উৎস আর চরৈবেতি: কুমার নদী থেকে গঙ্গা।
মৃণাল সেন বাঙালির চলচ্চিত্র-ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত পুরোধা ব্যক্তিত্ব, যাঁর নাম সত্যজিৎ রায় এবং ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে এক-ই সঙ্গে উচ্চারিত হয়। তিনজনের-ই আবির্ভাব বিশ শতকের পাঁচের দশকে। বাংলা চলচ্চিত্র জগৎকে সাবলম্বী, শিল্পসম্মত ও আন্তর্জাতিক করতে এঁদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। মৃণাল সেনের ছবি কেবল স্বদেশেই নয়, বিদেশ থেকেও একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে।
সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক, তিনজনের ঐতিহ্য ও উৎস পূর্ববঙ্গ, যদিও দেশভাগ তাঁদের ভারতীয় বানিয়েছিল। সত্যজিৎ না জন্মালেও মৃণাল এবং ঋত্বিক জন্মেছিলেন পূর্ববঙ্গে, এবং যৌবনের একটা পর্যায় অবধি কাটিয়েছিলেন মাতৃভূমিতে। এর প্রভাব আমরা এই দুজনের জীবনযাপন ও ছবি তৈরির মধ্যে লক্ষ্য করি। অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরে জন্ম মৃণাল সেনের। সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ফরিদপুরে কাটিয়েছেন, ম্যাট্রিক পাশ করা পর্যন্ত। তারপর কলকাতায় যাওয়া। মা-বাবা যদিও আরও কিছুদিন ছিলেন, ফরিদপুর পাকিস্তানের অন্তর্গত হওয়ার পরেও। ফরিদপুর থেকে এই বিশ্বের দেশ-দেশান্তরে পাড়ি দেওয়া চলচ্চিত্রের হাত ধরে,— এই মনীষার সামগ্রিকতার নাম-ই মৃণাল সেন।
মৃণাল সেনের জন্ম যে দশকে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সেই দশকের তাৎপর্য বহুবিধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ও League of Nations-এর জন্ম (১৮২৯), সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপ্লব-পরবর্তী দুর্ভিক্ষ (১৯২২), আমেরিকা-ইয়োরোপে Jazz Age (Roaring Twenties), ফ্যাসিবাদের উদয়, যার ঢেউ ঔপনিবেশিক ভারতেও পড়েছিল। ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন বর্জন চৌরিচৌরায় জনতার বিক্ষোভে থানায় আগুন ও বাইশজন পুলিশকর্মীর নিহত হওয়ার ঘটনায় (১৯২২), এমন সব ঘটনায় আকীর্ণ ১৯২০-র দশক। আপাত কোনও মিল নেই একটি ঘটনার সঙ্গে অন্যটির। সময় ও যুগকে বুঝতে গেলে দরকার আছেও আবার। মৃণাল সেন রাজনৈতিক দিক দিয়ে ছিলেন বামপন্থায় বিশ্বাসী। তাঁর জন্মবছরেই মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই) প্রথমবারের মতো ভারতে পালিত হল মে দিবস, মালয়াপুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার ওড়ালেন লাল নিশান, তার কোন একটা দ্যোতনা, তাৎপর্য, মরমী বার্তা রয়েও গেছে যেন কোথায়।
রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুলের ১৯২৩ খচিত ছিল প্রথমজনের শিলঙে বসে ‘রক্তকরবী’ নাটক লেখা, যা পরের বছর ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় বেরোবে, আর জেলে নজরুলের উপবাস-ভঙ্গ, সাতাশে মে ঊনিশশো তেইশ। মৃণাল দুসপ্তাহের সেদিন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বরাজ্যদল গড়েছেন ওই বছরেই। আর প্রয়াত হয়েছেন মুকুটহীন রাজা, ‘মহাত্মা’-র আগেই যিনি মহাত্মা, সেই অশ্বিনীকুমার দত্ত।
পরাধীন ভারতে মধ্যবিত সংসারে বড় হচ্ছিলেন মৃণাল, আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো। কিছু কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা তাঁর জীবনে রেখাপাত করে, যেমন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একাধিকবার তাঁদের বাড়িতে অতিথি হয়ে আসা, বালক মৃণালকে দাঁতের ব্যথায় ওষুধের নিদান দেওয়া। বা কবি জসীমউদ্দীনকে, কাছাকাছি থাকার সুবাদে, বড়ভাইয়ের মতো করে পাওয়া। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মৃণালের বোন রেবা যখন দুপুরবেলা খাওয়ার শেষে নিজেদের পুকুরে মুখ ধুতে গিয়ে জলে ডুবে মারা যায়, সেই শোকে জসীমউদ্দীন বালিকাকে নিয়ে কবিতা লেখেন ওই পুকুরের সিঁড়িতে বসে। জসীমউদ্দীন এরকম করতেন, জানি আমরা। তাঁর রুপাই একটি বাস্তব চরিত্র। আসমানীও তাই। তবে এই কবিতাটির ক্ষেত্রে পার্থক্য হল, কবিতাটি মৃণালের মাকে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, এটা অন্য কাউকে না দেখাতে। এটি একান্তই কন্যাহারা মায়ের সম্পত্তি। মৃণালজননী কবিতাটি বরাবর নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন। ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত’, বুদ্ধদেব বসুর সুবচনটি মিথ্যে নয়।
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া।
ফরিদপুরের শান্ত জনপদ থেকে মৃণাল চলে এলেন কলকাতায়। মাত্রই শ’দেড়েক কিলোমিটার, আসতে ছঘণ্টা মাত্র, কিন্তু জয়যাত্রার শুরু, যিনি তাঁর দীর্ঘ পঁচানব্বই বছরের জীবনে জগৎটাকে দেখবেন একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত,— কানাডা থেকে ইতালি, জাপান থেকে রাশিয়া, চীন থেকে আন্দামান, তার শুভসূচনা একদা মীর্জা গালিব-লুই মাল-রেনোয়ার ভ্রমণে আসা শহর কলকাতা। এর আগেকার ফরিদপুর-পর্বে দীনেশচন্দ্র-সরযূবালার সন্তান মৃণাল এক অভাবিত কারণে শ্রীঘরেও কাটিয়ে এসেছেন ‘বন্দে মাতরম্’ গেয়ে মিছিল করার জন্য। ফরিদপুরে জননেতা বিপিনচন্দ্র পাল, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়দের আগমন তাঁর স্মৃতিধার্য করে নিয়ে ১৯৪০-এ কলকাতায় এলেন তিনি। স্কটিশে ভর্তি হলেন বিএসসি পড়তে। বিষয় পদার্থবিদ্যা। ১৯৪০, লাহোর প্রস্তাব, যার পরিণতিতে মৃণাল, তাঁর পরিবার, পুব বাংলার হিন্দু বাঙালির এক বিরাট অংশ দেশত্যাগী হবেন আর মাত্র সাতবছরের মাথায়। মৃণালের কলকাতায় বসবাস, বিয়াল্লিশের ‘ভারত ছাড়ো’, পঞ্চাশের মন্বন্তর, তেতাল্লিশে মেদিনীপুরের বন্যা ও ছেচল্লিশের দাঙ্গা, অবশেষে সাতচল্লিশের স্বাধীনতা ও দেশভাগ-লাঞ্ছিত। এখানে এসেও সাতদিনের জেলবাস। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগসাজসের অপরাধে। ১৯৪১-এ নেতাজির মহানিষ্ক্রমণ (সতেরোই জানুয়ারি) এবং রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ (সাতই আগস্ট)। বাইশে শ্রাবণ। যে-নাম দিয়ে ছবি করবেন মৃণাল একদিন।
এই যে সময়সারণি ও ঘটনাপ্রবাহ, এসবের সঙ্গে বস্তুত মৃণালের আবশ্যিক যোগ নেই। আবার আছেও। দুর্ভিক্ষ ধরে রেখেছেন তিনি তাঁর ১৯৬০-এ নির্মিত তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ। যোগ আছে তাঁর এইপর্বের মন-মানসিকতা, সমমনস্ক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ও মতবিনিময়, মতান্তর ও পঠনপাঠনের মধ্যে। যথারীতি ফিজিক্সে এমএসসি শেষ করেও ভাল চাকরি জোটেনি। জুটেছিল মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ, বহির্বঙ্গে। তাই সই। কেননা গীতা সোমকে ক’বছরের গান্ধর্ব সম্পর্কের পরিণতিতে বিয়ে করেছেন তিনি ১৯৫৩-র ১০ই মার্চ, আর চব্বিশে সেপ্টেম্বর ১৯৫৪-তে একমাত্র সন্তান কুণাল জন্মেছেন। কারুবাসনা কিন্তু তাঁর মনে দানা বেঁধেছে ততদিনে: ছবি বানাবেন, ছবি। বায়োস্কোপ।
কালীঘাটের ‘প্যারাডাইস কাফে’-তে দিনের পর দিন বন্ধুদের নরকগুলজার মূলত ছবি করা নিয়ে। ততদিনে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’, সত্যজিৎ রায় চিদানন্দ দাশগুপ্ত রাধাপ্রসাদ গুপ্ত বংশীচন্দ্র গুপ্ত প্রমুখের আগ্রহে। সন ঊনিশশো সাতচল্লিশ। ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্সের চলচ্চিত্রে নতুন যৌবনের দূতেরা আসতে শুরু করেছেন। আসবেন আরও। কলকাতায় ঋত্বিক মৃণাল হৃষিকেশ সলিল চৌধুরি তাপস সেন কলীম শরাফীরা স্বপ্ন দেখছেন দুনিয়া-কাঁপানো কিছু করার। করেছেন-ও।
পাঁচের দশক: বিশ্বচলচ্চিত্র ও মৃণাল।
চলচ্চিত্রের জন্ম ১৮৯৭-তে, ফ্রান্সের দুই লুমিয়ের ভাইয়ের হাত ধরে। জন্মের অর্ধশতক পার হতে না হতে এটি গোটা বিশ্বেই সবচেয়ে জনপ্রিয় বিনোদন-মাধ্যম হয়ে উঠল। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ চলচ্চিত্রের কারিগরি দিক ও জনপ্রিয়তায় জোয়ার আনল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে এর গ্রহণযোগ্যতা পৌঁছল তুঙ্গে। আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইয়োরোপ, ভারত, সর্বত্র সিনেমার জনপ্রিয়তা ছড়াল দ্রুত। নির্বাক ছবি থেকে সবাক হল যখন সে, গতিজাড্য পেল বহুগুণ। তারকাপ্রথার জন্ম হল প্রথমে হলিউডে ও পরে অন্যত্র, ছবিতে গানের ব্যবহার উত্তুঙ্গে নিয়ে গেল ভারত (কলকাতা, বম্বে ও মাদ্রাজ, তিন জায়গাতেই)।
বিশ শতকের পাঁচের দশকে চলচ্চিত্রের নতুন তরঙ্গ আনল ইয়োরোপ। ইতালি, জার্মানি ও ফ্রান্সে। এর আলোচনা মৃণাল সেনের ছবি বুঝবার প্রাক্-শর্ত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইতালির চলচ্চিত্রে নবতরঙ্গ দেখা দিয়েছিল ভিত্তোরিও ডি সিকা, রোজেলিনি, লাভাত্তিনি, ফেলিনি, আন্তোনিয়নির হাত ধরে। ১৯৪৩-এ ভিসকন্তির ছবি ‘OSSESSIONS’-কে নবতরঙ্গের অগ্রদূত বলা হয়। তাছাড়া ১৯৪৬-এ রোসেলিনির ‘Rome, the Open City’। ১৯৪৮-এ ডি সিকার ছবি ‘Bicycle Thieves’ সারা পৃথিবীতে নন্দিত হয়ে ওঠে। ভিসকন্তি, পুৎসিনি, পিয়েত্রো ইনগাও প্রমুখ চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা ও দিগন্তকে প্রসারিত করে দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইতালির স্টুডিও ক্ষতবিক্ষত। সুতরাং আউটডোরকে কাজে লাগানো হল। মার্ক্সবাদী চেতনা, তার সঙ্গে খ্রিস্টীয় মানবতা এবং কাব্যিক সুষমায় রঞ্জিত হয়ে দেখা দিল নবতরঙ্গের ছবিগুলো।
এর পর এল ফ্রান্সের কান ফিল্ম ফেস্টিভাল, ১৯৩৮-এ। ভেনিসের স্পর্ধিত প্রতিবাদ। এর প্রকৃত আবির্ভাব ১৯৪৬ অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক পরের বছর থেকে।
গোল্ডেন পাম, গ্রা প্রিঁ, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জন্য পুরস্কার, পরিচালক-চিত্রনাট্যকারের জন্য-ও, কান হয়ে উঠল চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কৌতূহলের কেন্দ্র। মৃণাল সেন কখনও এখানে যোগ দেবেন ছবি নিয়ে, কখনও বিচারক হয়ে।
বার্লিন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল তুলনায় নব্য, ১৯৫১-তে জাত। তবে সম্ভ্রান্ততায় তাই বলে কোনও অংশেই কম নয়। ১৯৮১-তে মৃণাল এখান থেকেই তো ‘Silver Bear’ পাবেন তাঁর ‘আকালের সন্ধানে’ ছবির জন্য।
বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র আন্দোলন বিশ্ব চলচ্চিত্রকেও বিপুলভাবে প্রভাবিত করল। ফ্রান্সে যে ‘La Nouvelle Vague’, যার বৈশিষ্ট্য ছবির সম্পাদনা থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতা পর্যন্ত প্রসারিত, তা একদিকে সোভিয়েত চলচ্চিত্র, অন্যদিকে ভারতীয় ও যুগপৎ লাতিন আমেরিকার ছবিতে দেখা গেল।
ঘটনা ও চরিত্রগুলিকে ভাঙচুর যেন ষষ্ঠীচরণের হাতি লোফা, যা গদারের এ-হেন উক্তিতেই প্রমাণিত, ‘A story should have a beginning, a middle and an end, but not necessarily in that order.’ মৃণাল বহুলাংশে ঋণী এঁদের কাছে, যখন তাঁর ছবিতে সামান্য সেট আপ, আলোর সুমিত ব্যবহার, poetic realism লক্ষ্য করি। ফরাসি ‘Cahiers du Cinema’-ও এঁদের চলচ্চিত্রজগতে কম অবদান রাখেনি। ত্রুফো চলচ্চিত্রে সাহিত্যের অনুপ্রবেশ চাইছেন না ১৯৫৪-তে লেখা তাঁর এক প্রবন্ধে। তাঁর নিরঙ্কুশ যুক্তি, ‘Cinema was in the process of becoming a new means of expression on the same level as painting and the novel …a form in which and by which an artist can express his thoughts, however abstract they may be, or translate his obsession exactly he does in the contemporary essay or novel. This is why I would like to call this new age of cinema the age of the camera-stylo’. চিত্রপরিচালক এখন থেকে বিবেচিত হতে লাগলেন ‘Author of film’-রূপে। ঋত্বিক ঘটক তাঁর ছবিতে ‘ঋত্বিক প্রণীত’ লিখেছেন অনেক স্থলে। মৃণালের ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘ইন্টারভিউ’ বা সত্যজিতের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-তে ত্রুফোর অনুসৃতি লক্ষ্য করি।
>>> ক্রমশ >>>
চিত্র: গুগল
আরও পড়ুন…