এ-বছর কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশের একশো বছর পূর্ণ হল। ১৯২২-এর ২৪-এ অক্টোবর এটি কবির নিজ অর্থব্যয়ে বেরিয়েছিল। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকনন্দিত হয়েছিল বইটি, যে-কারণে প্রথম সংস্করণের দুহাজার কপি দ্রুত শেষ হয়েছিল। সে-আমলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থও এত দ্রুত বিক্রি হত না।
এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এ-বই প্রকাশের আগেই তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন ‘বিদ্রোহী’ লেখার সূত্রে। একটিমাত্র কবিতা লিখে পাঠকচিত্ত তুমুলভাবে জয় করার ইতিহাস বাংলা কবিতার জগতে অভূতপূর্ব। কবিতাটি খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হুয়েছিল। বোধ করি সব সম্পাদক কবির অনুমতি নেবার অপেক্ষাও করেননি এ-ক্ষেত্রে।
প্রথমে কবিতাটি কোন পত্রিকায় বেরোয়, তা নিয়ে মতভেদ আছে। ‘মোসলেম ভারত’-এ (কার্তিক ১৩২৭) বেরোলেও নজরুলসখা মুজফফর আহমদ জানাচ্ছেন, পত্রিকার কার্তিক সংখ্যা বেরোয় অনেক পরে। সাপ্তাহিক ‘বিজলী’-তে এটি সেবছরের পৌষে বেরোয়। ‘প্রবাসী’-তে মাঘে, এবং ১৩২৯-এর বৈশাখে ‘সাধনা’-য়। ইতিমধ্যে নজরুল নিজের সম্পাদনায় বের করলেন ‘ধূমকেতু’। ১৯২১-এর আগস্টে কবিতাটি সেখানেও পত্রস্থ হল।
‘বিজলী’ রাতারাতি বিক্রি হয়ে গেল কবিতাটির জোরে। ফলে পত্রিকাটির দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপতে হয়েছিল পাঠকচাহিদা মেটাতে।
এইখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানানো যাক। একাধিক পত্রিকায় কবিতাটির পাঠভেদ আছে। তাছাড়া, বেশ কিছু পঙ্ক্তি গোড়ায় কবিতাটিতে ছিল, কিন্তু তা বর্তমান সংস্করণগুলিতে পাওয়া যায় না। যেমন, গোড়ায় পেয়েছি এ-সব লাইন, ‘আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার’-এর ঠিক আগে, ‘আমি উত্তাল, আমি তুঙ্গ ভয়াল মহাকাল,/ আমি বিবসন, আজ ধরাতল নত ছেয়েছে আমারই জটাজাল/ আমি ধন্য, আমি ধন্য,/ আমি মুক্ত, আমি সত্য, আমি বীরবিদ্রোহী সৈন্য,/ আমি ধন্য, আমি ধন্য’।
‘অগ্নিবীণা’ নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, কিন্তু প্রথম বই নয়। ১৯২২-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘ব্যথার দান’-ই তাঁর প্রথম বই। আর ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশের একই দিনে বেরোয় নজরুলের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘যুগবাণী’।
গ্রন্থে প্রকাশিত প্রায় সব কবিতাই বিভিন্ন সাময়িকপত্রে পূর্বেই বেরিয়েছিল। তার মধ্যে কয়েকটি হল—
১. শাত্- ইল আরব: মোসলেম ভারত, জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৭।
২. খেয়াপারের তরণী: ঐ, শ্রাবণ ১৩২৭।
৩. কোরবানী: ঐ, ভাদ্র ১৩২৭।
৪. মোহররম: ঐ, আশ্বিন ১৩২৭।
৫. কামাল পাশা: ঐ, কার্তিক ১৩২৭।
৬. উৎসর্গ-কবিতা উপাসনা: শ্রাবণ ১৩২৮।
৭. রণভেরী: সাধনা, আশ্বিন ১৩২৮।
৮. আনোয়ার: ঐ, কার্তিক ১৩২৮।
৯. প্রলয়োল্লাস: প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯।
১০. ধূমকেতু: ধূমকেতু, শ্রাবণ ১৩২৯।
১১. রক্তাম্বরধারিণী মা: ঐ, ভাদ্র ১৩২৯।
নজরুলের জীবন তাঁর কবিতা-পঙ্ক্তির মতই,— ‘ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া’, অথবা ‘তাজী বোররাখ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার’! তাই এ-কাব্য প্রকাশ, ‘ধমকেতু’ সম্পাদনা, সেখানে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ বেরোনোমাত্র রাজরোষে পড়ে কারাবাস, অনশন, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ‘বসন্ত’ উৎসর্গ হিসেবে পাওয়া, এসব ঘটে যায় নিমেষেই, পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছিলেন বলে সমসাময়িক কবিকুল যখন কাজটিকে অযথার্থ মনে করেছিলেন এমত বিবেচনায় যে, নজরুল যথার্থ কবিপদবিতে আরূঢ় হওয়ার যোগ্য কিনা, সেসময় রবীন্দ্রনাথকেই রূঢ়তার সঙ্গে বলতে হয়েছিল, নজরুলকে যারা কবি বিবেচনা করেন না, তাদের কবিত্বশক্তি নিয়েই সংশয় আছে। অন্যত্র তিনি বলছেন, ‘জনপ্রিয়তা কাব্যবিচারের স্থায়ী নিরিখ নয়, কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে, তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য’। রবীন্দ্রনাথকে বারবার যথার্থ কবিদের প্রতি ঈর্ষাকাতর ও অবিবেচকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছিল,— জসীম উদ্দীন, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, বন্দে আলী মিয়া, বেগম সুফিয়া কামাল, অপরাজিতা দেবী প্রমুখ।
কাব্যটি নজরুল উৎসর্গ করেছিলেন বিপ্লবী বারীন্দ্রনাথ ঘোষকে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইয়ের প্রচ্ছদনির্মাতা। সে বড় সুখের সময়!
‘অগ্নিবীণা’-র প্রথম সংস্করণে ছিল বাইশটি কবিতা। প্রথম সংস্করণ দ্রুত শেষ হওয়ায় এর দ্বিতীয় সংস্করণের প্রস্তুতি চলতে থাকে। নজরুলের ইচ্ছে ছিল, দ্বিতীয় সংস্করণে আরও কিছু কবিতা ও গান যোগ করবেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ‘ধূমকেতু’-তে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ লেখার জন্য তিনি বন্দি হন, যেজন্য নজরুলের পরিকল্পনাও ভণ্ডুল হয়ে যায়। তাঁর নির্বাচিত লেখাগুলির অধিকাংশ স্থান পায় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বিষের বাঁশী’-তে।
বইটির প্রায় সব কবিতাই কোনও না কোনও পত্রিকায় পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল। ফলে পাঠক কবিতাগুলির কঠোরতা-কোমলতা সম্পর্কে অবহিত ছিল।
বইটি প্রকাশিত হতে বিভিন্ন পত্রিকা এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত সমালোচনা বেরোয় ‘প্রবাসী’-তে। সেখানে লেখা হয়, ‘‘এই কবির বৈশিষ্ট্য তাহার ছন্দের বৈচিত্র্যে, উপল-বিষম ঝর্ণাধারার মতন শব্দের ঝঙ্কারে, অগ্নিগিরির উচ্ছ্বাসের মতন আবেগময় ভাবের উদ্দাম প্রবাহে, বন্যাস্রোতের মতন প্রবল আবহে, বলিবার শক্তিমান ভঙ্গীতে এবং হিন্দু-মুসলমান সাহিত্য ইতিহাস ধর্ম ও সভ্যতার ধারার ও চিন্তাপ্রণালীর সঙ্গে সুপরিচয়ে দুইয়ের সংমিশ্রণ ও সমন্বয় ঘটাইবার অসাধারণ শক্তিতে। …এর কবিতাগুলি আগুনের শিখার মতন প্রোজ্জ্বল উজ্জ্বল লেলিহান, অথচ তাতে বীণার মতন বিচিত্র ছন্দে মধুর সুর বাজিয়াছে।’’ (মাঘ ১৩২৯)।
ওই এক-মাসে প্রকাশিত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ পত্রিকার সমালোচনাটিও উদ্ধৃতিযোগ্য, ‘‘হিন্দু ও মুসলমান শাস্ত্রসিন্ধু মন্থন করিয়া কবি যেসব অনুপম উপমা সংযোজন করিয়াছেন, তাহাতে মুগ্ধ হইতে হয়।’’
যথাযথ মন্তব্য। কেবল ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি দিয়েই যদি বিচার করি তাহলে দেখব, হিন্দু পুরাণের কী বিপুল ব্যবহার! অন্যদিকে ইসলামের অনুষঙ্গও ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে ‘অগ্নিবীণা’-র কবিতাকায়ায়। তাছাড়া নজরুল বহু আরবি-ফার্সি শব্দকে বাংলাভাষায় প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু করেন এই কাব্যগ্রন্থ থেকে, যা বাংলাভাষাকে যথেষ্ট পরিমাণে সমৃদ্ধ করেছে। এমন কিছু আরবি-ফার্সি শব্দ অর্থসহ পরিবেশিত হল।
১. ফেরু= শেয়াল।
২. দিলির= সাহসী।
৩. তেগ= তলোয়ার।
৪. খিঞ্জির= শুয়োর।
৫. জালিম= অত্যাচারী।
৬. নকিব= তূর্যবাদক।
৭. হাইদর= সিংহের ডাক।
৮. আমামা= শিরস্ত্রাণ।
৯. গুর্দা= কলিজা। ইত্যাদি।
কবি নজরুল, জানি আমরা, ছিলেন সৈনিক। সৈনিকজীবনের মর্মবেদনা ফুটে উঠেছে তাঁর একটি কবিতায়— ‘সৈনিকেরই সত্যিকারের ব্যথার ব্যথী/ কেউ কি রে নেই? আহা!’ ‘কামালপাশা’ কবিতার অন্যতম পঙ্ক্তি। আরও আছে, যা পরের সংস্করণে বর্জিত, ‘হোহো ভগবানে আমি পোড়াবো বলিয়া/ জ্বালায়েছি বুকে চিতা (কবিতার নাম ‘ধূমকেতু’)। ‘কামালপাশা’-য় আছে চমৎকার কবিত্ব,— ‘সন্ধেটা আজ দেখতে যেন সৈনিকেরই বউ’।
‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশকালে রবীন্দ্রপ্রতিভা তুঙ্গে। নজরুলের জন্মসালে যিনি জন্মেছিলেন, সেই জীবনানন্দ তখনও অশ্রুত নাম। ১৯১৯-এই যদিও জীবনানন্দের কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বরিশালের ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায়। এই কাব্যটির মধ্য দিয়ে নজরুল পাঠকচিত্ত জয় করে নিলেন! পরবর্তী বিশ বছর নজরুল তাজী বোররাখের মতই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বাংলা কবিতা ও গানের জগতে, ও সেইসঙ্গে সঙ্গীতশিক্ষক, ছায়াছবির অভিনেতা, পত্রিকাসম্পাদক ও আরও বহুরূপে। তিনি নিজেই আসলে ছিলেন এক অগ্নিবীণা।