এখন শূন্যতা লেখা চলে। না লিখলে সে ঘরের কথা বলব কেমনে মরমিয়া, যে ঘর শূন্যের উপর? জানত যদি হাছন রাজা বাঁচব কতদিন…। এ কথা লিখতে বসে শক্তিগড়ের মাঠ মনে আসছে। সেই যে গৌর ক্ষ্যাপা, ক্ষ্যাপার পরম, স্তিমিত কণ্ঠকে উজ্জ্বল করে সে নৌকার কথা বলছিলেন যাতে ক্ষ্যাপা চড়লেই হবে না, সাধন জানতে হবে। সত্তরের প্রবলকে নিভতে দেখছিলাম। সেদিন সেখানে, যেন শেষ। শেষ তারপরই। জয়দেব থেকে ফেরার পথে— হ্যাঁ, পথেই, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা মারে গাড়ি।
গাড়ি একদা গাড়ী ছিল। দীর্ঘ স্বর তো বাংলার উচ্চারণে নেই, তাই গাড়ি। তবু গাড়ী সংস্কৃত নিষ্ক্রান্ত বুঝি? উচ্চজনের উচ্চকোটির ভাষা বলে দীর্ঘ স্বর না থাকা বাংলাতে, আমাদের কাংলাতে দীর্ঘ আনতে হত। জয়দেব দীর্ঘ কবি। সংস্কৃতে।
‘‘মেঘৈর্মেদুরমম্বরং বনভুবঃ শ্যামাস্তমালদ্রুমৈর্ —
নক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়।’’
[জয়দেব : গীতগোবিন্দ, ১.১]
আহা, হেদে মন আউলায়। কবিত্বে কাব্যে যে সুষমা ঝরে। তবু যে প্রাণের নহে, নয়। রাধা এল, ত্রাস-ভীত বালক এল, মন্মথর তীর ঘনাল, মেঘে আন্ধার হল দ্যাশ। দেশ যে। আন্ধারের টান বাংলাতেই থেকে যায়, মাতৃভাষায়। শিলচর থেকে উড়া দিলেন বা কালিকাপ্রসাদ? ডানা ভাঙল কি? সেই যে সুরমা নদীর গাঙচিল, ডানা ভেঙে কলকাতায়, যাকে কলকাতা চিনে না, সেই অচিনের আপনিও? সাহিত্যে, সহিতে এলেন যাদবপুর। একদা দুর্বার। তাও থেকে গেল শিলচরের আসনাই।
এই তো সেদিন কাকার মৃত্যুর পর— সেই মৃত্যু যা স্তব্ধ করে এককে, অপরকে দেয় যাত্রা— আপনি দল বাঁধলেন। আপনারা। মনে আছে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আপনি সামনে চলে এসেছেন বটে, তবু বাকিরা ছাড়া দল দল নয়। আপনি আপনি না। ভাঙনের থেকে সরে থেকে এই সব আপনাদের। দোহার।
‘‘আমরা হাজার বছরের বাংলা গান নিয়ে একটি কাজ শুরু করব। বাংলা গান শুরু হয়েছে চর্যাপদ থেকে। আর শেষ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত। তার মধ্য গানগুলো নিয়ে একটি প্রজেক্ট করার ইচ্ছা আছে।’’
আপনি দীক্ষিত বাউল সাধক না। আপনি লোক। যার জন্য লোকগান। যে লোকের জন্য আপনার বিস্তার। হাজার বছর নিয়ে ভাবছিলেন। দেখছিলাম, শুনছিলাম আপনাকে।
‘‘গান আমার জপমালা
গানে খুলে প্রেমের তালা
প্রাণ বন্ধু চিকনকালা
অন্তরে দেয় ইশারা
আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া
ভাবে করিম দীনহীন
আসবে কি আর শুভদিন?
জল ছাড়া কি বাঁচিবে মীন
ডুবলে কি ভাসে ভরা?
আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া।’’
শাহ আবদুল করিম। ভাটি-পুরুষ। হেমাঙ্গ বিশ্বাস একদা বলেছিলেন, আপনি মনে করিয়েছিলেন, তিস্তার মাঝি মাঝনদীতে গান গাইলে তা ভাটিয়ালি না। যেখানে জলা-খাল-বিল-হাওড়-মনযমুনা সেখানেই সুর ওঠে বাতাসে, ভাটি দেশে, সেই ভাটিয়ালি। শাহ আবদুল করিম আপনার চোখে তাই। এবং আপনি দীক্ষিত না।
‘‘…সিলেটের বাউলদের ঘরানাটা আবার এ রকম না। দূরবীন শাহ, আরকুম শাহ, জালাল উদ্দিন শাহ, এঁরা এমনিতে সংসারী মানুষের মতই পোশাক পরে আছেন। তাঁদের সংসারও আছে। তাঁরা ‘স্ত্রী’ বলছেন, ‘সাধনসঙ্গিনী’ নয়। সাধনা তাঁদের গানে, তাঁদের জীবনে। আমরা কি শুনেছি, হাসন রাজায় কয় রে আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয়, হাসন রাজা বাউল ছিলেন না সেটা অন্য একটা জিনিস। লালন বলেন, দুদ্দু বলেন, পাঞ্জুশাহ মনে করে, এই কথাগুলো আমরা ভনিতায় শুনি। তো তাদের কাউকে আমরা চিনি না, ভাইবে রাধারমণ বলে চিনি না। এই প্রথম দেখলাম একজন বাউল নিজের মুখে বলছে বাউল আবদুল করিম বলে। এটা যে কী রোমাঞ্চকর আমার কাছে! তারপর তো তাঁর সঙ্গে কথা বললাম। স্বপ্নে কিছু কিছু মানুষ থাকে। ইনি এমন একজন স্বপ্নের মানুষ যাকে দেখে ফেলেছি। লোকায়ত সংস্কৃতি আর আধুনিক সংস্কৃতির ঠিক প্রান্তসীমায় কেউ যদি দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে তাঁর নাম বাউল শাহ আবদুল করিম।’’
এই বলেছিলেন দৈনিক জনকণ্ঠকে। কাল শুনেছে কালিকা। সিলেট, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, যশোর, নদিয়া, বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের বাউল ফকিরি গান— সে সব তত্ত্বতালাশ আপনার। মঞ্চে অবিরল ঝরেছে। এই বাংলার সেই সব যা এবারে আপনার কাছে ঋণ শুধবে। বা শুধবে সুধার ঋণ। বাংলার ভাঁটফুল, নদী ও নক্ষত্র ছিন্ন খঞ্জনার পা’য় যেমন যেভাবে বেজেছিল, আপনার সুধাকরতায়। এখন শূন্য লিখতে লিখছি অতীত কাল দিয়ে। বেজেছিল। অথচ বাজবেও। যা রয়ে গেল তা বাজবে তো। তবু গাড়ি কেন দীর্ঘ থেকে হ্রস্ব হবার পথে আমাদের নিঃস্ব করে কালিকা? এ ভুবন, ব্যথাভার, নিবিড়ের এ কি অতিরেক নয়, নহে?
‘‘গাড়ি চলে না চলে না,
চলে না রে, গাড়ি চলে না।
চড়িয়া মানব গাড়ি
যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি
মধ্যপথে ঠেকল গাড়ি
উপায়-বুদ্ধি মেলে না।।’’
শাহ আবদুল করিম, গুরু-মোর্শেদের কথা মান্যতায়। এও কি ন্যায্য তবে? এইভাবে? একে একে ক্ষ্যাপার দল পথে পথে, পথে পথেই? যদি মূর্খ তবে আলো দাও। চলে যাওয়া দেখে বিস্মিত হই, আঁচে আঁচে ঘুরি সন্তাপে সান্ত্বনা নিতে। যদি দিতে পারি অনুভবে কিছু— তবে তাই সামান্য।
“পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন— মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠ্যঙারে বীরু রায়ের বটতলায় কী ধলচিতের খেয়াঘাটের সীমানায়! তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বেত্রবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে। দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডি এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে। দিন রাত্রি পার হয়ে, জন্ম-মরণ পার হয়ে, মাস বর্ষ মন্বন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়, তোমাদের মর্মর জীবন-স্বপ্ন শেওলা ছাতার দলে ভ’রে আসে, পথ আমার তখনো ফুরোয় না। চলে, চলে, এগিয়েই চলে।’’
এই মেনে নেওয়া, এরপরে?