বনে-পাহাড়ে বসবাসকারী আদিম মানুষ যেদিন তার পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি-জীবজন্তু সম্পর্কে সচেতন হল, সেদিন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করল— প্রকৃতির বিভিন্নতা, জীবজন্তুর স্বভাবগত বৈপরীত্য। নিজের সীমিত জ্ঞান-বুদ্ধির দ্বারা যার কোনও ব্যাখ্যাই সে খুঁজে পায়নি। জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার লড়াইয়ে যা তার পক্ষে অনিষ্টকর তা-ই তার মনে প্রভাব ফেলেছিল, অনুভব করেছিল তারা তার চেয়ে শক্তিশালী, বুদ্ধিমান— এককথায় অলৌকিক। এই অলৌকিক শক্তির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তার মনে ভয়জাত ভক্তির উদ্রেক হয়েছিল, অনিষ্টকারী প্রাকৃতিক শক্তি-জীবজন্তুর ওপর দেবত্ব আরোপ করে সে পরিত্রাণ পেতে চেয়েছিল। বলাবাহুল্য, সাপ তার ব্যতিক্রম ছিল না।
কোনও পা কিংবা ডানা ছাড়াই সাপের স্বচ্ছন্দ-সাবলীল অথচ নিঃশব্দ-রহস্যময় গতি, চকিতে আবির্ভূত হয়ে হতভম্ব করার ক্ষমতা, উজ্জ্বল চক্ষুর মুগ্ধ করার শক্তি যেমন মানুষের মনে বিস্ময় জাগিয়েছে, তেমনই এই সুন্দর অথচ ভয়ংকর প্রাণীটির এক ছোবলেই যে মৃত্যু এই বাস্তব অভিজ্ঞতা তাকে ভীতসন্ত্রস্ত করেছে। আবার খোলস ত্যাগ করে সাপের নবরূপ লাভ মানুষের কাছে তাকে দীর্ঘায়ু এমনকি অমর রূপে প্রতিভাত করেছে। সাপের এইসব বৈশিষ্ট্যের জন্য বিস্ময়, ভয়, শ্রদ্ধা থেকে একদিন সর্পপূজার উদ্ভব হয়েছে। ধীরে ধীরে সর্পকেন্দ্রিক একটি ধর্মধারা গড়ে উঠেছে। পূজা-অর্চনা, মন্ত্র-তন্ত্র, কলা-ভাস্কর্য, সাহিত্যে তা বিকশিত হয়েছে।
পৃথিবীর বহু দেশের মতই সমগ্ৰ ভারতের সমাজ, ধর্মধারণা, কলা ও সাহিত্যে সর্পসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। তবে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে মূলত ওড়িশা ও বঙ্গের সাধারণ সীমান্তভূমিতে অর্থাৎ অখণ্ড মেদিনীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ, ওড়িশার বালেশ্বর জেলার উত্তর অংশ ও ময়ূরভঞ্জ জেলা আমাদের আলোচ্য ভূখণ্ড। সংস্কৃতি গবেষকদের মতে, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি মণ্ডলের মিলনভূমিতে একটি মিশ্র সংস্কৃতির পরিমণ্ডল গড়ে উঠে। আলোচ্য ভূখণ্ডও তার ব্যতিক্রম নয়। ওড়িয়া ও বঙ্গ সংস্কৃতির একটি মিশ্র রূপ অধিবাসীদের জীবনচর্যায় স্পষ্ট। তবুও বলতে হয় রাজনৈতিক সীমারেখা বা বৃহত্তর সংস্কৃতির আধিপত্যবাদ একটি অঞ্চলের আদি তথা কৌম সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করতে পারে না। বহিরঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির আবরণ থাকলেও অভ্যন্তরে ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত হয় আদি কোমগুলির সংস্কৃতি। তবে অনেকক্ষেত্রে বৃহৎ সাংস্কৃতিক বিন্যাসের মধ্যে কোম কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক অণুগুলি মিশে গিয়ে এমন নতুন রূপ লাভ করে যে, তার থেকে আদিরূপটি খুঁজে পাওয়া যায় দুষ্কর হয়ে ওঠে। আলোচ্য ভূখণ্ডের সর্পসংস্কৃতির অনুসন্ধানে এই বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন। আলোচ্য ভূখণ্ডের বর্তমান রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন, কী ভৌগোলিক পরিবেশে কী জাতিগত বিন্যাসে প্রায় অভিন্ন। এই ভূখণ্ডের বেশিরভাগ অংশই ছোটনাগপুর মালভূমির দক্ষিণ-পূর্বাভিমুখী ক্ষয়িত প্রান্তভাগ।
সাঁওতাল, কোল, মুণ্ডা, কোড়া, লোধা-খাড়িয়া, ওরাঁও, ভূমিজ, কুড়মি প্রভৃতি আদিজন এবং থাকবন্দি হিন্দু সমাজের নিম্নতম সোপানে অবস্থানকারী বাউরি, বাগদি, কৈবর্ত, কদমা, পোদ, কাঁড়রা প্রভৃতি জনগোষ্ঠী এই ভূখণ্ডের আদি অধিবাসী। তাই এই অঞ্চলের সর্পসংস্কৃতির অনুসন্ধান মূলত এঁদেরই সংস্কৃতির অনুসন্ধান। অবশ্য আমাদের একথাও মনে রাখা প্রয়োজন, আলোচ্য ভূখণ্ড কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়, ওড়িয়া-বঙ্গ তথা সর্বভারতীয় সর্পসংস্কৃতির উত্তরাধিকার যেমন তার মধ্যেও বিদ্যমান তেমনি ভারতীয় সর্পসংস্কৃতি গড়ে ওঠার পশ্চাতে হয়তো এই ভূখণ্ডেরও কিছু অবদান আছে। ফলে এই অঞ্চলের সর্পসংস্কৃতির অনুসন্ধানের পূর্বে ভারতীয় সর্পসংস্কৃতির যৎসামান্য অবলোকন জরুরি হয়ে পড়ে।
২
ভারতীয় সর্পসংস্কৃতি একরৈখিক কোনও বিষয় নয়, স্বতন্ত্র সর্প ধর্মধারার সঙ্গে কালক্রমে বিভিন্ন বিশ্বাস-সংস্কার এবং অপরাপর ধর্মধারা যুক্ত হয়ে এক জটিল বিন্যাস তথা সমন্বয় গড়ে তুলেছে। ফলে ভারতে সর্পপূজার সূত্রপাত কবে, তা বোধহয় আজ আর বলা সম্ভব নয়। তবে হরপ্পা-মহঞ্জোদারো থেকে প্রাপ্ত সিলমোহরে সর্পের উপস্থিতি দেখে পণ্ডিতগণের অভিমত, দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মানুষেরাই এদেশে সর্পপূজার সূচনা করেন এবং তা অন্তত পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে। আজও দক্ষিণের দ্রাবিড়ভূমে সর্পপূজার বাহুল্য তারই সাক্ষ্য বহন করছে। কিন্তু হরপ্পা-মহঞ্জোদারো সভ্যতার যথার্থ ইতিহাস আমাদের অজানা, ফলে উক্ত সভ্যতার সর্পসংস্কৃতি বহুলাংশে অনুমান-নির্ভর। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ‘অহি’, ‘ফণি’, ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ থাকলেও সর্পকে দেবতাজ্ঞানে বৈদিক আর্যরা পূজা করতেন এমন প্রমাণ নেই বরং অনেকে মনে করেন, সর্পপূজা ভারতীয় আর্যদের বৈদিক দেবকল্পনার সম্পূর্ণ বিরোধী। আবার উক্ত শব্দগুলি প্রাণীবাচক না গুণ বা বৈশিষ্ট্য বাচক সেবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। যেমন ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এ উল্লিখিত ‘সর্পরাজ্ঞী’ শব্দটির সায়নাচার্য ব্যাখা করেছেন— ‘সর্পরাজ্ঞী ভূমির অবতাররূপ কোন দেবতা’।১ অর্থাৎ সর্পরাজ্ঞী সর্পের ‘রাজ্ঞী’ নয়। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, সর্প ও ভূমির নৈকট্য এবং উভয়ের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রাচীনকালেই মানুষের চোখে ধরা পড়েছিল। ফলে ভূমি বোঝাতে হয়তো সর্প শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকে বলেন, বৈদিক সাহিত্যে সর্পবাচক শব্দগুলি অনেকক্ষেত্রেই জাতিসূচক। পরবর্তীকালের মহাভারত-এ ‘নাগ’ শব্দটি স্পষ্টতই জাতিবাচক। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, আদিম মানুষ ভয়ংকর শক্তির আধারস্বরূপ সাপকে কেবল দেবতারূপে গ্রহণ করেছে এমন নয়, নিজেকে বা নিজ গোষ্ঠীকে সাপের মত ভয়ংকর ও চতুর রূপে প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মুখে পরিচয় দিয়েছে। কালক্রমে ওইসমস্ত গোষ্ঠীর ‘কুলকেতু’-রূপে নাগ গৃহীত হয়েছে। সুপ্রাচীনকাল থেকেই সারা ভারত জুড়ে এই রকম নাগগোত্রীয় মানুষদের বসবাস। কখনও কখনও তারা নিজেদের বসতি বা অঞ্চলকে গোষ্ঠী বা বংশ নামে চিহ্নিতও করেছেন। যেমন নাগভূমি বা নাগরাজ্য (Nagaland), অনন্তনাগ, নাগপুর/ ছোটনাগপুর, নাগপট্টনম, নাগনাড়ু (তামিলনাড়ু) ইত্যাদি স্থাননামগুলির উল্লেখ করা যায়। মনে হয়, এই নাগগোত্রীয় নাগপূজক গোষ্ঠীগুলিই এদেশে সর্পসংস্কৃতির প্রবক্তা। আর্যরা এদেশে প্রবেশ করে যেমন ভারতের বিষধর সর্পকুলের সম্মুখীন হয়েছে, তেমনই প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে জড়িয়েছে সর্পপূজক নাগজাতির সঙ্গে। অনেকসময় সর্পের বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছে এই সর্পপূজক গোষ্ঠীগুলির ওপর। তাই তাদের সাহিত্যে এরা পণি (ফণি), বৃত্র (বৃত্ত, সর্পের কুণ্ডলীকৃত অবস্থা), অহি ইত্যাদি।
আর্যদের এদেশে বসতি বিস্তারের প্রথম অবস্থায় হয়তো নাগজাতির সঙ্গে তাদের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চলছে। বৃত্ত-ইন্দ্র, সরমা প্রভৃতি উপাখ্যানগুলি সেই ইঙ্গিতই দেয়। কিন্তু ক্রমশ তারা যেন উপলব্ধি করে এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রামে তাদেরই অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবে। ফলে তারা সংঘর্ষ-সহাবস্থান-সমন্বয়ের পথ অবলম্বন করে। তাই ভাগবত, মহাভারত-এ দেখি একদিকে কালীয়দমন, খাণ্ডবদহন, জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞ— অপরদিকে, কাশ্যপ-কদ্রু, অর্জুন-উলূপী-চিত্রাঙ্গদা ইত্যাদি উপাখ্যান। বৈদিক সাহিত্য কিংবা মহাভারত থেকে এটা স্পষ্ট যে, আদি সর্পপূজক জনগোষ্ঠীকে আর্য নয়, অনার্য। ফলে ভারতীয় সর্পসংস্কৃতিতেও এসে মিশে সেই বহুকথিত আর্য-অনার্যের লড়াই। লড়াইটা যেমন ভূমির অধিকারের জন্য তেমনই সংস্কৃতি বিস্তারের জন্যও। কালীয়নাগের স্বভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া কেবল নাগজাতির ভূমির অধিকার হারানো নয়, নাগধর্মের ওপরে শ্রীকৃষ্ণ চেতনার বিজয়যাত্রাও। সর্পযজ্ঞে আস্তিকের বেদপাঠ শুধু নতিস্বীকার করে সর্পকুল তথা নাগজাতিকে রক্ষা করা নয়, একই সঙ্গে আর্যসংস্কৃতিকে গ্রহণের বার্তাও যেন দেয়। কিন্তু শুধুই অনার্য তথা নাগজাতি বা নাগসংস্কৃতির পরাজয় এমন নয়। এই বিপুল গণধর্ম বা গণসংস্কৃতিকে উপেক্ষা বা বিলুপ্ত করা সম্ভব নয়, আর্যরা তা ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিল। ফলে তারা সমন্বয়ের পথে হাঁটতে একপ্রকার বাধ্য হয়। কাশ্যপ-কদ্রু উপাখ্যানটি সেই সমন্বয়সাধনের সার্থক প্রচেষ্টা। এই উপাখ্যানানুসারে, কাশ্যপ মুনির ঔরসে কদ্রুর গর্ভে অনন্ত, বাসুকি, শেষ, কর্কোটক, পুণ্ডরীক প্রমুখ অষ্টনাগ সহ সহস্র নাগের জন্ম। ফলে অনার্য তথা নাগসংস্কৃতির সঙ্গে আর্যসংস্কৃতির যেন রক্তসম্পর্ক স্থাপিত হল। আজও বর্ণহিন্দু সমাজে অষ্টনাগ শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হয়।
অবশ্য বৈদিক যুগ থেকেই আর্যদের মনে সর্প ও সর্পপূজক নাগজাতির প্রতি একইসঙ্গে ভয় ও শ্রদ্ধার ভাব জাগরিত হয়েছিল। আশুতোষ ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন— “ঋগ্বেদে ‘অহি বুধ্ন্য’ নামক এক শক্তিমান জীবের উল্লেখ রহিয়াছে। আর্য্য-সাহিত্যে বিশিষ্ট শক্তিসম্পন্ন সর্প-চরিত্রের ইহাই সর্বপ্রথম উল্লেখ। এই চরিত্রের উপর দেব-গুণ আরোপ করা হইয়াছে।”২ যজু ও অথর্ব বেদে সর্পবিষনাশক বা সর্পবশীকরণ মন্ত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিন্তু এইসব আভিচারিক ক্রিয়াগুলির চলন কোন মুখী অর্থাৎ এগুলি আদি সর্পপূজক জনগোষ্ঠীর বিচিত্র আচার-সংস্কার থেকে আত্মীকরণ করা হয়েছিল কিনা সেবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কিন্তু আর্যসমাজেও যে সর্পসংস্কৃতি ক্রমশ গৃহীত হচ্ছিল তা স্পষ্ট। তাই দেখি— “বৈদিক যুগের পরবর্তী যুগ অথবা ব্রাহ্মণের যুগে ‘সর্পবিদ্যা’ এবং ‘সর্পবেদ’ দুইটি জ্ঞাতব্য বিষয় বলিয়া উল্লিখিত আছে।”৩ এবং আশ্বালয়ন প্রমুখের ‘গৃহ্যসূত্রের মধ্যে যে গার্হস্থ্য বিধি আচারের নির্দ্দেশ রহিয়াছে তাহাতে সর্প পূজার বিস্তৃত ব্যবস্থার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়।’৪
উপরের আলোচনা থেকে একথা বলা যায় যে, ভারতীয় সর্পসংস্কৃতি সংঘাত ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। আর এই সমন্বয় বা আর্যসংস্কৃতির দ্বারা নাগসংস্কৃতি আত্তীকরণ প্রচেষ্টায় নাগসংস্কৃতির বিন্দুমাত্র পরাভব ঘটেনি। বরং আরও বিকশিত হয়ে উঠেছে। পরবর্তী পৌরাণিক যুগের দেবভাবনায়, মূর্তি কল্পনায় তা স্পষ্ট। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব কোনও ধর্মধারাই নাগ তথা সর্পসংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত নয়। এমনকি বৈদিক যাগ-যজ্ঞ বিরোধী জৈন বা বৌদ্ধ ধর্মও এই ব্যাপক গণসংস্কৃতিকে উপেক্ষা করতে পারেনি। কাজেই আলোচ্য ভূখণ্ডের সর্পসংস্কৃতির অনুসন্ধানে উক্ত ধর্মধারাগুলির সঙ্গে নাগসংস্কৃতির সংযোগ দিকটির প্রতি দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। কারণ আলোচ্য ভূখণ্ডে বিভিন্ন ধর্মধারার অসংখ্য মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলির সঙ্গে সর্প-সংযোগ বিদ্যমান। আবার এমন কিছু দেবতার পূজা প্রচলিত যেগুলি আদিতে হয়তো ছিল সর্পপূজা কিন্তু আত্তীকরণের ফলে মূলরূপটি হারিয়ে গেছে। তাই সেই সকল দেবতার সঙ্গে সর্প-সংযোগ বিষয়টি বুঝে নিতে হয়—
শৈবধর্ম: শৈবধর্মের সঙ্গে সর্পসংস্কৃতি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। শিবমন্দিরে শিবলিঙ্গের ওপরে ফণা বিস্তার করা সর্পমূর্তি পরিচিত দৃশ্য। এমনকি কোথাও কোথাও শিবমূর্তি বা শিবলিঙ্গের পরিবর্তে সর্পের প্রতিকৃতিও পূজিত হতে দেখা যায়। অনেকে বলেন, লিঙ্গ ও সর্প উভয়েই প্রজননশক্তির প্রতীক তাই এই সমন্বয়। সর্পমালা, সর্পকুণ্ডল, সর্প উপবীত ধারণ করে শিব নাগভূষণ। অপর নাম নাগেশ্বর। আলোচ্য ভূখণ্ডের বহুস্থানে নাগেশ্বর ও মণিনাগেশ্বর নামে শিব পূজিত হন। আজও শিব পূজক নাথ সম্প্রদায়ের মানুষদের ধাতুনির্মিত সর্পমূর্তি নিয়ে ঘরে ঘরে ভিক্ষা করতে দেখা যায়।
শাক্তধর্ম: আলোচ্য ভূখণ্ড দুর্গা, কালী, চামুণ্ডা ও বিরজা মূলত এই চার শাক্তদেবীর প্রভাবমণ্ডল। প্রত্যেকের মূর্তিতেই সর্প বিদ্যমান। বিরজার মস্তকে সর্পফণা, অন্যদের হস্তে ধৃত সর্প। এই সর্প শুধু প্রহরণ নয়, বরং প্রতীক। সর্পের সঙ্গে ভূমির গভীর সংযোগ, দুর্গা ধরিত্রীরই রূপ। বাকিরা এই মহাদেবীর ভিন্নরূপ।
বৈষ্ণবধর্ম: বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে এমন অনেক বিশ্বাস জড়িত যেগুলিতে সর্পের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অনন্তনাগ বিষ্ণুরই এক প্রকাশ বা রূপ। আবার অনন্তনাগ-রূপী শয্যায় শায়িত বিষ্ণু জগৎ সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন। মাথার ওপর ছত্ররূপ ফণা বিস্তার করে অনন্ত। সদ্যোজাত কৃষ্ণকে বাসুকীনাগ বৃষ্টি-ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করে, বৈষ্ণবীয় সাহিত্য ও মূর্তিকলায় এই বিষয়গুলি বহুল প্রচলিত। আবার কৃষ্ণ অগ্রজ বলরামকে অনন্ত বা শেষনাগের অবতাররূপে দেখা হয়। বিশ্বাস, বলরামের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা সর্পরূপে বেরিয়ে এসে সমুদ্রে প্রবেশ করে। বলরাম বা বলভদ্র আরাধনা আলোচ্য সীমান্তভূমিতে প্রচলিত।
বৌদ্ধধর্ম: অনেকে মনে করেন বুদ্ধ নাগ বংশোদ্ভূত, জন্মের পরেই নন্দ ও উপনন্দ নামের দুই নাগ তাঁর পরিচর্যা করে। বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তারে নাগ জাতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জাতক-এ অনেকগুলি বুদ্ধ-নাগ আখ্যান আছে। নাগরাজ মুচলিন্দ তপস্যারত বুদ্ধের ওপরে ফণাবিস্তার করে ঝড়বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে। বৌদ্ধ সাহিত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলায় সর্পের সরব উপস্থিতি। বৌদ্ধ সর্পদেবী জাঙ্গুলি। আলোচ্য অঞ্চলের কিছু অংশে সর্পদেবীরূপে জাঙ্গুলি পূজিত হয়।
জৈনধর্ম: তেইশতম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ তপস্যায় মগ্ন থাকার সময় তাঁর তথা জৈনধর্ম বিরোধী কামথ বজ্রবিদুৎ সহ প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু করে। তখন নাগরাজ ধরণেন্দ্র ও তার পত্নী পদ্মাবতী ফণাবিস্তার করে পার্শ্বনাথকে রক্ষা করে। জৈন মূর্তিতে পার্শ্বনাথের মাথার ওপর সপ্তফণা বিশিষ্ট সর্পের অবস্থান। পদ্মাবতী জৈন সর্পদেবী। বিভিন্ন জৈনগ্রন্থ থেকে জানা যায়, পার্শ্বনাথ ধর্মপ্রচারে বেরিয়ে পুণ্ড্র-তাম্রলিপ্ত হয়ে নাগদেশে যান। সঙ্গী হয় শিব, সুন্দ্র, সৌম্য ও জয় নামক চার শিষ্য। পথে তাঁরা কোপকটা বা কোপকটক নামক স্থানে কয়েকদিন অবস্থান করেন। নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে, নাগদেশ ময়ূরভঞ্জ সহ ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল আর কোপকটক বর্তমানে বালেশ্বর-ময়ূরভঞ্জ সীমানায় কোপারি।৫ নিকটবর্তী বালেশ্বরের কোশালি থেকে পার্শ্বনাথের একটি মূর্তি পাওয়া গেছে— তাতে উক্ত চারশিষ্য বর্তমান। দু’জন বসে, বাকি দু’জন দাঁড়িয়ে। পার্শ্বনাথের মাথার ওপর সপ্তফণা। অনেকে বলেন, তিনি ‘সর্প ফণাচ্ছত্র ধারণ করে লোকবিশ্বাসীদের অধীশ্বর হয়ে উঠেছিলেন।’৬
শুধু দেবকল্পনায় মানুষের সর্পভাবনা থেমে থাকল না। উৎপাদন তথা প্রজননশক্তির প্রতীকরূপে যেমন সর্প গৃহীত হল, তেমনই যোগ, জ্যোতিষশাস্ত্র, বাস্তুশাস্ত্রে মানুষ সর্পশক্তির সন্ধান পেল। যথাক্রমে কুণ্ডলিনী শক্তি, সর্পদোষ ও বাস্তুনাগ অর্থাৎ মানুষের যোগ ও সংযম শক্তি, গ্রহ-নক্ষত্রের ঘূর্ণন প্রক্রিয়া ও বাস্তুর শুভ-অশুভের মধ্যে নাগশক্তি বিদ্যমান বলে বিশ্বাস করা হল। সর্পের ছন্দময়, শৈল্পিক ভাবভঙ্গি মানুষের ভাস্কর্য-চিত্রকলাকে প্রভাবিত করল। সর্পকুণ্ডল, নাগহার, নাগবলয় ইত্যাদি রূপে সর্প মানুষের অলঙ্কারে স্থান পেল। সর্পবিষনাশনের উদ্দেশে ঝাড়-ফুঁক-মন্ত্র সমন্বয়ে এক বিচিত্র আভিচারিক বিদ্যার উদ্ভব হল। ফলে ভারতীয় ধর্ম, সাহিত্য, শিল্পকলায়, লোকবিশ্বাসে সর্পসংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করল। ভারতীয় সর্পসংস্কৃতির এই বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে এবার আলোচ্য ভূখণ্ডের সর্পসংস্কৃতির সন্ধান করা যেতে পারে।
৩
আলোচ্য ভূখণ্ডে সর্পসংস্কৃতির অনুসন্ধানে আমরা দু’টি বিষয়ের ওপর দৃষ্টিপাত করব। প্রথমত, আলোচ্য অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাচীন পুরাবস্তু, মূর্তি এবং স্থানিক ইতিহাস— যেগুলি এই অঞ্চলে সর্পসংস্কৃতির প্রাচীনত্ব বুঝতে আমাদের সহায়ক হবে। দ্বিতীয়ত, অধিবাসীদের জীবনচর্যা— যা থেকে আমরা বাহিত হয়ে আসা সর্পসংস্কৃতির বর্তমান অবস্থা নিরূপণ করতে পারব।
আলোচ্য অঞ্চলে সর্পসংস্কৃতির প্রাচীনত্ব অনুসন্ধানে প্রথমেই পুরী জেলার কনাস গ্রামে প্রাপ্ত দু’টি তাম্রশাসনের উল্লেখ করতে হয়। প্রথমটি ২৮০ গুপ্তাব্দ (৫৯৯-৬০০ খ্রিস্টাব্দ)-এ প্রদত্ত। এই তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তোষলীর অধিপতি লোকবিগ্রহ যজুর্বেদের মৈত্রয়ানী শাখার জনৈক ব্রাহ্মণকে একটি গ্রামদান করছেন ‘মণিনাগেশ্বর ভট্টারক’-এর পূজাপাঠের জন্য।৭ এখানে উল্লেখ্য, অখণ্ড মেদিনীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগ থেকে গঞ্জামের উত্তরাংশ পর্যন্ত ভূভাগ একসময় তোষলী নামে পরিচিত ছিল। তোষলীর দু’টি ভাগ ছিল উত্তর ও দক্ষিণ। আমাদের আলোচ্য ভূখণ্ড উত্তর তোষলীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঐতিহাসিকদের অভিমত, আলোচ্য মণিনাগেশ্বর ভট্টারকের মঠ বা মন্দিরটি পুরী জেলার কোথাও অবস্থিত ছিল। দ্বিতীয় তাম্রশাসনটি সপ্তম শতকের প্রথমপাদে মহাসামন্ত ভানুদত্ত কর্তৃক প্রদত্ত।৮ এক্ষেত্রেও বিষয় উক্ত মণিনাগেশ্বরের পূজার্চনার জন্য উক্ত শ্রেণির ব্রাহ্মণদের ভূমিদান। বালেশ্বর ও সোরো (বালেশ্বর জেলা) থেকে প্রাপ্ত ভানুদত্তের দু’টি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, ভানুদত্ত উত্তর তোষলীর সামন্ত নৃপতি ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, এই দত্তবংশীয়রা যথাক্রমে বিগ্রহ, মান বংশ ও শশাঙ্কের সামন্তরূপে দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুর সহ বালেশ্বর অঞ্চল শাসন করতেন। ভানুদত্তের কনাস তাম্রশাসনে মণিনাগেশ্বরের অবস্থান ক্ষেত্ররূপে ‘একাম্বক’ নামক স্থানের উল্লেখ আছে, তার প্রকৃত অবস্থান নির্ণীত হয়নি। কিন্তু গবেষকদের অভিমত, তোষলী তথা ওড়িশার উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত মণিনাগেশ্বর উপাসনা প্রচলিত ছিল— Maninageswar deities are installed at the mouths of Nagavali and Suvarnarekha.৯ বস্তুত আমাদের আলোচ্য ভূখণ্ডের সুবর্ণরেখা অববাহিকায় সুপ্রাচীনকাল থেকেই মণিনাগেশ্বর উপাসনা প্রচলিত। আর কনাস তাম্রশাসনদু’টি থেকে স্পষ্ট মণিনাগেশ্বর উপাসনা প্রচলনের ক্ষেত্রে যজুর্বেদের মৈত্রয়ানী শাখার ব্রাহ্মণদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। মণিনাগেশ্বর সম্পর্কে গবেষক বিনায়ক মিশ্রের অভিমত— Maninageswar meaning the Lord of Maninag.As Siva has been made to wear Naga or cobra as an ornament, we can hold that when Siva worship was imposed on the Naga worshippers, for the sake of compromise the Siva worshippers admitted Naga as an ornament of Siva.১০ আজও পুরানগাঁ, ভীমপুর (অযোধ্যা, বালেশ্বর)-এ মণিনাগেশ্বর পূজিত হন। গৌরীপুর (জলেশ্বর)-এর নাগেশ্বর শিবমন্দিরটি অষ্টাদশ শতকে নির্মিত হলেও শিবলিঙ্গ বেশ প্রাচীন।
পরবর্তী দু’টি তাম্রশাসনে এই অঞ্চলে সর্পসংস্কৃতির প্রাচীনত্বের একটি দিক উদ্ভাসিত হয়। তাম্রশাসনদু’টি গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক (আনুমানিক ৬০০-৬২৫ খ্রিস্টাব্দ)-এর অধীনস্থ দণ্ডভুক্তি-র দুই শাসক মহাপ্রতিহার শুভকীর্তি ও সামন্ত-মহারাজ সোমদত্ত কর্তৃক প্রদত্ত। উল্লেখ্য যে, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষার্ধে বা সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে অখণ্ড মেদিনীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ, বালেশ্বর ও ময়ূরভঞ্জের কিছু অংশ নিয়ে দণ্ডভুক্তি নামে একটি রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এযাবৎ প্রাপ্ত ষষ্ঠ থেকে নবম শতাব্দীর বিভিন্ন তাম্রশাসনে দণ্ডভুক্তি কখনও তোষলীর কখনও বা উৎকলের অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে। যাই হোক, আলোচ্য তাম্রশাসনদু’টিতে শশাঙ্কের যশকীর্তন করতে গিয়ে পৃথিবী প্রসঙ্গে একটি শ্লোকে বলা হয়েছে— ‘…শেষাশেষ-শিরো-মধ্যমধ্যাসীন-মহতনুং ( নুম্)…’, অর্থাৎ ‘যাঁর মহাকায় শেষনাগের অগণিত মস্তকের মধ্যবর্তীটির মধ্যস্থলে অবস্থিত।’১১ প্রসঙ্গত, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণে অনন্ত বা শেষনাগের মূর্তি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে— অনন্তনাগ চতুর্ভুজ। তাঁর দক্ষিণ দুই হস্তে পদ্ম ও গদা এবং বামহস্তদ্বয়ে শঙ্খ ও হল থাকবে। এছাড়া তাঁর মস্তকের ওপরে সর্পের প্রসারিত বহুফণার মধ্যে মাঝের ফণার ওপরে পৃথিবীমাতা অবস্থান করবেন।১২ আমাদের মনে হয়, অনন্তনাগ বা পৃথিবী সম্পর্কে এই বিশ্বাস তৎকালীন জনমানসে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত না থাকলে তাম্রশাসনদু’টিতে কখনও তা উল্লেখিত হত না। শশাঙ্ক কঙ্গোদ মণ্ডল (বর্তমান গঞ্জাম অঞ্চল) পর্যন্ত তাঁর রাজ্যসীমা বিস্তার করেছিলেন। অর্থাৎ মেদিনীপুর থেকে ওড়িশার দক্ষিণ সীমা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগ তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শাসনাধীন ছিল। আবার কানিংহাম, নগেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ পুরাতত্ত্ববিদ-ঐতিহাসিকদের মতে, হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মার যৌথ আক্রমণে বিপর্যস্ত শশাঙ্ক ময়ূরভঞ্জ ও সিংভূমের মধ্যবর্তী কোনও স্থানে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।১৩ এই বক্তব্য সম্পর্কে দ্বিমত থাকলেও সকলেই স্বীকার করেন শশাঙ্ক ছিলেন পরম শৈব। অষ্টাদশ শতাব্দীর ওড়িয়া কবি মহাদেব দাস ‘কার্ত্তিক মাহাত্ম্য’ গ্রন্থে লিখেছেন— ‘সুবর্ণরেখা মধুমতী/ যে হ্রদ শিববনে স্থিতি।’ বস্তুত প্রাচীনকাল থেকে আজও সুবর্ণরেখা বিধৌত এই অঞ্চল শৈব প্রভাব মণ্ডল। ফলে আলোচ্য অঞ্চলে শৈবধর্ম বিস্তার এবং সেই সূত্রে নাগধর্মের সঙ্গে শৈবধর্মের সমন্বয়ে শশাঙ্কের ভূমিকা পৃথক অনুসন্ধানের দাবি রাখে। শশাঙ্কের সময়কালে এগরা তাম্রশাসনে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী হিসেবে নাগসেন, নাগদেব, যশোনাগ ও বান্ধবনাগ-এর নাম উল্লেখিত হয়েছে।১৪ আমাদের মনে হয়, এঁরা সর্প-উপাসক নাগজাতির বা নাগবংশের। আবার পূর্বোক্ত লোকবিগ্রহের কনাস তাম্রশাসনেও উচ্চপদস্থ আধিকারিক হিসেবে ভবনাগ ও নাগদত্ত-র নামোল্লেখ দেখে আমাদের অনুমান, তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় নাগজাতির মানুষেরা বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
নবম শতাব্দীতে ভৌমকর রানি দ্বিতীয় ত্রিভুবন মহাদেবী কর্তৃক প্রদত্ত একটি তাম্রশাসন থেকে জানা যায়— বিরাট রাজবংশের কন্যা ও মহামণ্ডলাধিপতি মঙ্গলকলসের স্ত্রী শশীলেখা দ্বারা নির্মিত নান্নেশ্বর মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত উমামহেশ্বরের পূজাবিধির জন্য উত্তর তোষলীর দণ্ডভুক্তি মণ্ডলের তমালখণ্ড বিষয় অন্তর্ভুক্ত কোটপুরা নামের একটি গ্রাম দান করা হয়।১৫ এই তাম্রশাসনে উল্লেখিত বিরাট রাজবংশ আলোচ্য অঞ্চলের ইতিহাসের এক জটিল গ্রন্থি। দু-একটি তাম্রশাসনে উল্লেখ ও কয়েকটি প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন ব্যতীত বিরাট রাজবংশ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। অথচ সমগ্র অঞ্চল জুড়ে এমনকি মেদিনীপুরের অভ্যন্তরভাগ পর্যন্ত বিরাট রাজবংশ তথা ‘বিরাট রাজা’ সম্পর্কে নানা কিংবদন্তি-জনশ্রুতি প্রচলিত। লোকবিশ্বাস, মহাভারত-এ বর্ণিত মৎস্যদেশ হল এই অঞ্চল। মৎস্যদেশাধিপতি বিরাট রাজার রাজধানী ছিল রাইবনিয়া গড় (জলেশ্বর)। পাণ্ডবরা বারো বৎসর বনবাসের শেষে এখানেই এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করেছিলেন। কপ্তিপদা, খিচিং-এর বিরাটগড়, কীচকগড় ছিল বিরাট রাজার অন্যান্য গড় বা দুর্গ আর মেদিনীপুরের গোপগিরি ছিল তাঁর উত্তর গো-গৃহ। বিরাট রাজার ইষ্টদেবী ছিলেন কীচকেশ্বরী। পরবর্তীকালে ময়ূরভঞ্জের ভঞ্জরাজারা কীচকেশ্বরীকে রাইবনিয়া থেকে নিয়ে গিয়ে খিচিং-এ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে, ওড়িশার গড়জাত রাজ্যগুলি ও মেদিনীপুরের কিছু অংশ নিয়ে বহুপূর্বে কোটদেশ বা কোটাটবী নামক এক রাজ্য গঠিত হয়েছিল। সেই রাজ্যের শাসকের নাম ছিল বিরাটগুহ। শাসকের নামানুসারে রাজ্যটি বিরাটদেশ, রাজধানী বিরাটগড় এবং তাঁর বংশ বিরাট বংশ নামে পরিচিত হয়।১৬ এই বিরাট রাজারা ছিলেন নাগ-উপাসক ‘বিরাট ভুজঙ্গ’-রূপে পরিচিত।১৭ গবেষক বঙ্কিমচন্দ্র মাইতির অভিমত— তাঁদের দুর্গে মনসা কুলদেবী বিরাটেশ্বরীরূপে পূজিত হত। লোকবিশ্বাসে, ‘বিরাট রাজা’ মহাভারতের বিরাট রাজায় পরিণত হন। আর বিরাটেশ্বরী মহাভারতের বিরাট-শ্যালক কীচক কাহিনিকে আশ্রয় করে কীচকেশ্বরীতে পরিণত হন। লোকবিশ্বাস, কীচক ঘোর তান্ত্রিক, মদ্য-মাংস উপাচারে সর্প বিনাশন-অভিজ্ঞ মনসার উপাসক। ওড়িয়া অভিধানে ‘কি-চক’ শব্দের একটি অর্থ সাপের হিস্ হিস্ ধ্বনি। কীচক শব্দের আশ্রয়ে সর্প আনুষঙ্গিকতা আছে। ব্যঞ্জিত অর্থ; সাপের ওঝা, বিষমন্ত্রের গুরু।১৮ ঐতিহাসিকদের অনুমান, নবম-দশম শতাব্দীতে ময়ূরভঞ্জের ভঞ্জরাজাদের হাতে বিরাট বংশের পতন ঘটে। তারপরেও হয়তো দীর্ঘকাল বিরাট বংশের উত্তরপুরুষেরা আলোচ্য ভূখণ্ডের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের ভূস্বামীরূপে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিলেন। কারণ কপ্তিপদার ভূস্বামী জনৈক বসন্ত বিরাট ওড়িশার সূর্যবংশীয় নৃপতি পুরুষোত্তম দেবের (১৪৭৯-১৫০৪খ্রি.) কাঞ্চি বিজয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেওয়ায় ‘জয় ভুজঙ্গ’ উপাধি পান। বসন্ত বিরাট বোধহয় উক্ত বিরাট বংশেরই উত্তরপুরুষ। বিরাট বংশের প্রকৃত ইতিহাস না জানা গেলেও প্রাপ্ত প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের নিরিখে বলা যায়, আলোচ্য ভূখণ্ডে নাগ তথা সর্পসংস্কৃতির বিস্তারে এই বংশের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। সমগ্র অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিরাট রাজাদের সর্প-উপাসনার স্মৃতিচিহ্ন। নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে— “Evidence of sarpent-Worship by the Vairata dynasty are also found in many places of Mayurbhanja as far as Raibania in the district of Midnapur* on the North,Viratgada near Khiching on the South, Kaptipada and Nilgiri on the East and Sirsa on the West.”১৯
এবার আমরা আলোচ্য ভূখণ্ডে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করতে পারি। প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন বলতে মূলত সর্প-উপাসনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মূর্তিগুলির কথাই বলা হচ্ছে। গবেষকদের অনুমান, নিম্নে আলোচ্য মূর্তিগুলি সপ্তম থেকে দশম শতকের মধ্যে নির্মিত—
১. পুরাডিহা (ময়ূরভঞ্জ)-র নিকটবর্তী পাটমুণ্ডি পাহাড় গাত্রে উৎকীর্ণ কিঞ্চকনাগের প্রতিকৃতি। অনেকে মনে করেন, এই পাটমুণ্ডি পাহাড় ছিল বিরাটরাজাদের সর্প-উপাসনার প্রধান কেন্দ্র।
২. কপ্তিপদা (ময়ূরভঞ্জ)-র পূর্বতন ভূস্বামীদের কুলদেবী— বিরাট (বৈরাট) পাট ঠাকুরানির মূর্তি। এই দেবীর ঊর্ধ্বাংশ মনুষ্যাকৃতি নিম্নাংশ সর্পাকৃতি। জনশ্রুতি, এই মূর্তিটি পূর্বোক্ত পাটমুণ্ডি পাহাড়ে ছিল। ভুজঙ্গ বংশীয় ভূস্বামীরা সেখান থেকে নিয়ে এসে স্বগৃহে প্রতিষ্ঠা করেন।
৩. খিচিং (ময়ূরভঞ্জ)-এর কীচকেশ্বরী দেবীরূপে বর্তমানে চামুণ্ডামূর্তি পূজিত হন। “কীচকেশ্বরী চামুণ্ডা উক্ত নগরে/ বিরাজমানা মন্দির-হৃদয় গহ্বরে”২০ কিন্তু খিচিংয়ের বর্তমান মন্দিরটি ১৯৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। কীচকেশ্বরীর সুপ্রাচীন মন্দির ১৩৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজ শাহ ওড়িশা আক্রমণের সময় ধ্বংস করেন। ফলে কীচকেশ্বরীর আদিরূপ কী ছিল জানা যায় না। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে খিচিং প্রত্নক্ষেত্র উৎখননে অন্যান্য বহু মূর্তির সঙ্গে কয়েকটি নাগমূর্তিও পাওয়া যায়। যেগুলি বর্তমান মন্দির সংলগ্ন সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। প্রাচীন মন্দিরের অনেক খোদিত প্রস্তর বর্তমান মন্দির নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে।
৪. ধ্বংসপ্রাপ্ত কোইঁসারিগড় (ময়ূরভঞ্জ) থেকে একটি দেবীমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। দেবী পদ্মাসনে উপবিষ্ট, দু’হাত দিয়ে একটি ভাঁড় জাতীয় পাত্র ধরে আছেন। হাত, গোড়ালি, কণ্ঠ কারুকার্যময় অলঙ্কারে শোভিত। সুগঠিত শরীর, গোলাকৃতি মুখ। মুদ্রিত চক্ষু, ধ্যানমগ্না। মাথার ওপর সপ্তফণা ছত্রাকারে বিন্যস্ত যদিও সর্পের দেহাংশ অদৃশ্য। স্থানীয়ভাবে দেবী কোটাসিনি বা কোটবাসিনী নামে পরিচিত। অনেকে বলেন, দেবী নাগমাতা কদ্রু।
৫. দাহিগারিয়া (বালেশ্বর) থেকে প্রাপ্ত দেবীমূর্তিটি সুখাসনে উপবিষ্ট। মস্তকের ওপরে সপ্তফণা বিশিষ্ট সর্প। ডানহাতে একটি সাপ, বামহাত বামজঙ্ঘার ওপরে বিন্যস্ত। মুখমণ্ডল ক্ষতিগ্রস্ত। অনেকের মতে, মূর্তিটি বৌদ্ধ সর্পদেবী জাঙ্গুলি।
৬. তুণ্ডরা (বালেশ্বর)-য় মনসারূপে পূজিত দেবীমূর্তিটি পদ্মসিংহাসনে সুখাসন মুদ্রায় উপবিষ্ট। মাথার ওপরে সপ্তফণা ছত্র। বামজঙ্ঘায় একটি শিশু বামহাত দিয়ে ধরে আছে, ডানহাতে একটি সাপ। নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে, মূর্তিটি স্কন্দষষ্ঠী, কেউ কেউ বলেন, আস্তিকমাতা জারুৎকারু।
৭. ‘দাঁতনের ইতিহাস’ গ্রন্থে ললিতমোহন সামন্ত একটি সর্পদেবী মূর্তির সন্ধান দিয়েছেন— “দাঁতনের উড়িশাল ও বেনাপুরা গ্রামের মধ্যবর্ত্তী একটি তেঁতুল বৃক্ষের নিম্নে একটি মূর্ত্তি আছে। ইহার মস্তকোপরি ৪/৫টি সর্প ফণা বিস্তার করিয়া আছে। ইহা মনসার মূর্ত্তি বলিয়া অনুমিত হয়। প্রত্নতত্ত্ববিদ শ্রী প্রভাসচন্দ্র পাল মূর্ত্তিটিকে পাল যুগের নিদর্শন বলিয়া অভিমত প্রকাশ করিয়েছেন।”২১
৮. উক্ত গ্রন্থে ললিতমোহন সামন্ত দাঁতনের ললিতাপুর গ্রামে পূজিত একটি মনসার মূর্তির কথা বলছেন, কিন্তু বর্তমানে মূর্তিটি নেই। পরিবর্তে কয়েকটি প্রস্তরখণ্ড বিষহরিরূপে পূজিত হয়।
৯. দাঁতনের নতুন বাজার থেকে প্রাপ্ত একটি মনসামূর্তি দাঁতন টাউন লাইব্রেরিতে রক্ষিত ছিল। পরে সেটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ নিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন ললিতমোহন সামন্ত।২২
১০. দাঁতনের তকিনগরের ঝিলিকেশ্বর শিবমন্দির প্রাঙ্গণে প্রস্তরনির্মিত ভগ্ন নাগবন্ধ অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
১১. নারায়ণগড় থেকে প্রাপ্ত একটি গোলাকৃতি প্রস্তরখণ্ডের ওপর কুণ্ডলীকৃত সর্পের মধ্যিখানে প্রস্ফুটিত পদ্ম খোদিত।
এছাড়া আলোচ্য ভূখণ্ডে বিভিন্ন ধর্মধারার বহু মূর্তি পাওয়া গেছে যেগুলির সঙ্গে সর্প সংযোগ বিদ্যমান। বাহুল্যবোধে সেগুলির উল্লেখ করা হল না।
৪
শুধু পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন বা মূর্তিকলায় নয়, অধিবাসীদের বহমান জীবনচর্যায় সর্পসংস্কৃতি স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান। বিরাট রাজবংশ সর্পদেবীকে কুলদেবীর মর্যাদা দিয়ে যেন রাষ্ট্রীয় দেবীতে উত্তীর্ণ করেছিলেন। পরবর্তী ভঞ্জরাজারাও বিরাট পূজিত সর্পদেবীকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিলেন। বোধহয় সর্প উপাসনাই ছিল তৎকালীন গণধর্ম, তাই কোনও রাজশক্তিই সর্পদেবীকে উপেক্ষা করতে পারেনি। প্রসঙ্গক্রমে ওড়িশার অধিবাসীদের গোত্র সম্পর্কে গবেষক বিনায়ক মিশ্রের একটি মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে— It will be found that half of the population bearing the gotras Naga or Nagas and Kasyapa belong to the Naga lineage.২৩ বলাবাহুল্য, এই বক্তব্য আলোচ্য অঞ্চলের অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আবার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তবঙ্গে মনসা পূজার উৎপত্তি সম্পর্কে শক্তি সেনগুপ্ত বলেছেন—
“এই অঞ্চলে মনসা পূজার প্রধান উদ্যোক্তা কৈবর্ত বা কেওট সম্প্রদায়, যাদের আদি বাস ছিল কৃষ্ণা নদীর অববাহিকায় কেবট্টভোগ বা কৈবর্তভূমিতে। দ্রাবিড়ভাষী মৎসশিকারজীবী এই কেবট্ট সম্প্রদায় কলিঙ্গ যুদ্ধে অশোকের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করার অপরাধে কেবট্ট ভূমি থেকে নির্বাসিত হয় (অশোকের এয়োদশ শিলালিপি)।”২৪
তিনি আরও বলেন— ‘মনসা’ এই নামটিই দ্রাবিড় লক্ষণাক্রান্ত। ‘মনচাম্মা’ বা ‘মনসাম্মা’ দ্রাবিড়ভাষীদের সর্পদেবী। আমাদের আলোচ্য ভূখণ্ড দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বাংলার অংশবিশেষ। কৈবর্ত সম্প্রদায় এই ভূখণ্ডে অন্যতম জনশক্তি ঠিকই কিন্তু তারাই এই অঞ্চলে সর্পপূজার প্রবর্তক একথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। বস্তুত মনসা নয়, কীচকেশ্বরীই যেন এই অঞ্চলের আদি সর্পদেবী। দাঁতন, নয়াগ্রাম থেকে শুরু করে রাইবনিয়া (বালেশ্বর), বহলদা, রাইরঙ্গপুর, খিচিং, বারিপদা (ময়ূরভঞ্জ) সর্বত্র আজও কীচকেশ্বরী সাড়ম্বরে পূজিত হন—
ঈশানি কীচকেশ্বরী যে স্থানে অদ্যপি
বিরাজন্তি নাহান্তি সে অন্যত্র কুত্রাপি।২৫
সমীক্ষায় দেখা যায়, ভঞ্জরাজাদের একদা অধিকারাধীন অঞ্চলে কীচকেশ্বরী আজও মুখ্য সর্পদেবী।
আলোচ্য ভূখণ্ডে শীতলা ব্যতীত অন্যান্য লোকদেবীর থেকে সর্পদেবী (কীচকেশ্বরী, বিষহরি বা মনসা যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন)-ই লোকমানসে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেছে। মূলত নিম্নরূপ মূর্তি বা প্রতীকে দেবী পূজিত হন—
১. সর্পের যথাযথ প্রতিমূর্তি— মাটি, আটার মণ্ড, বিভিন্ন ধাতু বা প্রস্তর নির্মিত।
২. প্রস্তর নির্মিত প্রাচীন দেবীমূর্তি— পূর্বেই এই ধরনের মূর্তির উল্লেখ করা হয়েছে। এই মূর্তিগুলি আবার দুই প্রকার—
ক. মনুষ্যাকৃতি মূর্তি, মাথার ওপর পঞ্চ বা সপ্তফণা বিস্তারী সর্প। হস্তে ধৃত সর্প।
খ. মূর্তির ঊর্ধ্বাংশ মনুষ্যাকৃতি, নিম্নাংশ সর্পাকৃতি।
৩. প্রস্তরনির্মিত প্রাচীন কোনও মূর্তির ভগ্নাংশ বা অখোদিত প্রস্তরখণ্ড।
৪. ইদানীংকালে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তিও পূজিত হয়— যা বাংলায় পূজিত মনসামূর্তির অনুরূপ।
৫. পোড়ামাটির বারিঘট, মনসাচালি— বিশেষত ঝাড়গ্রাম ও সংলগ্ন ময়ূরভঞ্জে।
৬. মনসা বা সিজ ডাল এবং উনুনের প্রতীকে।
জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন এই পাঁচমাস দেবীর পূজার সাধারণ সময়কাল। তবে পূর্বোক্ত প্রায় সব স্থানেই কীচকেশ্বরী নিত্য পূজিত হন। ১৩ জ্যৈষ্ঠ রোহিণ পরবে সর্পপূজার সূচনা আর আশ্বিনের ডাকসংক্রান্তিতে সমাপ্তি। এই সময়কালের মধ্যে বিভিন্ন বার-তিথিতে সর্পপূজাকে কেন্দ্র করে নানা ব্রত-পার্বণের আয়োজন। নিম্নে তারেই কয়েকটি সংক্ষেপে আলোচিত হল—
নাগপঞ্চমী: শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চম দিনটি নাগপঞ্চমী রূপে পরিচিত। নাগপঞ্চমী সর্বভারতীয়। সর্ববর্ণের হিন্দু সমাজ পালন করে। পার্থক্য শুধু আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যে। আলোচ্য ভূখণ্ডে প্রচলিত বিশ্বাস এইদিন কদ্রুর গর্ভ থেকে অষ্টনাগ ভূমিষ্ঠ হন। কৌলিক রীতি অনুসারে বিভিন্ন পরিবারে অষ্টকুলনাগ পূজিত হন। সাধারণত মৃত্তিকা নির্মিত উত্তোলিত ফণাযুক্ত সর্প পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও মনসার মৃন্ময়ী মূর্তিও পূজিত হয়। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কোনও কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে এইদিন অরন্ধন পালনের প্রথা আছে। শুধু হিন্দুরা নয়, এই ভূখণ্ডের কোল, ওরাঁও, ভূমিজ প্রভৃতি জনজাতিরাও নাগপঞ্চমী পালন করেন। তবে কোল সমাজে পূর্বে নাগপঞ্চমী পালনের প্রথা যে ছিল না তা বোঝা যায় তাদের মধ্যে প্রচলিত একটি ‘কথা’ থেকে। বর্তমানে কোল সমাজের একটি অংশ দিনটি পালন করেন। চতুর্থীর দিন উপবাস করে পঞ্চমীর দিন নাগমূর্তি বা সর্পের প্রতিকৃতিতে পূজা করা হয়। তারপর নিকটবর্তী টিলা, ডুংরি বা সাপ থাকতে পারে এমন সম্ভাব্য স্থানে দুধ উৎসর্গ করা হয় এবং সমবেত ভোজনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হয়। এইদিন মাটি খনন, বা লাঙল করা নিষিদ্ধ, যাতে সাপ আঘাত না পায় বা বিরক্ত না হয়। দ্রাবিড় বংশের কুড়ুখভাষী ওরাঁও-রা এইদিন তাদের সর্পদেবতা ‘খেট্টা’-র পূজা করেন। দেবতার উদ্দেশে মুরগি বা কোনও পশু বলিদান করা হয়। ভূমিজ সম্প্রদায় দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করেন। ঘরের উঠোন গোবর দিয়ে নিকিয়ে একস্থানে মাটির ঘট স্থাপন করা হয়। তারপর পাড়হীন একটি সাদা কাপড় সেই ঘটের ওপরে রাখা হয়। ধান, ফুল, বেলপাতা দিয়ে স্থানটি সাজানো হয়। নৈবেদ্য হিসেবে থাকে দুধ, মিষ্টি ও গাঁজা। ছাগল, মুরগি বা পায়রা বলি দেওয়া হয়। সমগ্ৰ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন লায়া। এছাড়া বীরহড়, লোধা প্রভৃতি জনজাতির মধ্যেও এইদিন সর্পপূজার প্রচলন আছে।
জাগুলাই পঞ্চমী: ওড়িশার কটক, যাজপুর প্রভৃতি অঞ্চলে শ্রাবণ মাসের নাগপঞ্চমীকে জাগুলাই পঞ্চমী ভাবে পালন করা হয়। আমাদের আলোচ্য ভূখণ্ডের মধ্যে কেবল বালেশ্বরের কোনও কোনও গ্রামে দিনটি জাগুলাই পঞ্চমী হিসেবে পালিত হয়। সাধারণত গ্রামের বারিক (নাপিত) মৃত্তিকা নির্মিত তিন চোখ বিশিষ্ট একটি নাগমূর্তি নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ‘মাগন’ আদায় করেন। আদায়ীকৃত অর্থ বা দ্রব্যে জাগুলাই ‘ঠাকুরানি’-র পূজা করা হয়। রাত্রে কখনও কখনও নাগদেবতার মাহাত্ম্যসূচক ‘অপেরা’ বা নাটক মঞ্চস্থ হয়। গবেষক প্রদ্যোতকুমার মাইতির মতে— The Jaguli seems to be snake Goddess Janguli of the Buddhists, who enjoyed wider popularity in the age of Buddhist predominance.২৬ প্রসঙ্গত, আমাদের আলোচ্য ভূখণ্ডে এক সময় বৌদ্ধধর্মের প্রাবল্য ছিল। দাঁতনের মোগলমারিতে আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহারের পশ্চিম দেওয়ালে স্টাকো নির্মিত বিভিন্ন মূর্তির মধ্যে একটি বৌদ্ধ সর্পদেবী জাঙ্গুলী-র বলে পণ্ডিতদের অভিমত।
অরন্ধন: এই অঞ্চলে অরন্ধন ‘অরান্ধ’ নামে পরিচিত। অরন্ধনের জন্য কোনও একটি দিন নির্দিষ্ট নয়। বিভিন্ন জাতি-সম্প্রদায় এমনকি পরিবার ভিন্ন ভিন্ন দিনে অরন্ধন পালন করেন। সাধারণত নাগপঞ্চমী থেকে শুরু করে আশ্বিনের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন দিনে অরন্ধন পালিত হয়। অরন্ধনের দিন পখাল (পান্তা) খাওয়া বিধি। ঘরে রন্ধনকার্য হয় না, ঘরের বাইরে অস্থায়ী উনুনে তরিতরকারি রান্না করে জ্ঞাতি-কুটুম্ব, পাড়া-পড়শি, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে খাওয়া হয়। সম্বচ্ছরে একদিন ঘরের স্থায়ী উনুনের বিশ্রাম এবং পারিবারিক সর্পপূজা। এইদিন উনুন ভালভাবে পরিষ্কার করে গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে নেওয়া হয়। উনুনের চারপাশে আলপনা এবং ফুল-পাতা দিয়ে সাজানো হয়। তারপর মাটি বা আটার মণ্ড দিয়ে তৈরি সর্পের প্রতিকৃতি উনুনের মধ্যে রেখে পূজা করা হয়। আলোচ্য ভূখণ্ডে সর্প আরাধনার এই রীতির মধ্যে নগেন্দ্রনাথ বসু বিরাটরাজাদের প্রভাব লক্ষ করেছেন— The Vairata Rajas perform the worship of the Nagamata and of eight Nagas in their respective hearths. অবশ্য এই রীতির উৎসসন্ধানে তিনি মধ্য এশিয়ার সর্পপূজক গোষ্ঠী ও শকদের প্রভাব অনুভব করেছেন— This form of worship of the Nagamata in the kitchen is of very ancient orgion. … … The goddess of the hearth was a principal object of worship by the Scythians. তাঁর আরও অভিমত— In all possibility she has come to be regarded as the Nagamata by the Vairata dynasty of Mayurbhanja and the same goddess in worshipped by the Hindus of Bengal as Manasa every year in the month of August and September.২৭ আলোচ্য অঞ্চলে অরন্ধন বহুপ্রকার যথা— দিনিকিয়া (একদিবসীয়), ওলিকিয়া (একবেলা) প্রভৃতি। অরন্ধনের দিন সন্ধ্যায় এই অঞ্চলের কোথাও কোথাও ঘরের নোংরা আবর্জনা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাইরে ফেলে দিয়ে আসে, সেই সময় তারা কুলো বাজিয়ে গান করে—‘হিড়মী (হিড়ম্বী) গনে বনকু; লক্ষ্মী আইলে কনকু (ঘরের কোণে)।”২৮
গমহা পূর্ণিমা: শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা গমহা পূর্ণিমা নামে পরিচিত। অনেকের মতে, গমহা শব্দটি গো শব্দের অপভ্রংশ। এইদিন গাই-গোরু পূজিত হয়। আবার এইদিন বলরামের জন্মদিবস, হলধর কৃষককুলের প্রতীক। তিনিও পূজিত হন। গোয়াল পরিষ্কার করে আলপনা দেওয়া হয়, গাই-গোরুকে স্নান করিয়ে শিংয়ে, খুরে তেল হলুদ, কপালে সিঁদুর মাখানো হয়। গলায় ফুলের মালা পরানো হয়। পিঠে তৈরি করে গাই-গোরুকে খাওয়ানো হয়। সন্ধ্যায় গোয়ালে বলরাম পূজা। পূজার বিভিন্ন উপকরণের সঙ্গে থাকে মৃত্তিকা নির্মিত একটি সাপ। বলরাম অনন্তনাগের অবতার, সাপ অনন্ত তথা বলরামের প্রতীক। গবেষকদের অনুমান, বলরাম পূজা আসলে সর্পপূজার রূপান্তর। প্রদ্যোতকুমার মাইতির মতে— The practice suggest that in orissa the snake cult has been assimilated with in the fold of Baladev worship…২৯
লাগল চতুর্থী: আশ্বিনের ডাকসংক্রান্তিতে সর্পকেন্দ্রিক ব্রত-পার্বণের সমাপ্তির কথা পূর্বে বলা হয়েছে। সাধারণত মানত ও কোনও কোনও স্থানে নিত্যপূজা ছাড়া সর্পদেবীর পূজা আর হয় না, ব্যতিক্রম শুধু লাগল চৌথী বা লাগল চতুর্থী। কার্তিক মাসের শুক্ল চতুর্থীতে এই ব্রত পালন করা হয়। বাংলায় বোধহয় এই ব্রতের প্রচলন নেই। দক্ষিণ ওড়িশা এই ব্রতের প্রভাব মণ্ডল। তবে আলোচ্য ভূখণ্ডে লাগল চৌথী অপরিচিত নয় বলে এখানে উল্লেখ করা হল— লাগল চতুর্থীর দিন ব্রতী মহিলারা উইমাটি এনে পূজাস্থানে একটি ঢিপির মত তৈরি করেন। পাশে রাখেন মাটির একজোড়া নাগ-নাগিনীর মূর্তি। তারপর সিঁদুর, ফুল, ফল দিয়ে পূজা করেন। পূজা শেষে লাগল চৌথী ব্রতকথা শোনেন। ব্রতকথাটি এইরকম—
ধনপতি সদাগরের সাতপুত্র, সাত পুত্রবধূ। শাশুড়ি ছোটবউকে পছন্দ করে না, সব সময় গঞ্জনা দেয়। একদিন শাশুড়ি পুকুরে স্নান করতে গিয়ে সাতটি গড়িশা (গড়ই) মাছ নিয়ে এল। ছোটবউকে বলল সেগুলো ভেজে দিতে, ভাতের সঙ্গে খাবে। ছোটবউ পরে ভাজবে বলে একটি কাপড়ের পুটলিতে বেঁধে সেগুলো চালে গুঁজে রাখল। কিন্তু খাবার সময় শাশুড়ি বউ দু’জনেই মাছের কথা ভুলে গেল। কিছুদিন পর বউয়ের মনে পড়তে সে চাল থেকে বের করে এনে পুটলিটি খুলতেই সাতটি ছোট ছোট সাপ বাচ্চা বেরিয়ে এসে ঘরের ঈশান কোণে চলে গেল। ছোটবউয়ের সাপ বাচ্চাগুলোর ওপর মায়া হল, সে মাঝে মাঝে তাদের দুধ বা অন্য খাবার দেয়। একটু বড় হতে একদিন ছোটবউ তাদের নিয়ে গিয়ে একটি বিলে ছেড়ে দিয়ে এল। সাপ বাচ্চাগুলো তাদের ঘর পাতালে চলে গেল। পাতালে গিয়ে তাদের মাকে বলল ছোটবউ তাদের কেমন যত্ন করেছে। নাগমাতা খুশি হয়ে বলল, তোমরা কিছুদিনের জন্য ছোটবউকে আমাদের ঘরে নিয়ে এসো। সাপ বাচ্চারা মানুষের বেশে সদাগরের বাড়িতে এসে সদাগরের স্ত্রীকে বলল, আমরা তোমার ছোটবউয়ের ভাই। আমরা কিছুদিনের জন্য তাকে আমাদের ঘরে নিয়ে যাব। শাশুড়ি তাদের সঙ্গে ছোটবউকে পাঠাল। সর্পপুরে ছোটবউ কিছুদিন রইল। নাগমাতা ও অন্যান্য সাপেরা তার খুব আদরযত্ন করল। সর্পপুরীতে একটি ঘরের কপাট সবসময় বন্ধ থাকত। নাগমাতা ছোটবউকে সেই ঘরটি খুলতে নিষেধ করে কিন্তু কৌতূহলে ছোটবউ একদিন সেই ঘরের কপাট খুলে ফেলে। সেই ঘরে ছিল ভয়ংকর সব সাপ। ছোটবউকে দেখে তারা ফণা উঠিয়ে গর্জে উঠল। তাদের দেখে ছোটবউ ভয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল। নাগমাতা বুঝতে পেরে বলল, নরলোকে যেসব নাস্তিক, ঈশ্বরদ্রোহী, দোষী, অপরাধী, নির্দয় লোক আছে তাদের দংশন করার জন্য সময়ে সময়ে এদের পাঠানো হয়। তাছাড়া এরা আর কোথাও যায় না। ছোটবউ বলল, তুমি তো হত্তাকত্তা সেইসব লোককে ক্ষমা করে দাও না কেন? নাগমাতা বলে, যারা লাগল চৌথী ব্রত করে তাদের সর্পদংশন দণ্ড থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। ছোটবউয়ের ইচ্ছায় নাগমাতা তাকে লাগল চৌথী ব্রত শিখিয়ে দিল। সর্পপুর থেকে ফিরে এসে ছোটবউ লাগল চৌথী ব্রত পালন করল। কিন্তু শাশুড়ির গঞ্জনা কমল না। নাগমাতা শাশুড়িকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তার অনুচরদের পাঠাল। কিন্তু যেহেতু ছোটবউ লাগল চৌথী ব্রত করে তাই সাপেরা পরিবারের কারও ক্ষতি করতে পারল না। ছোটবউ এই ব্রতের মহিমা সবাইকে বলল। তখন সবাই মিলে লাগল চৌথী ব্রত পালন করল। তারপর থেকে শাশুড়ি ছোটবউকে খুব ভালবাসতে লাগল।৩০
ব্রতকথাটি থেকে স্পষ্ট মূলত সর্পভীতি বা সর্পদংশন থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে এই ব্রতের সূত্রপাত। ওড়িশার গঞ্জাম অঞ্চলে এই ব্রতের আরও নানা ‘কথা’ প্রচলিত।
রোহিণ: ১৩-১৯ জ্যৈষ্ঠ রোহিণ পরবের সময়কাল। রোহিণ মূলত কৃষিকেন্দ্রিক পরব। কৃষিকাজে শুভারম্ভ। একই সঙ্গে সর্পপূজারও সূচনা। লোকবিশ্বাস, এই সময় বীজ বপন করলে ফসল ভাল হয় আর সর্পের বিষ ধোওয়ার জন্য এই সময় বৃষ্টি হবেই। স্পষ্টত প্রজনন তথা উর্বরতাবাদ থেকে কৃষিকাজের সঙ্গে সর্পসংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছে রোহিণ পরবে। এই সময় নারীরা সদ্যকর্ষিত জমির মাটি (রোহিণ মাটি) নিয়ে এসে ঘরের চারিদিকে ছড়িয়ে দেন। বিশ্বাস, তাহলে সাপ ঘরে ঢুকবে না। সাপের ওঝা বা গুনিনরা এই সময় সাপ ধরেন, শিষ্যদের ‘সর্পবিদ্যা’ শিক্ষা দেন। আলোচ্য ভূখণ্ডের ঝাড়গ্রাম ও সংলগ্ন ময়ূরভঞ্জে রোহিণ পরবের আধিক্য দেখা যায়।
ঝাঁপান: রাঢ়বঙ্গের সর্পসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ পর্ব ঝাঁপান। আলোচ্য সীমান্তভূমির ঝাড়গ্রাম, ময়ূরভঞ্জ অঞ্চলেও ঝাঁপান প্রচলিত। ঝাঁপানের জন্য নির্দিষ্ট কোনও দিন নেই। সাধারণত শ্রাবণ সংক্রান্তি, দশহরা বা আশ্বিনের ডাক সংক্রান্তিতে ঝাঁপান অনুষ্ঠিত হয়। স্থানভেদে ঝাঁপানের আচার-পদ্ধতির পার্থক্য থাকলেও ঝাঁপান মূলত সাপের খেলা দেখানোর অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মুখ্যভূমিকা ওঝা, গুনিন এবং তাদের শিষ্যদের। রোহিণের সময় ওঝা বা গুনিনরা মনসার পূজা করে শিষ্য গ্রহণ করেন, প্রতি সন্ধ্যায় শিষ্যদের মন্ত্র-সর্পবিদ্যা শেখানো হয়। ঝাঁপান পর্যন্ত চলে শিষ্যদের প্রশিক্ষণ। ঝাঁপানের দিন গুরু শিষ্যদের নিয়ে তাঁর সর্পবিদ্যা প্রদর্শন করেন। অন্য ওঝা বা গুনিনদের সঙ্গে চলে বিদ্যা প্রদর্শনের লড়াই।
সর্পকেন্দ্রিক এই উৎসব অনুষ্ঠানগুলি ছাড়াও আষাঢ় মাসের অম্বুবাচীর দিন সর্বত্রই গৃহস্থের ঘরে সর্পদেবী পূজিত হন। রাঢ়বঙ্গে প্রচলিত ‘খইঢেরা’ বা ‘খইধারা’ অনুষ্ঠানও ঝাড়গ্রাম অঞ্চলে প্রচলিত। এটি সম্প্রদায় বিশেষের অনুষ্ঠান। সাধারণত নাগপঞ্চমীর পরে কোনও মঙ্গল বা শনিবার এই অনুষ্ঠান হয়। যাদের খইঢেরা আছে তাদের বাড়িতে সেদিন মনসা পূজা হয়। সেদিন বাড়িতে রান্না হয় না। আগের থেকে ভেজে রাখা খই, মুড়ি ইত্যাদি খাওয়া হয়। এছাড়া ‘চিতোই অমাবস্যা’ (শ্রাবণ মাসের অমাবস্যা), ভাদ্রমাসের শুক্ল চতুর্দশীতে পালিত ‘অনন্ত ব্রত’-এর মধ্যে অনেকে সর্পপূজার স্মৃতি লক্ষ করেছেন। আবার ভূমিজ, কুড়মি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের গরাম দেবতা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত মন্তব্য করেছেন— “আমন ধান তোলবার আগে ‘গরাম থানে’ ‘গরাম দেবতা’র ‘জাঁতাল’ পূজা দিতে হয়, উপচার নতুন আমন ধান। আমরা জানি, গ্রামদেবতা ছদ্মবেশে মনসাই অথবা বলা ভালো সর্পদেবতা।’’৩১
৫
সর্পকেন্দ্রিক পূজা বা উৎসব ছাড়া আলোচ্য ভূখণ্ডের মানুষের দৈনন্দিন জীবনচর্যায়-বিশ্বাসে-সংস্কারে, লোককথায়, প্রবাদে জড়িয়ে আছে সর্পভাবনা। রোহিণের দিন সাপের বিষ ধোওয়ার জন্য বৃষ্টি হবেই এই বিশ্বাসের কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। সর্পদংশনে মৃত ব্যক্তির দেহ দাহ না করে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হত, বিশ্বাস জলে সর্পের বিষ নাশ হয়ে মৃত ব্যক্তির দেহে পুনরায় প্রাণের সঞ্চার ঘটবে। এইসব বিশ্বাস সর্পের সঙ্গে জলের সম্পর্কের ভাবনাকে সূচিত করে। জলাশয়ে সাপের স্বচ্ছন্দ গতি দেখে আদিম মানুষ হয়তো জল ও সাপের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের কথা ভেবেছিল। আজও আলোচ্য ভূখণ্ডের বিভিন্ন জলাশয়ের পাড়ে সর্পমূর্তি কিংবা শিবলিঙ্গের সঙ্গে সর্পমূর্তি দেখা যায়। শুধু জল বা বৃষ্টির সঙ্গে সাপের সম্পর্কের ভাবনা নয়, লোকভাবনায় ভূমির উর্বরতা শক্তি ও ফসল উৎপাদনের সঙ্গেও সর্পের যোগ খুঁজে পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে আশুতোষ ভট্টাচার্যের বক্তব্য উদ্ধার করা যেতে পারে— ধরিত্রীর মধ্য থেকে শস্যরাশি উৎপন্ন হয়, সুতরাং তার প্রাণ আছে, আত্মাও আছে। সর্প মাটির নীচে বসবাস করে, মাটির ওপরে ঘুরে বেড়ায়, আবার দীর্ঘকাল গর্তের মধ্যে বাস করতে পারে। সুতরাং সর্পই ধরিত্রীর প্রাণশক্তি বলে কল্পিত হল। সেইজন্য পৃথিবীব্যাপী আদিম জাতির মধ্যে সর্পের সঙ্গে উর্বরাশক্তির একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে বলে কল্পনা করা হয়।৩২ এই বিশ্বাস থেকেই হয়তো আলোচ্য অঞ্চলে অনন্ত বা শেষনাগের অবতাররূপে বলভদ্র কৃষিদেবতায় পরিণত হয়েছেন। আবার পূর্বপুরুষের আত্মা সর্পদেহ ধারণ করে সবার অগোচরে ঘরে প্রবেশ করে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। সর্পকে গুপ্তধনের রক্ষাকর্তা হিসাবেও কল্পনা করা হয়। ঘুমন্ত ব্যক্তির মাথার ওপর সর্প ফণাচ্ছত্র ধারণ করলে সেই ব্যক্তি রাজা হয় বলে বিশ্বাস। সর্প সম্পর্কে এই ধরনের বিশ্বাস অবশ্য সারা ভারতেই প্রচলিত। সর্প বা সর্পদেবতার পূজা করলেও আলোচ্য ভূখণ্ডে সাপ যে মারা হয় না, তা নয়। সাধারণত বিষধর সাপ মারার পর তাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয় তারপর পোড়ানোর স্থানটি হলুদ জল দিয়ে ভাল করে ধোওয়া হয়। লোকবিশ্বাস, না পোড়ালে মৃত সাপের চোখে হত্যাকারীর প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। তা দেখে মৃত সাপের আত্মীয়স্বজনরা হত্যাকারীকে দংশন করে প্রতিশোধ নেয়।
আলোচ্য ভূখণ্ডের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বা লোকসমাজে সর্পকেন্দ্রিক বহু ‘কথা’ প্রচলিত। তবে একদা প্রায় সমগ্ৰ অঞ্চলে প্রচলিত ‘শশিসেনা’ কাহিনির উল্লেখ এখানে করতে হয়। দাঁতনের মোগলমারি বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ লোকমুখে শশিসেনা বা সখিসেনার পাঠশালারূপে পরিচিত ছিল। লোকশ্রুতি রাজকন্যা শশিসেনা এই পাঠশালায় পড়তে এসে মন্ত্রী বা কোটালপুত্র অহিমানিকের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। তাদের প্রণয়কাহিনি লোকসমাজে বেশ জনপ্রিয় ছিল। বহু কবি এই কাহিনি নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। পালাগানের আকারে একসময় গাওয়াও হত। স্বাভাবিকভাবেই জনপ্রিয় এই কাহিনির অঞ্চলভেদে কিছু রূপান্তর দেখা যায়। ওড়িশা অঞ্চলে প্রচলিত এই কাহিনিতে দেখা যায় অহিমানিক মন্ত্রী বা কোটালপুত্র নয়। সে আসলে নাগরাজার পুত্র হলাহলকুমার। একবার মর্ত্য দেখতে এসে ছোট সাপবাচ্চা রূপে নদীতে খেলছিল। সেইসময় নদীতে স্নান করতে এসেছিল এক চকুলিয়া পণ্ডা (নিম্ন শ্রেণির ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ)। পণ্ডার অজান্তে তার কলসিতে সাপবাচ্চা রূপী হলাহলকুমার ঢুকে পড়ে। পণ্ডা কলসিতে জল নিয়ে এসে ঘরে রেখে দেয়। পণ্ডা-গৃহিণী কলসি থেকে জল নিতে গিয়ে সাপবাচ্চাটিকে দেখতে পায়। সে তখন কলসির জল সমস্ত ঢেলে দেয় আর সঙ্গে সঙ্গে সাপবাচ্চাটি সুন্দর মানবশিশুতে পরিণত হয়। পণ্ডা দম্পতি খুব যত্নে শিশুটিকে বড় করে তোলে। পাঠশালায় ভর্তি করে। সেই পাঠশালায় শশিসেনার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কাহিনির বাকি অংশ দাঁতন অঞ্চলে প্রচলিত কাহিনির অনুরূপ। অবশ্য কাহিনির প্রায় সব রূপভেদে দেখা যায় অহিমানিক নিজেকে ‘হালি’ অর্থাৎ হলধর বলে কয়েকবার পরিচয় দিচ্ছে। আমরা জানি হলধর বা বলভদ্র অনন্তনাগের অবতার। সমগ্ৰ কাহিনিতে তন্ত্রের প্রভাবও রয়েছে। আলোচ্য ভূখণ্ডে একসময় বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখার প্রভাব ছিল। মহাযান তন্ত্রের সঙ্গে সর্পভাবনা বা সর্পতন্ত্রের সমন্বয়ে এই কাহিনি গড়ে উঠেছিল কিনা তা অনুসন্ধানের বিষয়।
আলোচ্য ভূখণ্ডে সর্পদেবীর মাহাত্ম্যমূলক কোনও স্বতন্ত্র কাহিনি রচিত হয়েছিল কিনা আমাদের জানা নেই। তবে ওড়িয়া কবি দ্বারিকাদাসের মনসামঙ্গল একসময় বোধহয় কিছুটা জনপ্রিয় হয়েছিল। কারণ কাঁথি অঞ্চল থেকে দ্বারিকাদাসের পুথির অনুলিপি পাওয়া গেছে। কাব্যটি বিষ্ণুপদ পাণ্ডার সম্পাদনায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে সমগ্র অঞ্চলে কেতকাদাসের মনসামঙ্গল সর্বাধিক জনপ্রিয়। মনসামঙ্গল পালাগানের গায়কেরা কখনও কখনও ‘বাইশা’ থেকেও গান করেন। পালাগানের দলগুলি ওড়িশা ও বাংলা উভয় অংশেই পালাগান পরিবেশন করে। তবে শ্রোতা-দর্শকদের চাহিদায় পালাগান ক্রমশ লোকনাটকের রূপ নিচ্ছে। মনসামঙ্গলের বিভিন্ন চরিত্র রীতিমত সাজসজ্জায় আসরে অবতীর্ণ হচ্ছে। চরিত্রের মুখে কাহিনিক্রম অনুযায়ী তাৎক্ষণিক সংলাপ রচিত হচ্ছে কিংবা ‘ওস্তাদ’ পূর্ব থেকে সংলাপ রচনা করে অভিনেতাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
ওঝা বা গুনিনদের গৃহে সন্ধ্যার আসরে কিংবা ঝাঁপানের সময় গেয় গানগুলি ছাড়া সর্পকেন্দ্রিক কোনও গানের সন্ধান আমরা পাইনি। তবে আলোচ্য ভূখণ্ডের মানুষের দৈনন্দিন কথাবার্তায় ব্যবহৃত প্রবাদে সর্পভাবনার সন্ধান পাওয়া যায়। নীচে সেই রকম কয়েকটি প্রবাদের উল্লেখ করা হল—
১. সাপ শালা গুণ্টিয়া (গ্রামের মোড়ল)/ ই তিনহে মহা চুটিয়া।
২. সাপ শালা জমিনদার/ তিন নয় আপনার।
৩. ধরম ঘরে নাই থাই (থাকে) পাপ/ খুলা ঘরে নাই যাই সাপ।
৪. পাপের ধন সাপে খায়।
৫. সাপের লেখা বাঘের দেখা।
৬. বিছুর মন্ত্র নাই জানিকরি, নাগ সাপের মুড়ে হাত। (বিছের মন্ত্র না জেনে বিষধর সাপের মাথায় হাত দেওয়া/ অপরিণামদর্শিতা)
৭. নাগের পুঅ (পুত্র) দেনু (ঢোঁড়া বা বিষহীন সাপ)
৮. অদেখা পাপ/ আঁধারের সাপ।
৯. আঁধার ঘরে সাপ/ ঘরের চারি আড়ে (দিকে) সাপ।
১০. ছুয়া (বাচ্চা) সাপের বড় বিষ।
১১. যা (যে) পুঅকে সাপ কামুড়ে/ তা (তার) মা দড়ি দেখিলে ডরে।
৬
আলোচ্য ভূখণ্ডে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রচলিত জনশ্রুতি, লোককথা এবং বর্তমান অধিবাসীদের জীবনচর্যা থেকে একথা বলা যায় যে, প্রায় অষ্টম-নবম শতক থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সর্প উপাসনা চলে আসছে এবং ভারতীয় সর্পসংস্কৃতির ক্ষেত্রে আলোচ্য ভূখণ্ড একটি বিশিষ্টাঞ্চল বললে বোধহয় অত্যুক্তি হয় না। ওড়িয়া, বঙ্গ এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঝাড়খণ্ডী বা মানভূমি সর্পসংস্কৃতিকে স্বীকার করলেও আলোচ্য ভূখণ্ডের সর্পসংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে সর্পদেবী রূপে কীচকেশ্বরীর প্রতিষ্ঠায়। ওড়িশা, বাংলা তথা ভারতের আর কোথাও বোধহয় সর্পদেবী রূপে কীচকেশ্বরী পূজিত হন না।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান আলোচনায় ওড়িশা-বঙ্গ সীমান্তের সর্পসংস্কৃতির একটি প্রাথমিক রূপরেখা অঙ্কনের চেষ্টা করা হল মাত্র। প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য ভূখণ্ডে সর্পসংস্কৃতির একটি বিশিষ্ট দিক সর্প ওঝা, গুনিনদের বিচিত্র ক্রিয়াকর্ম। তাদের ঝাড়-ফুঁক, বিষ বিনাশ, বশীকরণ প্রভৃতির মন্ত্রাচার নিয়ে আলোচনা না করলে এই আলোচনা পূর্ণতা পায় না কিন্তু অসুসন্ধানের অভাবে তা আলোচনার বহির্ভূত রইল। একই কারণে ওরাঁও এবং শবর সমাজের সর্পভাবনার সন্ধান দেওয়া গেল না। উল্লেখ যে, আলোচ্য ভূখণ্ডে সর্পসংস্কৃতির প্রসারে এই দু’টি জনজাতির ভূমিকা বিশেষ অনুসন্ধানের দাবি রাখে। তাই আলোচ্য ভূখণ্ডের সর্পসংস্কৃতির যথার্থ রূপটি ফুটিয়ে তোলার জন্য আরও অনুসন্ধান, নিরীক্ষণ, অনুধ্যান প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র:
১. বিধুশেখর ভট্টাচার্য (অনূদিত), মাধ্যন্দিন শতপথ ব্রাহ্মণ, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় কাণ্ড, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৮৬, পৃষ্ঠা ২৮-২৯
২. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, কলিকাতা বুক হাউস, কলকাতা, ১৩৪৬, পৃষ্ঠা ১০২
৩. তদেব
৪. তদেব
৫. Nagendranath Basu, Archaeological survey of Mayurbhanja Vol. I, 1911, page Xliii
৬. বঙ্কিমচন্দ্র মাইতি, সুবর্ণরেখা অববাহিকার লোকসংস্কৃতি, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০১৮, পৃষ্ঠা-২১২
৭. Epigraphia Indica, Vol. XXVIII, Page 329-331
৮. Ibid, page 332-334
৯. Inscription of Orissa, Vol. I Part II, page 123
১০. Orissa Historical Research Journal, Vol-2 No-3, page 45
১১. দীনেশচন্দ্র সরকার, শিলালেখ তাম্রশাসনাদির প্রসঙ্গ, কলকাতা, পৃষ্ঠা-৬৯
১২. Stella Kramrisch, The Vishnudharmottara (part-III), Calcutta University Press, 1928, page 86-87
১৩. নগেন্দ্রনাথ বসু, বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, কায়স্থ কাণ্ড, প্রথম অধ্যায়, পৃষ্ঠা-৬৬, ৬৮
১৪. দীনেশচন্দ্র সরকার, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৭৬
১৫. Epigraphia Indica, Vol. XXIX, Part VII, page 211
১৬. শ্রীকান্ত চরণ পাত্র, রাইবনিয়ার দিগদিগন্ত (ওড়িয়া), দ্বিতীয় সংস্করণ, সুবর্ণশ্রী প্রকাশনী, বালেশ্বর, ২০১৯, পৃষ্ঠা ১২৯
১৭. Nagendranath Basu, Archaeological Survey of Mayurbhanja, Vol.I, 1911, page XXXVI
১৮. বঙ্কিমচন্দ্র মাইতি, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-২১০
১৯. Nagendranath Basu, Ibid, page XXXVI
২০. রুদ্রনারায়ণ ষড়ঙ্গী, বিরাটনগর ও স্বর্ণরেখা (ওড়িয়া), পৃষ্ঠা-১৩
২১. ললিতমোহন সামন্ত, দাঁতনের ইতিহাস, প্রতিকথা, দাঁতন, ২০১৫, পৃষ্ঠা-৬০
২২. এবং সায়ক পত্রিকার সম্পাদক সূর্য নন্দী মহাশয়ের নিকট রক্ষিত নথি
২৩. O.H.R.J, Ibid, page 41
২৪. শক্তি সেনগুপ্ত, দামুন্দা কশিপা শিলাবতী, অন্তরাল, কলকাতা, ২০০২, পৃষ্ঠা-৯৩
২৫. রুদ্রনারায়ণ ষড়ঙ্গী, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-১২
২৬. Prodyut kumar Maity, Historical Studies in the Cult of goddess Manasa, Ponthi pustaka, calcutta, 1966, page 299
২৭. Nagendranath Basu, Ibid, Page XXXIX
২৮. ব্রজমোহন মহান্তি, পঠানি পট্টনায়ক প্রমুখ (সম্পাদিত), ওড়িশার পর্ব-পর্বাণি, যানিযাত্রা (ওড়িয়া), ওড়িশা বুক স্টোর, কটক, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা-২৮১
২৯. Prodyut kumar Maity, Ibid, page 29
৩০. লাগল চতুর্থী ব্রতকথা, ধর্মগ্রন্থ স্টোর, কটক
৩১. বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত, ঝাড়খণ্ডের লোকভাবনা, কথাশিল্প, কলকাতা, ১৩৯০, পৃষ্ঠা-৮৯
৩২. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলার লোক-শ্রুতি, পুরোগামী প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৬০, পৃষ্ঠা-১০৬-১০৭
পড়ে ফেললাম। অনেক কিছু জানলাম।