Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

বাংলার লোকসংস্কৃতিতে মনসা

হিন্দু দেবদেবীদের মধ্যে প্রধানত দুটো ভাগ দেখা যায়। পৌরাণিক এবং লৌকিক। শিব, দুর্গা, কালী, সরস্বতী— এঁরা পৌরাণিক। অন্যদিকে, শীতলা, সন্তোষী, মনসা প্রমুখ লৌকিক। এঁদের পূজারাধনা অনেক পরবর্তীকালের। পৌরাণিক দেবীরা পূজিতা হন নির্দিষ্ট তিথিনক্ষত্র মেনে, অন্যদিকে লৌকিক দেবতারা সাধারণত বাংলা মাসের শেষদিন, অর্থাৎ সংক্রান্তিতে পূজিত হন। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে যেমন বিশ্বকর্মা। মনসার পুজো শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে।

বর্তমান লেখায় আমাদের আলোচ্য মনসাকে কেন্দ্র করে রচিত বাংলা সাহিত্য, বাংলা সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে মনসার স্থান, মনসার পট, মনসামঙ্গল গীত এবং মনসার জাত ও রয়ানি। মনসার মূর্তি নিয়েও কিছু কথা থাকবে।

মনসা বাংলা ভূখণ্ডে (সাবেক বাংলা ও তৎসহ বিহার, ওড়িশা ও আসাম) পূজিতা হওয়ার কারণ, নদীমাতৃক ও জঙ্গলাকীর্ণ এ-অঞ্চলে সাপের উপদ্রব। সুন্দরবনে বাঘের দেবতা বনবিবি-দক্ষিণরায়, সারা বঙ্গে ওলাওঠা (কলেরা-বসন্ত) থেকে রক্ষা পেতে যেমন শীতলার পুজো দেন লোকে, সর্পভীতি থেকে বাঁচার জন্য তেমনই মনসা পূজা। অন্য পুজোয় বলির ব্যবস্থা না থাকলেও মনসা পূজায় বলির বিধান আছে।

লৌকিক দেবদেবীদের দিয়ে মধ্যযুগে বাংলায় অজস্র মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। মুখ্য কাব্যগুলির মধ্যে চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ও মনসামঙ্গল, আর গৌণ কাব্যগুলি শীতলামঙ্গল, রায়মঙ্গল ইত্যাদি।

মনসা যে বাংলায় দীর্ঘদিন ধরে পূজিত, তার দুটি অব্যর্থ প্রমাণ আছে। ঢাকার বিক্রমপুরে দশম শতাব্দীর একটি মনসা মূর্তি পাওয়া গিয়েছে, কোলে সন্তান আস্তিক। অন্যদিকে মনসামঙ্গলের কবি বাংলার ব্যাপ্ত অঞ্চল থেকে এসেছেন। এ-কাব্যের আদিকবি তেরো শতকের কানা হরিদত্ত ময়মনসিংয়ের। বিজয় গুপ্ত বরিশাল, বিপ্রদাস পিপলাই চব্বিশ পরগনা, কেতকীদাস ক্ষেমানন্দ হুগলি এবং নারায়ণদেব প্রথমে রাঢ় ও পরে পূর্ববঙ্গের।

শিবভক্ত চাঁদ সদাগর কীভাবে নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে মনসাকে পুজো করতে বাধ্য হলেন, এই কাহিনি নিয়েই মনসামঙ্গল। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের চেয়ে মনসামঙ্গলের পার্থক্য হল, অন্যসব মঙ্গলকাব্যে দেবদেবীদের কাছে ভক্তদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ আছে, কিন্তু চাঁদ সদাগর দেবী মনসার কাছে নয়, আত্মসমর্পিত তাঁর পুত্রবধূ বেহুলার কাছে, যিনি তাঁর মৃত স্বামী লখিন্দরকে স্বর্গ থেকে দেবতাদের কাছে, জীবনানন্দের ভাষায় ‘ছিন্ন খঞ্জনার মত’ নেচে দেবতাদের তৃপ্ত করে পুনর্জীবিত করে এনেছিলেন একটি শর্তে, চাঁদ যদি মনসা পুজো করেন, তবেই লখিন্দর আয়ু লাভ করবেন। চাঁদের মনসা পুজো বেহুলার প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা। গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘বিজয় গুপ্ত দেবতার মাহাত্ম্য রচনা করেন নাই, মানবেরই মঙ্গলগান গাহিয়াছেন।’ কবি কালিদাস রায় এ-জন্য চাঁদের প্রশস্তিবন্দনায় লিখেছেন, ‘তুমি দেবতার-ও বড়/ এই মোর অর্ঘ্য ধর/ শৈব সাধু চন্দ্রধর বীর।’

উল্লেখ্য, প্রাচীন মিশর, গ্রিস ও রোমেও কিন্তু মনসার অনুরূপ সর্পদেবতা আছেন। আবার পূর্ব ভারত যেমন, তেমনই দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে— যেমন, কর্নাটক, তামিলনাড়ু বা অন্ধ্রপ্রদেশে মনসার অনুরূপ নাগাম্মা, বালাম্মা, মুদাম্মার পুজো প্রচলিত আছে।

মঙ্গলকাব্য হিসেবে মনসামঙ্গলের অনন্যতা হল, এখনও প্রতি বছর আষাঢ়-সংক্রান্তি থেকে শ্রাবণ সংক্রান্তি পর্যন্ত একমাস ব্যাপী গ্রামেগঞ্জে মহিলাদের দ্বারা সুরসহযোগে গীত হয়। আমার সংগ্রহে বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল আছে, বরিশাল থেকে প্রায় একশো বছর পূর্বে প্রকাশিত। বরিশাল থেকে এ-বই প্রকাশ সমগ্র জেলাতে বইটির জনপ্রিয়তার পরিচয় দেয়।

মনসামঙ্গল পাঠের শ্রোতা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। কত বিচিত্র সুর-ই না আছে এর! ‘ঢলান-জিয়ান’ বলে দীর্ঘ একটি পর্ব আছে এর। অর্থাৎ লখিন্দরকে সাপে কামড়ানো থেকে তাঁর পুনর্জীবনপ্রাপ্তির সুদীর্ঘ অধ্যায়, সুরসহযোগে যা শেষ করতে আট-দশ ঘণ্টা লাগে। যত সময়ই লাগুক, ওই অংশটা একদিনেই পড়ে শেষ করতে হবে। পনেরো-বিশজন মহিলা উদাত্ত কণ্ঠে এত সময় ধরে সুর করে চিৎকৃত স্বরে ‘ঢলান-জিয়ান’ পাঠ করছেন দেখাটা দুর্লভ অভিজ্ঞতা। সর্পদংশনের অধ্যায়ে পাঠের সঙ্গে কান্না, আবার যখন ‘লখাইর শরীরে বিষ নাই নাইরে’ অধ্যায়ে চলে এসে গায়িকাদের পুলকিত হর্ষধ্বনি, অসাধারণ শিহরণ এনে দেয় দর্শক-শ্রোতাদের মনে।
এক মাস পাঠ শেষে শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মনসা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মন্দিরে অথবা বাড়িতে। অন্যান্য নৈবেদ্য তো থাকেই, মনসার বাহন সাপের জন্য দুধকলা অবশ্যই রাখতে হয়। বলির প্রথাও আছে, তবে সর্বত্র নয়। বিজয় গুপ্তের লেখায় পাই, মনসাকে আহ্বান জানানো হচ্ছে এইভাবে, ‘মর্ত্যভুবনে আইয়া/ ছাগমহিষ বলি খাইয়া/ সেবকেরে বর দিয়া যাও।’

মনসামঙ্গল পাঠ করা হয় শ্রাবণ মাস জুড়ে। আর মনসার কাহিনিভিত্তিক ‘রয়ানি’, যা একধরনের পালাগান, এক-দুঘণ্টায় সমাপ্য (সেলিম আলদীন একে বলেছেন ‘বাইশা রীতি’), অনুষ্ঠিত হতে পারে যে-কোনও ঋতুতে। আবার ‘মনসার জাত’ কেবল মেয়েদের দ্বারা গীত, মূলত পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার নিজস্ব মনসাবন্দনা গান। সে-গানের সুরবৈচিত্র‌্য মুগ্ধ করার মত। মনসা পূজায় মাটির মূর্তি, বাঁধানো ছবি বা পট ব্যবহৃত হয়। এ বছর ঢাকায় থাকার সুবাদে স্বামীবাগস্থিত লোকনাথ আশ্রমে দক্ষ কারিগরের হাতে তিলে তিলে মনসা মূর্তি নির্মাণ দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে। হরিদ্বারে মনসা মন্দিরে গেছি, তবে বরিশালের গৈলায় বিজয় গুপ্তের বাড়ির মনসা মন্দির দেখার অনুভূতি আলাদা।

একালে মনসাকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন অমিয়ভূষণ মজুমদার, সেলিনা হোসেন। কায়সার হক রচিত ‘The Triumph of the Snake Goddess’ এক অসাধারণ কাজ। আছে শম্ভু মিত্রের নাটক ‘চাঁদ বণিকের পালা’। আর রয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতা, চাঁদ সদাগরের বকলমায় তাঁর উচ্চারণ, ‘যতদিন হিন্তাল কাঠের/ লাঠি আছে হাতে, আছে/ ধমনীতে পৌরুষের কিছু তেজ, যতদিন ঠোঁটে/ আমার মুহূর্তগুলি ঈষৎ স্পন্দিত হবে, চোখে/ নিমেষে উঠবে ভেসে কোন শোভাযাত্রার মশাল,/ করবো না আন্ধারের বশ্যতা স্বীকার ততদিন।’

চিত্র: পাল যুগে নির্মিত ধাতুনির্মিত ভাস্কর্যে মনসা। সৌজন্যে গুগল।
4.5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
কল্পোত্তম
কল্পোত্তম
2 years ago

পড়ে খুবই ভালো লাগলো। মনসার বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। তবে পুরুলিয়াতে ছেলেরাই জাঁত গেয়ে থাকে সুর ও বাজ-বাদ্য সহকারে।

Recent Posts

সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »
নন্দিনী কর চন্দ

স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্দরমহলে: কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি

বিস্মৃতির অতলে প্রায় তলিয়ে যাওয়া এমন কয়েকজন মহিলা কবির কথা আলোচনা করব, যাঁরা তাঁদের কাব্যপ্রতিভার দ্যুতিতে বাংলা কাব্যের ধারাকে উজ্জ্বল ও বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণকামিনী দাসী, মোক্ষদায়িনী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, লজ্জাবতী বসু, জগন্মোহিনী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, হিরণ্ময়ী দেবী, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, সুরবালা ঘোষ প্রমুখ।

Read More »
মোহাম্মদ কাজী মামুন

বালকেরা অচেনা থাকে : এক অবিস্মরণীয় পাঠ অভিজ্ঞতা

ঘাসফুল নদী থেকে প্রকাশিত ‘বালকেরা অচেনা থাকে’ গল্পগ্রন্থটি যতই এগোনো হয়, একটা অনুতাপ ভর করতে থাকে পাঠকের মনে— কেন আগে সন্ধান পায়নি এই অমূল্য রত্নসম্ভারের! হ্যাঁ, রত্নসম্ভারই, কারণ একটা-দুটো নয়, প্রায় দশটি রত্ন, তাও নানা জাতের— লুকিয়ে ছিল গল্পগ্রন্থটির অনাবিষ্কৃত খনিতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসবের শতবর্ষ

কবির প্রয়াণের পরের বছর থেকেই আশ্রমবাসী বাইশে শ্রাবণকে বৃক্ষরোপণ উৎসব বলে স্থির করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনটিই এ-উৎসবের স্থায়ী তারিখ। বাইশের ভোর থেকেই প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় উৎসব। সকালে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বিচিত্রভাবে একটি পালকি চিত্রিত করেন ছবি এঁকে, ফুল, লতাপাতায়। মঙ্গলধ্বনি দিতে দিতে এর পর পালকির ভিতরে টবের মধ্যে একটি চারাগাছকে স্থাপন করা হয়। অতঃপর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গীত-পরিবেশন-সহ আশ্রম-পরিক্রমা।

Read More »