আমি কিংবদন্তির কথা বলছি
ভারতবর্ষ, পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশে প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীর অভাব নেই। পশ্চিমবঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের নায়িকারা কী অসামান্য অভিনয়ের নিদর্শন রেখেছেন, তবু সুচিত্রার মত হৃদগত করে কোনও অভিনয়শিল্পীকে নেয়নি তাঁর ছবির প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরের দর্শকেরা। দেবিকারানী, কাননদেবী, সন্ধ্যারানী, ছায়াদেবী, যমুনা বড়ুয়া, বিনতা রায়, স্মৃতিরেখা বিশ্বাস তাঁদের অবিস্মরণীয়তা ম্লান হতে দেননি আজও কিন্তু স্বপ্নের নায়িকা তাঁরা কেউ হতে পারেননি। ঢাকায় কত যে সেলুন ছিল একসময় ‘সুচিত্রা’ নামে, যেখানকার সাইনবোর্ডে লেখা থাকত ‘এখানে উত্তমরূপে চুল ছাঁটা হয়’! ছবির জগৎ থেকে স্বেচ্ছানির্বাসন নেবার পর তিনি বহির্জগৎ থেকে অন্তরালবর্তিনী হলে তাঁকে নিয়ে টানা পঁয়ত্রিশ বছরে লক্ষ গল্পকথা, পরীকথা তৈরি হয়েছে। অনিচ্ছুক বিবাহে জড়িয়ে পড়ে মাত্রই পনের বছর বয়সে তাঁকে কলকাতায় চলে আসতে হয়। পরে মাত্রই একবার সুযোগ হয়েছিল তাঁর ইছামতী-পদ্মার যুগ্মতার প্রশ্রয়ধন্য পাবনায় আসার। তারপরে তো ১৯৪৭-এর দেশভাগ, যে জন্য তাঁর বাবামাভাইবোন সবাইকেই পাবনা ছাড়তে হয়। পদ্মা আর ইছামতী, যেন রবীন্দ্রনাথ আর বিভূতিভূষণের দ্বৈততায় নির্মিত কিংবদন্তি তিনি। দ্বৈততা তো জীবনভরই লক্ষ্যণীয় তাঁর মধ্যে। হতে চেয়েছিলেন সঙ্গীতশিল্পী, হলেন অভিনেত্রী। দাম্পত্য আর বিচ্ছেদ, প্রবল জনপ্রিয়তা আর ব্যবসায়ী স্বামীর সঙ্গে নিয়ত সংঘাত, তারকার উচ্ছলতা আর অধ্যাত্ম-এষণা, বৈপরীত্যে ভরা তাঁর ব্যক্তিজীবন।
গ্রেটা গার্বোর সঙ্গে বেশ কিছু মিল রয়েছে সুচিত্রার। দুজনেই দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছেন যথাক্রমে ‘Two Faced Woman’ (১৯৪১) আর ‘উত্তর ফাল্গুনী’-তে (১৯৬৩)। দুই অভিনেত্রীকেই ছবিদু’টিতে নাচতে হয়েছে। অবসরগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেবার পর গার্বোর কাছে প্রস্তাব আসে মার্শেল প্রস্ত-এর ধ্রুপদী উপন্যাস ‘Remembrance of Things Past’ ছবিতে অভিনয়ের, তেমনি সুচিত্রাকে নিয়ে টলস্টয়ের ক্লাসিক সৃষ্টি ‘Ressurrection’-এর ছায়া অবলম্বনে ছবি করবার কথা ভেবেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। স্বভাবতই তা বাস্তবায়িত হয়নি। গার্বো ও সুচিত্রা দুজনেই ছবি করতে এসেছিলেন অল্পবয়সে, তাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি কারওই। দুজনের কেউই সাক্ষাৎকার দেওয়া একেবারেই পছন্দ করতেন না। গার্বোর কাছে যুক্তিটা ছিল এরকম, ‘I feel able to express myself only through my roles, not in words, and that is why I try to avoid talking to the press.’ শোনা যায়, একবারমাত্র তিনি সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সুচিত্রার অনীহা, এ ব্যাপারে, প্রকৃত প্রস্তাবে অব্যাখ্যাত। কচ্চিৎ দু-একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তিনিও। সুচিত্রা দিতেন তবুও, গার্বো অটোগ্রাফ পর্যন্ত দিতেন না কাউকে, যোগ দিতেন না কোনও ছবির প্রিমিয়ারে, চিঠি লিখতেন না ফ্যানদের। চিঠি এলে পড়েও দেখতেন না। গার্বোর দেশ সুইডেন ভোলেনি গার্বোকে, সুচিত্রার জন্মস্থান পাবনা তথা বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশও ভোলেনি সুচিত্রাকে। আরও এক সমাপতন ৬ এপ্রিলকে নিয়ে— ওইদিন সুচিত্রার জন্মদিন, আর ২০১১-র ৬ এপ্রিল সুইডিশ সরকার ঘোষণা দেয় গার্বোর ছবি থাকবে সুইডেনের ১০০ ক্রোনার নোটে।
সুচিত্রার ব্যক্তিজীবন এমন গোপনতায় আচ্ছন্ন ছিল যে, শুধুমাত্র কল্পনা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না আমাদের। তাঁর লেখা চিঠি, তাঁকে লেখা চিঠি, হয়তো আছে, তবে জীবৎকালে তা লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে। দুই সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী এবং গোপালকৃষ্ণ রায়ের কাছে তিনি অতীব অন্তরঙ্গ ছিলেন। তাঁরা দুজনেই তাঁদের বইয়ে তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন কিন্তু সে গ্রন্থপাঠে সুচিত্রা সম্পর্কে যতটা ওয়াকিবহাল হওয়া যায়, তাঁর সম্পর্কে রহস্য আর ধোঁয়াশা তৈরি হয় আরও বেশি। বছরের পর বছর দেখে, তাঁর সঙ্গে কুড়ি বছরের ওপর অন্তরঙ্গতা সত্ত্বেও গোপালকৃষ্ণ এটুকুই জানাতে পারেন যে মুনমুন জন্মাবার আগে সুচিত্রার একটি পুত্রসন্তান হয়েছিল, বাঁচেনি। গোপালকৃষ্ণকে দেওয়া একটি একান্ত সাক্ষাৎকার রয়েছে সুচিত্রার আজও অপ্রকাশিত। যদি কোনওদিন তা প্রকাশ পায়, হয়তো সুচিত্রার জীবনের লৌহযবনিকা ঘুচবে। চলচ্চিত্র থেকে সরে আসার যথার্থ কারণ কী, সে বিষয়েও নীরব সুচিত্রা। সুচিত্রার ঘরে যামিনী রায়ের ছবি ছিল, তবে মেয়ে মুনমুনকে চিত্রশিল্পী বানানোর অভীপ্সায় তাকে পরিতোষ সেনের মত শিল্পীর ছাত্রী বানালেও সুচিত্রার শখ ছিল ছবিতে নয়, বাগান নির্মাণে।
তিনি আবালবৃদ্ধবনিতা বাঙালির একাধারে সুদূর, অন্যদিকে একান্ত নিকটজন। উত্তমকুমারের সঙ্গে মনোমালিন্যে দার্জিলিং থেকে শুটিং ফেলে (সেখানে আউটডোর ছিল ‘শিল্পী’ ছবির) স্বামীকে নিয়ে কলকাতা চলে আসেন, আর এজন্য ছ’মাস বন্ধ থাকে এ ছবির চিত্রায়ন। সত্যজিৎ রায়ের ছবি প্রত্যাখ্যান করেন, কেননা সত্যজিৎ শর্ত দিয়েছিলেন, ‘দেবী চৌধুরানী’ করার সময়পর্বে তিনি অন্য কোনও ছবিতে অভিনয় করতে পারবেন না। বাংলা ও হিন্দিতে যথাক্রমে ‘উত্তর ফাল্গুনী’ আর ‘মমতা’-র পরিচালক ছিলেন অসিত সেন। তাঁকে তিনি নির্দ্বিধায় ‘স্কাউড্রেল’ বলে দিতে পারেন। আবার তিনিই অসুস্থ ঋত্বিক ঘটককে অর্থসাহায্য করেন গোপনে। ১৯৬৩-তে মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা নায়িকার পুরস্কার পান তিনি, যেখানে আবার সত্যজিৎ রায়ই জুরির আসনে! কেবল তাই নয়, জুরি মহাশয় কলকাতায় ফিরে সুচিত্রার রিসেপশন পার্টিগুলোতেও সস্ত্রীক গিয়েছেন। তাঁর মনের আরাম, আত্মার শান্তি ছিল বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দের উত্তরসূরিদের সান্নিধ্যে। সেখানকার মহারাজের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। রামকৃষ্ণ-সারদামা থাকতেন তাঁর নিয়ত অনুধ্যানে। পাশাপাশি বীরভূমের শক্তিপীঠ কঙ্কালীতলায় যেতেন তিনি, যেতেন কালীঘাটের কাছে এক পিরসাহেবের কাছেও।
না, এসবের মধ্যে কিংবদন্তি নেই, আছে অন্যত্র। আজও কলকাতা হাইকোর্টের এগারো নম্বর রুম অপরিবর্তিত রেখে দেওয়া হয়েছে, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর। ‘উত্তর ফাল্গুনী’-র বিচার দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছিল এখানে। পরবর্তীকালে এখানে আর কোনও চলচ্চিত্রের দৃশ্যগ্রহণের অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি। মা ও মেয়ের দ্বৈত চরিত্রে এখানে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। মা-রূপিণী পান্নাবাইয়ের মৃত্যুদৃশ্যটিও তোলা হয়েছিল এখানে। পরিচালক ছবিতে অনেকানেক আইনজীবীকেও কোর্ট দৃশ্যে উপস্থিত দেখান। জুরিদের বসার জায়গাসমেত সমস্ত সেশনস কোর্টটিকে হুবহু একই আসবাবসমন্বিত রেখে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাস ও কিংবদন্তির মিতালি, নয়?
তুমি কি কেবলি ছবি?
ছবি করেছেন তিনি কমবেশি ষাটটি। তার মধ্যে সাতটি হিন্দিতে, বাকিগুলি বাংলায়। ১৯৫৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর যে ছবিটি প্রথম রিলিজ হয়, সুকুমার দাশগুপ্ত পরিচালিত সে ছবির নায়ক সমর রায়। এ ছবিতে ছিলেন উত্তমকুমারও, অরুণকুমার নামে। এর আগে তাঁর যে ছবিটির কথা জানতে পারি আমরা, তার নাম ‘শেষ কোথায়’। সেটি কোনওদিন প্রদর্শিত হয়নি। তাঁর শেষ যে ছবিটি মুক্তি পায়, সে ছবির নাম ‘প্রণয় পাশা’। ছবিটির মুক্তির তারিখ ৯ জুন ১৯৭৮। ছবির নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মোট তিপ্পান্নটি বাংলা আর সাতটি হিন্দি, এই মোট ষাটটি ছবিতে অভিনয় করেন পঁচিশ বছরব্যাপী অভিনয়জীবনে। সুচিত্রার বিপরীতে বাংলা ছবিতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রধান উত্তমকুমার। মোট তিরিশটি ছবিতে উত্তমকুমার সুচিত্রার নায়ক। সুচিত্রার বিপরীতে বিকাশ রায় করেন সাতটি ছবি, বসন্ত চৌধুরী চারটি ও সৌমিত্র চট্টোপ্যাধায় তিনটি। সমর রায়, রবীন মজুমদার, প্রশান্তকুমার, দীপক মুখোপাধ্যায়, অশোককুমার, রঞ্জিত মল্লিক, শমিত ভঞ্জ এবং উৎপল দত্তের সঙ্গে তাঁর ছবি একটি করে। ‘কাজরী’ ছবিটি ছিল নায়কবর্জিত। যে সাতটি হিন্দি ছবি করেন, তার মধ্যে দু’টিতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন দেব আনন্দ (‘বোম্বাই কা বাবু’, ১৯৬০) ও (‘শারহাদ’ ১৯৬০)। ‘দেবদাস’-এ (১৯৫৫) দিলীপকুমার, ‘মুসাফির’ (১৯৫৭), ‘চম্পাকলি’ (১৯৫৭), ‘মমতা’ (১৯৬৬) আর ‘আঁধি’ (১৯৭৪)-তে যথাক্রমে শেখর, অশোককুমার, ধর্মেন্দ্র ও সঞ্জীবকুমার।
পরিচালকদের মধ্যে অজয় কর তাঁকে নিয়ে করেছেন ছ’টি ছবি, অগ্রদূত (বিভূতি লাহা) ওই একই সংখ্যক। সুকুমার ভট্টাচার্য তিনটি, নীরেন লাহিড়ী, দেবকীকুমার বসু, বিজয় বসু, পিনাকী মুখোপাধ্যায় আর সুশীল মুখোপাধ্যায় দু’টি করে ছবি করেন। অসিত সেনও বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে তিনটি। হরিসাধন দাশগুপ্ত, সলিল সেন, দীনেন গুপ্ত, মঙ্গল চক্রবর্তী, হীরেন নাগ, নির্মল দে, নরেশ মিত্র, চিত্ত বসু ও বেশ কিছু অখ্যাত পরিচালক একটি করে। সত্যজিৎ রায়, রাজ কাপুর, ঋত্বিক ঘটক ইচ্ছে থাকলেও সুচিত্রাকে নিয়ে ছবি করতে পারেননি। পুর্ণেন্দু পত্রী ‘চতুরঙ্গ’ শুরু করেছিলেন, কিন্তু তাঁর শুটিং শুরু হওয়ার তিনদিনের মাথায় প্রযোজক হেমেন গঙ্গোপাধ্যায় সুইসাইড করায় সুচিত্রার রূপায়ণে রবীন্দ্রনাথের দামিনীকে দর্শকরা আর দেখতে পেল না। সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’-ও করবেন তাঁকে নিয়ে, কথা ছিল। নানা কারণে হয়নি। বহু বছর (আসলে ‘পথের পাঁচালী’ করারও আগে থেকে এ ছবি করার ইচ্ছে ছিল তাঁর) পরে, তাঁর পরিচালকজীবনের প্রায় অন্তিমে সে ছবি করলেন সত্যজিৎ, কিন্তু ১৯৮৩-৮৪-তে সে ছবি তোলা হয় যখন, সুচিত্রা স্বভাবতই বিমলা রূপায়িত করবার চেহারায় নেই। জীবনে রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসের চরিত্রে অভিনয় করা হয়নি তাঁর। ‘চতুরঙ্গ’-এর দামিনী চরিত্রটি করার জন্য তিনি এতটাই প্রলুব্ধ ছিলেন যে তাঁর বিশেষ বন্ধু সাংবাদিক, রবীন্দ্র-অনুধ্যায়ী এবং ছড়াকার অমিতাভ চৌধুরীকে তিনি উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিতে বলেছিলেন, মঞ্চে অভিনয় করবেন তিনি। এমনিতে কোনওদিনই মঞ্চাভিনয়ে আগ্রহ দেখাননি তিনি। অমিতাভ চৌধুরী নাট্যরূপ দেননি শেষ পর্যন্ত, তাই দামিনী চরিত্র রূপায়ণ চির আকাঙ্ক্ষিতই থেকে গেল তাঁর। অন্যদিকে সত্যজিতের পরিচালনায় না করলেও দীনেন গুপ্ত তাঁকে নিয়ে করেছিলেন ‘দেবী চৌধুরানী’। স্বস্তি ছিল তাতে সুচিত্রার?
সেসময়ের তরুণ মজুমদার, পার্থপ্রতিম চৌধুরী, মৃণাল সেন, ইন্দর সেনরা তাঁকে নিয়ে ছবি করার ভাবেননি, ভাবতে অবাক লাগে। বাংলাদেশেও ছবির সূত্রে তাঁর কোনও যোগাযোগ হয়নি, এও একটু অদ্ভুত ব্যাপার। বিশেষ করে ’৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ তাঁকে কি ছবি করতে আহ্বান জানায়নি, না ছবি করতে রাজি হননি তিনি?
তপন সিংহ কিন্তু তাঁর লেখায় সুচিত্রা-প্রশস্তি যথাযথভাবে করে গিয়েছেন। কেবল তাই নয়, তাঁর লেখায় তিনি সত্যজিৎ রায়ের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে এমন একটি তথ্যের সর্বাতিশয় প্রমাণ করেছেন, যাতে উত্তম-সুচিত্রা জুটির ঐতিহ্য প্রতিযোগিতাহীন হয়ে পড়ে। তপন সিংহ লিখছেন, ‘বাঙালিদের ঘরে ঘরে উত্তম-সুচিত্রার নাম। সত্যজিৎবাবু বলতেন, এত বড় রোমান্টিক জুটি পৃথিবীতে হয়নি।’ এ প্রসঙ্গে তপন সিংহ হলিউডের দু’টি ছবি ‘রোমান হলিডে’ আর ‘সাউন্ড অফ মিউজিক’-এর উল্লেখ করেন। লেখকের মতে, ছবিদু’টি পৃথিবীর অন্যতম সেরা রোমান্টিক ছবি। তারপর তপন সিংহের সংযোজন, ‘দুটোই কালজয়ী সৃষ্টি। কিন্তু উত্তম-সুচিত্রার মত জুটি এতদিন ধরে মানুষকে আনন্দ দিয়েছিল, পৃথিবীর কোনও রোমান্টিক জুটি এতদিন স্থায়ী হয়নি।’
ছবির নায়িকা হিসেবে উত্তমকুমারের নাম সুচিত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তবু কিন্তু তাঁর সৌভাগ্যলিপির যথার্থ পাঠ নিতে যাঁর নাম নিতে হবে, তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিৎ রায়ের এই একান্ত পছন্দের অভিনেতার বিপরীতে ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে অভিনয় করেই মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর শিরোপা পান তিনি। তবে তার আগে দেবকীকুমার বসুর ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ ছবিটির জন্যও বিদেশে প্রশংসিত হয়েছিলেন সুচিত্রা। আবার, উত্তমকুমারের সঙ্গে সুচিত্রার ‘সাগরিকা’ সবচেয়ে বেশিদিন চলেছিল, ২৪ সপ্তাহ। অন্যদিকে সুচিত্রা-সৌমিত্র অভিনীত ‘দত্তা’ চলেছিল ২৩ সপ্তাহ। তাই অন্তত এ ক্ষেত্রে সৌমিত্র ছিলেন উত্তমকুমারের নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী। ‘দত্তা’ এক অর্থে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ (১৯৫৩, ৮ সপ্তাহ), ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪, ১৫ সপ্তাহ), ‘শাপমোচন’ (১৯৫৫, ১১ সপ্তাহ), ‘হারানো সুর’ (১৯৫৭, ১২ সপ্তাহ), ‘সপ্তপদী’ (১৯৬১, ১৫ সপ্তাহ), ‘গৃহদাহ’ (১৯৬৭, ১৫ সপ্তাহ) ছবিগুলিকে হারিয়ে দেয়।
তবে হ্যাঁ, অন্য একটি হিসেবও রয়েছে। উত্তম-সুচিত্রার ছবিগুলি প্রেক্ষাগৃহে বারবার মুক্তি পেয়েছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, বছরের পর বছর পাড়ায় পাড়ায় সামিয়ানা টাঙিয়ে ১৯ পয়সার বিনিময়ে যে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা ছিল বিশেষ করে ১৯৭৫-এর কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের প্রাক-দূরদর্শনের যুগে, সেখানে উত্তম-সুচিত্রার ছবি প্রদর্শিত হত বেশুমার। তারপর যখন দূরদর্শন এল, এল হরেক স্যাটেলাইট চ্যানেল, এঁদের ছবির জনপ্রিয়তা যে কোন উত্তুঙ্গতা স্পর্শ করল এবং করে চলেছে, তা রীতিমত গবেষণার বিষয়।
কী এমন রসায়ন চেহারা, অভিনয়, কাহিনির বিষয়বস্তু, সঙ্গীত আর দেশীয় ঘরানা মিলিয়ে, যার জন্য জনপ্রিয়তার শীর্ষে তিনি। এমন একটা সময়ে সুচিত্রা বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে আসেন, নানাদিক থেকেই যে সময়টি ছিল ক্রান্তিকাল ও একই সঙ্গে তাৎপর্যবাহী। এই উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেনের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা, ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম যুগের স্বনামখ্যাত চিত্রপরিচালক বিমল রায়ের সঙ্গে (বিমল রায় ‘দেবদাস’ ছবিতে পার্বতীর ভূমিকার সুচিত্রাকে অভিনয় করিয়ে তো অবিস্মরণীয় করে গেছেন তাঁকে) কিংবা সুখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী, যাঁকে রেনেয়ার ছবি ‘The River’-এ ক্যামেরাম্যান হিসেবে দেখা গেছে, সেই রামানন্দ সেনগুপ্তের সঙ্গেও যে সুচিত্রার আত্মীয়সম্পর্ক, এতসব সমাপতন মিলিয়েও আমরা ব্যাখ্যা করতে অক্ষম কেন সুচিত্রা চলচ্চিত্রে আবির্ভাবের প্রায় শুরু থেকে অভিনেত্রী হিসেবে স্থায়ী আসনটি করে নিতে পারলেন। এর পেছনে যে ঐতিহাসিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক কার্যকারণগুলি ক্রিয়াশীল ছিল, আমরা সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি।
বিষয় চলচ্চিত্র: আজ কাল পরশুর গল্প
বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নির্বাক ও সবাক যুগের কালপর্বে নিউ থিয়েটার্সের ঐতিহ্য ও সংকল্পের অবসানে ১৯৪৭-এ, অর্থাৎ স্বাধীনতার বছরেই সত্যজিৎ রায়, হিরণকুমার সান্যাল, চিদানন্দ দাশগুপ্ত প্রমুখ প্রতিষ্ঠা করেন ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’। ১৯৫০-এ তাদের মুখপত্র বেরোল, ‘চলচ্চিত্র’। বিদেশি ছবি দেখার সুযোগ এর ফলে উন্মুক্ত হল। ৫২-তে অনুষ্ঠিত হল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, এ দেশে প্রথম কলকাতায়। সত্যজিৎ এ বছরেই শুরু করেন ‘পথের পাঁচালী’-র কাজ, যা মুক্তি পায় ১৯৫৫-তে। প্রাক ’৪৭ বাংলা চলচ্চিত্র যেসব পরিচালক-প্রযোজক-অভিনেতাঅভিনেত্রীর দ্বারা মূলত প্রভাবিত হত, তাঁরা স্থানচ্যুত হচ্ছিলেন ক্রমশ। বিশ শতকের প্রথম চল্লিশ বছর ছিল নির্বাক ছবির যুগ। প্রথম সবাক ছবি নির্মিত হয়েছিল ১৯৩৯-এ, তবু এরপরেও নির্বাক ছবির পর্যায় পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। কেবল বাংলায় নয়, অখণ্ড বাংলাদেশে তৈরি নির্বাক ছবি গোটা উপমহাদেশেই জনপ্রিয় ছিল, কেননা ছবিগুলিতে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু প্রভৃতি সাবটাইটেল থাকত। সেসময় ‘নিউ থিয়েটার্স’ ছিল ভারতবর্ষব্যাপী সম্ভ্রান্ত চিত্রনির্মাণ সংস্থা। দেবকীকুমার বসু, নীতিন বসু, হেমচন্দ্র, অমর মল্লিক, মধু বসু, প্রমথেশ বড়ুয়া প্রমুখ পরিচালকদের হাতে তৈরি হচ্ছিল পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও কচ্চিৎ কিছু কিছু সামাজিক ছবি। সতু সেন, তিনকড়ি চক্রবর্তী, জ্যোতিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ পরিচালকও ছিলেন। একইসঙ্গে বাণিজ্যসফল এবং শিল্পসম্মত ছবি তৈরির খ্যাতি ছিল এসব পরিচালকের। বিদেশ থেকে চিত্রবিদ্যা শিখে আসার প্রবণতা হীরালাল সেন, দাদাসাহেব ফালকের মত চলচ্চিত্রপরিচালনার পথপ্রদর্শকদের সময় থেকেই ছিল, পরবর্তীকালে প্রমথেশ-সতু সেনরা এই ধারা অক্ষুণ্ণ রাখেন। ফিল্ম রিয়ালিটি নিয়ে এলেন বিমল রায় তাঁর ‘উদয়ের পথে’ ছবিতে। তাঁর ‘দো বিঘা জমিন’, খাজা আহমদ আব্বাসের ‘ধরতী কি লাল’ (৫০-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে তোলা), নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ ছবির মাধ্যমে বাংলা ও হিন্দি ছায়াছবি সাবালকত্ব অর্জন করতে থাকে।
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে প্রথম যুগে ছিলেন চারু রায়, হিমাংশু রায়, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশ মিত্র, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, জীবেন বসু, ইন্দুবালা, প্রভা দেবী, পদ্মা দেবী, দেবিকারানী, চন্দ্রাবতী দেবী, মলিনা দেবী, কানন দেবী প্রমুখ।
যুগসন্ধিক্ষণ। সত্যজিৎজায়া বিজয়া রায় ছবি করছেন বম্বে গিয়ে, সে-ছবির প্রদর্শনীতে সদ্যবিবাহিতা বিজয়ার আহ্বানেও উপেক্ষা দেখাচ্ছেন ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে ছবি করার ভাবনায় আচ্ছন্ন সত্যজিৎ। অথচ ছবির পরিচালক সত্যজিতেরই কাকা নীতিন বসু।
সদ্যস্বাধীন দেশ তখন সংস্কৃতির যাবতীয় অঙ্গনেই নতুনের সন্ধান করছিল। নাটক, কথাসাহিত্য, চিত্রকলায় লেগেছে নতুন জোয়ার। সমান্তরালভাবে ঢাকাতেও নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে। সুচিত্রা সেনের আবির্ভাব স্বভাবতই ছিল ইতিহাসের গতিপথে অবধারিত ও স্বাভাবিক।
এই বন্দীই আমার প্রাণেশ্বর…
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন সমবেতভাবে এবং পাশাপাশি স্বতন্ত্রতা নিয়ে অনন্য। ঋত্বিক ঘটক সুচিত্রা সেনকে নিয়ে কী উত্তুঙ্গ মন্তব্য করেছেন দেখা যাক। ‘রমা একটা বিরাট উঁচুতে উঠে গেল তার নিজের বেছে নেওয়া পথে।… এটা জানি রমা তার সমস্ত সম্ভাবনা পূর্ণ করে এখন, এখনই একমাত্র, গর্বিতা রানীর মত স্বপ্রকাশ ক্ষমতা অর্জন করেছে। এখন যা করবে, যদি করে, এবং যদি তেমন পরিচালকের হাতে পড়ে, ফাটাবে। … একমাত্র এই মেয়েটিরই আছে প্রাণান্ত সাধনা করে সেই প্রাতঃস্মরণীয় স্মৃতি মনে পড়িয়ে দেবার।’ এই প্রাতঃস্মরণীয় স্মৃতি প্রভা দেবীর। [প্রভা দেবীর অভিনয় প্রতিভা সম্পর্কে শোভা সেন লিখছেন, ‘তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ছিলেন, একথা অনেক বিদগ্ধজন বলে গিয়েছেন।… একমাত্র পূর্ব জার্মানির ব্রেশট-এর স্ত্রী শ্রীমতী হেলেনেভাইগেল-এর অভিনয় দেখে আমার মনে হয়েছিল, অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীকে দেখেছি। ভাইগেল সম্পর্কে উৎপল দত্ত: The first lady of the world theatre.] অতএব স্বভাবতই স্বতন্ত্র সুচিত্রা।
আমরা এর সঙ্গে উত্তমকুমারের স্বতন্ত্রতা, অনন্যতার খোঁজ নেব। সত্যজিৎ উত্তমকুমারকে মাথায় রেখে ‘নায়ক’ ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। ‘নায়ক’ ছবিতে পরিচালকের ত্রুটি পরে অস্বস্তিতে ফেলেছিল সত্যজিৎকে, কিন্তু উত্তমকুমার তাঁর অভিনয়ে ষোল আনা পারফেক্ট, মন্তব্যটি স্বয়ং সত্যজিতের। যে রাতে উত্তম প্রয়াত হন, স্ত্রী বিজয়া রায়ের কাছে তাঁর আক্ষেপোক্তি, ‘ওঁকে আরও কিছু ছবিতে ব্যবহার করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তা আর হল কই!’
এই সুচিত্রা, এই উত্তম— দু’জনে নায়ক-নায়িকা হিসেবে যে তিরিশটি ছবিতে অভিনয় করলেন, বাংলা সিনেমার ইতিহাসে নান্দনিকতার অন্যতর মাত্রা যোগ করল সে-সব ছবি। তাঁরা যখন সিনেমা জগতে জাঁকিয়ে বসেছেন, ভারতীয় ও বিশ্ব চলচ্চিত্র ততদিনে স্টার সিস্টেমের জন্ম দিয়ে ফেলেছে। এর পেছনে সক্রিয় ছিল পুঁজিবাদের নিজস্ব যাত্রাপথ। পুঁজিবাদের অন্তিমপর্বে বিনোদনের ব্যাপক আয়োজন নিয়ে এল দূরদর্শন। উত্তম-সুচিত্রার তারকা হয়ে ওঠা ছিল আসলে পুঁজিবাদ বিকাশেরই সমরেখায় অবস্থিত।
মোট ষাটটি ছবি করেন সুচিত্রা, যার মধ্যে উত্তম ছিলেন অর্ধেকসংখ্যক ছবিতে তাঁর বিপরীতে। পুঁজিবাদের অভিযাত্রায় সঙ্গীত, শিল্পকলা ও অন্যান্য কলামাধ্যম যেমন চরিত্রগতভাবে পাল্টে গেল বিশেষ করে বৈষয়িক তথা আর্থিক দিক থেকে, চলচ্চিত্রশিল্পও তেমনি বদলাল। এর ফলে প্রতিযোগিতা বাড়ল সব ক্ষেত্রেই। চলচ্চিত্র বিনোদনের মাধ্যমে পরিণত হতে শুরু করল, যা চলচ্চিত্রসাধনার দিকপালদের অণ্বিষ্ট ছিল না।
আমরা সুচিত্রার চলচ্চিত্রজয়ের আয়ুধ হিসেবে এক অপার সৌন্দর্যময়ী নারীর রূপকে প্রধান বলে বিবেচনা করতে চাই, যে রূপ আবার নৃতত্ত্বের দিক থেকে বাঙালিমানসের নন্দনপরিসীমার কেন্দ্রে। তাঁর সৌন্দর্য একাধারে মানবী, আবার যুগপৎ প্রত্নপ্রতিমা যেন তিনি, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। নারীপুরুষনির্বিশেষে তাঁর সৌন্দর্যে বিমোহিত, ফলে সহজেই প্রমাণ করা যায়, লাবণ্য, কিটস যাকে বলেছেন, Fine excess, আর ভারতীয় আলঙ্কারিকেরা যাকে বিবেচনা করেন মুক্তাফলের আভা বলে, সুচিত্রার সৌন্দর্যের পরিচায়িকা। লাবণ্য, যৌনতা নয়।
এই লাবণ্যে বাঁধা পড়লেন তাঁর অগণিত দর্শক, এবং তাঁর সহাভিনেতা উত্তমকুমার। স্পর্শকাতর, তবু দুঃসাহসী সুচিত্রার দাবি, ছবির ক্যাপশনে আগে তাঁর নাম থাকতে হবে, পরে উত্তমকুমারের। স্পর্ধাযোগ্য সুচিত্রার দ্বিতীয় দাবি, উত্তমের চেয়ে তাঁকে সম্মানদক্ষিণা বেশি দিতে হবে। তার পরেও, ‘শিল্পী’ ছবির আউটডোরে দার্জিলিং গিয়ে সুচিত্রার ইচ্ছে বিঘ্নিত হয়েছিল বলে শুটিং মাঝপথে থামিয়ে তিনি কলকাতা ফিরে আসেন। দীর্ঘ ছ’মাস লেগেছিল সুচিত্রার ক্রোধ গলনাঙ্কে পৌঁছতে। দু-একবার তো বাক্যালাপ বন্ধ করে বসে আছেন সুচিত্রা, হ্যাঁ, উত্তমের সঙ্গে। অথচ পাশাপাশি তাঁদের রোমান্টিক দৃশ্য চিত্রায়িত হচ্ছে। এইসব একদিকে, অন্যদিকে উত্তমকুমার জানাচ্ছেন, সুচিত্রা না এলে উত্তমকুমার হতে পারতেন না। সুচিত্রার মস্কো-স্বীকৃতিতে তোড়া পাঠানোয় ত্রুটি হয় না উত্তমের। সুচিত্রাকে নায়িকা পেয়ে উত্তমের মন্তব্য, ‘‘তাঁর আগে তো অন্য নায়িকাদের সঙ্গে প্রেমের ডায়লগ বলতে গিয়ে মনের মধ্যে কোনও উত্তাপই বোধ করতাম না। এম পি প্রোডাকশনস্-এর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে সুচিত্রা সেন নামে এক নায়িকার সঙ্গে অভিনয় গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার নায়িকা এসে গিয়েছে।’’
এসব প্রমাণ করে দু’জনের সম্পর্কের টানাপোড়েন, সুচিত্রার অবচেতনায় উত্তমকে অধস্তন করে রাখার মানসিকতা, অন্যদিকে উত্তমের, না, ঠিক নতি বলব না একে, বিনতি। অথচ সাংবাদিকের নজর এড়ায় না যখন সুচিত্রা ফোনে উত্তমকে চুমু খান, একমাত্র তাঁরাই পরস্পরকে ‘তুই’ সম্বোধন করেন, আর চুয়ান্ন বছর বয়সে মৃত্যুতে ফুল দিতে এসে কান্নাভেজা গলায় সুচিত্রার উক্তি আর আক্ষেপ এই মর্মকথাই ব্যক্ত করে, এঁরা দু’জন পরস্পরের কী না হতে পারতেন (বা হয়েছিলেনই হয়তো!) উত্তম-সুচিত্রা যা, বাস্তব জীবনেও ভ্রম হত, এবং তাদের ভ্রমকে তাঁদের দর্শকরা জিইয়েও রাখতে চাইত যে, এঁরা স্বামী-স্ত্রী।
দু’জনের সম্পর্কের শৈথিল্যের প্রামাণ্যতা দেখানোর জন্য বলি, উভয়ের দ্বৈত অভিনয়ের তিরিশটি ছবির মধ্যে ১৯৫৩ থেকে ’৬০-এর মধ্যে যেখানে তৈরি হয়েছিল বাইশটি ছবি, পরবর্তী কুড়ি বছরে অর্থাৎ উত্তমকুমার প্রয়াত হলেন যেবার, সেই ১৯৮০-র সালতামামি অনুযায়ী তাঁদের যৌথ অভিনয়ের ছবি মাত্র আট। প্রযোজক-পরিচালকরা তো আরও বেশি মনোযোগী হবেন তাঁদের নিয়ে ছবি করতে, বিশেষ করে দু’জনেরই জনপ্রিয়তা বাড়ছিল যেমন, তেমনি অভিনয়দক্ষতায় বারবারই নিজেদের অতিক্রম করছিলেন এঁরা। দু’জনের সম্পর্কে চিড় ধরেছিল, ইগোর সমস্যা ছিল সুচিত্রার, কেউ কেউ এমত বলেন।
সুচিত্রার আগে নায়িকাদের ইতিহাস তো তাঁদের প্রতি তঞ্চকতা, বিশ্বাসহানি আর শোষণের ইতিহাস। সিনেমা, নাটকের পেছনে মেয়েদের আত্মত্যাগের মহিমা উজ্জ্বল হয়ে আছে বিনোদিনীর জীবনীপাঠে। আর্থিক শোষণ তো ছিলই, ছিল মানসিক এবং এমনকি শারীরিক হেনস্তার দীর্ঘ অরুন্তুদ ইতিবৃত্ত। ছবিতে, নাটকে পুরুষপ্রাধান্য থাকবে, এটা স্বতঃসিদ্ধ ছিল। সুচিত্রা এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। মাধবী মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়রা সুচিত্রার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই দিকটির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘বাংলা চলচ্চিত্রে আর্থিক কৌলীন্যের ধারাবাহিকতা নিয়ে এলেন তিনি।’ আর পুরুষসর্বস্বতার বিরুদ্ধে দ্রোহ। তাঁর অভিনয়শৈলী, দেশে-বিদেশে নানা পুরস্কার লাভ, এসবের তো যথার্থ মূল্যায়ন অপেক্ষিত হয়ে রইলই। এর বাইরে এই যে একক নারীবাদের লড়াই, যার ফল ভোগ করছে আজকের নারীপ্রজন্ম, তাঁকে যথাযথ মর্যাদা না দিলে বাংলা চলচ্চিত্র সুচিত্রার কাছে অপরাধী হয়ে থাকবে।
উত্তমকুমার যখন ব্যক্তি উত্তমকুমার, তখন তিনি তাঁর সুহৃদ, অন্তরঙ্গ, এমনকি বন্ধু। বন্ধু শব্দটি এখানে তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করা হল। শাস্ত্রে বলে, যার ত্যাগ, বিচ্ছেদ সহ্য করা যায় না, তাকে বলে বন্ধু, ‘অত্যাগসহনো বন্ধুঃ’। অন্যদিকে উত্তমকুমার যখন একটি প্রতিষ্ঠান, সামন্ততন্ত্রের প্রশ্রয়িত পুরুষ, তখন তাঁর বিরুদ্ধে সুচিত্রার লড়াই। এই লড়াই জারি থাকা সত্ত্বেও উত্তম যখন সুচিত্রার জেদের কাছে নত হন, তাতে উত্তমের মহানুভবতা যেমন প্রমাণিত হয়, ঠিক তেমনি ‘সুচিত্রা ছাড়া আমি উত্তম হতে পারতাম না’ উত্তমের এহেন বিনয়ী সুবাক্য পাঠ করে তার চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সুচিত্রার, সে সংলাপ বঙ্কিমচন্দ্রের কাছ থেকে ধার করে আমাদের উচ্চারণ করতে হবে, আয়েষা যা ওসমান সম্পর্কে বলেছিল, ‘এ বন্দী আমার প্রাণেশ্বর।’ এ বন্দিত্ব কল্পনীয়, ব্যাখ্যেয় নয়।
শেষের সেদিন
সুচিত্রা সেন প্রয়াত হন ১৭ জানুয়ারি ২০১৪ শুক্রবার সকাল ৮.২৫-এ, কলকাতার বেল ভিউ নার্সিং হোমে। বয়স হয়েছিল তিরাশি বছর। তারও তেত্রিশ বছর আগে বাংলা সিনেমার মহানায়ক উত্তমকুমারও একই নার্সিং হোমে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে প্রায় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর অভিনয় শেষে যেদিন সুচিত্রা চলচ্চিত্রজগৎকে বিদায় জানিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার ইচ্ছে করলেন এবং তিন যুগ ধরে অন্তরালবর্তিনী হয়ে থাকতে সফল হলেন, তাঁর মৃত্যুর পর অতি উৎসাহীদের তাঁকে শেষবারের মত দেখবার আকুলতার কাছে নতিস্বীকার করে তাঁর পরিবার সুচিত্রার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে শিথিলতা দেখিয়ে ফেলতে পারেন, এমন আশঙ্কা ছিল। ভাগ্যক্রমে তা হয়নি। ফলে, সুচিত্রার শেষকৃত্য অনন্য মাত্রা পেয়ে যায় শোক, গাম্ভীর্য, রাষ্ট্রীয় সম্মান, জনসাধারণের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং সর্বোপরি শৃঙ্খলাবোধের অনবদ্য প্রকাশে। ১৯৭৮ সালে যাঁকে শেষবারের মত শুটিংয়ে দেখা গেছে, তাঁকে নিয়ে কী অভাবিত আবেগ!
শুটিং শেষ হতে না হতেই ঘরে ফিরে যাওয়ার উদ্গ্রীব উৎকণ্ঠা থেকে নাকি সুচিত্রা বারবার বলতেন, ‘আমি বাড়ি যাব, আমি বাড়ি যাব’। মেয়েকে একাকী রেখে কোন বাড়িতে ফিরে গেছেন তিনি? তাঁর মৃত্যুর পর সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মেয়ে মুনমুন সেন বলেন, ‘‘সত্যিই মা আমাকে ‘একা’ করে দিয়ে গেলেন, একেবারে একা।’’ শাস্ত্রবিধি মেনে চার দিনের দিন শ্রাদ্ধকাজ সম্পন্ন করেছেন মুনমুন, বাড়িতে স্মরণসভার আয়োজনও করেছেন, মায়ের অস্থি বিসর্জন দিয়ে এসেছেন বারানসী গিয়ে। হ্যাঁ, তারপর তো এক নিঃসীম শূন্যতা অথচ তাঁর মৃত্যুতে এপার যেমন ওপার বাংলাও, না, শোকস্তব্ধ নয়, শোকমুখর। বাংলাদেশের রাজ্জাক আর এদেশের রঞ্জিত মলিক, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ববিতা, শংকরলাল ভট্টাচার্য আর নির্মলেন্দু গুণ তাঁকে নিয়ে অক্ষরের বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সুচিত্রার মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁকে নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখতে বসেছেন। দুই বাংলার মানুষ অশ্রুবেদনাসিক্ত আর্তির পরিপূরক হিসেবে দেখে নিয়েছেন সুচিত্রা অভিনীত চলচ্চিত্র, দুই বাংলার টিভি চ্যানেলগুলোর দৌলতে। মুখে মুখে গুঞ্জরিত হয়েছে সুচিত্রার অধরে ধৃত বিভিন্ন শিল্পীর গান: ‘কানে কানে শুধু একবার বলো, তুমি যে আমার’-ই হোক বা ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, অথবা ‘কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে…’। সৌমিত্র জানান, সত্যজিৎ-মৃণালের বহু ছবির অবধারিত নায়ক সৌমিত্র, ‘সুচিত্রা সেনের সৌন্দর্যের এমন একটি প্রভা ছিল, ক্যামেরার সামনে এমন একটি লাবণ্য ছিল যে, তাঁর সঙ্গে একই পর্দায় আসা বড় একটি ঘটনা ছিল নিঃসন্দেহে।’ ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘The Daily Star’ সুচিত্রার মৃত্যু বাদ ছাপে এরকম শিরোনাম দিয়ে, ‘Departure of a queen of million hearts’, অন্যদিকে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ স্তব্ধতার নিরাবরণে বয়ন করে সংবাদ, মৃত্যুর কথা না লিখে সে পত্রিকায় কেবল লেখা হয়, ‘সুচিত্রা সেন ১৯৩১-২০১৪’। পত্রিকায় পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য।
পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছিলেন, কীভাবে ‘চতুরঙ্গ’-কে চলচ্চিত্রয়িত করার সূত্রে পূর্ণেন্দু পত্রী সুচিত্রার বাড়ির নিয়তপরিবর্তনশীল রূপপরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেও অনুসরণকারী হয়ে ওঠেন সুচিত্রার। অন্যদিকে সুচিত্রা যে পাঁচের দশকে অন্তত একবার বেতার নাটকে অভিনয় করেছিলেন বসন্ত চৌধুরীর সঙ্গে শ্রীচৈতন্যকে নিয়ে লেখা নাটকে, বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায়, জানা যায় এ তথ্যও। নিঃসন্দেহে একটি অজানা তথ্য এটি।
এই সব দুরূহ তথ্যের পাশে রাখা যাক অন্য একটি বিবেচনাযোগ্য প্রসঙ্গকে। ১৯৫৫-তে যখন ‘দেবদাস’ মুক্তি পায়, সুচিত্রা তাঁর তিন বছরের অভিনেত্রী জীবনে এতটাই সমীহ আদায় করে নিতে পেরেছিলেন যে ছবিটি মুক্তির পূর্বে ‘দেশ’ পত্রিকা, যেটি মূলত সাহিত্যপত্রিকা, অন্তত পাঁচবার ছবি ছেপেছে সুচিত্রার, পার্বতীরূপিণী নায়িকার। পত্রিকাটির ইতিহাসে এই ঘটনা দ্বিতীয়রহিত।
চিত্র: গুগল
আরও পড়ুন…
বেশ লেখা, বেশ বিশ্লেষণ
বা: খুব ভালো লাগলো। তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।