Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

শাহেদা বেগম: পেঁয়াজ সমাচার

তৃতীয় কিস্তি

‘… শাহেদা আপার বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শন করিলাম। বীজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি একটি অনন‍্যসাধারণ প্রযুক্তি। নদীর (কুমার) পাড়ে বিশাল স্থানে বীজ শুকানো, মাড়াই ও বাছাই করা হয়। একটি বিশাল কর্মযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে রইলাম। কর্মচারীদের সঙ্গে শাহেদা আপার খুবই সুসম্পর্ক। তার এ কর্মযজ্ঞ অদম‍্য। পেঁয়াজবীজ উৎপাদনে তার অবদান অনস্বীকার্য। জাতীয় অর্থনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আমি তার সমৃদ্ধি ও সাফল্য কামনা করছি।’ লিখেছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক, ফরিদপুরের মনোজিত কুমার মল্লিক। তার প্রতি প্রশংসার বাণ ডেকেছে কত! উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়ে স্বধর্মচ‍্যুত হননি তিনি কদাপি, অগ্রযাত্রা অব‍্যাহত রেখেছেন।

সরকারের তরফ থেকে দফায় দফায় পরিদর্শনে আসেন বহু কর্মকর্তা, আর শাহেদার খামার দেখে উদার মন্তব‍্য করেন। আজ ০১/ ০৪/ ২০২৩ শনিবার ছিল তেমন-ই একটি দিন, যেদিন তাঁর খামার পরিদর্শনে এসেছিলেন বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (BARI) ডিরেক্টর জেনারেল ড. দেবাশিস সরকার, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. হারুন-অর-রশীদ, ড. মো. আলাউদ্দিন খান (প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক, মশলা গবেষণাকেন্দ্র বগুড়া), এবং ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার (প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান পরিচালক, মশলা গবেষণা উপকেন্দ্র, ফরিদপুর)। উপলক্ষ্য ছিল একটি আলোচনা অনুষ্ঠান—, ‘মানসম্পন্ন পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে নিয়ন্ত্রিত পর-পরাগায়নের ব‍্যবস্থাপনা’। আবহমান কাল ধরে পরাগায়নের কাজ মৌমাছিরাই করে আসছিল। কিন্তু ফসলে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার দেওয়ার পর থেকে মৌমাছি আর পরাগায়নে নেই! এজন‍্য খেতে খেতে মৌমাছির মাধ‍্যমে মধু সংগ্রহের কাজ-ও ব‍্যাহত। এই সংকট নিরসনে মানুষের হাত দিয়ে পরাগায়ন হচ্ছে এখন।

আলোচনা অনুষ্ঠানে শাহেদা বেগম (ডানদিকে) সহ কৃষিকর্তারা।

মনে পড়ল, মারসেলো মাস্ত্রোয়ানি-অভিনীত একটি ছবি দেখেছিলাম নয়ের দশকে। ছবির নাম ‘The Beekeeper’. ছবির নায়ক খেতে খেতে মধু-সংগ্রাহক। আমার এক বন্ধু কবি রাজকুমার রায়চৌধুরীর পেশাও ছিল এটি। আছে কি এখনও?

মৌমাছির জীবনকাহিনি শুনছিলাম খেতে বসে শাহেদার মুখে। পুরুষ ও স্ত্রী মৌমাছিরা পরাগায়ন ঘটায় না। যত পরিশ্রম শ্রমিক মৌমাছির। তাদের জন্মকাহিনি বড় অদ্ভুত। ওই মৌমাছিদের। এবং বড় রোমান্টিক। একটি নারী-মৌমাছির পিছু ধাওয়া করে হাজার হাজার পুরুষ মৌমাছি, বায়ুপথে। তাদের সমবেত গুঞ্জনধ্বনি সেসময় যদি রবীন্দ্রনাথ শুনতেন, তাহলে তিনি তাকে ‘পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা’ বলতেন না। পুরুষ ও নারী মৌমাছির ক্লান্তিহীন এই অন্তরীক্ষ পরিক্রমায় নারী মৌমাছি একটি পুরুষ মৌমাছির কাছে ধরা দেয়। ওদের মিলন হয় আকাশে ভাসমান অবস্থায়! আর সেই একবারের মিলনে জন্ম নেয় দুই থেকে আড়াই হাজার মৌমাছি, যার অধিকাংশ-ই শ্রমিক মৌমাছি। কেবল দিনগত পাপক্ষয় যাদের ভাগ‍্যলিখন! মানুষের জীবনেও অধিকাংশের-ও কি প্রকৃতপ্রস্তাবে তা নয়? মধু তৈরির জাঁতাকলে কলুর বলদের মতো জীবন তাদের। সেজন‍্যই কি শেকসপীয়র মধুর মধ‍্যে সম্পূর্ণ মধুরতা দেখেননি? জুলিয়েট তাহলে বলবে কেন, ‘The sweetest honey is loathsome in his own deliciousness,/ And in the taste destroys the appetite./ Therefore, love modestly.’ তবু আমরা মধু ও মৌমাছির ইতিবাচকতায় থাকব, ‘মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্’!

মধু নয়, আমাদের আলোচ‍্য পেঁয়াজ। এবং তার আদি, মধ‍্য ও অন্ত‍্য। মিশরীয়দের কাছে এটি অজানা ছিল না। প্লিনির লেখায় পেঁয়াজের অস্তিত্ব আছে। পম্পেই নগরীর ধ্বংসাবশেষ তাঁর চোখের সামনে ঘটে। তখন তিনি জাহাজে। বহুবছর পর উনিশ শতকে (পম্পেইতে বিপর্যয় ঘটেছিল প্রথম শতাব্দীতে) সেই পম্পেইয়ের খননকাজ হলে সেখানেও পেঁয়াজের চাষ হত প্রমাণ মিলল। প্লিনির লেখায় পাই, মুখের ক্ষত চিকিৎসার অব‍্যর্থ ওষুধ এই পেঁয়াজ, যা এমনকি কুকুরের কামড়ের পর্যন্ত মহৌষধ। চিনে ব্রোঞ্জযুগে অস্তিত্ব ছিল এর। আমেরিকায় নিয়ে যায় ঔপনিবেশিকরা। নতুন নতুন দেশ আবিষ্কারের সময় দেশ-দেশান্তরে পাড়ি দিয়েছে পেঁয়াজ। কবিরাজী চিকিৎসায় যৌনশক্তি ধরে রাখতে এর প্রয়োগ আছে। পেঁয়াজকে পলাণ্ড বলা হয় সংস্কৃতে। এমনকি বাংলা ভাষাতেও শব্দটির প্রয়োগ পাই সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’-তে।

পেঁয়াজের জীবনে বাধা কম নয়। অনিয়ন ফ্রাই রোগে আক্রান্ত হয় সে, অনিয়ন এলওয়ার্মে, আর তাছাড়া আছে ফাঙ্গাস। স্বাদ দুরকম। ঝাঁঝালো আর মিষ্টি মিষ্টি। কখনও কখনও তেতো-ও হয়। সালফার আছে এতে। সেজন‍্য ঝাঁঝ। যেজন‍্য চোখে জল আনে। সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ হয় চিনে। তারপর ভারতে। তাছাড়া আফগানিস্তান, তুরস্ক। শীতপ্রধান অঞ্চলে এর আবাদ ভাল হয়। ভারতের নাসিক (মহারাষ্ট্র) পেঁয়াজের স্বর্ণপ্রসূ অঞ্চল। তাছাড়া উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, মধ‍্যপ্রদেশ ও দক্ষিণ ভারতেও হয়।

পেঁয়াজ নিয়ে দেশেবিদেশে নিয়ত গবেষণা হচ্ছে। ১৭৫৩-তে কারোলাক লিনিয়াস (Carl Linnaeus) এর নাম দেন Allium cepa। নামটির মধ‍্যে নিহিত রয়েছে যে সারসত‍্য, তা হল পেঁয়াজ আদপে কোনও শস‍্য না, হলুদ বা জিরে-মেথির মতো একটি মশলা। আজ অম্বিকাপুরে যে ব‍্যানার টানানো হয়েছিল অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে, সেখানেও উল্লিখিত আছে, ‘বাস্তবায়নে মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র’।

আজ এইটুকু জানিয়েই শেষ করব, পেঁয়াজের পিঠে ও কেক-ও চিন, কোরিয়া, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে জনপ্রিয়।

>>> ক্রমশ >>>
চিত্র: শাহেদা বেগমের সৌজন্যে

পড়ুন, প্রথম কিস্তি…

অম্বিকাপুর: শাহেদার দিগ্বিজয়

পড়ুন, দ্বিতীয় কিস্তি…

শাহেদার খেতের পথে

পড়ুন, চতুর্থ কিস্তি…

অথ পেঁয়াজচাষ কথা

পড়ুন, পঞ্চম কিস্তি…

শাহেদা বেগম: বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার আলোয়

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

ভূতের একটি বাজে গল্প

দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিতেই প্রথমে যেটি চোখে পড়ল, সেটি সেই লাল-হলুদ মাফলার, খাটের পাশে ঝোলানো। তাহলে সিড়িঙ্গেবাবু নিশ্চয়ই এই ঘরেই অধিষ্ঠান করেন, তালা দিয়ে কোথাও বেরিয়েছেন। হঠাৎ আমি ভূতগ্রস্তের মত করিডর ধরে হাঁটছি আর এক-একটা করে ঘরের দরজা ঠেলে ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছি। কী আশ্চর্য, প্রতিটি ঘরেই কোথাও না কোথাও দেখছি একটা করে ওই লাল-হলুদ মাফলার ঝুলছে। যত দ্রুত পারি দোতলায় ঘরগুলোর দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। সবখানেই এক ছবি।

Read More »
সুজিত বসু

কবিতা: জীবনের নানা দিক

ট্রেনের জানালা থেকে চোখে পড়ে ঘাসের গালিচা/ কোমল রোদের স্নেহে ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চল শান্তির নিদ্রায়/ সমুদ্রে দ্বীপের মতো ছোট ছোট বাড়িগুলি ঘাসের শয্যায়/ অতি দ্রুত বদলে যায় দৃশ্যাবলি, ট্রেন থামে ব্রাসেলস স্টেশনে/ বেলজিয়ামের মোহ দূরে রেখে ট্রেন চলে স্থির নিশানায়/ অভ্রান্ত লক্ষ্যের দিকে, আমস্টারডাম ডাকে কুহকী মায়ায়/ নগরে পৌঁছেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, সুন্দরী ট্রামেরা/ হাতছানি দিয়ে ডাকে, বহু বহুদিন পরে প্রিয় বাহনের/ ডাকে সাড়া দিয়ে আমি পৌঁছে যাই মহার্ঘ নিবাসে

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »