তৃতীয় কিস্তি
‘… শাহেদা আপার বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শন করিলাম। বীজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি একটি অনন্যসাধারণ প্রযুক্তি। নদীর (কুমার) পাড়ে বিশাল স্থানে বীজ শুকানো, মাড়াই ও বাছাই করা হয়। একটি বিশাল কর্মযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে রইলাম। কর্মচারীদের সঙ্গে শাহেদা আপার খুবই সুসম্পর্ক। তার এ কর্মযজ্ঞ অদম্য। পেঁয়াজবীজ উৎপাদনে তার অবদান অনস্বীকার্য। জাতীয় অর্থনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আমি তার সমৃদ্ধি ও সাফল্য কামনা করছি।’ লিখেছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক, ফরিদপুরের মনোজিত কুমার মল্লিক। তার প্রতি প্রশংসার বাণ ডেকেছে কত! উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়ে স্বধর্মচ্যুত হননি তিনি কদাপি, অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন।
সরকারের তরফ থেকে দফায় দফায় পরিদর্শনে আসেন বহু কর্মকর্তা, আর শাহেদার খামার দেখে উদার মন্তব্য করেন। আজ ০১/ ০৪/ ২০২৩ শনিবার ছিল তেমন-ই একটি দিন, যেদিন তাঁর খামার পরিদর্শনে এসেছিলেন বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (BARI) ডিরেক্টর জেনারেল ড. দেবাশিস সরকার, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. হারুন-অর-রশীদ, ড. মো. আলাউদ্দিন খান (প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক, মশলা গবেষণাকেন্দ্র বগুড়া), এবং ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার (প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান পরিচালক, মশলা গবেষণা উপকেন্দ্র, ফরিদপুর)। উপলক্ষ্য ছিল একটি আলোচনা অনুষ্ঠান—, ‘মানসম্পন্ন পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে নিয়ন্ত্রিত পর-পরাগায়নের ব্যবস্থাপনা’। আবহমান কাল ধরে পরাগায়নের কাজ মৌমাছিরাই করে আসছিল। কিন্তু ফসলে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার দেওয়ার পর থেকে মৌমাছি আর পরাগায়নে নেই! এজন্য খেতে খেতে মৌমাছির মাধ্যমে মধু সংগ্রহের কাজ-ও ব্যাহত। এই সংকট নিরসনে মানুষের হাত দিয়ে পরাগায়ন হচ্ছে এখন।
মনে পড়ল, মারসেলো মাস্ত্রোয়ানি-অভিনীত একটি ছবি দেখেছিলাম নয়ের দশকে। ছবির নাম ‘The Beekeeper’. ছবির নায়ক খেতে খেতে মধু-সংগ্রাহক। আমার এক বন্ধু কবি রাজকুমার রায়চৌধুরীর পেশাও ছিল এটি। আছে কি এখনও?
মৌমাছির জীবনকাহিনি শুনছিলাম খেতে বসে শাহেদার মুখে। পুরুষ ও স্ত্রী মৌমাছিরা পরাগায়ন ঘটায় না। যত পরিশ্রম শ্রমিক মৌমাছির। তাদের জন্মকাহিনি বড় অদ্ভুত। ওই মৌমাছিদের। এবং বড় রোমান্টিক। একটি নারী-মৌমাছির পিছু ধাওয়া করে হাজার হাজার পুরুষ মৌমাছি, বায়ুপথে। তাদের সমবেত গুঞ্জনধ্বনি সেসময় যদি রবীন্দ্রনাথ শুনতেন, তাহলে তিনি তাকে ‘পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা’ বলতেন না। পুরুষ ও নারী মৌমাছির ক্লান্তিহীন এই অন্তরীক্ষ পরিক্রমায় নারী মৌমাছি একটি পুরুষ মৌমাছির কাছে ধরা দেয়। ওদের মিলন হয় আকাশে ভাসমান অবস্থায়! আর সেই একবারের মিলনে জন্ম নেয় দুই থেকে আড়াই হাজার মৌমাছি, যার অধিকাংশ-ই শ্রমিক মৌমাছি। কেবল দিনগত পাপক্ষয় যাদের ভাগ্যলিখন! মানুষের জীবনেও অধিকাংশের-ও কি প্রকৃতপ্রস্তাবে তা নয়? মধু তৈরির জাঁতাকলে কলুর বলদের মতো জীবন তাদের। সেজন্যই কি শেকসপীয়র মধুর মধ্যে সম্পূর্ণ মধুরতা দেখেননি? জুলিয়েট তাহলে বলবে কেন, ‘The sweetest honey is loathsome in his own deliciousness,/ And in the taste destroys the appetite./ Therefore, love modestly.’ তবু আমরা মধু ও মৌমাছির ইতিবাচকতায় থাকব, ‘মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্’!
মধু নয়, আমাদের আলোচ্য পেঁয়াজ। এবং তার আদি, মধ্য ও অন্ত্য। মিশরীয়দের কাছে এটি অজানা ছিল না। প্লিনির লেখায় পেঁয়াজের অস্তিত্ব আছে। পম্পেই নগরীর ধ্বংসাবশেষ তাঁর চোখের সামনে ঘটে। তখন তিনি জাহাজে। বহুবছর পর উনিশ শতকে (পম্পেইতে বিপর্যয় ঘটেছিল প্রথম শতাব্দীতে) সেই পম্পেইয়ের খননকাজ হলে সেখানেও পেঁয়াজের চাষ হত প্রমাণ মিলল। প্লিনির লেখায় পাই, মুখের ক্ষত চিকিৎসার অব্যর্থ ওষুধ এই পেঁয়াজ, যা এমনকি কুকুরের কামড়ের পর্যন্ত মহৌষধ। চিনে ব্রোঞ্জযুগে অস্তিত্ব ছিল এর। আমেরিকায় নিয়ে যায় ঔপনিবেশিকরা। নতুন নতুন দেশ আবিষ্কারের সময় দেশ-দেশান্তরে পাড়ি দিয়েছে পেঁয়াজ। কবিরাজী চিকিৎসায় যৌনশক্তি ধরে রাখতে এর প্রয়োগ আছে। পেঁয়াজকে পলাণ্ড বলা হয় সংস্কৃতে। এমনকি বাংলা ভাষাতেও শব্দটির প্রয়োগ পাই সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’-তে।
পেঁয়াজের জীবনে বাধা কম নয়। অনিয়ন ফ্রাই রোগে আক্রান্ত হয় সে, অনিয়ন এলওয়ার্মে, আর তাছাড়া আছে ফাঙ্গাস। স্বাদ দুরকম। ঝাঁঝালো আর মিষ্টি মিষ্টি। কখনও কখনও তেতো-ও হয়। সালফার আছে এতে। সেজন্য ঝাঁঝ। যেজন্য চোখে জল আনে। সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ হয় চিনে। তারপর ভারতে। তাছাড়া আফগানিস্তান, তুরস্ক। শীতপ্রধান অঞ্চলে এর আবাদ ভাল হয়। ভারতের নাসিক (মহারাষ্ট্র) পেঁয়াজের স্বর্ণপ্রসূ অঞ্চল। তাছাড়া উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ ও দক্ষিণ ভারতেও হয়।
পেঁয়াজ নিয়ে দেশেবিদেশে নিয়ত গবেষণা হচ্ছে। ১৭৫৩-তে কারোলাক লিনিয়াস (Carl Linnaeus) এর নাম দেন Allium cepa। নামটির মধ্যে নিহিত রয়েছে যে সারসত্য, তা হল পেঁয়াজ আদপে কোনও শস্য না, হলুদ বা জিরে-মেথির মতো একটি মশলা। আজ অম্বিকাপুরে যে ব্যানার টানানো হয়েছিল অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে, সেখানেও উল্লিখিত আছে, ‘বাস্তবায়নে মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র’।
আজ এইটুকু জানিয়েই শেষ করব, পেঁয়াজের পিঠে ও কেক-ও চিন, কোরিয়া, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে জনপ্রিয়।
>>> ক্রমশ >>>
চিত্র: শাহেদা বেগমের সৌজন্যে
পড়ুন, প্রথম কিস্তি…
পড়ুন, দ্বিতীয় কিস্তি…
পড়ুন, চতুর্থ কিস্তি…
পড়ুন, পঞ্চম কিস্তি…