Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

অথ পেঁয়াজচাষ কথা

চতুর্থ কিস্তি

আমরা কখনও পেঁয়াজ, কখনও আবার মৌমাছি, অম্বিকাপুর, শাহেদা আর মধুতে পর্যটলশীল এখন। পেঁয়াজের কুষ্টিঠিকুজি দেখি একটু।

পেঁয়াজের বৈজ্ঞানিক নাম এলিয়াম সেপা (Allium cepa)। এই বর্গে আরও যেসব উদ্ভিদ পড়ে তার মধ‍্যে রসুন আমাদের কাছে অতি পরিচিত। হিন্দু বিধবাদের মধ‍্যে, এমনকি বহু হিন্দুদের মধ‍্যেও পেঁয়াজভক্ষণ নিষিদ্ধ (পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে বিহার-উত্তরপ্রদেশের হিন্দুদের আবার পেঁয়াজ খেতে বাধা নেই)। অথচ কেন জানা নেই, বাঙালি বিধবার কাছে রসুনের স্বাদগ্রহণ বৈধ। এর ভেষজগুণের জন‍্যই কি? তা পেঁয়াজের ভেষজগুণ কি কিছুমাত্র কম? বিধানদাতাকে পেলে জিগ‍্যেস করা যেত।

কেন পেঁয়াজ আনাজ বা তরকারি নয়? একে নিপাট ‘মশলা’ বলার পিছনে যুক্তি কী? মশলা যেমন রান্না বা ব‍্যঞ্জনের স্বাদ বাড়ায়, তেমনই পেঁয়াজ। যুক্তিটি কতদূর গ্রাহ্য তা পণ্ডিতরাই বলতে পারবেন। আমরা দোটানায়। তবে পণ্ডিতরা যে বলেছেন, রান্না করা পেঁয়াজের চেয়ে কাঁচা পেঁয়াজ অধিক উপকারী, সেটা মানতে আমাদের দ্বিমত থাকার কথা নয়। যদিও রান্নাতেও আমাদের পেঁয়াজ অতি অবশ‍্যই চাই। পেঁয়াজ ছাড়া মাংস, কল্পনা করা যায়? অবিশ‍্যি কল্পনা নয়, বাস্তবেও পেঁয়াজ-সংযোগ ছাড়া মাংস রান্না হয়। হিন্দুরা যখন পুজোয় পাঁঠা বলি দেয়, তা রাঁধতে হয় পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া-ই। জিরেবাটা-তেজপাতা-লঙ্কা-গরমমশলা সংযোগে রান্নাটা উৎরে যায়-ও কিন্তু। সঙ্গে ভক্তিভাবটাকে যদি যুক্ত করে নেওয়া যায়, তাহলে তো কথা-ই নেই। তবে অবশ‍্যই বিবেকবাবাজির মতো প্রশ্নটিকে ভুলে থাকতে হবে, ‘এতো রক্ত কেন!’

আমরা যারা শহরে থাকি, তাদের কাছে ভাত ডাল তরকারির সঙ্গে যোগ কেবল কেনা আর আহারের। ভাত শব্দটি আমাদের কাছে আজীবন একটি নির্দিষ্ট ও অনড় অর্থ নিয়ে আসে। ভাত নিয়ে আমরা বর্ণালীর বিচ্ছুরণে মাতি না। কিন্তু একজন কৃষিজীবীর কাছে ভাত বিচিত্র অনুভূতির ক্রমপ্রসারিত সমাহার। ট্রাক্টর দিয়ে চাষের জন‍্য মাটি প্রস্তুত করা, বীজধান রোপণ, তা বেড়ে উঠলে তাকে অন‍্য জমিতে হাত দিয়ে লাগানো (নিপুণ শিল্পীর মতো দ্রুত ও সমদূরত্বে, তবে এখন তা যন্ত্রের সাহায্যে করা হয়), সার দেওয়া, জলসেচ দেওয়া, পেস্টিসাইড দেওয়া (এতে নিজের শরীরেও বিষাক্ততা ছড়ায়), মাঝেমাঝে আগাছা পরিষ্কার, ধান পাকলে ধান কাটা, গাছ থেকে ধানকে আলাদা করা (ধান ঝাড়া), তাকে সেদ্ধ করা, শুকোনো, মিলে নিয়ে গিয়ে ধান ভেনে চাল আনা,— এই এতগুলো পর্যায় ধারাবাহিকভাবে কৃষকের কাছে ভেসে আসে। রোদঝড়জলে ভেজা আছে, পোকামাকড়ের আক্রমণ আছে, সাপ ও ইঁদুরের কামড়, আরও কত বিঘ্ন!

পেঁয়াজের চাষেও কমবেশি অনুরূপ স্তর-স্তরান্তর পেরোতে হয়।

এবং আশ্চর্য লাগে, এই সব বাধা, বাধা ছাড়া আর কী কোমল শব্দে প্রকাশ করি একে, অতিক্রম করে সাফল‍্যের মুকুট মাথায় পরেন শাহেদার মতো মেয়েরা! যাতে করে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক তাঁকে লিখতে প্রাণিত হন, ‘অদ‍্য (তারিখ নেই) সাহিদা বেগমের পিয়াজচাষের ক্ষেত পরিদর্শন করি। পরিদর্শনকালে উপপরিচালক, ডি এই সহ কৃষিবিভাগের অন‍্যান‍্য কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। পিয়াজ ক্ষেতে ফুল এসেছে। শ্রমিকগণ ফুলে হস্ত পরাগায়ন করাচ্ছে। পূর্বে মৌমাছি হস্ত পরাগায়নের কাজটি করতো। গত কয়েক বছর যাবত ক্ষেতে মৌমাছি আসছে না। ফলে চাষীর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সাহিদা বেগম একজন সফল পিয়াজচাষী এবং অনুকরণীয় নারী উদ‍্যোক্তা। তার উৎপাদিত পেয়াজ বীজের মান অত‍্যন্ত ভাল এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে এ পিয়াজবীজ পিয়াজচাষীরা ব‍্যবহার করেন। তাঁর প্রচেষ্টা দেশের নতুন সকল নারী / পুরুষ উদ‍্যোক্তাগণ অনুসরণ করতে পারে। সাহিদা বেগমের জন‍্য নিরন্তর সফলতা কামনা করি। মহান আল্লাহ্ তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে সুস্থ রাখুন।’ এক-সঙ্গে যোগ করতে চাই ফরিদপুর সদর-এর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আনোয়ার হোসেনের প্রশংসাবাক‍্যটি, ‘তার উৎপাদিত পেয়াজবীজ গুণে ও মানে অন‍্য সকল বীজ হতে ভালো। …বাংলাদেশের পেয়াজ উৎপাদন বৃদ্ধির জন‍্য তার ভূমিকা অনেক।’

পেঁয়াজের চারা রোপা শুরু হয় বসন্ত। ফলন ওঠে শরতে। দোআঁশ মাটি পেঁয়াজ চাষের সবচাইতে উপযোগী। পলিমাটির স্থান তার পরে।

পেঁয়াজের বাজার সবসময় অস্থিতিশীল। যেমন আদা, রসুন, কাঁচালঙ্কা বা লেবুর। কখনও কখনও বেগুন, ডিম বা চিনির। তব এসবের মধ‍্যে অতিরিক্ত মাত্রা ছাড়ায় কিন্তু নিঃসন্দেহে পেঁয়াজ। দুহাজার কুড়িতে বাংলাদেশে রাতারাতি বিশ-পঁচিশ-তিরিশ থেকে এর দাম উঠে গেল তরতর করে পঞ্চাশ-একশো-দেড়শো ও অবশেষে দুশোতে! পেঁয়াজের স্বাদ মুলোয় মেটাতে হয়েছে তখন বাংলাদেশের মানুষকে। দেশবিদেশ থেকে রাতারাতি পেঁয়াজ আমদানি করে অবস্থা সামাল দিতে হয়েছিল। সেবার-ই দেখা গেল তুরস্কের পেঁয়াজ বাংলাদেশে। পেল্লায় সাইজ, সাত-আটশো গ্রাম এক একটা পেঁয়াজের।

সেবার পেঁয়াজ-মন্বন্তরের কারণ ছিল। ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে গেছিল। ২০১৯-এ মহারাষ্ট্রে বন‍্যা হয়ে পেঁয়াজ-দুর্ভিক্ষে পড়ে ভারত। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে কলকাতায় পেঁয়াজের দর সেবার দেড়শো টাকা ছোঁয়। বর্ধমানে বিয়েতে নবদম্পতিকে বন্ধুরা মিলে উপহার দিয়েছিল তিরিশ কেজি পেঁয়াজ! আরও তাজ্জব কি বাত, মেদিনীপুর জেলার সুতাহাটায় এক দোকান থেকে চুরি যায় দশ বস্তা পেঁয়াজ। একনিষ্ঠ পেঁয়াজচোরেরা সুযোগ পেয়েও দোকানদারের ক‍্যাশে পর্যন্ত হাত দেয়নি! মধ‍্যপ্রদেশের কৃষকরা পেঁয়াজের খেত পাহারা দিত চোর ঠেকাতে। সেবার ভারত সরকার NAFED (National Agricultural Co-operative Marketing Federation of lndia)-র মাধ‍্যমে ওই তুরস্ক থেকেই তুরন্ত পেঁয়াজ এনে অবস্থার সামাল দেয়।

>>> ক্রমশ >>>
চিত্র: গুগল

পড়ুন, প্রথম কিস্তি…

অম্বিকাপুর: শাহেদার দিগ্বিজয়

পড়ুন, দ্বিতীয় কিস্তি…

শাহেদার খেতের পথে

পড়ুন, তৃতীয় কিস্তি…

শাহেদা বেগম: পেঁয়াজ সমাচার

পড়ুন, পঞ্চম কিস্তি…

শাহেদা বেগম: বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার আলোয়

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »