‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’ মাত্র চৌষট্টি পৃষ্ঠার একটি অতি ক্ষুদ্রকায়া পুস্তিকা। অধ্যায় অনেকগুলি— এগারোটি। তিনটি— লেখিকার পরিচিতি এবং বইটি লেখা হল কেন, এইদুটি বিষয় সম্পর্কিত এবং বাকি আটটি লেখিকার বিভিন্ন বিষয়-সম্পর্কিত রচনার অনুবাদ। কন্নড় ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদের বাংলা ভাষান্তর করেছেন সজল রায়চৌধুরী ও সোমনাথ গুহ। বইটি সম্পাদনার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন সজল রায়চৌধুরী। লেখিকার নাম গৌরী লঙ্কেশ— সত্যকথনে নির্ভীক এক মানবী-নাম। তাঁর রচনা ক’টি পড়তে পড়তে এবং পড়ার পর পাঠক-হৃদয় গুরুভার বইতে অপারগ হয়ে যায়। ক্ষুদ্রাকৃতি বইয়ের আধারে ধৃত সহজ-সরল ভাষায় অনূদিত রচনা-পাঠ যে এত বহন-অযোগ্য হতে পারে, তা অকল্পনীয়! চোখের জলের ধারায় বন্যা নেমে আসে! বইয়ের প্রচ্ছদে আটকে থাকা উজ্জ্বল রক্তমাখা মুখখানি আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মনের আয়নায়। বিড়বিড় করে ওঠে ঠোঁট— সার্থক জন্ম তোমার গৌরী লঙ্কেশ!
গৌরী লঙ্কেশ (১৯৬২-২০১৭) খ্যাতনামা সাংবাদিক পিতার যোগ্য সন্তান। তাঁদের পারিবারিক পত্রিকার নাম ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’। পিতা পি. লঙ্কেশের মৃত্যুর পর তিনিই পত্রিকাটি চালানোর ভার নেন। পরে ‘গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকে’ প্রকাশ করতে থাকেন। ইংরেজি ভাষায় পড়াশুনা। কন্নড় ভাষা, নিজের মাতৃভাষা, না জেনে বিপাকে পড়েছেন। কিন্তু সাংবাদিকতা তিনি ছাড়তে পারেন না। অতএব লড়াই-ব্যর্থতা-সাফল্য পাশাপাশি চলেছে। হারতে তিনি জানেন না। হারেননি। আর সেটাই হল ‘কাল’! দুর্জয় সাহসকে নমিত করার জন্য পরিকল্পিত হত্যার শিকার হতে হল তাঁকে। ব্যর্থতা? তাঁকে ছুঁতে পারবে কেমন করে? তিনি লাভ করলেন অমরত্ব! ‘নামাবলী গায়ে’ চড়ানো ‘শ্বাপদেরা’ যে জানে না, মৃত্যুতেই কোনও কোনও জীবনের সমাপ্তি ঘটে না! কী ধরনের সত্যকথনে পারঙ্গম ছিলেন গৌরী লঙ্কেশ? কিছু উল্লেখ করা যাক।
কর্ণাটকের বাবাবুদানগিরিকে ‘দক্ষিণের অযোধ্যা’-য় পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ‘গেরুয়া বাহিনী’। গুরু দত্তত্রেয় বাবাবুদানস্বামী দরগায় হিন্দু-মুসলমানের যাওয়া-আসা চলে নিরন্তর। এই দরগা ‘প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার এক মহান উদাহরণ।’ এটিকে কেবলমাত্র হিন্দুদের পবিত্র স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি এবং বজরং দল। এর বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখলেন তিনি ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’-য়। বহু বিশিষ্ট মানুষকে নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সভা করলেন। ২০০৩ সালের ঘটনা। গৌরী লঙ্কেশ ‘গেরুয়া বাহিনী’-র শত্রু হিসেবে পরিচিতি লাভে এতটুকু শঙ্কা বোধ করলেন না। [‘বাবাবুদানগিরিতে আমি কী দেখেছিলাম’, ২০০৩]
লিঙ্গায়েত দক্ষিণ ভারতের একটি ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতিভেদবিরোধী ধর্মসম্প্রদায়। এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বাসবান্না মন্দির ও মূর্তিপ্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন। দ্বাদশ শতাব্দীর কবি ও সমাজসংস্কারক এই দৃঢ়চিত্তের অধিকারী মানুষটি যে মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন তা হল— ‘কর্মই ধর্ম’। ‘নিচু জাতি’-র মানুষদের সঙ্গে ছিল তাঁর ঐকান্তিক হৃদ্যতা। তিনি অসবর্ণ বিয়ের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন যা নৃশংস কুফল ভোগ করতে হয় তাঁর অনুগতদের। তিনি স্থানত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। লিঙ্গায়েত ধর্মের মূল ভাবাদর্শ ভুলিয়ে দেওয়া হল সেখানকার মানুষ-জনকে। সুপণ্ডিত, ইতিহাসবিদ, কন্নড় ভাষার ঐতিহ্যরক্ষায় একনিষ্ঠ কুলবুর্গি তদের বোঝাতে চাইলে তাঁকে ‘ধর্মদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া হল এবং তাঁকে প্রাণ দিতে হল। গৌরী লঙ্কেশ লিখলেন— ‘তবু প্রতিবাদী ভাবাদর্শের তো মৃত্যু হয় না।’ [‘গতকাল বাসবান্না, আজ কলবুর্গি’, ২০১৫]
জয়পুর সাহিত্য উৎসবে সলমন রুশদির আগমনবার্তা জানাজানি হলে দেওবন্দ মুসলিমরা প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। এমনকি তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। আবার রাস্তায় মুসলিম ছেলেরা হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে ‘ছিনালি’ করে এই অপরাধে তাদের ‘মেরে ফেলা ন্যায্য’ বলে দবি তুলেছেন আর. এস. এস. নেতা। গৌরী লঙ্কেশ আরও কিছু মৌলবাদী হুঙ্কারের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করলেন যে, সকল মৌলবাদ কেবল ধ্বংসই সৃষ্টি করে এবং সেকারণে সকল মৌলবাদই সমান নিন্দাযোগ্য। [‘সব মৌলবাদ ভ্রান্ত’, সাল অনুল্লেখিত]
কবি প্রসাদ মাত্র ২৩ বছরের তরুণ কবি। তাঁর পুরো নাম— হুচ্ছাংগিপ্রসাদ। এতটুকু বয়সে তাঁর কবিতার বই ‘ওড়ালা কিচ্ছু’ (অন্তরাগ্নি) পুরস্কৃত হয়েছে। তিনি জাতিভেদপ্রথা, হিন্দুত্ব ও অন্ধবিশ্বাসের প্রবল বিরোধী। তাঁর মা দেবদাসী, বাবা দলিত। তাঁর জীবন শুরু হয়েছে দাসমজুর হিসেবে। তিনি শিক্ষালাভ করার সুযোগ পান একটি সরকারি প্রকল্পের দৌলতে। তিনি ক্রমাগত লিখতে থাকেন তাঁর যন্ত্রণার কথা। ধর্মের নামে নানাপ্রকার নিপীড়নের তীব্র সমালোচনামূলক রচনা। তাঁর হাত কেটে নেওয়ার ষড়যন্ত্র থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও হাতের তালুতে আঘাত নিয়েও তিনি লিখলেন— ‘ওরা দ্রোণাচার্যের বংশধর হতে পারে। আমরা একলব্যের বংশধর।’ গৌরী লিখলেন— ‘… ওহে ডানপন্থী গুন্ডারা, তাকে তোমরা কোনোদিন গুঁড়িয়ে দিতে পারবে না।’ সে প্রতিজ্ঞা করেছে যে, গুরু আম্বেদকরের দেখানো পথেই সে ‘নিজেদের জন্য উঠে দাঁড়াতে’ পারবে আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মসচেতনতা অন্তরে জাগিয়ে রেখে। [‘আমরা একলব্যের বংশধর’, ২০১৫]
দয়ামণি বারলা আদিবাসী পরিবারের জন্ম নেওয়া ঝাড়খণ্ডের এক বিরলদর্শন লড়াকু মানবীর নাম। জন্মের পর থেকে খাওয়া-পরা-থাকা-শিক্ষা-জীবিকা সবকিছুর জন্য লড়াই চালিয়ে হারেননি এই ভারত-কন্যা। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে চায়ের দোকান দিয়ে রুজি-রোজগার সম্ভব করেছেন। নিজস্ব এই সংগ্রামে থেকে থাকেনি তাঁর জীবন। দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার, গরিব আদিবাসীদের ক্ষুধার অন্ন কেড়ে নেওয়া বিত্তবান, দৃর্বৃত্ত, কোম্পানির মলিক— কাদেরকেও তিনি রেয়াত করেননি। তাঁদের আদিবাসী জনস্বার্থঘাতী সমস্ত প্রকল্পে জল ঢেলে দিয়েছেন জন-আন্দোলনের জোয়ার এনে দিয়ে। ‘জন হক’ নামে সংবাদপত্র প্রকাশ করেছেন। ‘আদিবাসী মূলবাসী অস্তিত্ব রক্ষা সমিতি’ গঠন করেছেন। পুরস্কার মিলেছে সেসবের জন্য জেল-হাজতবাস।
গৌরী আশা প্রকাশ করেছেন দয়ামণির মত ‘সাহসী কর্মীরা’ তাঁর রাজ্যেও উঠে আসবেন এবং কর্ণাটকে বিজেপি সরকারের লুট করার লক্ষ্যকে রুখে দেবেন। [‘দয়ামণি বারলার মর্মবেদনা’, ২০১২]
২০১৬ সালে পোশাক কারখানার হাজার হাজার মহিলা শ্রমিক বিস্ময়কর প্রতিবাদ আন্দোলন বাস্তবায়িত করে ভবিষ্যনিধি বিলটিকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেন— কেন্দ্রীয় সরকারকে। সরকার বারংবার চেষ্টা করেছে যাতে মহিলা শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের গর্ভে তলিয়ে যায়। ভবিষ্যনিধি তহবিল বলে তাদের জন্য কিছু না থাকুক। অরুণে জেটলির ভূমিকা সেক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য রকমের অমানবিক বললে কম বলা হয়। গৌরী লঙ্কেশের বিবৃতি থেকে তা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন বোম্মানাহাল্লিতে বিজ্ঞাপিত এক প্রয়াসকে, যাতে দুজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে উল্লেখিত বিল প্রত্যাহার করার জন্য বাহবা দেওয়া হয়েছে!
দুর্জয় সংকল্পে দৃঢ় প্রতিবাদী মহিলা পোশাককর্মীদের তিনি কর্ণাটকের কিট্টুর অঞ্চলের ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করা বীরাঙ্গনা রানি চিন্নাম্মার উত্তরসূরি বলে গণ্য করে গর্ব প্রকাশ করেছেন। [‘বুড়ো বয়সে মরূদ্যানের বদলে মরীচিকা’, ২০১৬]
নিজের মাতৃভাষা কন্নড় ভাষা শেখার সুযোগ তিনি পাননি। মূলত মায়ের ভুলে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিশুবয়সে ভর্তি করানোর ফল তাঁকে ভালমতই ভোগ করতে হয়েছিল! অথচ এই ভাষার প্রয়োজন দেখা দিল তাঁর জীবনে এমনভাবে যে ভাষাটি আয়ত্ত করা ভিন্ন গতি ছিল না। জেদী স্বভাবের গুণে সে কঠিন পরীক্ষায় উৎরে যাওয়ার বৃত্তান্ত লিখেছেন তিনি সরসতা মিশিয়ে। পরিবারের পত্রিকা, নিজের পত্রিকা, পেশা সবই সামলেছেন মাতৃভাষাতে এবং সেইসঙ্গে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন গভীরভাবে। তিনি নির্দ্বিধায় লিখেছেন যে, মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ বিনা সেই ভাষায় কিছু ভাবা এবং অনুভব করা যায় না। এমনকি ‘কন্নড় রাজ্যোৎসব’-এ এই সত্য তিনি অকপটে উচ্চারণ করেছিলেন। [‘কন্নড় ভাষা: পরিত্যাগ ও ফিরে আসার গল্প’, ২০১৩]
প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণকালে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভ করা যে কত জরুরি তা স্বল্পকথায় হলেও তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর পাঠক ও দেশবাসীকে। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, মাতৃভাষার ‘জোরালো ভিত্তি’ এবং ইংরেজিকে ‘বাড়তি হাতিয়ার’ হিসেবে পেলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় যেকোনও মানুষের জীবনে। যদি মাতৃভাষা বর্জন করে দেশবাসী তার সন্তানদের ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার ওপর বেশি গুরুত্ব দেন তাহলে ‘আমরা শিকড়হীন প্রাণির দেশ তৈরি করব’— গভীর বিশ্বাসে উচ্চারণ করেছিলেন তিনি।
অপূর্ব ভঙ্গিতে মাটি ও আকাশকে তিনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন দেশবাসীকে— মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ ঘটলে পা শক্ত মাটিতে আটকে থাকবে আর তার সঙ্গে ইংরেজি ভাষা জানতে পারলে শিক্ষার্থীদের ‘প্রসারিত হাতে ধরা থাকবে আকাশ’। [‘ভাষার শিকড় এবং ইংরেজির আকাশ’, সাল অনুল্লেখিত]
আবেগের প্রকাশ ও প্রয়োজনের তাগিদ— দুয়ের সমন্বয় ঘটানো বড় কঠিন কাজ। আলোচ্য বইখানির প্রকাশমুক্তি ঘটিয়েছেন যে সম্পাদক, অনুবাদক, অলংকরণশিল্পী ও প্রকাশক গোষ্ঠী তাঁরা সেই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করেছেন। সমগ্র পাঠকমহলের পক্ষ থেকে তাঁদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানানোর দায় নিলাম আমি। মূলত, ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’, ‘গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকে’ এবং ‘ব্যাঙ্গালোর মিরর’ নামক তিনটি পত্রিকা থেকে তাঁরা গৌরী লঙ্কেশের লেখাগুলি নিয়েছেন। পাঠকের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর জীবন-বার্তা ও জীবনাদর্শ। তাঁদের এই প্রয়াস নিঃসংশয়ে সমাদৃত হবে। তদুপরি কিছু কিছু ঐতিহাসিক বিষয়ে তাঁদের প্রদত্ত ‘টীকা’ পাঠককুলের বিশেষ প্রাপ্তি বলে গণ্য হবে, বলা বাহুল্য।