বড়াইটা করে স্বয়ং অয়দিপাউসই— অয়দিপাউস তুরান্নস (Oidipous Turannos) নাটকে (যেটা আমরা ‘রাজা অয়দিপাউস’ হিসেবে জানি)— একেবারে প্রথম সংলাপে। কে এই অয়দিপাউস? কী করে বা সে জগতে বিখ্যাত হয়ে পড়ল? থিবসের বাইরে তো তার বিশেষ কোনো কীর্তিকলাপ নজরে আসে না! এথেন্সের কাছে কলোনাসে সে রহস্যজনকভাবে মরে বটে, আর এথেন্সের সে যক্ষও ছিল; কিন্তু জীবৎকালে তো সে সেই ভবিতব্যতার কথা জানত না! সে তো এক আদর্শ রাজা! নাটকের শুরুতেই তার এমন আত্মম্ভরী বড়াই কেন? ব্যাপারটা আমাদের ভাবায়, কারণ ‘ঈডিপাস’ নামে ইংরিজিতে আর ‘অয়দিপাউস’ নামে বাংলায় যাকে চিনি, মূলে তার নামটা ‘ঐদিপৌস’ বা ‘ঐদিপউস’ বা ‘অইদিপউস,’– এইধরনের ছিল। উচ্চারণের ভ্রান্তি/অভ্রান্তি নিয়ে কথা নয়; প্রশ্নটা হল, এই সর্বলোকখ্যাত নামটা এল কোথা থেকে? গ্রীক পুরাণে অউস্-ভাগান্ত নাম দুর্লভ। বেশিরভাগই এউস্ অথবা আউস্-ভাগান্ত। Nilsson প্রমুখ পুরাসংস্কৃতির বিশেষজ্ঞরা বলছেন : অউস্-অন্তিকতা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এটা একটা অতিপ্রাচীন নাম। গ্রীক পুরাকথার একেবারে আদিতম স্তরে এই নাম উদ্ভাবিত হয়েছিল ও কাহিনী গড়ে উঠেছিল।
দ্বিতীয়ত, অয়দিপাউস মানে বলা হয় ‘স্ফীতপদ’। আদি ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষায় ‘অইদ্রস্’ বলে কোনও শব্দ ছিল বলে যদি ধরে নেওয়া হয়, তবে ‘অয়দি’ শব্দের মানে দাঁড়ায় ‘জলস্ফীতি’ (যে ‘অয়দি’ শব্দটা এখনও oedema রোগের নামের মধ্যে রয়ে গেছে)। ঈডেমা রোগ পায়েই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়; অতএব অয়দিপাউসের পা জলের কারণে না-ফুললেও তার সঙ্গে স্ফীতপদ নামটা বেশ খাপ খেয়ে যায়। কিন্তু গোল বাধে অন্য জায়গায় : ‘পউস’ শব্দটাও ‘পা-ওয়ালা’ অর্থে সিদ্ধ নয়। অইদি-র সঙ্গে মেলাবার জন্য জোর করে ওর অর্থ ‘পা’ করা হয়েছে মনে হয়। যদি ped (পদ) থেকে ওর উৎপত্তি হয়ে থাকে তো ওর ‘দ’ ধ্বনিটা গেল কোথায়? আবার যদি octopos-এর মতো দ-লুপ্ত হয় তো নামটা Oidipos নয় কেন? ous-অন্তটা ওখানে কী করছে? তাই কেউ কেউ বলেন যে ও-শব্দটা আসলে ওই বিরল অন্ত-যুক্ত ‘pous’ নয়, ‘pais’— অর্থাৎ শিশুসন্তান। তখন নামটার মানে গিয়ে দাঁড়ায় ‘জলস্ফীতির সন্তান’।
ব্যাপারটা খুব অর্থহীন হয়ে পড়ল কি? তেমন অর্থহীন লাগে না, যখন ভাবি যে আবিশ্ব পুরাকথায় কর্ণ, পার্সিউস, মোজেস, ভীষ্ম, প্রমুখ বহু বীরকেই শৈশবে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, জোয়ারের স্ফীতিতে ভেসে তাঁরা কোথাও গিয়ে ঠেকেছিলেন, এবং অতঃপর উদ্ধার পেয়ে, দেশের বাইরে শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে, বয়সকালে ঘরে ফিরে রাজ্যলাভ করেছিলেন। সে-হিসেবে বীরমাত্রেই ‘স্ফীত জলধির সন্তান’। প্রাপ্ত কাহিনীতে অয়দিপাউসকে জলে ভাসানো না-হলেও তার নাম থেকে প্রমাণ হয় সে মূল একটা পুরাকথার ছকে গড়ে নেওয়া অতি প্রাচীন এক বীর, গ্রীকরা যাদের বলত ‘হেরস্’। যাবতীয় মানবগোষ্ঠীরই নিজেদের হেরস্ ছিল, যাদের যুগটাকে হেরোইক বা হিরোইক যুগ বলা হত; তাদের নিয়ে বীরগাথা ও নাট্য ছিল, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল কোনো না কোনো হেরস্। সেই হিরোইক নাট্যের কল্যাণেই নাটকের মূল চরিত্রের ভূমিকা পরের যুগে ‘হিরো’ বা ‘হীরো’ হয়ে গেছে।
তাহলে কে ছিল এই অতিপ্রাচীন অতিপ্রথিত অয়দিপাউস? রবার্ট গ্রেভস্ অনুমান করছেন অয়দিপাউস পূর্বেতর যুগের ত্রয়োদশ শতকের, অর্থাৎ গ্রীসে প্রথম আর্য্যা হানাদারির যুগের, কোনও আগ্রাসী অনুপ্রবেশকারী গোষ্ঠীর নেতা বা প্রতিভূ হয়ে থাকতে পারে। সে (অর্থাৎ তার গোষ্ঠী) একটা জনপদ ক্রমে দখল করে সেখানকার প্রাচীন মাতৃধর্মের উচ্ছেদ ঘটিয়ে পিতৃধর্মী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। পুরাকথায় এর প্রথমটা স্ফিংক্সের মৃত্যুতে আর দ্বিতীয়টা য়োকাস্তের মৃত্যুতে প্রতীকায়িত হয়েছে।
অবশ্য ব্যাপারটা এত একরৈখিক নয়। বর্বর আর্যরা সুসভ্য আমেরিকানদের মত গুলি-বন্দুক চালিয়ে নরহত্যা-জাতিহত্যা করে একটা দেশ দখল করে নিয়েছিল— এ-ছবিটা খুব চাঞ্চল্যকর হলেও সঠিক নয়। গোড়ায় অল্প কিছু লোক এক জায়গায় থানা গেড়ে বসত; তারপর আরও কিছু লোক, আরও কিছু… এবং তারা ক্রমে আদি অধিবাসীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের সমাজ ও সংস্কৃতির ওপরে চাপ সৃষ্টি করত। অতঃপর বলবত্তর হবার জোরেই তারা ক্রমে সমাজ ও শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটাত। কিন্তু আর্যরা ছিল নভোবাসী দেবতাদের উপাসক। মাটিতে শেকড়-গাড়া যে প্রাচীন ধর্মধারা, তাকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ তারা করতে পারত না। সেগুলো সব থাকত; কিন্তু প্রাচীন সংস্কৃতির বহু চর্চা ও প্রতীকের অর্থ তারা নিজেদের মত করে বানিয়ে নিত, ব্যাখ্যামূলক কাহিনী হিসেবে। সেই সময়ে আগন্তুক ও আবাসী এই দুইয়ের ‘দ্বন্দ্ব’— অর্থাৎ সংঘাত ও মিলনের ফলে জন্ম নিয়েছিল নানা কাহিনী বা মিথ, যার মধ্যে অন্যতম প্রাচীন হল অয়দিপাউসের মিথ।
মাতৃধর্মীরা ছিল ধরিত্রীর পূজারী। ধরিত্রী নিত্যপ্রসূ, কিন্তু তিনি কারও অধীনা নন; বছর বছর নতুন বীজ তাঁর গর্ভে উপ্ত হয় আর তিনি শস্য প্রসব করেন। তিনি চিরমাতৃকা ও চিরকুমারী : তাঁর অধিকার আছে শস্যের ওপরে; কিন্তু শস্যের কোনো অধিকার তাঁর ওপরে নেই : শস্যকে কেটে ফেলা হয়, তারই বীজ ধরিত্রীকে পুনরায় শস্যবতী করে। সেই শস্যও কেটে ফেলা হয়, এবং… এবং এই প্রক্রিয়াটাকে স্থায়ী করার জন্য সমাজের স্বার্থে গোষ্ঠীগতভাবে নানা ঊর্বরতা-কৃত্য করতে হয়। সারা পৃথিবীতেই ঊর্বরতা-কৃত্যে নৃত্যের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে।
ঋতুচক্রে বাঁধা সেই ঊর্বরতা-নৃত্য অবশ্যই একটা রূপকধর্মী উপস্থাপনার মাধ্যমে ঘটত : অর্থাৎ কৌমরাণী ধরিত্রী হলেন, এক পুরুষ শস্যদেব হল, আর একজন তার বীজ বা সন্তান সাজল, আর বৎসরান্তে সেই বীজ বা সন্তান পুরোনো শস্যদেবকে কেটে ফেলে ধরিত্রীকে পুনরায় প্রসবিনী করল। সেক্ষেত্রে এ-কথা নিশ্চিত যে এমন ব্যাপার যাদের জীবনবীক্ষায় কখনও ছিলই না— অর্থাৎ পশুপালক যাযাবর গোষ্ঠী— তারা এই ঊর্বরতা-আবাহনের মধ্যে রাজহত্যা আর মাতৃগমন ছাড়া আর কিছু দেখতে পেত না।
কিন্তু যাযাবর-জীবন ত্যাগ করে কৃষি-জীবন গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে আর্যরা কার্যত ওই ঊর্বরতা-অনুষ্ঠানটাও মানতে বাধ্য হল, এবং তার ব্যাখ্যা হিসেবে অয়দিপাউসের কাহিনীটা তৈরি করে নিয়ে সেটা ওই অঞ্চলের, অর্থাৎ থিবসের, ইতিহাসের অঙ্গ হিসেবে চালিয়ে দিল। তাতে করে এই দাবিটাও প্রতিষ্ঠিত হল যে তাদের গোষ্ঠীবীর এই অঞ্চলেরই এক আদিপুরুষ। এটা কিছু আশ্চর্য ব্যাপার নয় : স্কটল্যান্ডের স্টুয়ার্ট রাজবংশ রটিয়েছিল যে তারা ম্যাকবেথের সঙ্গী ব্যাঙ্কোর বংশধর। এদিকে ব্যাঙ্কো বলে আসলে কেউ ছিলই না; স্কট ইতিহাসে সে নেহাত বানানো এক চরিত্র।
এই অয়দিপাউস তাহলে ছিল হেরস্। এই হেরস্-দের জীবনে কিছু-না-কিছু পাপকর্ম থাকে, প্রাচীন গ্রীকে যাকে ‘হামার্তিয়া’ বলা হত (ঈস্কাইলাসে এ-প্রয়োগ আছে)। ওরেস্তেস ও আল্কমাইয়ন দুজনেই মাতৃঘাতী তথা নির্বাসিত বীর। তান্তালস, কর্ণ, প্রমুখ সন্তানবলি দিয়েছিলেন (আব্রাহাম প্রায় তাই); অর্জুন ভূরিশ্রবা এবং ভীষ্মকে আড়াল থেকে আক্রমণ করেছিলেন; রাম ও লক্ষণ দুজনেই গুপ্তঘাতক। কেইন (Cain) ভ্রাতৃঘাতক। হার্কিউলিস, পার্সিউস, থিসিউস, জেসন, প্রমুখ সব বীরেরই জীবন নানাভাবে কলঙ্কিত। এমনকি চাঁদ বণিকও বেশ্যাসংসর্গে মহাজ্ঞান হারিয়েছিলেন। কাজেই হেরস্ হিসেবে অয়দিপাউসের সঙ্গে মাতৃগমনের কলঙ্কটা খাপ খেয়ে যায়। (পাপের শাস্তিটাকেও ‘হামার্তিয়া’ বলা হত [সফোক্লিসে সে-প্রয়োগ আছে]।)
কিন্তু প্রাচীনতম বৃত্তান্তে অয়দিপাউসের অন্ধত্ব বা ইয়োকাস্তের আত্মহত্যা, ইত্যাদি কিছুই ঘটেনি, এ-কথা প্রায় নিশ্চিত। তবু বোঝা যায়, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মাতৃধর্মীরা মনে মনে ওই হেরস্-দের অভিযুক্ত করত তাদের দেবীর অপমান তথা ধর্মের উচ্ছেদের জন্য। অয়দিপাউসের কাহিনীতে দেশে মড়ক আসে, এবং প্রতীকীভাবে, মাতৃগর্ভেই সন্তানের মৃত্যু ঘটে। হতে পারে, তখন জনগণই স্থির করে যে অয়দিপাউস এসবের জন্য দায়ী; এবং তাকে অন্ধ করে দিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়। (ইউরিপিডিসের ‘অয়দিপাউস’ নাটকে জন্মরহস্য ফাঁস হবার আগেই লাইয়সের অনুচররা অয়দিপাউসকে অন্ধ করে দেয়।) প্রসঙ্গত, পুরাণবিদদের মতে অন্ধত্ব হল পুরুষত্বহীনতার প্রতীক। সেক্ষেত্রে— মিথের মধ্যে— ‘মাতৃগমনের শাস্তি হিসেবে অয়দিপাউস নিজের লিঙ্গচ্ছেদ করেছিল’, এইরকম একটা শাস্তি মাতৃধর্মীরা অন্ধত্ব-রূপে প্রবিষ্ট করেছিল, এ-কথা ভাবা যায়; আর ব্যাপারটাকে গপ্পো হিসেবে ভাবলে ওর একটা মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিও যেন মেলে।
অবশ্য অয়দিপাউসের কাহিনীটা আসলে মিথ-কল্পনার একটা প্রকাশ; কোনো ব্যক্তির জীবনঘটনা নয়। গ্রীক মিথে তুলনীয় উদাহরণ আরও আছে : অডিসিউসের সম্বন্ধেও ভবিষ্যৎবাণী ছিল যে সে ছেলের হাতে মরবে। কির্কে-র গর্ভজাত অডিসিউস-পুত্র তেলেগোনস অজ্ঞতার বশে পিতৃহত্যা করে ও অডিসিউসের পত্নী পেনিলোপে-কে বিয়ে করে; অপর এক ছেলে তেলেমাখস মায়ের (পেনিলোপের) পাণিগ্রহণের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ধনুকে জ্যা পরায় ও অবশেষে তার পিতার নর্মসঙ্গিনী কির্কে-কে বিয়ে করে। হার্কিউলিসের এক ছেলে হুল্লস-ও তার সৎমাকে বিয়ে করে। (ভারতবর্ষে তো কিছু জনগোষ্ঠীতে পিতার মৃত্যু হলে বিমাতাকে বিবাহ করার রীতি বস্তুতই চালু আছে।)
কিন্তু এ-কথা নিশ্চিত যে মাতৃদেবীর অধিকারহরণ করেই পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেইসঙ্গে এও সত্যি যে বহিরাগত ব্যক্তি এসে সিংহাসনে চড়লে তাকে বেদখলকারী ও অত্যাচারী বলে ভাবাই লোকের পক্ষে সঙ্গত। পিতৃতন্ত্রের নিয়মানুসারে রাজার সন্তানই রাজা হয়; কিন্তু সে যদি বহিরাগত হয়, তবে একটা গোলযোগ বাধে। রাজা হতে গেলে তাকে দু’ধরনের পরস্পরবিরোধী ন্যায্যতা দর্শাতে হয় : মাতৃধর্মীদের নিয়মে তাকে রাণীর শয্যাসঙ্গী হতে হয়; আবার পিতৃতন্ত্রীদের নিয়মে রাজার পুত্রও হতে হয়। এই দোরোখা প্যাঁচ সামলানো মিথের বৃত্তান্তকারদের পক্ষে সম্ভব হল না; অয়দিপাউস নিন্দিত কিন্তু অসামান্য দৈবশক্তিময় এক অস্তিত্ত্ব হিসেবে প্রথিত হল— মৃত্যুর পরে। ইতিহাসে সম্ভবত অনেক পরে।
অয়দিপাউস মরল এথেন্সের কাছে কলোনস বলে এক জায়গায়, এবং এথেন্সের যক্ষ বা রাক্ষস (অর্থাৎ রক্ষক) হিসেবে প্রথিত হল। ব্যাপারটায় সবাই বিশ্বাস করত; কাজেই অন্তত এথেন্সে তার ‘জগদ্বিখ্যাত’ শিরোপা পাওয়ার কোনো সমস্যাই ছিল না। বস্তুত সেই খ্যাতির কারণেই থিবসের লোকেরা একবার ‘তাদের’ রাজার অস্থি ফেরত চাইতে এথেন্সে এসেছিল; কারণ সেগুলো নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশে পুঁতলে অয়দিপাউস থিবসের রক্ষক হয়ে যাবে। কিন্তু এথেনীয়রা তাদের বলে : ‘তাই তো, আমরা তো ঠিক জানি না, ঠিক কোনখানে কীভাবে সে মরেছিল— হাড়গোড় তো কিছুই পাইনি!’ ফলে থিবসের লোকেদের স্বদেশে অয়দিপাউস ও এরিনিদের একটা যৌথ পীঠ বানিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল।
কিন্তু অয়দিপাউস কীভাবে মরেছিল, এ-রহস্যের কোনো সমাধান হয়নি। হোমারে তার অন্ধত্বের কোনও উল্লেখই নেই; তিনি বলছেন য়োকাস্তের মৃত্যুর পরে সে রাজত্ব চালিয়ে যায় এবং শেষে যুদ্ধক্ষেত্রে মরে। এছাড়া থিবসেই তার দেহ দাহ করা ও সে-উপলক্ষ্যে ক্রীড়া-প্রতিযোগিতার একটা উল্লেখ আছে। সফোক্লিসের নাটকে দেখি সে অন্ধ হয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত; আবার ইউরিপিডিসে সে থিবসের মহাযুদ্ধকালেও থিবসেই অন্তরীণ হয়ে আছে; সঙ্গে আছে য়োকাস্তা। অর্থাৎ এ-কাহিনীটার নানা ব্যত্যয়ী রূপ ছিল।
জনমানসে অবশ্য অয়দিপাউসের সেই ‘বেদখলকারী’ চরিত্রটা কোনোভাবে টিঁকে গিয়ে থাকতে পারে। কারণ বহু শতাব্দী পরে সফোক্লিস যখন তার পতনের ওপরে একটা নাটক লিখলেন, তখন সেটার নাম দিলেন ‘অয়দিপাউস তুরান্নস’ বা স্বৈরাচারী অয়দিপাউস। এই ‘তুরান্নস’ শব্দটা কিন্তু গণতান্ত্রিক এথেন্সে খুব নিন্দিত শব্দ ছিল। পেলোপন্নেশীয় যুদ্ধে এথেন্স সম্পূর্ণ পরাজিত হলে বিজয়ী স্পার্টা এথেন্সের গণতন্ত্র দমনের জন্য তিরিশজন শাসক নিযুক্ত করে, যারা গণতন্ত্রীদের নির্বিচারে হত্যা অথবা দেশছাড়া করে (প্রায়শই তাদের ভূসম্পত্তি দখলের জন্য)। ওই তিরিশজনকে ‘ত্রিশ স্বৈরী’ (Thirty Tyrants) বলা হত; কারণ তারা ক্ষমতা বেদখল তো করেইছিল, উপরন্তু নাগরিকদের ওপরে চাবুকের অত্যাচারও চালাত। সফোক্লিসের নাটকটা এর মাত্র পঁচিশ বছর আগে লেখা, এবং নাটকের নামে ‘রাজা’ (বাসিলেউস) শব্দটা ব্যবহার না করে তিনি ‘স্বৈরাচারী’ (তুরান্নস) শব্দটা ব্যবহার করেছেন।
নাটকে দেখি অয়দিপাউস তাইরেসিয়াসকে অপমান করছে, অজ্ঞ বলছে, তার অন্ধত্ব নিয়ে ব্যঙ্গ করছে; এমনকি তাকে চক্রান্তকারী পর্যন্ত বলছে। অথচ তাইরেসিয়াস বস্তুত, আমাদের সংস্কৃতির ভাষায়, হলেন ‘মহর্ষি তাইরেসিয়াস’। ক্রেয়োনকেও সে মৃত্যুদণ্ড দিতে উদ্যত হয়, তার কোনো কথা বা যুক্তি না-শুনেই। তার পরে সে তার এক ভয়ঙ্কর পাপের স্বীকারোক্তি করে (দেবস্থানে নরহত্যা); উপরন্তু নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের জন্য এক বৃদ্ধের ওপর নির্মম অত্যাচার করে। কাজেই অন্তত সফোক্লিসের নাটকে, তার স্বৈরাচারী চরিত্রটা বেশ স্পষ্ট।
প্লেটোর চিত্রণে স্বৈরাচারীদের দেখি একধরনের অহমিকাতাড়িত উন্মাদ হিসেবে। এরা সাময়িক আবেগতাড়িত হয়ে যে-কোনো অন্যায় কাজ করতে পারে (অভয়স্থানে লাইয়স-হত্যা)। এরা যে-কোনো কাজে গোড়ায় দেখে স্বার্থসিদ্ধি হবে কিনা (হত্যাতদন্তের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সুরক্ষা খোঁজা)। এরা নিজের মতকেই আইন বলে ঘোষণা করে (ক্রেয়োনের নির্বাসন)। এরা ঝোঁক চরিতার্থ করার জন্য যে-কোনো অত্যাচার-অবিচার করতে পারে (বৃদ্ধ মেষপালকের নির্যাতন)।
এইসব কারণেই নাটকের শেষে কোরাস অয়দিপাউসকে বলে : ‘তোমাকে কখনও না-চিনলেই আমাদের ভাল ছিল; হ্যাঁ, তুমি জন্মের পরেই মরলে ভাল ছিল; অন্ধ হয়ে বেঁচে না-থেকে মরলেই পারতে,’ ইত্যাদি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, অয়দিপাউসকে তার পৌরাণিক পশ্চাৎপট থেকে উপড়ে এনে সফোক্লিস তাঁর নাটকে এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হাজির করেছেন : ‘বীর’ নয়, এক ‘স্বৈরাচারী’। নাটকের একেবারে শুরুতে অয়দিপাউসের ঐ অহংকারী আত্মপ্রশংসা হল তারই ভূমিকা।
প্রনাম।