সিনেমায় মৃণাল কী কী অভিনবত্ব নিয়ে এসেছেন? একেবারে শুরুতে যে ছবি করলেন, সেই ‘রাত-ভোর’-কে তিনি নিজেই পরে নিজের ছবি বলে স্বীকার করতে চাননি। ১৯৫৫-তে তৈরি সে ছবি না পেয়েছে বাণিজ্যিক সাফল্য, না পেয়েছে সমালোচকদের প্রশংসা। অথচ ছবিতে উত্তমকুমার, সাবিত্রী, কালী ব্যানার্জি, ছবি বিশ্বাসের মতো অভিনেতা, সলিল চৌধুরীর মতো সুরকার, রামানন্দ সেনগুপ্তের মতো ক্যামেরাম্যান, রমেশ যোশীর মতো সম্পাদক, সবাই ছিলেন।
মৃণাল আলোচিত হবেন যেসব বৈশিষ্ট্যের জন্য, তার সূত্রপাত তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’ দিয়ে। এপর্যন্ত বাংলা ছবির কাহিনিকাররা ছিলেন বাঙালি গল্প-ঔপন্যাসিক। এই প্রথম বাংলার বাইরের লেখক,— হিন্দি কথাসাহিত্যিক মহাদেবী বর্মার গল্প অবলম্বনে ছবি করলেন তিনি। পরে ওড়িয়াভাষী বিখ্যাত লেখক কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহীর ‘মাটির মনীষ’ নিয়ে ছবি করেছেন তিনি, করেছেন মুন্সী প্রেমচাঁদের কাহিনি নিয়েও। বাংলা ছবির কাহিনিতে সর্বভারতীয়তা তিনি-ই প্রথম এনেছেন, সত্যজিৎ রায়ের প্রেমচাঁদ নিয়ে ছবি তৈরির ঢের আগে। মহিলা লেখকদের লেখাও কি বাংলায় তিনিই প্রথম এনেছিলেন?
মৃণালের আরও এক অনন্যতা, চার চারটি ভাষায় ছবি নির্মাণ। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, তেলুগু এবং ইংরেজি। পরবর্তীতে সত্যজিৎ ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দুতে ছবি করলেও এক্ষেত্রে মৃণাল এগিয়ে।
সর্বভারত মিলেছে এভাবে মৃণালের ছবিতে। আমাদের মনে পড়বে মালয়ালম ছবি ‘চেম্মিন’— রামু কারাইতের মতো বিখ্যাত মালয়ালম চিত্রপরিচালকের কথা, যে ছবির কাহিনিকার জ্ঞানপীঠ-বিজেতা মালয়ালম লেখক তাকাষি শিবশঙ্কর পিল্লাই। ছবিটি তোলা হয় মারাঠীতে, সম্পাদনায় বম্বের হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, আর সঙ্গীত পরিচালনায় বাংলার সলিল চৌধুরী। তেমনই ‘গাইড’ আর ‘রুদালি’।
প্রথমটির কাহিনিকার পদ্মবিভূষণ তামিল ইংরেজিভাষী লেখক (তিনি ছাড়া মূলক রাজ আনন্দ ও রাজা রাও ভারতীয় ত্রয়ী, যাঁরা ইংরেজিতে লিখে প্রাক্ অরুন্ধতী রায়-চেতন ভকত-অমিত চৌধুরী আমলে খ্যাতি পেয়েছেন। ছবির নায়ক দেব আনন্দ পঞ্জাবিভাষী, আর নায়িকা ওয়াহিদা রহমানের মাতৃভাষা তামিল। সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেববর্মণ বাঙালি-ত্রিপুরী, গীতিকার শৈলেন্দ্রর ঐতিহ্য বিহার-রাওয়ালপিন্ডি! গায়ক মহম্মদ রফি অমৃতসর ও লাহোরের যুগ্ম ঐতিহ্যে লালিত, এবং মান্না দে নিপাট বাঙালি। গায়িকা লতা মঙ্গেশকর, পদবিতেই প্রকাশ, মারাঠী। এই সর্বভারতীয়তা বোধ হয় নিজের অজান্তেই ভারতীয় চলচ্চিত্রে নিয়ে এলেন ছবির চিত্রনাট্যকার-পরিচালক বিজয় আনন্দ, ছবির নায়ক দেব আনন্দ-এর ভাই। প্রসঙ্গত, ২০২৩ মৃণালের মতো দেব আনন্দের-ও জন্মশতবর্ষ।
‘রুদালী’-তেও কল্পনা লাজমী-ভূপেন হাজারিকা-ডিম্পল কাপাডিয়ার ত্রিবেণীসঙ্গম, কাহিনির রাজস্থানী প্রেক্ষাপট ও অসমীয়া ভাওয়াইয়ার যুগলবন্দী সত্যিই ছবিটিকে যথার্থ ভারতীয় করে তুলেছে। মৃণাল সেনকে বলতে চাই চলচ্চিত্রে ভারতীয়তা আনবার ভগীরথ।
মৃণালের আরও এক বৈশিষ্ট্য, তিনি স্থির চিত্রনাট্যতে বিশ্বাসী নন। যদিও উইলিয়াম ওয়াইলার থেকে সত্যজিৎ রায়, ডেভিড লিন, এটেনবোরো চিত্রনাট্যের গুরুত্ব বিষয়ে সর্বদা সজাগ। হিচকক তো এমন-ও বলেছেন, ছবি করতে তিনটে জিনিস লাগে, ‘Script, script and script’, আর স্পিলবার্গের মধ্যেও রয়েছে হিচককের কথার প্রতিধ্বনি,— ‘Audience …are easy to please if its a good story’। মৃণাল কিন্তু চিত্রনাট্যে ভয়ানক পরিযায়ী। এক ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ অন্য ভাবনায় চলে যায় তাঁর ছবির পরম্পরা, গোদার-আইজেনস্টাইনের মতো। এতে আমোদ পান মৃণাল।
তাঁর ছবি, খুব বাধ্য না হলে বিখ্যাত বাংলা গল্প-উপন্যাসের মধ্যে বিশ্বস্ত থাকে না। কাহিনির রদবদল ঘটে বহুলাংশে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কাহিনিতেও তিনি যে একবারমাত্র নিবিষ্ট হয়েছিলেন, ‘ইচ্ছাপূরণ’, সেখানেও ডিকনস্ট্রাকশনের ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন তিনি।
তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’ থেকেই নিজস্বতায় স্বকীয় তিনি। ছবিতে কাহিনির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তিরিশের দশকে জাপানের চীন-আগ্রাসনের সাম্রাজ্যবাদিতা তুলে ধরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ-ও সমসময়ে জাপানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তাঁর সুদীর্ঘকালের জাপানি বন্ধু নোগুচির সঙ্গে পত্রযুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছিল এই জাপানি আগ্রাসন নিয়ে। তাছাড়া মৃণালের ছবিটিতে ছিল মার্ক্সবাদের সপক্ষে বক্তব্য।
ছবিটি দিল্লির রাষ্ট্রপতিভবনে প্রদর্শিত হয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, তাঁর মেয়ে ইন্দিরা ও রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদের সামনে। ছিলেন মৃণাল সেন এবং ছবির প্রযোজক-সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। জওহরলাল ছবিটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ছবিটির প্রদর্শনী সরকার-কর্তৃক নিষিদ্ধ হলে সাংসদ হীরেন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপে প্রধানমন্ত্রী নেহরু ছবিটির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার ব্যবস্থা করেন।
মৃণাল সেন সম্পর্কে বলতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর পুত্র কুণালের উক্তি, বাবা চিত্রনাট্য লেখার সময় বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতেন। কখনও দিঘা, আবার নিদেন হাওড়া স্টেশনের গেস্ট হাউস। কলকাতায় তাঁর কোনও বন্ধুর বাড়িতে, নিতান্ত কোথাও না যেতে পারলে। কুণাল আরও বলেছেন, পারিবারিক বন্ধনকে খুব মর্যাদা দিতেন মৃণাল। পুত্র-পুত্রবধূকে ‘বন্ধু’ ডাকতেন। মৃণালের আত্মজীবনী ‘তৃতীয় ভুবন’-এও এর সমর্থন পাই, যেখানে তিনি নিজেকে ‘ভালোবাসার কাঙাল’ বলে উল্লেখ করেন। সহধর্মিণী গীতার প্রতি ভালবাসা তো বটেই, ছিল শ্রদ্ধাবোধ। ‘ইন্টারভিউ’ ছবিতে নায়ক-নায়িকার ভারতীয় যাদুঘর দিয়ে হাঁটার দৃশ্যটিকে আমাদের মনে না হয়ে পারে না, প্রেমিক মৃণাল তাঁর চিরসখী গীতার সঙ্গে হাঁটছেন। তাঁর চিত্রনাট্যের নিবিড় শ্রোতা ও সমালোচক গীতা, শত কাজের অবসরে নিরাবিল অবসর কাটিয়ে আসেন তাঁরা আন্দামানে গিয়ে, তাঁর ছবিতে অভিনয় করেন গীতা (বিপরীতে, সত্যজিতের ছবিতে আমরা বিজয়াকে অভিনয়ে পাই না, যদিও বিয়ের আগেই বিজয়া দুটি বাংলা ও দুটি হিন্দি ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন)। মৃণালের পারিবারিক চিত্রে ছেলে-ছেলের বউ কাছে না থাকার (তাঁরা দুজনেই কানাডা থাকেন) এক চাপা বেদনা আত্মজীবনীতে রয়েছে। মৃণাল যেমন তাঁর বাবার প্রতি খুব আকর্ষণ বোধ করতেন, সন্তানের প্রতিও। এই নাজুক সম্পর্ক তাঁর ছবির পারিবারিক সম্পর্কগুলো তৈরির নেপথ্যে ক্রিয়াশীল বলেই আমাদের প্রত্যয়।
‘নীল আকাশের নীচে’ প্রশংসিত ছবি, অন্যদিকে খানিক পরের ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’-পরবর্তী ‘আকাশ কুসুম’ হয়ে দাঁড়াল চরম বিতর্কিত, বিশেষ করে ছবিটি নিয়ে সত্যজিৎ-মৃণালের মসীযুদ্ধে, কলকাতার বিখ্যাত ‘The Statesman’ পত্রিকায়। বিতর্ক ছিল ছবির সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে। কাহিনিকার আশিস বর্মণের প্রাথমিক নেতিবাচক চিঠি বেরোয় স্টেটসম্যানে। পরে মৃণাল ও সত্যজিৎ জড়িয়ে পড়েন। দীর্ঘ দু’মাস ধরে চিঠির লড়াইশেষে পত্রিকার সম্পাদক ইতি টানেন বাগযুদ্ধের। এর মধ্য দিয়ে একটা নিপাট সত্য বেরিয়ে আসে, সত্যজিৎ এবং মৃণালের দর্শনপ্রেক্ষিত একেবারেই আলাদা।
>>> ক্রমশ >>>
চিত্র: গুগল
আরও পড়ুন…