রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল বাংলা সাহিত্যে যেন দুই ভ্রাতৃসূর্যলোক। এক-ই যুগে আবির্ভূত হয়ে তাঁরা বাংলা সাহিত্যকে নিজ নিজ প্রতিভাবলে যা দিয়ে গিয়েছেন, যাবচ্চন্দ্রদিবাকর তার মহিমা অক্ষুণ্ন থাকবে। যুগ এক, কিন্তু তাঁদের জগৎ নিজস্ব, ঘরানা স্বতন্ত্র, শৈলী আলাদা, নির্মাণের ভুবনে ফারাক, তদুপরি ভাগ্যদেবতার বিচারে একজন বরমাল্য পান তো অন্যজন বিড়ম্বিত হয়ে থাকেন। বিড়ম্বিত, তবু তাঁর হাতে-বওয়া জয়ধ্বজা অম্লান, উত্তুঙ্গ, দৃপ্ত, উজ্জ্বল ও কালান্তরী।
দুই বাঙালি কবি, দুই ধর্মসম্প্রদায়ের। একজন শহর, রাজধানীর ভূমিপুত্র ও জমিদারতনয়, অন্যজন বাংলার অজপাড়াগাঁর নিতান্ত প্রান্তবাসী নিম্নবর্গ থেকে উঠে আসা অভাজন। একজনকে পিতা যে কৈশোরে আকাশ চেনান, পাঠ দেন পাহাড়ী উপত্যকায় নিয়ে গিয়ে উপনিষদ আর হাফেজের, অন্যজন তখন বাল্যে পিতৃহীন, ফলে অধ্যয়নভ্রষ্ট, ক্ষুণ্নিবৃত্তির জন্য কখনও খাদেম, মোয়াজ্জেম, ভৃত্য আর রুটির কারখানায় শ্রমিকের পেশা বেছে নেন। হ্যাঁ, হাফেজ তিনি অনুবাদ করবেন, যদিও ফার্সি জানেন না বলে, ওই পিতৃমুখে হাফেজ-দুরস্ত কবি বিদেশে এক পার্শি পরিবারের মহিলাদের দ্বারা ভর্ৎসিত হন বলে প্রত্যক্ষকারী আচার্য সুনীতিকুমার জানিয়েছেন। একজনকে পিতা পাঠান বিলেতে ব্যারিস্টার হতে, সতের বছরের তরুণকে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে দিন কাটে তাঁর, ক্লাসে পাঠ নেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের। ওই এক-ই বয়সে অন্যজনকে কখনও লেটোর দলে যোগ দিয়ে গ্রামগ্রামান্তরে চারণকবি হতে হয়, অন্যের বদান্যতায় ত্রিশালে গিয়ে কখনও, ফের স্বস্থান চুরুলিয়ায় ফিরে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়। দুজনের আপাত মিল একাধিক বিদ্যালয়ে পাঠ নেওয়া। আপাত মিল, ম্যাট্রিকের গণ্ডি অতিক্রম না করা, এবং গভীর মিল, দুজনের লেখা-ই স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবশ্যিক পাঠ্যতালিকায়, দেশেবিদেশে তাঁদের নিয়ে অন্তহীন গবেষণা হচ্ছে এবং বিশেষ করে দুজনের গান-ই বাঙালির নন্দনভুবনে চিরসখা আর সংগ্রামের হাতিয়ার। শেক্সপিয়র বা কালিদাস, গ্যেটে ও খৈয়াম কালজয়ী প্রতিভা, কিন্তু রণে-সংগ্রামে তাঁরা ইন্ধন দেন না। শিশুতোষ কবিতা লিখে এই দুজনের মতো তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের শৈশবকাল থেকেই হৃৎকোষে স্থায়ী আসন পেতে নেই।
পিতৃ-অর্থ ও যুগপৎ ইচ্ছা জলাঞ্জলি গেল, ব্যারিস্টার হলেন না একজন। ভবিতব্য! অন্যজন নিতান্ত দারিদ্র্যের কারণে ম্যাট্রিক পরীক্ষা না দিতে পেরে চলে গেলেন নিয়তিনিয়ন্ত্রিত নক্ষত্রের মতোই বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে, এ-ও ভবিতব্য! সৈনিক কবি করাচীতে গিয়ে ফার্সিতে রপ্ত হবেন (যদিও তাঁর ফার্সিশিক্ষার গোড়াপত্তন হয় ছোটবেলাতেই, নিজ গ্রামে), রুশবিপ্লবের আঁচ পোহাবেন, সুদূর বাঙালিবর্জিত স্থানে ‘ভারতবর্ষ’, ‘মানসী ও মর্মবাণী’, ‘সওগাত’-এর গ্রাহক হবেন, কী তীব্র কারুবাসনা! এবং তার ফলেই রচিত হল ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’, বেজে উঠল নবাবির্ভূত অগ্নিবীণকারের রাগিণী! নিতান্ত অপাঙ্ক্তেয় মানুষটি মাত্র একুশ বছর বয়সে একটি কবিতা লিখে বালকবীরের বেশেই বলতে হয়, বিশ্ব জয় করে নিলেন। ‘বিদ্রোহী’। না, অন্যজন তা পারেননি, ওই বয়সে। তাঁর প্রায় ওই বয়সে লেখা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ শাশ্বত-অমর, কিন্তু অতটা হৃদয়প্লাবী নয়। বিদ্রোহীর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ‘রানার’ তথা সমগ্র সুকান্ত।
দুই কবি। দুজনেই গীতিকার সুরকার গায়ক। নতুন নতুন রাগরাগিণীর একের সঙ্গে অপরের বিয়া দেন। একজন পাশ্চাত্য গানের সুর নিয়ে আসেন তো অন্যজন আরবের। নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন গড়ে তোলেন ‘সঙ্গীতভবন’, নিজে গান শেখান, গান শেখাতে নিয়োজিত করেন গুণী শিক্ষকদের। অন্যজন গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গীতগুরুর দায়িত্বে থাকেন, আকাশবাণী কলকাতাতেও গানের তালিম দেন দূর-শিক্ষার্থীদের। সিনেমায় একজনের গান ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয় তাঁর জীবিতকালেই প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ ছবিতে। অন্যজনকে গান লিখতে হয় সিনেমার প্রয়োজনে। একজনের ছোটগল্প ‘মানভঞ্জন’-এর কাহিনি নিয়ে ছবি তৈরি শুরু হয়, আর-একজন ছবি তৈরির জন্যই লেখেন ‘সাপুড়ে’-র কাহিনি, এবং সে-ছবির জন্য গান। ছবির পরিচালনা? তাতেও রয়েছেন দুজনেই। অগ্রজের পরিচালিত ছবি নিজের লেখা নিয়ে— ‘নটীর পূজা’। আর অনুজের ‘ধূপছায়া’। দুজনের নিজ নিজ ছবিতে অভিনয়-ও রয়েছে। তবে অনুজের ফিলমি জগৎ অগ্রজের চেয়ে প্রশস্ততর, যদিও তিনি অগ্রজের মতো অনুজের রাশিয়ায় গিয়ে আইজেনস্টাইনের ‘Battleship Potemkin’ দেখার সুযোগ হয়নি পরিচালকের স্ত্রীর পাশে বসে। একাধিক ছবির সঙ্গীত পরিচালক অনুজ,— জামাই ষষ্ঠী, গৃহদাহ, ধ্রুব, পাতালপুরী, সাপুড়ে, গ্রহের ফের, রজতজয়ন্তী, নন্দিনী, অভিনয়, দিকশূল, চৌরঙ্গী। শেষতম ছবিটির হিন্দি ভার্সনের জন্য সাতখানি গান লিখেছিলেন তিনি, হিন্দিতে। আর অগ্রজের জীবিতকালে ১৯৩৮-এ নির্মিত ‘গোরা’- র সঙ্গীতপরিচালনাতেও ছিলেন তিনি।
দুজনের বয়সের ব্যবধান উনচল্লিশ বছরের। তবু ১৯২৩-এ অগ্রজ ‘বসন্ত’ উৎসর্গ করেন তাঁকে, আর ১৯২৯-এ অনুজ সঞ্চিতা উৎসর্গ করেন অগ্রজকে। ভ্রাতৃপ্রতিম অগ্রজকে কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির অনুষ্ঠানে প্রণামান্তে দর্শকাসনে বসতে গেলে অগ্রজ তাঁর হাত ধরে মঞ্চেই তাঁর পাশটিতে বসান। তাঁকে কবি সত্যেন্দ্রনাথ বলেন (ছান্দসিক সত্যেন্দ্রনাথের প্রয়াণেই ইনি লিখবেন, ‘অসত্য যতো রহিল পড়িয়া, সত্য সে গেল চলি’), ‘তুমি ভাই নতুন ঢেউ এনেছ। আমরা তো নগণ্য, স্বয়ং গুরুদেবকে পর্যন্ত বিস্মিত করেছ তুমি।’
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, উভয়ে দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। এক-ই সঙ্গে দুজনের ধর্মীয় উদারতাও বিস্ময়কর। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ সনাতন হিন্দু দেবদেবীদের স্থান দেন তাঁর সাহিত্যে। নিরাকার ব্রহ্মোপাসক কবি তাঁর ‘শান্তিনিকেতন’ বক্তৃতামালায় পরমব্রহ্মের ব্যাখ্যা দিয়ে চলেন। পাশাপাশি তিনি সাকারে-ও যে শ্রদ্ধান্বিত, তার প্রমাণ তাঁর গানের এসমস্ত চরণ, ‘চরণ ধরিতে দিও গো আমারে, নিও না নিও না সরায়ে’, কিংবা ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ’, যেখানে দেবীকে ‘শুভ্র মেঘের রথে’ পৃথিবীতে নেমে আসতে তিনি আহ্বান জানাচ্ছেন। পৌত্তলিকতা? তার চেয়েও বড়কথা ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার উপরে উঠতে পারা। সেজন্যই তিনি হিন্দু পুরাণকে ব্যবহার করে লেখেন ‘শারদোৎসব’, ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’, ‘রথের রশি’, ‘নটরাজ ঋতুরঙ্গশালা’। আবার হিন্দুধর্মের গোঁড়ামিকে আঘাত করতেও তিনি ছাড়েন না তাঁর ‘অচলায়তন’ ও ‘বিসর্জন’ নাটকে, ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসে। শেষদুটি লেখায় কালীর সামনে পশুবলির ঘোর বিরোধী কবি কিন্তু আবার শ্যামাসঙ্গীত-ও লিখেছেন তাঁর ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ গীতিনাট্যের জন্য,— ‘রাঙাপদপদ্মযুগে প্রণমি গো ভবদারা’। লিখেছেন বুদ্ধদেব ও যিশুখ্রিস্টকে নিয়ে কবিতা ও গান। জার্মানিতে ‘Passion Play’ দেখে লেখেন যিশুকেন্দ্রিক ‘Child Pilgrim’, এবং তার বঙ্গানুবাদ করেন ‘শিশুতীর্থ’ নামে। বুদ্ধ ও যিশুকে নিয়ে তিনি সারাজীবন যা লিখেছেন, আলাদা করে দুটি বই আছে তা নিয়ে। অনুবাদ করেছেন কবীরের একশো দোঁহা, ইংরেজি থেকে। উপনিষদের পাশাপাশি তুকারাম অনুবাদেও তিনি স্বচ্ছন্দ। আর অন্তিমে এসে তাঁর বিখ্যাত ঘোষণা, ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন’ উচ্চারণ আমাদের শিহরিত না করে পারে না।
এইবার নজরুলের ধর্মৈষণার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। কী বার্তা সেখানে?
নজরুল মুসলমান। খাদেম। মসজিদে আজান দিতেন একসময়, অর্থাৎ মোয়াজ্জেম। কিন্তু নিজ মুদ্রাগুণে তাঁর মধ্যে যে ধর্মীয় সম্প্রসার লক্ষ্য করি, বিস্মিত না হয়ে পারি না।
নজরুল অতি অল্প বয়স থেকেই ইসলামের ধর্মীয় ব্যাপারগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। মুসলমানের ঘরে জন্মেছিলেন বলে নয় কেবল, পিতৃপিতামহের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার দৌলতে। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহ্ এবং পিতা কাজী ফকির আহমেদ ছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলমান। ফকির আহমেদ ইমামতি করতেন ও মাজারের খাদেম ছিলেন। পিতার দ্বিতীয় বিবাহের ষষ্ঠ সন্তান নজরুলকে ন’বছর বয়সে পিতৃহারা হতে হলে তাঁর প্রথমে মক্তবে নিম্ন মাধ্যমিক পাশ-অন্তে সেখানেই যেমন শিক্ষকতা করতে হয়েছিল, পাশাপাশি দায়িত্ব নিতে হয়েছিল মুয়াজ্জিনের কাজের। এইসব কারণে নজরুলের ইসলাম-সম্পৃক্তি প্রবল হয়েছিল। কিন্তু ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে সমর্থ হন তিনি একদিকে নিজের মানসিক সহজাত ঔদার্যগুণে, অন্যদিকে লেটোর দলে যুক্ত হয়ে, যেখানকার গান ও অভিনয়ে হিন্দু অনুষঙ্গ ও পুরাণের অজস্রতা তাঁকে সনাতন ধর্মে অবগাহন করায়। এসময়ে নজরুল যে পালাগুলো লেখেন, তার নামগুলো জানলেই আমাদের প্রত্যয় হবে, পনেরো বছর বয়সের মধ্যেই হিন্দুধর্মের কতটা ভিতরে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। তাঁর পালাগুলোর নাম শকুনিবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ। তিনি আকবর বাদশা লিখছেন, পাশাপাশি কালিদাস।
প্রতিতুলনায় যেতে ইচ্ছে করে। রবীন্দ্রনাথ ওই বয়সে রূপ দিচ্ছেন বৈষ্ণবকবিতা। সমালোচনা করছেন মেঘনাদবধ কাব্যের। আশ্চর্য, নজরুলের অন্যতম পালার নাম মেঘনাদবধ। রবীন্দ্রনাথ না-হয় মাইকেলের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন ‘বঙ্গদর্শন’-এ মেঘনাদবধ প্রকাশের সুবাদে। কিন্তু নজরুল? তাঁর কাছে আলো এসে পৌঁছল কীভাবে?
নজরুল বিস্ময়কররকমভাবে তাঁর সাহিত্য,— কী কবিতা, গান, গল্প-উপন্যাসে হিন্দু পুরাণকে এমন অনায়াসে ও সার্থকভাবে ব্যবহার করে গেছেন যা রীতিমতো গবেষণার বিষয় হওয়া উচিত। তাঁর মতো এত শ্যামাসঙ্গীত আর কেউ লেখেননি। সন্তানের নাম নির্দ্বিধায় কৃষ্ণ, সব্যসাচী, অনিরুদ্ধ রাখবার মধ্যে যে ধর্মীয় উদারতা, তা অন্যত্র আর পেলাম কই?
তাই বলে ইসলামের প্রতি তিনি ঔদাসীন্য দেখাননি কখনও। আমরা জানি, ইসলামি গান লেখার অগ্রদূত তিনি। তাঁর গানের সংকলন ‘জুলফিকার’- এর পাঠক জানবেন, ইসলাম তাঁর মধ্যে কী গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। নিজের জীবন বরাবর দারিদ্র্যকণ্টকিত ছিল। তিনি ভ্রূক্ষেপ করেননি। লিখেছেন, ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান/ তুমি মোরে দানিয়াছো খ্রীষ্টের সম্মান/ কণ্টকমুকুটশোভা’। আবার এই দীনাবস্থার জন্য অন্যত্র তাঁর আক্ষেপ দেখি ‘জুলফিকার’-এর একটি গানে, ‘হায় গো খোদা, কেন মোরে/ পাঠাইলে হায় কাঙাল করে/ যেতে নারি প্রিয় নবীর মাজারশরীফ জিয়ারতে।’
নজরুলের আরবি-ফার্সি চর্চা নানান সময়ে নানান লোকের মাধ্যমে হয়, এবং তা যথেষ্ট পরিণত ছিল বলেই তাঁর হাত দিয়ে বেশ কিছু ফারসি কবির কবিতা অনূদিত হতে দেখি। এর মধ্যে হাফিজ ও ওমরখৈয়াম প্রধান।
তাছাড়া রয়েছে আমপারা-র অনুবাদ। তাঁর ইচ্ছে ছিল সমগ্র কোরানশরীফ অনুবাদ করার। সময়াভাবে তা তিনি পারেননি। আমপারা-র ভূমিকায় তিনি লিখছেন, ‘বহুবৎসরের সাধনার পর খোদার অনুগ্রহে অন্তত পড়ে বুঝবার মতো-ও আরবি-ফার্সি ভাষা আয়ত্ত করতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করছি।’ উল্লেখ্য, নজরুল ফার্সি জানতেন অনেকে লিখেছেন, কিন্তু তাঁর আরবিতে অধিকার ছিল, একথা তাঁর এই বয়ান ছাড়া আর বিশেষ কোথাও পাওয়া যায় না।
‘শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার,/ করুণা ও দয়া যার অশেষ অপার।/ সকলি বিশ্বের স্বামী আল্লার মহিমা/ করুণা কৃপার যার নাই নাই সীমা।’— এইভাবে শুরু হয়েছে আমপারা।
নজরুল হজরত মহম্মদ রসূলুল্লাহের জীবনীও লিখতে শুরু করেছিলেন। অসমাপ্ত এই কাব্যটি বড় উপেক্ষিত হয়ে আছে। অথচ নজরুল-প্রতিভার বিশেষ স্বাক্ষর রয়েছে কাব্যটিতে। সাধারণত মহাপুরুষদের জীবনীকে কাব্যরূপ দেওয়া কঠিন, কেননা আবেগ আর ভক্তি এসে কাব্যের রসহানি ঘটাতে পারে। কিন্তু নজরুলের এই কাব্যটি, অসমাপ্ত এবং তাঁর অসুস্থতা-পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়, ১৯৫১-তে। ‘মরুভাস্কর’ নামে খ্যাত কাব্যটিতে শিশু মহম্মদের (স.) রূপবর্ণনা, ‘যায় রে পথে ফিনকি রূপের ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিক/ আরব-সাগর-মন্থন-ধন আরব দুলাল নীল মানিক’। নীল মানিক! এখানে কি আমরা শ্রীকৃষ্ণের রূপের ছায়া দেখি না? আর মনে পড়ে যায় আমাদের, তিনি তো কৃষ্ণ ও মহম্মদকে সেই কবেই মিলিয়েছিলেন তাঁর প্রথম পুত্রের নাম যখন ‘কৃষ্ণ মহম্মদ’ রাখেন।
নজরুল মুসলমান, কিন্তু ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বে। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু, অপিচ ব্রাহ্ম, কিন্তু ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বে। রবীন্দ্রনাথ শ্যামাসঙ্গীত লেখেন, নজরুল অজস্র। তার ওপর ঘরে কালীমূর্তি ও জায়নামাজের সমাহার। দুর্গা ওরফে আনন্দময়ীকে ডিকন্সট্রাক্ট করে যে কবিতা লেখেন, তাতে জেলে যেতে হয় নজরুলকে। নজরুলের কবিতায় ও গানে হিন্দু পুরাণের ব্যবহার যত্রতত্র। তাঁর হিন্দু অনুষঙ্গভিত্তিক কবিতা ও গান এমনকি প্রত্যাশা ছাড়িয়ে আগমনী-বিজয়ার গান পর্যন্ত গিয়েছে, এবং তা চমৎকার ও অভিনব। মধুসূদনের ‘যেও না রজনী আজি লয়ে তারাদলে,/ গেলে তুমি, দয়াময়ী, এ পরাণ যাবে’-র মধ্যে যে মেনকার আকুতি, তা চিরায়ত বিজয়ার গানের সঙ্গে একসুরে বাঁধা। কিন্তু নজরুল তাতে অভিনবত্ব আনলেন। তাঁর বিজয়ার গানে বিনির্মাণ: মেনকা দেবী দুর্গাকে পিতৃগৃহ ছেড়ে কৈলাশে যেতে বাধা দিচ্ছেন না, কেবল গৌরীর চার ছেলেমেয়ে লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক ও গণেশকে নিজের কাছে আটকে রেখে বলছেন, এবার দেখা যাক পুত্রকন্যার সান্নিধ্যবঞ্চিত হয়ে কতদিন উমা পতির কাছে থাকতে পারেন। এই বিনির্মাণ, এই Negative capability দুর্লভ, দুর্লভ, দুর্লভ!
নজরুলের অন্তরঙ্গগোষ্ঠীতে যেমন ছিলেন মুজফফর আহমেদ, শেরে বাংলা ফজলুল হক, মোহম্মদ নাসিরউদ্দীন (‘সওগাত’-সম্পাদক), আর আব্বাস উদ্দীন, কাজী মোতাহার হোসেন এবং হবীবুল্লাহ্ বাহার-শামসুননাহারের মতো বিশিষ্টজনেরা, তেমনই রবীন্দ্রনাথ-শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়-সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-দিলীপকুমার রায় ও কমল দাশগুপ্ত সহ বহু বহু মানুষ। আবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে উপমহাদেশের অসংখ্য মুসলমানের অন্তরঙ্গতা ছিল। বাঙালি মুসলমানদের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে তাঁর গাঢ় পরিচয়ের প্রমাণ ভুঁইয়া ইকবাল-সম্পাদিত বই, যেখানে অন্তত পঞ্চাশজন খ্যাত-অখ্যাত মুসলমানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রবিনিময়ের বিবরণ পাই, তাঁদের কবিকে লেখা পত্র এবং তাঁদের প্রতি কবির লেখা পত্রসমেত। এমনকি সপ্তম শ্রেণিতে পাঠরত সৈয়দ মুজতবা আলীর চিঠির উত্তর পর্যন্ত দেন তিনি নিষ্ঠাভরে! আরও কৌতূহলের, তিনি সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে দিয়ে হজরত মহম্মদের জীবনী লিখিয়েছিলেন, যে জীবনীগ্রন্থটি ১৯২৬ সালে বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। লালনকে তিনি পাশ্চাত্যে পরিচয় করিয়েছিলেন। সীমান্তগান্ধী বলে পরিচিত খান আবদুল গফফর খান শান্তিনিকেতনে কবির সম্মানিত অতিথি হয়ে আসেন, আর এই পাঠান নিজের ছেলেকে শান্তিনিকেতনে পড়তে পাঠান। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ থেকে কাজী আবদুল ওদুদ, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান থেকে নজরুল, সবাইকে তিনি শান্তিনিকেতনে উদার আহ্বান জানিয়েছিলেন বক্তৃতা দিতে। নজরুলকে শান্তিনিকেতনে ড্রিলমাস্টারের চাকরিও দিতে চেয়েছিলেন। বাউন্ডুলে কবি নেন কী করে তা? কবি বন্দে আলী মিয়া এবং জসীমউদ্দীনকে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যরচনায় কেবল উৎসাহ-ই দেন না, লেখার প্লট পর্যন্ত বলে দেন। প্রথমজনকে ‘বালুচর’, দ্বিতীয়জনকে ‘পল্লীবধূ’।
নজরুলের বই ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বাজেয়াপ্তির তালিকায় কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বই-ও আছে। ‘রাশিয়ার চিঠি’-র ইংরেজি অনুবাদ সরকারি রোষে পড়ে বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সোভিয়েত রাশিয়ায় ভ্রমণকে অভিহিত করেছিলেন ‘তীর্থযাত্রা’ বলে। অন্যদিকে নজরুল তাঁর ‘ব্যথার দান’ উপন্যাসে ১৯২০ সালেই নিয়ে আসেন রুশবিপ্লব প্রসঙ্গ। ম্যাক্সিম গোর্কিকে নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন। দুজনের-ই তাই রুশ-সম্পৃক্তি এবং রুশ-প্রীতি ছিল লক্ষ্যণীয়ভাবেই প্রবল।
এই দুই কবিকে যদি আপামর বাঙালি হৃদ্গত করে নিতে পারি, আমরা যথার্থ বাঙালি হতে পারব, পারব বিশ্বনাগরিক হতে। দুজনের-ই জীবনদর্শন এক জায়গায় এসে মিশেছে, যখন রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’, আর নজরুল, ‘আমি আজ-ও মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি’।