ঘরটা অতি সাধারণ। ক’টা বেঞ্চ আর টেবিলে ভর্তি। একটা কাচভাঙা কাঠের আলমারি। খবরের কাগজ দিয়ে আটকানো। পুরনো দেয়ালে চুনকামের ছোপ ছোপ জল শুকানোর দাগ। পুরনো বাড়ির ঘরটা লম্বাটে প্রকৃতির। সব মিলিয়ে চেপেচুপে গোটা কুড়ি বাবা-মা উদ্বিগ্ন মুখে বসে। তিন-চারটে ব্যাচ আসে-যায়। এই কোচিংয়ে পড়লে ইঞ্জিনিয়ারিং আর ভাল কলেজে ভর্তি হওয়া একদম নিশ্চিন্ত। উনি পরীক্ষা নেন একদিন অঙ্ক-ফিজিক্যাল সায়েন্স, অন্য দিন লিটারেচার। এর জন্যেও চাই একগাদা টাকা। কেউ বলে পিশাচ, কেউ বলে টাকার কুমির। প্রথম ব্যাচের আজ ফল ঘোষণা। উদ্বিগ্ন বাবা-মায়েদের দেখবার মত মুখ। কেউ কেউ ইষ্টনাম জপছে। কেউ গুরুদেবকে। আজ না হলে সব গেল। আজ বাজারহাট-রান্না সব বন্ধ। আজ পরবর্তী জীবনের সংকেত। একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি, পরনে গেরুয়া খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ঢোলা পায়জামা। একমাথা কালো-সাদা চুল। চোখদুটি ভারি চশমার ফাঁকে খুব উজ্জ্বল। বাবা-মায়েদের অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর লোকটি ঢুকল ঘরে। হাতে একটা কাগজ।
সামনে শেখরের দিকে তাকিয়ে তিনি রায়দানের মত বললেন, ‘ছেলেকে এনেছেন?’ বলে একঘর লোকের মধ্যে পাশে ছেলেকে দেখে বললেন, ‘ঠিক আছে। শুনুন, ওকে আমি নিতে পারছি না। খাতা দেখেছি। ওকে আর্টস পড়ান। ভাল করবে। ওর পছন্দমত সাবজেক্ট পড়ান, ভাল হবে। সায়েন্স ওর ভাল লাগার বিষয় নয়।’ শেখর কিছু বলবার আগেই মুখটা একপাশে ঘুরিয়ে পাশের ভদ্রলোককে বললেন, ‘বলেছি তো। না, টাকা কমবে না। একটাকা কমও নেওয়া যাবে না। দেখুন, না পারলে জানিয়ে যাবেন।’ তারপরের ভদ্রলোককে বেশ রুক্ষভাবে বলতে শুরু করলেন, ‘আগে অ্যাডমিশন ফিসের টাকা জমা দেবেন, তারপর পড়ানো শুরু হবে। যা বলব, সেটা করতেই হবে। সারা দিন রাত লাগলেও করতে হবে। বুঝেছেন?’
পাশের ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা শুকনো মুখে উঠে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আসলে স্যার, এর বেশি পারছি না। অন্য ছেলের জন্যে অনেক খরচ আছে। একটু যদি কিছু… অন্তত হাজার দশেক…।’
কথা শেষ করতে দিলেন না। ‘না, পারব না। অসুবিধা থাকলে অন্য কোথাও দেখুন। টাকা কমানো যাবে না।’
শেখর রায় বেরিয়ে এল ঘর থেকে। অদ্ভুত দমবন্ধ করা পরিবেশ।
সুরমা পুনুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘পারিসনি নাকি? কোয়েশ্চেন খুব কঠিন ছিল?’
পুনু মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘কঠিন ছিল।’
শেখর বলল, ‘অফিসের শ্যামল বলেছিল বলে আসা। লোকটা মানুষ? না চামার? কী ব্যবহার! টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না।’
সুরমা এতক্ষণ কিছু বলেনি। রাস্তায় নেমে বলল, ‘ছি, এই লোকের কাছে পুনুকে পাঠাব? দেমাক দেখেছ? একটু নাম হয়েছে, টাকা হয়েছে। ব্যাস, ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। এই তো মুশকিল বাঙালির।’
শেখর কোনও উত্তর দিল না।
পাশের সেই ভদ্রলোক এবং ওর স্ত্রী পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছেন। মুখোমুখি হওয়াতে শেখর বলল, ‘দেখলেন? কী টাকার গরম, না? আপনার ছেলে?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘পরীক্ষা নিয়েছে। নেবে বলেছে। কিন্তু অনেকগুলো টাকার ব্যাপার। আর এখুনি জমা দিতে হবে। ভেবেছিলাম বললে হয়তো একটু কমাবে। দুই ছেলে, এক মেয়ে। বোঝেনই তো।’
‘কী বলব বলুন তো? আমার ছেলেকে তো নেবেই না বলে দিল। দেমাক কী! শুনেছিলাম এনার কাছে পড়লে ভাল কলেজ, এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স হবেই। দারুণ পড়ান এবং তৈরি করে দেন।’
দুর দুর করতে করতে ওরা চলে গেলেন সামনে।
শেখর-সুরমার দুই ছেলে। বড়জন সুনু, স্বাভাবিক শিশু নয়। সবই আছে অথচ যেন কিছুই নেই। সবাই বোঝে না। সাধারণ স্কুলে পড়ে না। অনেক কষ্ট করে দুজন ওকে মানুষ করছে। সবই বোঝে, বলে, তবে জড়িয়ে জড়িয়ে। চিন্তা করার শক্তি প্রায় নেই। সাধারণ ছেলেদের থেকে পিছিয়ে। এখন ওর বয়েসি ছেলেরা কলেজে পড়ছে, কিন্তু ও ক্লাস সিক্স। খুব সংবেদনশীল ছেলে। মান অভিমান জেদ ভীষণ বেশি। ওর আলাদা স্কুল। ছোটটি পুনু। পড়াশুনায় ভালই। বাবা-মায়ের স্বপ্ন, এই অন্তত ছেলে ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার হোক। দেশে-বিদেশে যাক। মাধ্যমিক পরীক্ষায় শতকরা পঁচাত্তর পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছে। পেয়ে বুঝেছে কিছুই পায়নি। সামনে দুবছর পর উচ্চমাধ্যমিক। এবার সায়েন্স সাবজেক্টের জন্যেই দৌড়েছে অনল স্যারের কাছে। স্যার পরীক্ষা নিয়ে বলেছেন, নেবেন না। শেখর ও সুরমা চোখে অন্ধকার দেখছে। কী হবে ছেলের? শেষে কি সাধারণভাবে বড় হবে? বন্ধু-আত্মীয়রা কী বলবে?
শেখরের যখন মনমেজাজ ঠান্ডা থাকে তখন মাঝে মাঝে পুনুকে বোঝায়, ‘দেখ, কেন দুষ্টুমি, স্কুল পালানো, জিনিসপত্র ভাঙাভাঙি করিস। তখন তো আমার দিগবিদিক জ্ঞান থাকে না। তাই তো হাত উঠে যায় মাঝে মাঝে।’
একটু চুপ থেকে পুনু জিজ্ঞেস করে, ‘আমি পঁচাত্তর নম্বর পেলে মা বকে, আরও কেন পাইনি। অঙ্কে ষাট পেলে তুমি মারো। কেন? আমি তো এত ভাল নই। পেতেই হবে? না হলে হবে না?’
দূর থেকে রান্না করতে করতে এরকম প্রতিবাদীসুলভ বক্তৃতা শুনে সুরমা দৌড়ে আসে, গালে হাত দিয়ে বলে, ‘এত কথা শিখলি কোথায় বাপ? ভাল নই ভাল নই বলতে নেই। সব ভাল। এগোবি কী করে? কে তুই লাটের বাট যে তোকে নেবে কলেজে?’
শেখর দেখল ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে হবে, ‘না সবাই নব্বই পেলে, তুমি ষাট পেলে হবে? সামনে কলেজে ভর্তি হতে গেলে আশি পেলেও হবে না। ভাল কলেজ নব্বই না হলে নেবে না। চল সামনের শনিবার তোকে কিছু কলেজে নিয়ে যাই। জিজ্ঞাসা করে নিজেই জানবি।’
পুনু বলে, ‘আমি অন্য কিছু পড়ব।’
‘কী পড়বি?’
একটু ভেবে বলে, ‘যদি ছবি আঁকা শিখি? যদি ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-তে ভর্তি হই, তাহলে কি তোমরা খুব দুঃখিত হবে?’
চোখ কপালে উঠে যায় শেখরের, ‘এসব কী বলছিস? হায়, হায়, কে তোর মাথায় এসব ঢোকালে? ছি ছি। খবরদার এসব মনেও ভাবিস না কখনও। ওখানে পড়লে চাকরি পাবি? কেউ দেবে না চাকরি। ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হবে। চটির সুকতলা ক্ষয়ে যাবে কিন্তু চাকরি পাবি না। তখন আমরা কোথায়?’
পুনু খানিক চুপ করে রইল। তারপর উদাস হয়ে বলল, ‘সে আমি বুঝে নেব।’
শেখর সুরমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই তোমার জন্যে এইরকম হয়েছে। কোনও এইম-ই নেই।’
‘আমি ভাবছি ছোড়দি, জামাইবাবু, বড়দা কী বলবে।’
‘আর আমার বাড়ির কথা ভুলে গেলে? আমাকে কেউ ছেড়ে দেবে ভেবেছ? বলবে আমরা কিছুই দেখিনি। আজকাল একটু পড়লেই নাকি আশি-নব্বই পাওয়া যায়। সেখানে পঁচাত্তর! আমি ভাবতেই পারছি না। আমার প্রেসার বেড়ে যাবে এবার।’ একটু থেমে বলল, ‘তারপর কার বুদ্ধিতে কে জানে এইসব আর্ট আর থিয়েটারের কথা বলেছে। হাতের কাছে পেলে একদম মেরে ঠান্ডা করে দিতাম।’
পুনু মুখ তুলে বলল, ‘কেউ বলেনি বাবা। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব না, এটা ঠিক।’
কিছুটা বোঝানোর দিক খুঁজে পায় শেখর, ‘ওরে, ওটা পড়লে চাকরি আছে। অন্য কিছু পড়লে তোকে সেই বিষয়ে আরও আরও ভাল হতে হবে। শেষকথা হতে হবে। নাহলে খেতে পাবি না।’
পুনু বলে, ‘সবাই তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। তাই আমি পড়ব না।’
***
কয়েক বছর কেটে গেছে। পুনু আর্টস নিয়ে পড়েছে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েনি। ইতিহাস নিয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে এখন সে পোস্ট-গ্রাজুয়েট করছে। রীতিমত ভালবেসে পড়ছে। এরপর সে পিএইচ.ডি করবে ইচ্ছে আছে।
সুনুর স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশনে পৌঁছাতে খানিক দেরি হয়ে গেল। যখন পৌঁছল তখন রাস্তায় গাড়ি রাখা মুশকিল। প্রচুর হোমগার্ড আর পুলিশের ছড়াছড়ি। শিক্ষামন্ত্রী এসেছেন। হল ভর্তি। কোনওরকমে সামনের দিকে তিনটে সিটে তিনটে পঙ্ক্তি বাদ দিয়ে শেখর সুরমা আর পুনু বসল। সুনু আজ নাটক করবে ওর অন্য বন্ধুদের সঙ্গে। মন্ত্রীর বক্তৃতা চলছে। স্টেজে সুনুর স্পেশাল স্কুলের হেডমাস্টার, এলাকার বিডিও, আর প্রেসিডেন্ট। স্কুলখানি এই এলাকার একমাত্র পিছিয়ে থাকা বাচ্চাদের স্কুল। খুব সুন্দর রঙিন কাপড়ে প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে। স্কুলের হলঘরে অনুষ্ঠান হচ্ছে। কিছু সরকারি সাহায্য আর কিছু এলাকার মানুষের সাহায্যে চলে। অনেক মাস্টার আছেন, যারা অন্য কাজ করেও এখানে পড়ান। কিছু ব্যবসায়ী আছেন সাহায্য করেন।
মন্ত্রীমশাই শুরু করেন, ‘আমি এই স্কুলের সাথে প্রথম থেকেই জড়িত। কারণ আমার এক স্কুলের বন্ধু। এই স্কুল দশ বছর হল। বন্ধুর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। বন্ধুটির এক ভাই ছিল এই অসাধারণ ছেলেদের একজন। তখন কোনও এরকম স্কুল ছিল না। বাড়িতে সে চেষ্টা করত তার ভাইকে পড়াতে। অনেক কিছু শিখিয়েও ছিল। কিন্তু সাধারণ স্কুল তাকে নেয়নি। সবাই বলেছিল ওদের জন্য আলাদা স্কুল হয়, সেখানে যাও। শহরে তেমন স্কুল ছিল না। কিন্তু চার বছরের ছোট ভাই বেশিদিন বাঁচেনি। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে মারা যায়। বন্ধুটি পড়াশুনায় খুবই ভাল ছিল। পড়াশুনা শেষে ও কিছুদিন নামকরা একটি স্কুলে পড়িয়ে বাড়িতে একটা কোচিং ক্লাস শুরু করে। কোচিং ক্লাসটা এখন মহীরুহ হয়ে উঠেছে। কোচিং থেকে যা রোজগার হয়, তাই দিয়েই ও এই স্কুলটি চালু করে। প্রথম প্রথম একজন-দুজন আসত। তেমন বিশ্বাস করেনি কেউ। আস্তে আস্তে ছাত্রসংখ্যা বাড়তে থাকে। বিয়ে করেনি। একা মানুষ, এখন রোজগার প্রচুর, কিন্তু খুব সাধারণভাবে জীবনযাপন করে। টাকা বাঁচায় এই স্কুলের জন্যে। কোচিংয়ে পড়ায় আর এই স্কুলের সমস্ত অফিসিয়াল কাজ দেখে। তাই এখানকার ছাত্ররা ওকে চেনে না। কোচিং থেকে যা রোজগার, সবই এই স্কুলের জন্যে। ওর সঙ্গে কিছু অনুসরণকারী আছে, তারা কোচিংয়ে পড়ায়, এখানেও পড়ায়। সে এত প্রচারবিমুখ যে এই স্কুলে ওকে কেউ চেনে না। আমি তাকেই ডাকছি স্টেজে।’
কিছুক্ষণ কোনও সাড়াশব্দ নেই। এবার স্টেজের সামনে এগিয়ে এসে মন্ত্রীমশাই হাত দিয়ে চোখ ঢাকা দিয়ে সামনের সারির কাউকে ডাকেন। উনি উঠে দাঁড়ান কিন্তু সবার দিকে পিছন ফিরেই মন্ত্রীমশাইকে হাত নেড়ে মানা করেন। মন্ত্রীমশাই শোনেন না। কেউ দুজন এসে ওকে ধরে নিয়ে স্টেজে তুলে দেয়। মন্ত্রীমশাই দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরেন বন্ধুকে। তারপর সামনে নিয়ে আসেন। এই হচ্ছে আমার বন্ধু।
এ কী? প্রথমে পুনু চমকে ওঠে। তারপর শেখর আর সুরমার চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য! স্টেজে দাঁড়িয়ে উনি তো সেই চামার অনল স্যার। কাকে স্টেজে তুলেছে এরা? এরা কি জানে ওর অন্য রূপ? একমুখ দাড়ি নিয়ে লাজুক মুখে মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। শেখর-সুরমার মনের ভিতরে উথালপাথাল হতে থাকে।
মন্ত্রীমশাই বলে চলেছেন, ‘এই নিজের ঢাক নিজে পেটানোর দিনে শুনে রাখুন এই স্কুলের এখনও গভর্নমেন্ট ছাড়া যা সাহায্য আসে তার মধ্যে ওনার ভাগটাই সবচেয়ে বেশি।’ উনি একটু থামলেন, ‘অবিশ্বাস্য লাগছে? পাগল মনে হচ্ছে? হ্যাঁ কিছুটা পাগল তো বটেই।’ একটু হেসে বললেন, ‘কোচিংয়ে উনি কঠিন মানুষ, টাকার পিশাচ, এইটাই সবাই জানে। বন্ধু বলে বলছি না, আমি এমন শিক্ষকের দেখা আর ইদানীং পাইনি। একটা আন্ডার-ডেভেলপড ছেলেদের জন্যে স্কুল তৈরি করা আর তার জন্যে জীবন দিয়ে রক্ষা করার জন্যে করে যাওয়া, ভাবা যায় না।’ একটা মালা মন্ত্রী ওর গলায় পরিয়ে দিলেন। হল ফেটে পড়ল হাততালিতে। উনি কোনও কথাই বললেন না। সামনে হলের মানুষদের নমস্কার করে আস্তে আস্তে স্টেজ ছেড়ে নেমে গেলেন। শেখরের মনে হল ওনাকে চিনতে সত্যিই ভুল হয়েছে। এরকম মানুষও হয়?
কিছু বাচ্চাদের দিয়ে অনুষ্ঠান হল। প্রেসিডেন্ট অনেক কিছু স্কুল সম্বন্ধে বললেন। নাচ গান নাটকে তিন ঘণ্টা নিমেষে পেরিয়ে গেল। অনুষ্ঠান শেষে সবাই হল ধীরে ধীরে ছেড়ে গেল হলঘর। শেখর দেখল উনি সেই সামনের সিটে বসে আছেন। সব গোছানোর তদারকি করছেন। কয়েকটি যুবক ওর কথামত সব খুলছে। বাচ্চাদের বাসে তুলে দিচ্ছে।
সুরমা বলল, ‘চলো, ওনার সাথে একটু দেখা করি।’ দুজনে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অনল স্যার উঠে দাঁড়িয়ে বিনম্রভাবে বললেন, ‘কিছু বলবেন? আপনাদের ছেলেমেয়ে কি এখানে পড়ে?’
সুরমার গলা আবেগে কেঁপে গেল। বলল, ‘মাস্টারমশাই আপনাকে আমরা চিনতে পারিনি। আপনাকে ভুল ভেবেছিলাম।’
উনি কিছুটা অবাক হয়ে চারিদিক তাকিয়ে বললেন, ‘কেন? আমি কি কিছু…।’
শেখর বলল, ‘আমার বড়ছেলে এখানে পড়ে।’
উনি আশ্বস্ত হলেন, ‘পেয়েছেন ছেলেকে? হয়তো গ্রিনরুমে আছে।’
সুরমা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। বলে, ‘আপনার মনে নেই। আমার আর-একটি ছেলে আছে, সে স্বাভাবিক ছেলে। তাকে নিয়ে আপনার কোচিংয়ে গেছিলাম। তখন আপনার রুক্ষ ব্যবহার আমাদের খুব আঘাত করেছিল। আমরা আপনার এদিকটা জানতাম না। আপনি সামান্য কিছু টাকা কম দিতে পারার জন্যে একজনকে নিলেন না দেখলাম।’
একমাথা চুল সরিয়ে হেসে বললেন, ‘বুঝলেন না, এটা আমার সেবার জায়গা আর ওটা রোজগারের জায়গা। ওখান থেকে রোজগার কমলে যে এখানে মুশকিল। ওটা টাকা যোগাড় করার উপায়।’
শেখর বলল, ‘আমার ছেলেকে আপনি নেননি। বলেছিলেন, আর্টস পড়লে ওর ভাল হবে। এই যে ছেলে। ও এখন হিস্ট্রি নিয়ে মাস্টার্স করছে।’
পুনু এগিয়ে এসে প্রণাম করল। উনি পুনুর দুই কাঁধে দুটো হাত রেখে বললেন, ‘কেমন লাগছে ইতিহাস?’
পুনু লজ্জিত হয়ে হেসে বলল, ‘ভাল।’
শেখরের দিকে চেয়ে বললেন, ‘শুধু ওপরে উঠতে শেখাবেন না। জীবনে কিন্তু বহুবার স্বপ্নভঙ্গের ব্যথা বইতে হবে। হারতে দিন। হারতে এবং হেরে গিয়ে নিজেকে উঠে দাঁড়াতেও শেখান। না পারলে তখন হাত বাড়ান। এতে ওর ভাল হবে।’
সুরমা বলল, ‘ওকে কী উপদেশ দেবেন?’
সুরমাকেই বললেন, ‘ওই সবার মত ইঞ্জিনিয়ারিং করে আইটি কোম্পানিতে গেলে নিজের কিছু সখ আহ্লাদ মিটবে কিন্তু কয়জন আপনার নাম করবে? কয়জন চিনবে আপনাকে? শুধুই নেবেন, দেবেন না কিছু? কিছু এমন করুন, যাতে চারটে লোক আপনার সুখ্যাতি করে। শেষে কাজটাই পড়ে থাকে। টাকাপয়সা সোনাদানা কিছুই থাকে না। ইতিহাস দেখুন সেখানেও তাই।’ পুনুকে বললেন, ‘‘তুমি ইতিহাস পড়ছ, এটাও খেয়াল করো। স্বামীজির কথাই বলব, ‘এসেছ যখন একটা দাগ রেখে যাও।’’
শেখর বলল, ‘আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না তো?’
‘না, একদমই না। সব জিনিসপত্র না নিয়ে যাওয়া অবধি আমি এখানে আছি। আমিই শেষ যে এখন থেকে বেরোব। ভালই তো লাগছে।’
শেখর বলল, ‘আপনি আর্টস নিয়ে পড়তে বলেছেন। ও হিস্ট্রি নিয়ে পড়েছে। ভালবেসেই পড়ছে। গ্র্যাজুয়েশনে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে।
হঠাৎ পাশে ঘুরে কাউকে বললেন, ‘চেয়ারগুলো ওই ঘরে আর টেবিল এই পাশের ঘরে যাবে।’ তারপর বললেন, ‘ভালবাসাটাই আসল। সব সাবজেক্টই ভাল। তার ভিতরে ঢুকে যেতে হবে। যেন কাজে লাগে। পড়তে পারো, আরও রিসার্চ করতে পারো।’
শেখর বলল, ‘প্রথমে ওর আর্টস পড়া নিয়ে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন প্রায় ভেঙে পড়েছিল। ভাবল ইতিহাস মানে ও একটু নীচের ধাপের ছেলে।’
বললেন, ‘দেখবেন, ওকে শুধু ওপরে যাবার পথ দেখালেই চলবে না।’ পুনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জীবনে অনেক মানুষ আসবে যাবে। যাই পড়ো বাবু, সেটা কাজে লাগিয়ো। মানুষের যেন উপকারে লাগে।’
সুরমা বলল, ‘আমরা ওকে ওর যা ভাল লাগে তাই পড়তে বলেছি।’
অনল স্যার বললেন, ‘এই খারাপ আমিকে সামনে রেখে পিছনে ভাল আমিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছি। কেউ বলে নামের জন্যে, কিন্তু…’ একটু উদাস হয়ে বললেন, ‘এমন স্কুল তো আর নেই আমাদের এখানে।’
বলতে বলতে হাঁটতে গিয়ে সামনের চেয়ারে ধাক্কা খেয়ে অনল স্যার হঠাৎ চেয়ার নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেলেন মাটিতে। ‘আরে, আরে, স্যার’, বলতে বলতে ওকে ধরা গেল না। মুখথুবড়ে পড়লেন। শশব্যস্ত হয়ে শেখর এগিয়ে গেল। ব্যথায় মুখটা কুঁচকে গেছে। বেকায়দায় লেগেছে। কিন্তু শেখর বা পুনুর হাত ধরলেন না। শেখর, পুনু, সুরমা একটু অপ্রস্তুত হল। লোকটা পড়ে আছেন কিন্তু কারও সাহায্য নেবেন না। কঠিন স্বরে বললেন সবাইকে সরে দাঁড়াতে। মুখ কুঁচকালেন, বললেন, ‘আমি পারব, পারতেই হবে।’ অনেক কষ্ট করে শেষ অবধি বাঁকাটেরা হয়ে চেয়ারের পায়া ধরে উঠে দাঁড়ালেন। উঠে কিছুক্ষণ মুখ কুঁচকে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘আসলে এটা তো কৃত্রিম পা, তাই একবার পড়ে গেলে ওঠা বেশ কষ্টের। ওটা আমি নিজেই করি। কারুর হাত ধরি না পাছে দুর্বল হয়ে যাই নিজের কাছে।’ হাসি হাসি মুখ করে আঙুল নাড়িয়ে বললেন, ‘ওটি হতে দেওয়া যাবে না।’ উঠে পা-টা ঠিকমত লাগিয়ে দেখে নিয়ে সোজা উঠে দাঁড়ালেন। এমন সময় হলের গেটে দাঁড়িয়ে একজন খবর দিল চেয়ার তোলা, বাইরের লাইট খোলা শেষ হয়েছে। উনি একমুখ হাসি দিয়ে বললেন, ‘এবার আমি যাব। অনেক কাজ বাকি। পরে একদিন কথা হবে।’ হাসিটা দেখে কে বলবে কয়েক সেকেন্ড আগেই মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছিলেন।
উনি চলে গেলেন। যাবার সময় একটু খুঁড়িয়ে পা-টা টেনে হাঁটছিলেন। পিছনে পড়ে রইল তিনজনের মুগ্ধ চাহনি।
শেখর পুনুর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কী বুঝলি?’
পুনু জোর দিয়ে বলল, ‘আমি পাশ করে ওনার সঙ্গে থেকেই কাজ করতে চাই। এমন দাগই রেখে যেতে হবে।’
শেখর পুনুর কাঁধে চাপ দিয়ে বলল, ‘দেখ, দাদার হল কিনা। আমরাও যাব।’
সুরমা বলল আনমনে, ‘এমন জীবন পড়েছি, চোখে এই দেখলাম।’