Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

সিলভিয়া প্লাথ: শুধু কি মৃত্যুর পরিচয়ে সংজ্ঞায়িত হবেন একজন কবি?

সৃজনশীল কবি এবং বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে একটি কথার প্রচলন খুব বেশি। যে কথাটা বহুলাংশেই তাঁদের ওপর দাগিয়ে দেওয়ার মত। তা হল, কবিরা সাধারণত বিষণ্ণ প্রকৃতির আর বিজ্ঞানীরা কিছুটা পাগলাটে প্রকৃতির হয়ে থাকে। আসলে এর পেছনে রয়েছে বহু পুরনো একটি ধারণা, যার মধ্যে আছে ক্রিয়েটিভিটির সঙ্গে মানসিক অসুস্থতার সমীকরণের সম্পর্ক। দার্শনিক অ্যারিস্টটলও এরকম ধারণা পোষণ করতেন। তিনি লিখেছিলেন যে, খ্যাতনামা দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, কবি এবং শিল্পীরা প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর বিষাদগ্রস্ততাপ্রবণ (মেলানকোলিয়া)।

বর্তমান সময়েও এ নিয়ে চর্চা চলেছে। মাত্র দু’দশক আগেও আমেরিকান অধ্যাপক এবং সাইকোলজির গবেষক জেমস সি ক্যুফম্যান ‘দ্য সিলভিয়া প্লাথ এফেক্ট’ নামে একটি তত্ত্ব খাড়া করেন যেখানে তিনি ক্রিয়েটিভিটি, ডিপ্রেশন এবং সুইসাইডের মধ্যে একটি সম্পর্ক স্থাপন করেন। যদিও এরকম যুক্তি বা মতবাদ কয়েকটি মাত্র জীবনীর নমুনা থেকে টানা সরল সমীকরণ ছাড়া এর মধ্যে আর কোনও ভিত্তি নেই। একই সঙ্গে ক্যুফম্যান আরও একটি ধারণা পোষণ করেছেন, তা হল, মহিলা ক্রিয়েটিভ লেখক-কবিদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা এবং ডিপ্রেশন হওয়ার প্রবণতা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। সহজেই বোঝা যায় এর মধ্যে রয়েছে একাধিক পদ্ধতিগত ত্রুটি যা মূলত কয়েকটি বাস্তব জীবন আধারিত এবং যেখানে ‘ক্রিয়েটিভিটি’-র সংজ্ঞাও স্পষ্ট নয়। এই সব গবেষণালব্ধ ধারণায় যে কোনও সারবত্তা নেই, সেরকমই অনেকে মনে করেন।

কবি শিল্পী লেখক এবং সৃজনশীল ব্যক্তির সঙ্গে মানসিক অসুস্থতার সম্পর্কের যে ধারণা, তা এরকমই কিছু মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। কবি বা শিল্পীসত্তার সঙ্গে আবেগের যে একটা সম্পর্ক আছে, এ কথা প্রায় সকলেই মানেন। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেলেও সৃজনশীল কবি শিল্পীদের সঙ্গে বিষণ্ণতা বা মানসিক অসুস্থতার কোনও সম্পর্ক নেই।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আমেরিকান কবি, ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক সিলভিয়া প্লাথের কথা আমরা অনেকেই জানি। এই লেখাটি তাঁকে নিয়েই। মাত্র আট বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন সিলভিয়া। বাবা ছিলেন একজন মৌমাছি বিশেষজ্ঞ এবং বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ছোট থেকেই দারুণ মেধাবী ছাত্রী ছিলেন সিলভিয়া। আট বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখা শুরু। যখন তিনি স্মিথ কলেজে পড়েন, সেসময় পঞ্চাশটি ছোটগল্প লিখেছিলেন। স্কলারশিপ এবং পরীক্ষায় সব বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন।

মাত্র তিরিশ বছরের স্বল্প জীবন সিলভিয়া প্লাথের। ১৯৬৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, জীবনের কাছে হেরে গিয়ে নিজের ইচ্ছায় তিনি বেছে নিয়েছিলেন মৃত্যুকে। লক্ষ্য করা যায়, আত্মহননকারী যদি মহিলা হয়, সেক্ষেত্রে মানসিক ভারসাম্যহীন, হতাশাগ্রস্ত, স্যাডিস্ট ইত্যাদি শব্দের দিয়ে আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় মেধা, সৃজনশীলতা, কবি বা শিল্পীসত্ত্বা, কীর্তি ইত্যাদি গুণ ও প্রতিভার পরিচয়গুলি। সিলভিয়ার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হল না। তাঁর ‘প্রতিভাময়ী’ পরিচয়টি ‘হতাশাগ্রস্ত’ এই জীবনচর্যার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে বার বার।

সিলভিয়া আত্মহনন করেছিলেন এ যেমন সত্যি, তেমনি মেধাবী ছাত্রী সিলভিয়া ‘ফুলব্রাইট’ স্কলারশিপ অর্জন করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, এও সেরকমই সত্যি। মৃত্যুর উনিশ বছর পরে তিনি মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন। চব্বিশ বছর বয়সে ভালবেসে বিয়ে করেছেন, সমসাময়িক এবং নামকরা কবি টেড হিউজেসকে। মাত্র ছ’বছরের বিবাহিত জীবন। তখন দুটি ছোট ছোট বাচ্চা। এসময় স্বামী টেড হিউজেস সিলভিয়াকে ছেড়ে চলে যান অন্য নারীর কাছে। স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার এক বছর পরের ঘটনা। সন্তানদের নিরাপদে রেখে রান্নাঘরে দরজা বন্ধ করে কার্বন মনোক্সাইডের তীব্র বিষক্রিয়ায় সিলভিয়া আত্মহনন করেন।

তাহলে কি স্বামীর ছেড়ে যাওয়া হতাশাগ্রস্ত আর অস্থিরমনা কবি হৃদয়ের আঁচে ইন্ধন যুগিয়ে আরও তীব্রতর করে তুলেছিল? বিশ্বাসঘাতকতা, উপেক্ষা আর ঘৃণার আঘাতে তীব্রভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছিলেন সিলভিয়া? যা পুরনো হতাশার ক্ষত আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। যা ছিল চিরদুঃখী আর অস্থিরমতি সিলভিয়ার সহনশীলতা মাত্রার বাইরে? এর উত্তর পাওয়া আজ আর সম্ভব নয়। মানুষের মন সত্যিই দুর্বোধ্য আর জটিলতম। এই মনের ভাঙাগড়ার পরিমাপের হদিশ পাওয়া কি এতই সহজ?

১৯৬২ সাল ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ বছর; The Colossus সংকলন প্রকাশ পাচ্ছে আমেরিকা থেকে। তাঁর লেখা নাটক Three Women বিবিসি রেডিয়োতে সম্প্রচারিত হচ্ছে। Ariel-এর অধিকাংশ কবিতাগুলি লেখা হয়ে যাচ্ছে। ওই বছর জুলাইয়ে স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে। বিচ্ছেদের আগে এবং পরেও কয়েকবার তিনি সুইসাইডের চেষ্টা করেছেন। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে, বিষণ্ণ শীতে ১৯৬২-র শেষে এবং ১৯৬৩-র শুরুতে তখন তিনি একটি ছোট ফ্ল্যাটে ছোট্ট ছেলে এবং সদ্য হাঁটতে শেখা মেয়েকে নিয়ে একা রয়েছেন।

সিলভিয়ার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘বেলজার’। মৃত্যুর দুবছর আগে ‘বেলজার’ লেখা শুরু করেন সিলভিয়া। এই লেখায় তিনি নিজের অভিজ্ঞতা, ভাবনা, বিষণ্ণতা, হতাশা এবং আত্মহননের প্রবণতা, দূরদৃষ্টি এবং দুঃস্বপ্নের কথা প্রাণবন্ত করে তুলে ধরেছেন। এই লেখায় ১৯৫০-এর দশকে আমেরিকান নারীদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কথাও বলেছেন। ছবির মত এঁকে তোলা সিলভিয়ার একমাত্র এই উপন্যাসটি তাঁকে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ আমেরিকান ঔপন্যাসিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাঁর বিখ্যাত কাব্যসংকলন ‘The Colossus and Other Poems’ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। মৃত্যুর দু’বছর পরে ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘Ariel’ প্রকাশিত হয়। ‘Ariel’-এর এই সংস্করণটি সম্পাদনা করেছিলেন ‘টেড হিউজেস’। তিনি সিলভিয়ার নির্বাচন করে যাওয়া বারোটি কবিতা বাদ দিয়েছিলেন এবং কবিতাগুলির ক্রমবিন্যাসেরও অদলবদল করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৪ সালে নতুন সংস্করণের Ariel গ্রন্থে সিলভিয়াকৃত কবিতাগুলির মূল ক্রমবিন্যাস অনুযায়ী করা ছাড়াও সিলভিয়া ও হিউজেসের কন্যা Frieda Hughes একটি ভূমিকা লেখেন।

আজ ২৭ অক্টোবর প্রতিভাময়ী কবি সিলভিয়া প্লাথের (১৯৩২–১৯৬৩) জন্মদিন। তাঁর সমাধিস্থলে আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার একগুচ্ছ রঙিন ফুল রেখে গেলাম।

চিত্র: গুগল
5 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Soumyodeep Mukherjee
Soumyodeep Mukherjee
2 years ago

Very informative

Siddhartha Majumdar
Siddhartha Majumdar
2 years ago

ধন্যবাদ

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

স্বামী বিবেকানন্দ : প্রয়াণদিনে স্মরণ

বিবেকানন্দই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক বাঙালি তথা ভারতীয়। রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ১৯১২-পর্বে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় যাওয়ার পর, এবং তার পরের বছর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। কিন্তু এর প্রায় কুড়ি বছর পূর্বেই বিবেকানন্দ শিকাগো-বক্তৃতা ও আমেরিকা-ইয়োরোপে এক নাগাড়ে প্রথম দফায় চার বছর থাকার সুবাদে আমেরিকার বিদ্বজ্জনমহলে যেমন, তেমনই জার্মানির মাক্সমুলার, ফ্রান্সের রোমাঁ রোলাঁ, রাশিয়ার টলস্টয় প্রমুখের শ্রদ্ধা এবং মনোযোগ আদায় করেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

প্রফুল্ল রায়: ব্রাত্য সময়ের কথাকার

প্রফুল্ল রায় নাকি অতীশ দীপঙ্করের বংশের। দেশভাগের অভিশাপেই দেশছাড়া হতে হয় তাঁকে, ১৯৫০-এ। একটা বিধুর বিষয় আমরা লক্ষ্য না করে পারি না। দেশভাগ সুনীল-শ্যামল-মহাশ্বেতা-শীর্ষেন্দু-অতীনদের কেবল ভূমিচ্যুত করেই ছাড়ল না, এমনকি তাঁদের কারুবাসনাকেও অন্যতর রূপ দেওয়ালো। দেশভাগ না হলে আমরা সুনীলের হাতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীণ’ বা প্রফুল্ল রায়ের ‘পূর্বপার্বতী’ পেতাম না, যেমন পেতাম না শওকত ওসমানের ‘কর্ণফুলি’ বা হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি।’

Read More »
শৌনক দত্ত

মন্দ মেয়ে ভদ্র অভিনেত্রী: সুকুমারী দত্ত

বিনোদিনী দাসীর বর্ণময় জীবনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া এই ‘তারকা অভিনেত্রী’-র বহুমাত্রিক জীবনটিও কম রঙিন নয় বরং বিস্মৃত নক্ষত্র এক, যিনি ১২৮২ বঙ্গাব্দের ৩ শ্রাবণ (১৮৭৫ খ্রি., মূল্য ছিল ১ টাকা) ‘অপূর্ব্বসতী’ নাটকটি লিখে বাংলা নাট্যাতিহাসের প্রথম নারী নাট্যকার হিসেবে সুবিদিত হয়ে আছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »