সিঁদুর, আলতা, ধূপকাঠি, গোটা ফল, ভোগের মিষ্টি। কখনও তার সঙ্গে শাড়িও। এ দিয়েই সাজানো হয় বাঙ্গিটোলার ঐতিহ্যবাহী মুক্তকেশী কালীর ভোগের ডালা। এসব চোখে দেখা যায়। আর যেটা দেখা যায় না, তা হল শতাব্দীপ্রাচীন অটল বিশ্বাস ও সংস্কার, মায়ের প্রতি সন্তানের অগাধ আস্থা ও নির্ভরতা। যে নির্ভরতা রোগতাপ অশান্তি থেকে মুক্তির প্রার্থনা করে; সুখসমৃদ্ধির কামনা করে; ভাঙন, অনাবৃষ্টি আর নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় পেরিয়ে যাওয়ার সাহস যোগায়। হিন্দুর পাশাপাশি সংলগ্ন গ্রামের মুসলিম পরিবারের অনেকেও পুজোয় চাঁদার পাশাপাশি এই ডালা দেন— আর তা গৃহীতও হয়।
আচার্য শ্যামানন্দ ঠাকুর প্রণীত শ্রীশ্রীকালীপূজাপদ্ধতি-তে ডালা সাজানোর নয় রকম পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর থেকে আরম্ভ করে তমলুকের সিদ্ধপীঠ দেবী বর্গভীমার মন্দিরেও ডালা সাজানোর পদ্ধতি মোটামুটিভাবে এক, শুধু স্থানীয় বৈশিষ্ট্য একে আলাদা করে দেয়।
মালদার গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মৈথিল জনজাতি বিষয়ক গবেষক সৌমেন্দু বাবাই রায় তাঁর একটি যৌথ গবেষণাপত্রে দেখিয়েছিলেন, ১৮১৩ সালে রয়্যাল সোসাইটি অফ লন্ডন থেকে প্রকাশিত ব্রিটিশ সার্ভেয়ার জেনারেল স্যার ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটনের গবেষণাপত্রে পরোক্ষভাবে মা মুক্তকেশী দেবীর প্রাচীনত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বুকানন হ্যামিলটন ছিলেন জীববিজ্ঞানী এবং তিনি ১৮০৭ পর্যন্ত রাজশাহী ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
তিনি নিম্নগতির গঙ্গার পূর্ব কূল বরাবর ইলিশ মাছের প্রজনন নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাঁকে সার্ভের কাজে সাহায্য করছিলেন বর্তমানে পঞ্চানন্দপুর সংলগ্ন এলাকার মৎস্যজীবীদের একটা বড় অংশ। তাদের কাছ থেকেই হ্যামিলটন প্রথম শোনেন এই অঞ্চলের এক প্রাচীন শক্তিদেবীর অস্তিত্ব। সেই দেবীর কৃপায় নাকি প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে যেমন রক্ষা পাওয়া যায়, তেমনই এই দেবীকে ভয় ও ভক্তি করেন সকল গ্রামবাসী। হ্যামিলটন সাহেব তাঁর রিপোর্টের সংযোজন অংশে সসম্ভ্রমে উল্লেখ করেছিলেন এক ‘মাইটি ডিইটি’ (“Mighty Deity”)-র কথা। বলেছিলেন— তিনি এই অঞ্চলের জনজীবনের নিয়ন্ত্রক। এই দেবী আর কেউ নন, মা মুক্তকেশী। আরও নানা পার্শ্বীয় প্রমাণ, এমনকি মুঘল আমলের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার সংরক্ষিত নথি থেকে জোতকস্তুরী নামের প্রাচীনত্ব আবিষ্কার করে গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছিলেন দেবীর থানের বয়স আড়াইশো থেকে পৌনে তিনশো বছর।
স্থানীয়রা বলেন, অনেক কাল ধরে ডালা সাজানোর এই প্রথা চলে আসছে। এর সঙ্গে লোকবিশ্বাসের নিবিড় যোগ আছে। ইতিহাস বলে, চৈতন্যদেবের প্রভাব অধ্যুষিত গৌড়বঙ্গে শাক্ত সাধনার যে ধারা ধরে রেখেছিলেন মৈথিল ব্রাহ্মণদের একটা অংশ, পাল-সেন যুগের চণ্ডী থেকে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের পরবর্তী পর্যায়ে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের কালী পর্যন্ত যার বিবর্তনের সূত্ররেখা ছড়িয়ে রয়েছে, তার নিরিখে শক্তিদেবী মা মুক্তকেশী এই অবস্থানবিন্দুর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই মতকে সমর্থন করেছিলেন মালদার প্রামাণ্য ইতিহাসবিদ প্রয়াত ড. তুষার কান্তি ঘোষ।
বিশ্বাস কোন স্তর পেরিয়ে লোকবিশ্বাস হয়ে ওঠে, লোকবিশ্বাস হয়ে ওঠে একটি জনপদের প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার আর্তি— তার খোঁজ জানেন সমাজতাত্ত্বিকরা। যেমন গঙ্গার তীরবর্তী ভাঙন অধ্যুষিত এই গ্রামে দেবীর কাছে অনেকেরই প্রার্থনা থাকে: ভাঙনের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে যেন তিনি গ্রামকে রক্ষা করেন। ২০২০-২১ সালের ভাঙন কবলিত এই বাঙ্গিটোলা-জোতকস্তুরী অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিমের পাশাপাশি বসে অন্নকূট গ্রহণের মধ্যেও এই লোকবিশ্বাসের প্রতি সমর্থনই ঝরে পড়ে। বিপর্যয় মানুষকে একত্রিত করে, আর নিবিড় লোকবিশ্বাস হিন্দু-মুসলিম ভেদ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়।
বাঙ্গিটোলা গ্রামের বাসিন্দা চৈতালী ঝা ব্যাখ্যা করে বলেন: ফুল, ধুপ, আলতা, সিঁদুর ছাড়াও ডালায় গোটা ফল দেওয়াটাই রীতি। মিষ্টির মধ্যে প্যাঁড়া বা বাঙ্গিটোলার মণ্ডার প্রাধান্যই বেশি। আগেই পুজোর ডালা দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটা একটু এলোমেলো ছিল। করোনা পরবর্তী সময় থেকে মন্দিরে গ্রামের নামে আলাদা তাক করে দেওয়ায় সমস্যা অনেক কমেছে। করোনার সময়টুকু ছাড়া দুশো-তিনশো বা তারও বেশি ডালা এখানে জমা পড়ে। এবছর সংখ্যাটা ৫০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে। মায়ের আশীর্বাদ নিতে পাশের গ্রাম ছাড়াও দূরদূরান্তের মানুষ ডালা পাঠায়।
স্থানীয় শিক্ষক মলয় কুমার ঝা জোর দিয়ে বলেন— গোটা পাঁচ ফলের মধ্যে একছড়া পাকা কলা ও নারকেল বাধ্যতামূলক। আর বাঙ্গিটোলার ছানার মণ্ডা তো থাকবেই। আশপাশের গ্রামের মুসলিম পরিবারের অনেকেই কারও না কারও হাতে দানের টাকা বা ভোগ পাঠিয়ে দেন। পায়রা বলি এবং পাঁঠা মানত করার ব্যাপারটাও আছে। আমার পূর্বপুরুষদের সময় থেকে এই সম্প্রীতির ছবিটা দেখে আসছি।
মিষ্টি বিষয়ক গবেষকরা পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছিলেন: বাঙ্গিটোলার মুক্তকেশী পূজায় শতকরা ৯০টা ডালায় বাঙ্গিটোলা ছানার মণ্ডার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। যে মিষ্টি একমাত্র এই গ্রামেই তৈরি হয়। প্রায় শতবর্ষ আগে ইন্দুভূষণ ঝা-র হাত দিয়ে শুরু হয়ে সম্প্রতি ষষ্ঠীচরণ সাহার হাতে যে ঐতিহ্য কোনওমতে টিকে আছে। ছানা, চিনি আর এলাচ গুঁড়োর সঙ্গে মিশে থাকে সেই অদৃশ্য দুটি উপকরণ— বিশ্বাস আর ভক্তি।
নদী বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, কালিয়াচক-২-এর অন্তর্গত বাঙ্গিটোলা এবং জোতকস্তুরী অঞ্চলদুটি ভাঙনপ্রবণ। বাঁধ উঁচু করার কাজ হলেও আসল বিপর্যয়ের সামনে তার পরীক্ষা এখনও বাকি। লোকবিশ্বাসের পাথুরে দেওয়ালে একফোঁটা আঁচড় পড়ে না।
২০১৯ সালে তরুণ পরিচালক অচল মিশ্র মৈথিলী ভাষার সিনেমা ‘গামক ঘর’ (গ্রামের বাড়ি)-এর জন্য জাতীয় পুরস্কার পান। সিনেমার টাইটেল কার্ডে বিহারের দ্বারভাঙ্গার ক্ষয়িষ্ণু মৈথিল গ্রামের পাশাপাশি সারা উত্তর-পূর্ব ভারতব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মৈথিল গ্রামের সেই পরিবারগুলি, যারা খরা, বন্যা, নদীভাঙনে বারবার ঘর হারিয়েছে তাদেরও এক অদ্ভুত মায়ায় ঢেকে দিয়েছিলেন তিনি। সারি সারি বন্ধ দরজার বাড়িতে বোঝাই এককালের সমৃদ্ধ মৈথিল গ্রাম বাঙ্গিটোলা আর জোতকস্তুরীর মানুষের দমবন্ধ করা প্রার্থনা নীরবে শুনে যান উপাস্য গ্রামদেবী মা মুক্তকেশী। মানুষ মুক্তি চায়। ভাঙন থেকে— ভাঙনের স্মৃতি থেকেও। আর এই স্মৃতিযাত্রায় সময় ছুটি দিয়ে দেয় অসময়কে। অপেক্ষা শুরু হয় অন্য এক সময়ের।
লেখাটি তে খুব সুন্দর ভাবে সঠিক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
Excellent article
তথ্যবহুল লেখা।কিন্তু উত্তরপাড়ার মা মুক্তকেশী,যিনি দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর বোন হিসাবে খ্যাত,তাঁর সঙ্গে কি মালদার মা মুক্তকেশীর কোন সংযোগ রয়েছে?জানার আগ্রহ রইলো।
খুব প্রাসঙ্গিক লেখা … আসলে লৌকিক ধারণায় অনেক সময় ব্যক্তিগত স্মৃতি নির্ভর তথ্য সূত্রে ইতিহাস সম্মত সময় সারণির সমস্যা তৈরী হয়, যেটা মুক্তকেশী কালী -র ক্ষেত্রেও সত্য। ঋষি এই বিষয়ে যেভাবে বস্তুগত তথ্যসূত্র উল্লেখ করে এই পুজোর সময়কাল নির্ধারণ করেছে তাকে যথেষ্ট সঠিক বলেই মেনে নেওয়া যায় ….
গুরুত্বপূর্ণ। সমৃদ্ধ হলাম।