শান্তিনিকেতনের ব্রাহ্ম মন্দিরের সামনে মাধুরী বসু সাহা যখন জিপ থেকে নামলেন তখন শারদ আকাশের সূর্য মধ্যগগনে। এক নজর দেখেই বুঝে নিয়েছিলাম তিনি কবি, আপাদমস্তক কবি। রামকিঙ্কর বেজের শিল্পকর্ম, অমর্ত্য সেনের প্রতীচী, সাঁওতালপল্লির দুর্গাপূজার মহানবমীর মহাযজ্ঞ আর সৃজনী সংস্কৃতি কেন্দ্রের ইন্ডিয়ান কালচারাল হেরিটেজের রেপ্লিকাগুলো যখন দেখছিলাম আর তাঁর শীলিত কণ্ঠে বর্ণনা শুনছিলাম, তখন মনে হল, সবকিছু নতুন করে জানছি। আহা, কী অসাধারণ বর্ণনা! একজন বিদগ্ধ সংবেদনশীল কবি ছাড়া অমন সুন্দর করে কি কেউ বর্ণনা করতে পারেন! আমি কবি নই, কবিতার হৃৎমন্দিরে কখনও ঢুকিনি, ঢুকতে চেষ্টাও করিনি। কোনও অপার্থিব মোহন মায়ার ছলনে ভুলে কখনও কবিতা লিখতে প্ররোচিত হইনি। মাঝেমধ্যে মস্তিষ্কের গভীর থেকে দু-একটি পঙ্ক্তি শ্বেত কপোত হয়ে বেহেশতের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে, কিন্তু আমার অন্তর্গত মধ্যবিত্তীয় টানাপোড়েন আর দোলাচল কবিতার শ্বেত কপোতগুলিকে ডানা মেলে নীল আকাশে উড়তে দেয়নি। আমার মস্তিষ্কের নিউরন আর রক্তকণিকাগুলো কেবলই মনে করিয়ে দিয়েছে, ‘তুমি মধ্যবিত্ত, কবিতা লেখা তোমার কাজ না, কবিতা রচনা করে তুমি কী করবে? বরং কবিতার সঙ্গে বসবাস করে দিগন্তের অধিকার গ্রহণ করো।’ কবিতা লিখিনি বটে, তবে কবিতাপাঠ করেই ভোরের আলো, জ্যোৎস্নাধোয়া আকাশ, নিস্তব্ধ দুপুর দেখতে শিখেছি। রক্তের ভেতর কবিতার ঘোরলাগা উন্মাদনা কাজ করত বলেই বেকার জীবন, মুদ্রাস্ফীতি, কাঁটাতার, ব্যারিকেড, সাঁজোয়া বাহিনীকে তোয়াক্কা করিনি কোনওদিন। পরিবর্তমান সময়েও কবিতার মধ্যেই খুঁজে পাই বেঁচে থাকার অফুরন্ত প্রেরণা, সঞ্জীবনী সুধা। আমরা স্বীকার করি আর নাই-করি, কবিতা মধ্যবিত্তের জীবন সংগ্রামের ইশতেহার, যৌবনের নিষিদ্ধ প্যামফ্লেট। আমাদের সময়ের প্রিয় কবি শামসুর রাহমান হয়তো সেজন্যই বলেছেন, কবিতা হচ্ছে ‘মধ্যবিত্তের পাঁচালি’। আমরাও সেই মধ্যবিত্তেরই অংশ, তাই আমরাও আশৈশব কবিতার ঘাসফড়িং আর রঙিন প্রজাপতির পিছু নিয়ে পার করেছি অজস্র দুপুর। কবিতার ভেলায় পার হয়েছি গঙ্গা-যমুনা জলেশ্বরী। মধ্যবিত্ত হবার কারণেই কবিতার ঘুণপোকা এখনও আমাদের মস্তিষ্কের গহীন গভীরে বিষাদ ছড়ায়, কবিতার ধূপ ভালবাসার বারান্দা ভরে দেয় স্নিগ্ধ সৌরভে, কবিতার পরশে মনের তুলসীতলে প্রতি সন্ধ্যায় জ্বলে ওঠে লাল নীল দীপাবলি। কবিতা আছে বলেই গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে আমাদের সেনাবাহিনী মার্চপাস্ট করে দূর মফস্বলের কোনও এক প্রিয়তমাকে অভিবাদন জানাতে। মধ্যবিত্ত হবার কারণেই স্মৃতিসত্তায় প্রতিক্ষণ, প্রতি প্রহরে বয়ে চলেছি কবিতার অন্তর্গত ‘অন্তহীন আশ্চর্য বিষাদ’। কত যে বৈকালিক আড্ডা পার করেছি শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-সহ আরও কত কবির পঙ্ক্তিমালা আওড়িয়ে। তর্কে-প্রতর্কে পার করেছি কত যে-প্রহর, কে বড়, কবি নাকি কবিতা? পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক কবিতার সঙ্গে পরিচয় হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, জয় গোস্বামী আর সুবোধ সরকারের মাধ্যমে। সুনীলের ‘বুকের মধ্যে সুগন্ধী রুমাল’-রাখা বরুণা আর পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথনের শুভঙ্কর-নন্দিনী-ই তো আমাদের শিখিয়েছে ভালবাসার ছিন্নপত্র লিখতে!
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পাঠগ্রহণকারী মাধুরী বসু সাহার ‘অভিমানী অপেক্ষায়’ পড়তে পড়তে মনে হল, চারদিকে যখন ফাঁপা আশার মচ্ছব, তখন একজন প্রকৃত কবিই পারেন আমাদের চেতনাপ্রবাহের আইল্যান্ডে নতুন আশার বীজ বুনতে। কবিই পারেন জীবনের নিগূঢ় বারান্দায় ভালবাসার দীপশিখাটি জ্বালিয়ে রাখতে। বিষাদঘন বিবর্ণ জীবনও বর্ণাঢ্য ও অর্থময় হয়ে ওঠে কেবলই কবিতার স্নিগ্ধ মধুগন্ধের পরশে। কবি মাধুরী বসু সাহার ‘অভিমানী অপেক্ষায়’ পাঠ করে নতুন করে ‘শাশ্বত ভালবাসা, অন্তহীন আনন্দ ও সত্যময় সৌন্দর্য’-কে চিনলাম। নতুন করে চিনলাম শান্ত-স্নিগ্ধ সাবেকি জীবনকে। তাঁর কবিতায় থিসিস-অ্যান্টিথিসিসের দ্বৈরথ নেই, আছে কেবলই সরল জীবনের জয়গান। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গের একদল কবি পোস্টমডার্ন কবিতাচর্চা শুরু করেন। কবিতার মধ্যে একটি বক্তব্য থাকা দরকার এমন তত্ত্বকে তারা প্রবলভাবে খারিজ করে দেন। বাস্তবতাকে নকল বা অনুকরণ করার পরিবর্তে হাইপার-রিয়েলিটি তৈরি করতে বেশি বেশি মনোযোগী হন। গুরুত্বারোপ করেন কবিতার বিমানবিকীকরণের ওপর। এছাড়াও স্পষ্টভাবে তারা জানিয়ে দেন, কবিতাকে রাজনীতি ও যুক্তির খপ্পর থেকে মুক্ত করতে হবে। মাধুরী বসু সাহার কবিতা রাজনীতি ও লজিকের খপ্পর থেকে মুক্ত, তারপরও তাঁর পঙ্ক্তিমালাদের পোস্টমডার্ন কবিতার অভিধা প্রদান যায় না, কারণ তাঁর কবিতার পরতে পরতে রয়েছে মানবিক আবেদনের ছড়াছড়ি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ পড়ে জেনেছিলাম, ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য প্রিয়তমা স্ত্রীর বিয়োগব্যথার সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিলেন কিশোর রবীন্দ্রনাথের ‘ভগ্নহৃদয়’-এর পাঠগ্রহণ করে। কার্তিকের বিষণ্ণবেলায় মাধুরীর কবিতা পড়ে আবার নতুন করে চিনে নিলাম জীবনের গানে বয়ে যাওয়া ভালবাসাকে। পড়তে পড়তে মনে হল মানুষ বড় একা, বড় নিঃসঙ্গ। মাধুরীও কি একা! তার চারপাশ ঘিরে এত আয়োজন, এত মহাযজ্ঞ, এত উদ্বেল উপস্থিতি তারপরও আপনি একা? চির রোম্যান্টিক রবীন্দ্রনাথের মত কবিও ভালবাসার কাঙাল, বড় একা। জগতের সব মহৎ মানুষ-ই বোধহয় নিয়ত একা। একা বলেই অভিমানী কবির প্রতীক্ষার দীপে জ্বলে বিরহের মোমবাতি। এই একাকিত্ব, এই নির্জনতা তাঁর বুকের গভীরে সৃষ্টি করেছে এক অলৌকিক বেদনা আর ছটফটানি। তবুও ভালবাসার অধরা-মাধুরীর ছোঁয়া পাবার জন্য নিবিড় তৃষ্ণা তাঁর, যে তৃষ্ণা কাটে না অজস্র জীবনে, অজস্র মৃত্যুতে। তারপরও কবি ভালবাসা নামক অধরা-মাধুরীকে খুঁজে বেড়ান। তাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে জিজ্ঞাসা জাগে, এই পরিবর্তমান সময় ও কসমোপলিটান সমাজে একজন কবি কি শুধুই ভালবাসার ঘোরে দিবস রজনী আচ্ছন্ন থাকবেন? নাকি প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব নিয়ে রাজনৈতিক তত্ত্ব ছড়িয়ে আসর গরম করে বেড়াবেন? মনের ভেতর থেকেই জবাব পাই, নিজেকে ও নিজের ইতিহাসকেই খুঁজে ফেরা বোধহয় একজন প্রকৃত কবির কাজ। মাধুরীও তাই করেছেন, তিনিও নিজেকে খুঁজেছেন, মেলে ধরেছেন ‘অভিমানী অপেক্ষায়’ কবিতাগ্রন্থের পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। এই কবিতাগ্রন্থে চুঁচুড়া, চন্দননগর কিংবা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের মুগ্ধ শিক্ষার্থী মাধুরী বসু সাহাকে খুঁজে পেলাম না, খুঁজে পেলাম গঙ্গা তীরবর্তী আদি সপ্তগ্রামের এমন এক রাইকিশোরীকে যিনি ‘নন্দনে আর নলবনে’ শ্যামের বাঁশি বেজে ওঠার স্বপ্ন দেখেন। বইয়ের চিত্রশিল্পী স্বপন পালকে অভিবাদন স্নিগ্ধ প্রচ্ছদের জন্য। পাতায় পাতায় অলংকরণ বইটির মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে। সময়ের বিচারে বিনিময়মূল্য যৌক্তিক। ডা. শিশিরকুমার সাহাকে স্বত্ব প্রদান এবং কবি-দেবর মিহির সাহাকে উৎসর্গ করতে পেরে কবি সম্ভবত খুবই পুলকিত হয়েছেন। আশা করি, বইয়ের প্রতিটি কবিতা কবিতাপ্রেমীদের কাছে আদরণীয় হবে।
অভিমানী অপেক্ষায় ।। মাধুরী বসু সাহা ।। দেশ প্রকাশন, কলকাতা ।। বিনিময়: ৮০ টাকা