যখন উপরের সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এলেন জ্ঞানদাচরণ, তখন সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে তার পাশে একচিলতে ঘাসজমিতে বাজপড়া গাছের মত কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাণীকান্ত। পাশে দাঁড়িয়ে বাল্যবন্ধু শশধর ক্রমাগত ওকে অভয় দিয়ে যাচ্ছিলেন। বারবার বলছিলেন, ‘বাণী, শক্ত হ। আমি বলছি ভয়ের কিছু নেই। এত উতলা হচ্ছ কেন? তাছাড়া আমি তো আছি সাথে, কোনও কিছু হবে না। তাছাড়া এটা হতেই পারে না।’ তার দেওয়া সান্ত্বনার বাণী, তার বন্ধু বাণীকান্তর ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারছিল না।
এখানে একটু গোড়া থেকে বললে বিষয়টা সবাই বুঝতে পারবেন। বাণীকান্ত বুঢ়াগোহাঁই, জ্ঞানদাচরণ চক্রবর্তী আর শশধর চলিহা একেবারে ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হতে হতে এখন প্রায় বুড়ো হয়েছেন। তিনজনই পাঠশালা থেকে হাইস্কুল অব্দি একসাথে পড়েছেন, তারপর তাদের লাইন পেশাগত কারণে আলাদা হলেও বন্ধুত্বে একটুও চিড় ধরেনি, বরং দিন দিন আরও গাঢ় হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোবার পর জ্ঞানদাচরণ বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার সুবাদে ডাক্তারিতে সুযোগ পেয়ে যান। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী এই ডিব্রুগড় শহরে তখন বিশাল চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে পড়তে আজকের মত এত কাঠখড় পোড়াতে হত না। আর শশধর চলিহা ওকালতি পড়তে ভর্তি হয়ে গেলেন। তিন বন্ধুর মধ্যে শুধু বাণীকান্তই কলাবিভাগে ভর্তি হলেন ডিব্রুগড় শহরের বিখ্যাত কানৈ কলেজে।
তারপর ধীরে ধীরে দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর এবং কয়েক বছর পর তিন বন্ধুই নিজেদের জীবনে থিতু হলেন। জ্ঞানদাচরণ নিজের এলেমে এবং ভাল রেজাল্ট করে ডিব্রুগড় শহরের বিখ্যাত গাইনিকলজিস্ট রূপে পরিচিতি লাভ করলেন, শশধর চলিহা ওকালতি পাশ করে ডিব্রুগড় কোর্টে জয়েন করলেন এবং বর্তমানে উনি শহরের দুঁদে ক্রিমিনাল ল’ইয়ার। বাণীকান্ত কানৈ কলেজ থেকে বিএ পাশ করে সরকারি চাকরিতে ঢুকলেন এবং কালক্রমে উনি আবগারি বিভাগের সহকারী কমিশনার পদে আসীন।
এই পূর্বকথা বলার কারণ পরে ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে।
এই গল্পের মূল নায়ক এখন রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করবে। ও হল বাণীকান্ত বুঢ়াগোহাঁইয়ের একমাত্র ছেলে কুশল বুঢ়াগোহাঁই। বাণীকান্ত স্বাধীনতার দশ বছর পর জন্মেছেন এবং দেশপ্রেম তার রক্তে তখন টগবগ করছিল। শহিদ কুশল কোঁয়রের নামের সাথে মিলিয়ে ছেলের নাম রেখেছেন। এই ছেলে পৃথিবীর আলো দেখেছিল ওর বাবার বন্ধু জ্ঞানদাকাকার হাতে। চিরকুমার জ্ঞানদাচরণ কুশলকে নিজের ছেলের মত দেখেন এবং ওর ভালমন্দ বিষয়ে বাণীকান্ত বন্ধু জ্ঞানের সাথে সবসময় আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করেন।
গণ্ডগোলের শুরু তেরো বছর আগে, দু’হাজার তিন সালে। সদ্য কলেজে যাওয়া যুবক কুশল অনিয়মিত জীবনযাপন শুরু করল। প্রথমে এই ব্যাপার কেউ বিশেষ খেয়াল করেনি, কিন্তু যখন প্রায়ই দেরি করে রাতে ঘরে ফেরা শুরু করল এবং মাঝে মাঝে দু-একদিন রাতে ঘরে ফিরল না, তখন বাণীকান্তর ভ্রূতে ভাঁজ পড়ল। গিন্নি প্রণতিকে হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হ’ল কুশলৰ আজিকালি? কিবা অইন ধৰণৰ বন্ধু বান্ধৱ? লগৰীয়া পালে যেন লাগিছে, অলপ চকু ৰাখিব লাগিব, বয়স ঠিক নহয়। বেলেগ কিবা লাইন ধৰিছে জানো?’ (কুশলের কী হল আজকাল? কোনও অন্য ধরনের বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়েনি তো? একটু চোখে চোখে রাখবে তো, আসলে বয়সটা ঠিক নয়।)
কিন্তু কুশলের অনিয়ম বাড়তে লাগল দিন দিন। তারপর যেদিন ওর ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে প্রণতির হাতে এল তোষকের একদম তলায় লুকিয়ে রাখা কালো ঠান্ডা মেশিনটা, সেদিন বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল তার। অবধারিতভাবে স্বামীর কানে কথাটা তুলতে হল। সেদিন বিকেলে মিটিং বসল বাসায়।
ডাক পড়ল বাকি বন্ধুদের। পরের দিন কোর্টে একটা জরুরি কেস থাকায় শশধর আসতে পারলেন না। দুই বন্ধু আর বাণীকান্তের গিন্নি মিলে অনেক ভাবনাচিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এই ছেলের বিয়ে করিয়ে দিতে হবে। তো বিয়ের পাত্রী কোথায়? জ্ঞানদাচরণ বলে বসলেন, ‘অরে পাত্রী তো আমাদের চোখের সামনেই আছে!’ বাকি দুজন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে ডাক্তারবাবু হেসে বললেন, ‘অরে, শশধরের মা-মরা মেয়েটার কথা বলছি। আমাদের দীপ্তি গো! মেয়েটা দেখতেও যেমন মিষ্টি কাজেকর্মেও একেবারে ঘরোয়া। এই পারবে আমাদের কুশলকে শাসন করে ঘরমুখো করতে। আর দেরি করা উচিত নয়, কালই চলো শশধরের বাড়ি সম্বন্ধ নিয়ে। আশা করি বন্ধুত্বটা আত্মীয়তায় পরিণত করতে শশধর আপত্তি করবে না।’
পরদিনই হৈহৈ করে দুই বন্ধু জ্ঞানদাচরণ আর বাণীকান্ত শশধর চলিহার ঘরে বিয়ের আলাপ নিয়ে হাজির। আনন্দে অভিভূত শশধর। যদিও প্রথমে ছেলে উপার্জন করে না বলে শশধর একটু আপত্তি তুললেন, কিন্তু তাতে ভেটো দিয়ে বলা হল যেহেতু বাণীকান্তর সংসারে অন্নবস্ত্রের কোনও অভাব নেই, মেয়ের খাওয়া-পরার কোনও অভাব হবে না, বরং এই কুটুম্বিতায় বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হবে। মোদ্দা কথা, বিয়ে দিলে ছেলের যে সংসারে মতিগতি ফিরবে সেব্যাপারে কারওরই সন্দেহ ছিল না।
কুশল এবিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে কোনও আপত্তি করল না, বরং বিয়ের কথা শুনে ও একটু মজা পেল, খুশি হয়ে মত দিল। এই বিষয় নিয়ে তিন বন্ধুর কেউই কোনও সন্দেহ প্রকাশ করলেন না, বরং আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে বিয়ের আয়োজনে লেগে গেলেন। তারপর, এক গোধূলিলগ্নে সুতহিবুকযোগে কুশলের সাথে শশধর চলিহার মেয়ে দীপ্তির বিয়ে হয়ে গেল।
***
বিয়ের পর ক’দিন তো খুব আনন্দে কাটল। কুশল যদিও দীপ্তিকে আগে থেকেই চিনত কিন্তু ওকে নতুনভাবে স্ত্রী হিসাবে পেয়ে ও তো খুব খুশি। নুতন খেলনা পেলে বাচ্চারা যেভাবে খেলনাটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে এবং সকাল বিকাল ওই খেলনাটা নিয়েই মেতে থাকে, কুশলের সেই অবস্থা হল। প্রণতি আর বাণীকান্ত তো একাধারে মহাখুশি আর গর্বিত।
এভাবে কেটে গেলো মাস ছয়েক। বাণীকান্তের ঘরে আবার শুরু হল অশান্তি। বউয়ের শরীরের নেশা ধীরে ধীরে কেটে গেল কুশলের এবং ওর পুরোনো জীবনধারা ফের ওর ওপর ভর করল। ফের শুরু হল দেরি করে রাতে ফেরা, মাঝে মাঝে কোথাও দুই-তিনদিনের জন্য ডুব মারা ওর অভ্যাসে পরিণত হল। একদিন বাপ বাণীকান্ত জিজ্ঞেস করলে জবাব দিল, ‘জাতির কাজ করছি, নূতন অসমের সৃষ্টি করব আমরা।’ বাণীকান্তর বুক কেঁপে উঠল। তবুও আবার জিজ্ঞেস করল, ‘নূতন অসম কীরে? কোনও অনৈতিক অথবা বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়িসনি তো বাপু? ঘরে তোর বিয়ে করা বউ আছে ভুলে যাস না বাবা।’
‘তোমরা খেলার পুতুল চেয়েছিলে, বাবা পুতুল পেয়েছ, তাই নিয়ে সুখী থাকো আর আমাকে আমার কাজ করতে দাও।’ ক্রূর হেসে জবাব দিয়েছিল কুশল।
‘কিন্তু বাপু, পরের ঘরের মেয়ে এনেছি তোর জন্য, তার প্রতিও তোর কি কোনও দায়িত্ব নেই?’ নাছোড় বাণীকান্ত আর একবার প্রশ্ন করলেন।
‘এই নিয়ে আমি আর একটা কথাও বলতে চাই না।’ বলে কুশল বেরিয়ে গেল। পর্দার আড়াল থেকে সব কথা দীপ্তি শুনল। স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার পর জলভরা চোখে বেরিয়ে এসে শ্বশুরকে অনুরোধ করল, ‘দেউতা, আপনি এই বিষয় লৈ এওঁক একো নকব। তেওঁ যেনেকে চলিব বিছাৰে, চলিব দিওঁক। আপনি মুখ বেয়া কিও কৰে?’ (বাবা, আপনি এব্যাপারে ওকে কিছু বলবেন না, উনি যেভাবে চলতে চান চলতে দিন, আপনি মুখ নষ্ট কেন করেন?)
এর প্রায় দুসপ্তাহ পর একরাতে কুশল আর ঘরে ফিরল না। ড্রইংরুমের ফুলদানির তলায় একটুকরো কাগজ পাওয়া গেল, যাতে এক লাইন লেখা ছিল, ‘স্বাধীন দেশের কাজে যাচ্ছি। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করো না।’ কাউকে কোনও সম্বোধন নেই।
প্রণতি হাউহাউ করে কেঁদে ভাসালেন, বউমা দীপ্তি নীরবে কেঁদে কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে, সিঁদুর থ্যাবড়ানো কপালে, চান-খাওয়া কারও নেই। বিকেল গড়াল। বাণীকান্ত, জ্ঞানদাচরণ আর শশধর সারাদিন থেকে থানায় বসা। ফটো দিয়েছেন, বাঁহাতে ট্যাটু করে ইংরেজিতে k অক্ষর লেখা, তাও বলেছেন বাণীকান্ত। তিনজনই শহরের বিখ্যাত লোক, তাই পুলিশ মিসিং ডায়েরি করেছে কিন্তু কোনও আশা দিতে পারল না। বরং বলল, বাড়ি ফিরে যান, কোনও খবর পেলে জানাব’খন। সেদিন ছিল দুহাজার চার সালের ২৫-এ এপ্রিল।
***
ইতিমধ্যে কেটে গেছে পুরো বারোটা বছর। ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে লক্ষ লক্ষ কিউসেক জল বয়ে গেছে। অসমের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ১৯৭৮ সালে জোরহাটের রংঘরে যে আগুনের জন্ম হয়েছিল, নতুন শতাব্দীর প্রথম পদে তা স্তিমিতপ্রায়। দুর্ধর্ষ আলফা গোষ্ঠীর বড় বড় নেতারা সবাই সমাজের মূলস্রোতে ফিরে এসেছেন, শুরু হয়েছে ভারত সরকারের সাথে আলোচনার প্রচেষ্টা। শুধু মুষ্ঠিমেয় কিছু যুবক একজন স্বাধীনতাকামী নেতার পেছনে থেকে এখনও স্বাধীন অসমের স্বপ্ন নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ডিব্রুগড় শহর এই ক’বছরে অনেক বদলে গেছে। শান্ত নদীর পাড় বছর বছর ভাঙছে, লোকজন বেড়েছে, শহর অনেক ঘিঞ্জি হয়েছে। সব বদলে গেছে, শুধু বদলায়নি একটি পরিবারের জীবনযন্ত্রণা। এক মা, এক স্ত্রী আশায় বুক বেঁধে আছেন কবে তার ছেলে, তার স্বামী ঘরে ফিরে আসবে। এক স্ত্রী রোজ এত বছর ধরে তার স্বামীর মঙ্গলকামনায় সিঁথিতে সিঁদুর পরছে, আশায় বুক বেঁধে। বাণীকান্ত অনেক বুড়িয়ে গেছেন, চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর। বাকি দুই বন্ধুর সে বালাই নেই, দুজনেই এখনও ডাক্তারি আর ওকালতি করে যাচ্ছেন। সকালে-বিকেলে তিন বন্ধু কাজের ফাঁকে এখনও আড্ডায় বসেন, কুশলের কথা হয় কখনও, সবাই উদাস হয়ে যান।
আজ তেমনই এক সকাল। কিন্তু আজকের সকাল ওদের নিস্তরঙ্গ জীবনে ছন্দপতন নিয়ে এল। বাণীকান্তর বাড়িতে ল্যান্ডফোন ঝনঝন করে বেজে উঠল। বাণীকান্ত একটু অবাক হলেন কারণ আজকাল কেউ আর ল্যান্ডফোন ব্যবহার করে না, এ আবার কে? উনি একটু ইতস্তত করে ফোন তুলতেই ওধার থেকে ভারি গলা ভেসে এল, ‘বুঢ়াগোহাঁই স্যাৰ নেকি? মই সদৰ থানাৰ পৰা হাতিকাকতিএ কইছোঁ। আপনি পলম নোকোৰাকে মেডিক্যালৰ মর্গত আহক। বাকি কথা তাত হবো। মই তালৈ গৈ আছোঁ।’ ওপারে ফোন রেখে দেওয়ার শব্দ হল।
বিমূঢ় বাণীকান্ত বুঢ়াগোহাঁইয়ের পায়ের নিচের মাটি সরে যাওয়ার অবস্থা। স্ত্রী প্রণতিকে ডাকলেন এবং কথাটা শুনে স্ত্রীর অবস্থাও তথৈবচ। প্রণতি বুদ্ধি করে তৎক্ষণাৎ জ্ঞানদা এবং শশধরবাবুকে ফোন করে ডাকলেন। ওরা দুজন এসে পৌঁছলেন মিনিটকুড়ি পর। সব শুনে জ্ঞানদাচরণ পাল্টা ফোন করলেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিস্তারিত জানার জন্য। অনিকেত বলে এক জুনিয়র ডাক্তার স্যারের ফোন পেয়ে জানাল যে, গতকাল রাতে একদল দুর্ধর্ষ আলফা ক্যাডারের সাথে পুলিশ এবং সিআরপি-র খণ্ডযুদ্ধ হয় এবং তাতে তিনজন আলফা নিহত হয়েছে। পুলিশ ডেডবডিগুলো হাসপাতাল মর্গে নিয়ে এসেছে। এদের মধ্যে একজনের চেহারা বাণীকান্তর দেওয়া ফটোর সাথে কিছুটা মিলে যাচ্ছে। তাই সন্দেহের উপশম করতে বাণীকান্তকে বিস্তারিত না বলে মর্গে যেতে বলা হয়েছে মৃতদেহ সনাক্ত করতে। ওর ছেলের বডি না হলে পুলিশ অন্য বেওয়ারিশ লাশের সাথে নথিভুক্ত করবে।
ফোন রেখে জ্ঞানদাচরণ নিজেকে কিছুটা সামলে নিলেন। তারপর বললেন, ‘ভয় কী? আমি আর শশধরও সঙ্গে যাব, তোমার ভয় কীসের? চলো ওখানে গিয়ে সব শুনব, চলো হে শশ, যেতে যেতে বাকি কথা হবে।’ বলে একরকম টেনে বাণীকান্তকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের দিকে গাড়ি ছোটালেন।
রাস্তায় বাণীকান্ত বিস্তারিত শুনলেন বন্ধুদের কাছে। স্থবির পাথরের মূর্তির গলা চিরে তীক্ষ্ণ আওয়াজ বেরিয়ে এল, ‘না! এটা কুশল হতে পারে না! আমাদের কুশল নিশ্চয় বেঁচে আছে, সে আমাদের এভাবে ছেড়ে যেতে পারে না।’ ওর পিঠে অনবরত হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন ওর কুটুম্ব শশধর চলিহা।
হাসপাতাল পৌঁছে বাণীকান্তর পা চলে না। কিছুতেই মর্গে ঢুকতে রাজি নন। শেষ পর্যন্ত জ্ঞানদাচরণ বললেন, ‘ঠিক আছে বাণী, আমি যাচ্ছি ভেতরে, তোমাদের যেতে হবে না, আমি এই হাসপাতালে জীবন কাটিয়ে দিয়েছি, আমার ভয় নেই, তোমরা বাইরে এই কোণে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি দেখে আসছি।’
শশধর আর বাণীকান্ত সেই থেকে সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে, সেই কোনায় একচিলতে ঘাসজমির ওপর দাঁড়িয়ে আছেন।
***
মর্গের ভেতরে ডা. জ্ঞানদাচরণ চক্রবর্তী কতক্ষণ যে দাঁড়িয়েছিলেন তা মনে করতে পারেন না। মরাকাটা ডোম পুলিশ অফিসার হাতিকাকতির নির্দেশে ডেডবডির ওপর থেকে কাপড়ের ঢাকা সরিয়ে দিয়েছিল আর জ্ঞানদাচরণ একদৃষ্টে তাকিয়েছিলেন শবদেহের দিকে। পুলিশ অফিসার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে তিনি ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন এপাশ ওপাশ, মানে নেতিবাচক।
অফিসার বলল, ‘ভাল করে দেখে নিন, তারপর বলুন।’
জ্ঞানদাচরণ স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, ‘অফিসার, আমার হাতে কুশলের জন্ম, ওর নাড়ি আমি কেটেছি আর আমি ভুল করব? বাণীকান্ত আমার ভাই আর কুশল আমার ছেলের থেকে কম নয়। তাছাড়া কুশলের হাতে ট্যাটু করে ইংরেজি k অক্ষর আছে আর এর হাত রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত। এই হাতে কোনও ট্যাটু আছে কি না তা জানার আমার দরকার নেই। আমি শুধু দায়িত্ব নিয়ে বলছি এ যেই হোক, আমাদের কুশল নয়। আমি যাচ্ছি।’ বলে জ্ঞান ডাক্তার বেরিয়ে এলেন মর্গ থেকে। পেছন থেকে পুলিশ অফিসার আর একবার হাঁক দিল, ‘তাহলে একে বেওয়ারিশ বলে ঘোষণা করে দিচ্ছি।’
ডাক্তার চেঁচিয়ে জবাব দিলেন, ‘আপনারা যা ইচ্ছা করুন।’
যখন উপরের সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এলেন জ্ঞানদাচরণ, তখন সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে তার পাশে একচিলতে ঘাসজমিতে বাজপড়া গাছের মত কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাণীকান্ত, পাশে শশধর। পেছন থেকে এসে জ্ঞানদাচরণ পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘আমি কী বলেছিলাম বাণীকান্ত? ও আমাদের কুশল হতেই পারে না। আরে, কুশল কোঁয়ারের নামের সাথে মিলিয়ে যার নাম রেখেছি আমরা, সে কি এভাবে মরতে পারে? চলো ঘরে চলো, বউ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।’
অবাক আনন্দে বাণীকান্ত ধরাগলায় বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ঠিক দেখেছ, ও আমাদের কুশল নয়?’
‘তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো ভাই, আমার ওপর যদি ভরসা থাকে।’ জ্ঞানদাচরণ আশ্বস্ত করলেন।
আনন্দে কেঁদে ফেললেন বাণীকান্ত বুঢ়াগোহাঁই। ‘এখুনি প্রণতিকে জানাতে হবে।’ বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করলেন।
‘আগে গাড়িতে উঠো, চলো হে শশ, বাড়ি যাই।’ ডা. জ্ঞানদাচরণ পার্কিংয়ের দিকে এগোলেন।
শশধর চলিহা আর বাণীকান্ত বুঢ়াগোহাঁই দুই বন্ধু আবার দুই বেহাই পরম নিশ্চিন্তে এগোলেন গাড়ির দিকে। পেছন ফিরে দেখলে দুজনে দেখতে পেতেন ডা. জ্ঞানদাচরণ চক্রবর্তী আকাশের দিকে দুহাত জোড় করে নমস্কার করে ঈশ্বরকে বলছেন, ‘প্রভু! আমাকে ক্ষমা করো। একটা মেয়ে রোজ স্বামীর মঙ্গলকামনা করে সিঁথিতে সিঁদুর দিচ্ছে, দিক না, আমি কেন কেড়ে নেব! একটা মা ছেলের ফেরার অপেক্ষায় থাক না, কোনও ক্ষতি তো হচ্ছে না তোমার সংসারের! একটা বউ যদি ওর স্বামী একদিন ঘরে ফিরে আসবে এই বিশ্বাসে বছর বছর আশা নিয়ে অপেক্ষা করে তবে তার সেই ভরসা থাক না। থাক না এক পুত্রহারা বাপের বিশ্বাস যে, ছেলে ঠিক একদিন ফিরে আসবে। একটা ছোট্ট মিথ্যা যদি কারও বাঁচার পাথেয় হয়, তবে তোমার সংসারে তো কোনও ক্ষতি হবে না।’