উপন্যাস ‘L’Étranger’ প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। একই বছর প্রকাশ পায় ‘Le Mythe de Sisyphe’ (The Myth of Sisyphus) নামে দার্শনিক প্রবন্ধমালা। গ্রন্থদুটি একে অপরের পরিপূরক। কামু চেয়েওছিলেন রচনাদুটিকে এক মলাটে রাখতে। ফলে দুটি গ্রন্থকে সমান্তরালভাবে পড়াই দরকারি। ১৯৬৪ সালে প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘L’Étranger’ উপন্যাসটি ‘অচেনা’ নামকরণে অনুবাদ ও প্রকাশ করেন। এইটি ধরেই আমাদের আলোচনা। উপন্যাসের মূল চরিত্র ম্যুরসো।

উপন্যাসের কাহিনিতে সম্পর্কের ক্ষুদ্রতম একক হিসাবে ম্যুরসো ও তার মায়ের মধ্যেকার রক্তের সম্পর্ক, ম্যুরসো-মারির প্রেমের সম্পর্ক ও রেমন্ড-ম্যুরসোর বন্ধুত্বের সম্পর্ককে দেখানো হয়েছে। এবং বৃহত্তর অবস্থায় সমাজ, নৈতিক রাষ্ট্র ও Religion-এর সঙ্গে ব্যক্তি ম্যুরসোর সম্পর্ক উপন্যাসের বিষয়বস্তু। উপন্যাসের মূল চরিত্রই টেক্সটির কথক। সতর্ক ও সচেতন কথক।

‘L’Étranger’ প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে।

ম্যুরসোকে উদাসীন বলা গেলেও তাকে অসংলগ্ন বলাটাই খানিক বেশি উপযুক্ত হয়। তার সতর্ক সচেতনতা বেঁচে থাকার অনেক ভাব, অনুভূতি ও মনস্তত্ত্বকে অবজ্ঞায় এড়িয়ে যায়। উপন্যাসের কথনেও সেই ছাপ লক্ষ্য করা যায়। জীবনের ঘটনা বা দুর্ঘটনার, কোনও সম্পর্কের অর্থ সে নির্মাণ করতে চায় না। অস্বীকৃতির পাশাপাশি যাপনের অনিবার্য চলমানতা দ্বারাই তার ব্যক্তি, বিষয় ও ভাবের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয়। ম্যুরসোর এই সতর্ক সচেতন যাপন ও তার উপস্থাপন অন্য চরিত্রগুলোকে এক্সপ্লোর করার সুযোগ খানিক কমিয়ে দিয়েছে। ফলে উপন্যাসের সম্পর্কগুলিকে আমরা ম্যুরসোর দৃষ্টিতে দেখতেই চেষ্টা করছি।

মারির সঙ্গে তার সম্পর্ক আকাঙ্ক্ষার এবং অভ্যাসভিত্তিক। তাদের আলাপের পূর্বসূত্র থাকলেও তাদের সম্পর্কের সূচনা আকস্মিক ও খুব স্বাভাবিক। কোনও মনস্তাত্ত্বিক, প্রেমৈশ্বর্যপূর্ণ অর্থ সে এই সম্পর্ককে দিতে চায়নি প্রথম থেকেই। যদিও এই অর্থহীনতা সিদ্ধান্ত নয়, তা ম্যুরসোর যাপনের ভিত্তি। জীবনের প্রবাহমানতা সে নাকচ করে না, নাকচ করে প্রবাহমানতার অর্থনির্ণয় ও অর্থারোপের প্রচেষ্টাকে। ফলে বিয়েতে তার আপত্তি না থাকলেও, ‘ভালবাসা’ শব্দটিতে তার সংশয় প্রকাশ পেয়েছে।

দার্শনিক প্রবন্ধমালা ‘Le Mythe de Sisyphe’ (The Myth of Sisyphus)।

‘‘মারী সেদিন বিকেলে এল। জিজ্ঞেস করল আমি তাকে বিয়ে করবো কি-না। বললাম, আমার আপত্তি নেই। তার যদি আগ্রহ থাকে বিয়ে সেরে ফেলব।
মারী আবার তারপর জানতে চাইলো আমি তাকে ভালোবাসি কি-না। প্রায় আগের মতোই জবাব দিয়ে বললাম যে, ও প্রশ্নের কিছু মানে নেই বললেই হয়। তাকে ভালো বোধ হয় আমি বাসি না।’’ (৩৬)

অপর যে ভিত্তি তাদের সম্পর্ককে ধারণ করেছিল, তা আশা। উপন্যাসে কথক বলছে, ‘‘কিন্তু কিছুদিন কাটবার পর মনে হলো এই বিতৃষ্ণার কোন সত্যিকার হেতু নেই। সত্যি কথা বলতে গেলে প্রথমদিকে জেলে যে আছি তাই ভালো করে উপলব্ধি করতে পারি নি। কিরকম অস্পষ্ট একটা আশা তখন ছিল যে কিছু একটা শিগগিরই হবে— খুশি ও অবাক-করা কিছু।
মারী দেখা করতে আসার পরই পরিবর্তনটা ঘটল। মারী ওই একবারই দেখা করতে এসেছিল।’’ (৫৮)

জেলখানায় থাকাকালীন ম্যুরসোর মারির দেখা করতে আসার জন্য অপেক্ষা ও আশা এভাবে ফুটে উঠেছে। ফলে পাহারাদার একজন দর্শনপ্রার্থীর কথা উল্লেখ করা মাত্র ম্যুরসোর মারির কথাই মনে এসেছিল জেলে বসে। দেখা হলে অবশ্য ম্যুরসোর কোনও মানসিক স্বস্তি, শান্তি, উদ্বিগ্নতার কথা আমরা উপন্যাসে পাই না। তার সম্পর্ককে শরীরতৃষা মনে হলেও, আসলে ম্যুরসো সকল মানসিক অনুভূতিগুলো এড়িয়ে কেবল চারপাশে যা দেখা যায়, স্পর্শ করা যায়, তার অস্তিত্বকেই গুরুত্ব দেয়। মন ও চিন্তার নির্মিত আবেগ অনুভূতিগুলোকে সে এই সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তার জ্ঞানসীমার বহির্গত বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছে।

আলবেয়ার কামুর (১৯১৩-৬০)।

পরবর্তীতে যখন বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগ একেবারে ছিন্ন হয়ে গেল। স্মৃতিচর্চার মাধ্যমেও সে যে সবসময় মারির কথাই ভেবেছে— এমন নয়। আরও অন্য নারীর কথাও ভেবেছে এবং সেই ভাবনা শারীরিকই। আশাহীন আকাঙ্ক্ষা। মারির সঙ্গে তার সম্পর্ক যখনই অভ্যাস ও আশার সীমান্ত পেরিয়ে গেল, অনেক নারীর ভিড়ে মারিও একজন হয়ে উঠল। তবু মারির সঙ্গে তার পুরোনো যাপনের অভ্যাস তার স্মৃতিতে রয়েই গেল একটা সম্পর্ক হিসাবে,— যা কামনা আকাঙ্ক্ষার অন্য নারীদের থেকে তাকে পৃথক পরিচয়েই ম্যুরসোর মনে থেকে গেল। ম্যুরসো উপন্যাসে বলছে, ‘‘মারীর নানা পোশাক আর তার হাসি পরপর মনের উপর দিয়ে বয়ে গেল।’’ (৮৪) সর্বশেষে যদিও মারি ও মারির সঙ্গে ম্যুরসোর সম্পর্ক অভ্যাস, আকাঙ্ক্ষা, আশা, অপেক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে গেলে তা বাস্তবিক অর্থে প্রয়োজনহীন এবং সুখস্মৃতিতেই পরিণত হল। বিচারপতির রায়দানের সময় ম্যুরসোর আর মারির মুখের দিকে তাকানোর উৎসাহও এ-কারণে ফুরিয়ে গেল। এবং তার মৃত্যুর পর তার আশা ও স্মৃতির অস্তিত্ব যে থাকবে না, ম্যুরসো এও উপলব্ধি করল মৃত্যুদণ্ড লাভের পর।

ম্যুরসো ও মারির সম্পর্কটি আসলে বৃহত্তর অর্থে আলবেয়ার কামুর অস্তিত্বের অ্যাবসার্ডিটি চিন্তাকেই দৃশ্যমান করে। এই সম্পর্কটির মধ্যে দিয়ে অলংকারহীন যেকোনও মানবিক সম্পর্ককেই যেন ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। বাইরের অতিরিক্ত আবরণ ঝরাতে ঝরাতে আমাদের জীবনের অতি রিক্ত অথচ তাৎপর্যপূর্ণ অস্তিত্বকেই ম্যুরসো এবং মারির সম্পর্ক দিয়ে আমরা উপলব্ধি করতে পারি।

চিত্র: গুগল
3 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Debodhriti Das
Debodhriti Das
2 years ago

আপনাদের এখানে লেখা পাঠানোর মাধ্যম কি?

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »
দীপক সাহা

বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে লেন্সবন্দি করেছেন সাইদা খানম

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বিখ্যাত প্রায় সকল ব্যক্তিত্ব— ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— কার ছবি তোলেননি! সেই সঙ্গে রানি এলিজাবেথ, মাদার টেরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্নের মতো বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তুলেছেন। এই বিশাল তালিকায় আরও তিনটি নাম যুক্ত করে না দিলে অন্যায় হবে। চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন তিনি।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

দেবী কালিকার খড়ের মেড় দেখে মজুমদার গিন্নি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, মামলার রায় যদি তাঁদের পক্ষে যায় তাহলে কলাগাছের থোড় কুঁচো দিয়ে হলেও জগজ্জননী মা মহাকালীর পুজো করা হবে, আর যদি মামলার রায় তাঁদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ওই খড়ের মেড় দামোদরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। যদিও সেদিন দুপুরের মধ্যেই আদালত থেকে মজুমদার জমিদার পক্ষের জয়লাভের খবর পৌঁছেছিল থলিয়ার মজুমদার বাড়িতে। মজুমদার-গিন্নিও অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। মামলায় জয়লাভের খবর পাওয়া মাত্রই জমিদার-গিন্নির নির্দেশে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দীপাবলি উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বরিশাল শ্মশান-দীপালি

সমগ্র উপমহাদেশে বরিশাল শ্মশান একটি বিশেষ কারণে অনন্য। এই শ্মশানের বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিবছর কার্তিকী অমাবস্যায়, (যাকে শাস্ত্রে ‘অশ্বযুজা’ মাস বলে) সেখানকার এই শ্মশানে যে কালীপুজো হয়, সেখানকার পুজোর আগের দিন ভূতচতুর্দশীর রাতে লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়। উদ্দেশ্য, ওখানে যাঁদের দাহ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। সমগ্র শ্মশান জুড়ে কয়েক হাজার মঠ বা স্মৃতিসৌধ আছে, মুসলমানদের যেমন আছে বনানী বা অন্য বহু গোরস্তানে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বৌদ্ধসম্প্রদায়ের প্রবারণা ও কঠিন চীবরদান উৎসব

বিশ্বের বহু দেশেই এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। স্পেন ও ফ্রান্স-সহ ইয়োরোপীয় দেশে চীনা, জাপানি, বাঙালি বৌদ্ধরা পালন করেন যেমন, তেমনই বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি থেকে কুয়াকাটা-কলাপাড়া এই উৎসবে মেতে ওঠে। ইওরোপীয়দের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকবছর আগে দালাই লামা যেবার শিলিগুড়িতে তাঁর বার্ষিক অনুষ্ঠান করলেন, সেবার প্যারিস থেকে আগত বেশ কিছু ফরাসির সঙ্গে আলাপ হয়, যাঁরা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। তাঁদের কাছেই শুনেছিলাম, ফ্রান্সে বহু মানুষ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিচ্ছেন।

Read More »
শায়ক মুখোপাধ্যায়

শায়ক মুখোপাধ্যায়ের দুটি কবিতা

যাদের কাছে আজকে তুমি পৌঁছে গেছ,/ সবাই কিন্তু আয়নার মতো এখানে/ এখনও পুরো ফিরে আসতে পারেনি;// আয়না হয়ে কেউ আবার ফেরে নাকি!/ হয়তো কেউ কেউ বা কাছে ফিরে আসে;// সূর্যের রং হরিদ্রাভ কুসুম আলো/ শেষ আশ্রয় হৃদয়শূন্য হয়ে গেলে,/ যারা তবুও মনে করে রক্তের গন্ধ/ আজ শিরায় শিরায় নতুন যাদের/ ফিরে আসা এখানে অথবা যেখানেই দূরে হোক,// সে সবের প্রয়োজন সমস্তটাই ফুরিয়ে গেছে।

Read More »