Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

পরশপাথর

তাঁর মতো খুঁতখুঁতে মানুষের হাতে নোটখানা কী করে যে এল, অনেক ভেবেও ব্যোমকেশবাবু তার কিনারা করতে পারলেন না। তিনি বাজারে গিয়ে প্রতিটি আলু পুঙ্খনুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা না করে কেনেন না, মাছের কানকো উল্টে নাকের কাছে ধরে গন্ধ বিচার করেন, দাড়িপাল্লায় কারচুপি আছে কিনা পরখ করতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই দোকানদের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন, বাসে উঠে ভাড়ার তালিকা দেখতে চান, এমনকী আঁটির সাইজ না জেনে কখনও আম পর্যন্ত কেনেন না।

এহেন ব্যোমকেশবাবু নিজের পকেটে ওই অচল নোটখানা আবিষ্কার করে খুব মুষড়ে পড়লেন। একখানা পুরনো পাঁচ টাকার নোট, সেটির নম্বরের শেষ সংখ্যা সহ ছেঁড়া কোণটাতে সাদা কাগজের তাপ্পি মেরে অদক্ষ হাতে একটা কাল্পনিক সংখ্যা বসানো, সাদা জলছবির জায়গাটায় আফ্রিকার মানচিত্রের আদলে বড়সড় গর্ত, মাঝখান বরাবর দুভাগ হয়ে যাওয়া অংশ দুটো সেলোটেপ দিয়ে জোড়া। ডানদিক-ঘেঁষা সিকিয়োরিটি থ্রেডখানা কেউ যত্ন করে তুলে নেওয়ার ফলে সেখানে আড়াআড়ি ক্ষত।

সব কাজ ভুলে তিনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কার কার সঙ্গে টাকার লেনদেন করেছেন, মনে করবার চেষ্টা করলেন। মুদি গৌর সাধুখাঁ থেকে জুতো সেলাইওয়ালা হারাধন রুইদাস, সন্দেহের তালিকা থেকে কাউকেই বাদ দিতে পারলেন না। ভাবতে ভাবতে সারা রাত ভাল করে ঘুমই হল না!

পরদিন সাতসকালে উঠে জনে জনে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, দেখো তো, এই নোটখানা চিনতে পারো কিনা? আমি যতটা মনে করতে পারছি, গতকাল এটা তুমিই আমাকে দিয়েছিলে। ব্যোমকেশবাবুর কথা শুনে কেউ হেসেই উড়িয়ে দিল, কেউ বা চটে লাল হয়ে গেল। গৌর সাধুখাঁর এলাহি কারবার, তাঁর দোকানে কিছু কিনতে হলে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। তিনি ব্যোমকেশবাবুকে মাঝপথে থামিয়ে বললেন, অত কথার দরকার কী মুখুজ্জেমশাই, এই নেন আপনার পাঁচ টাকা!

ব্যোমকেশবাবু হাসিমুখেই টাকাটা নিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু গৌর সাধুখাঁ ছেঁড়া নোটখানা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ওটা বরং আপনার কাছেই রাখুন, ওসব ছেঁড়া-ফাটা নোটের কারবার আমরা করি না!

অপমানে ব্যোমকেশবাবুর চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। তিন একটা কড়া জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু লাইনে দাঁড়ানো অন্য খদ্দেররা ওটা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করছে দেখে রণে ভঙ্গ দিলেন।

একবার যখন গছাতে পেরেছে, ওই নোটখানার মালিকানা যে কেউই স্বীকার করবে না, এ ব্যাপারে তাঁর আর কোনও সন্দেহ রইল না। কিন্তু ছেঁড়া নোটখানা তাঁর বুকপকেটে বেলকাঁটার মত এমন খচখচ করে বিঁধতে লাগল যে সেটা পুনরায় কাউকে না গছানো পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছিলেন না।

কথায় আছে, ময়লা নোট বেশি হাতবদল হয়! ব্যোমকেশবাবুও এবার আদাজল খেয়ে লেগে পড়লেন নোটখানা চালাবার জন্যে।

একটু বেলার দিকে দুধওয়ালা এল, মাসকাবারি দুধের দাম নিতে। খানকয়েক সচল নোটের মধ্যে খুব যত্ন করে ওই নোটখানাকে গুঁজে দিয়ে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

দুধওয়ালা টাকার গোছার মধ্যে নোটখানা আবিষ্কার করে আঁতকে উঠল, এ কেয়া হ্যায় বাবুজি!

—পাঁচটাকার নোট হ্যায়, দেখতা নেহি?

—ইয়ে পাঁচ রুপেয়াকা নোট হ্যায়? রুপেয়াকা বাত ছোড়িয়ে, পাঁচ পয়সা সমঝকর কৈ লেগা ইয়ে নোট?

—অ্যা! তুম যে দুধমে জল মিশাতা হ্যায়, আমি জানি না সোচা? জ্যায়সা দুধ, ঐসা পয়সা!

এরপর প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে বিস্তর বাকবিতণ্ডার পরও দুধওয়ালা নোটখানা নিতে রাজি হল না।

ব্যোমকেশবাবু কিন্তু হাল ছাড়লেন না। একে একে কাজের মাসি মানদা গেল, ইস্তিরিওয়ালা পবন গেল, সাইকেল মিস্ত্রি বিশ্বনাথ গেল। এমনকী নোটখানা দেখে গান গেয়ে ভিক্ষে করতে আসা কানা গোঁসাইয়ের পর্যন্ত দৃষ্টিশক্তি ফিরে এল।

ব্যোমকেশবাবুর জেদও উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। যে করেই হোক ওই নোটখানার একটা হিল্লে না করে ছাড়বেন না। অনেক ভেবেচিন্তে গিয়ে ধরলেন মোড়ের মাথার হাজারিবাবুর ছেলে রন্টুকে। ছোকরা একটু ফিচেল বটে, কিন্তু দেহে দয়ামায়ার অভাব নেই! রাস্তায় দেখা হলে ভালমন্দ জিজ্ঞেস করে, হাতের আড়ালে বিড়ি লুকোয়! ইদানীং ডালহৌসির ওদিকে কোথায় নাকি কী কাজে ঢুকেছে! সেখান থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তো একেবারে ঢিলছোড়া দূরত্বে। তিনি শুনেছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নাকি এ ধরনের ছেঁড়া-ফাটা নোট বদলে দেয়।

কিন্তু নোটখানা হাতে নিয়ে রন্টু খুব নিরীহ মুখ করে বলল, এ জিনিস তুমি পেলে কোথায় জ্যেঠু? এ যে যাকে বলে, এক্কেবারে মহামূল্যবান সম্পদ! তুমি তো জ্যাকপট মেরে দিয়ে বসে আছ!

—মানে?

—মানে এমন জিনিস আজকাল তো আর দেখা যায় না! খামোখা রিজার্ভ ব্যাঙ্কে দিয়ে লোকসান করবে কেন? তাছাড়া নম্বর-ছেঁড়া নোট রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নেয় না!

—বলিস কী?

—ঠিকই বলছি জ্যেঠু। তুমি বরং এক কাজ করো, এটা নিয়ে সোজা মিউজিয়ামে চলে যাও, এমন খাসা জিনিস পেলে ওরা মোটা দামে কিনে নেবে!

ভয়ঙ্কর চটে গিয়ে একটা জুতসই জবাব দিতে গিয়েও অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলেন। বলা তো যায় না, ছেলেছোকরাদের যা মতিগতি, বিগড়ে গিয়ে হয়তো এরপর মুখের উপর ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করবে!

হঠাৎ ওঁর অবিনাশের কথা মনে পড়ে গেল। অবিনাশ একসময় তাঁর সহকর্মী ছিল। অমন ধুরন্ধর মানুষ তিনি জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখেননি। লোকে বলাবলি করত, সে নাকি একবার রাইটার্স বিল্ডিং ভাড়া দেবে বলে এক নতুন কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে আগাম বায়না নিয়েছিল।

একদিন অবিনাশ কথায় কথায় বলেছিল, অচল পয়সা চালাবার সবচেয়ে ভাল জায়গা হল ভিড় বাস। ভিড়ের মধ্যে কন্ডাক্টরদের নাকি অত খুঁটিয়ে দেখবার সময় থাকে না। তাছাড়া ছোটখাটো ছেঁড়াফাটা নাকি ওরা ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করে না!

ব্যোমকেশবাবু বরাবর একটু বেলা করে অফিসে যান। তাঁর ধারণা, সকাল সকাল অফিসে যায় দু’ধরনের লোক। এক, যাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অফিস ছাড়া অন্য কোনও যাওয়ার জায়গা নেই, আর দুই, অফিসে যাদের ধান্দা আছে! তাঁর বিশ্বাস, ও দুটোর কোনও ক্যাটেগরিতেই উনি পড়েন না।

যথারীতি একটু বেলার দিকে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালেন। বাড়ি থেকে মনে মনে পরিকল্পনা করে বেরিয়েছেন, প্রথমে দেখতে হবে, বাসে ভিড় কেমন। উপচে-পড়া ভিড়ের মধ্যে একবার সেঁধিয়ে যেতে পারলেই কেল্লা ফতে! অন্যান্য দিন অবশ্য তিনি বসার সিট না থাকলে একের পর এক বাস ছাড়তে থাকেন।

দীর্ঘ অপেক্ষার পর অনেক বাছবিচার করে শেষমেশ একটা ভিড়ে ঠাসা বাস পেয়ে উঠে পড়লেন। তারপর ভেতরে ঢুকবার জন্যে আপ্রাণ গুঁতোগুঁতি করেও একচুল এগোতে না পেরে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে বেজায় ফুর্তি, এবার অবিনাশের দাওয়াই আর নিজের হাতযশ!

কিন্তু ব্যোমকেশবাবুর সেই ফুর্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। পরের স্টপেজেই হুড়মুড় করে একগাদা লোক লোক নেমে গেল। বাস প্রায় ফাঁকা। মুখ চেনা কন্ডাক্টর হেসে বলল, কী হল, নামবেন তো লাস্ট স্টপেজে, খামোকা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? সিট খালি হয়েছে তো, বসে পড়ুন!

অগত্যা বসতেই হল। তবে খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। কী কৌশলে নোটখানা যে কন্ডাক্টরের হাতে গুঁজে দেবেন ভাবতে গিয়ে ভেতরে ভেতরে ঘামতে শুরু করলেন। বুকের মধ্যে বিনা টিকিটের রেলযাত্রীর মত দুন্দুভি বাজতে লাগল।

Advertisement

তবে সহজে হাল ছাড়বার পাত্র নন তিনি। টেনশন কাটাবার জন্যে জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখতে দেখতে মনে মনে গায়ত্রী মন্ত্রের মত ‘মন্ত্রের সাধন, নয়তো শরীর পাতন’ জপ করতে লাগলেন।

যথাসময়ে কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতে তিনি গম্ভীর মুখে কয়েকটা খুচরো পয়সার সঙ্গে সেই পেঁচোয়-পাওয়া নোটখানা ধরিয়ে দিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তাতে অবশ্য বুকের ধুকপুকুনি কমল না, বরং বেড়ে গেল।

কিমাশ্চর্যম অতঃপরম! কন্ডাক্টর আড়চোখে একবার নোটখানা দেখলেন বটে, কিন্তু বিনা বাক্যব্যয়ে সেটাকে ভাঁজ করে হাতের আঙুলের মধ্যে গুঁজে নিয়ে টিকিট ধরিয়ে দিলেন। ব্যোমকেশবাবুর বুক থেকে আধমণি পাথর নেমে গেল।

ফুরফুরে মেজাজে তিনি পাশে বসা সহযাত্রীর সঙ্গে খেজুরে গল্প জুড়ে দিলেন। এখনকার দিনের রাজনীতিকরা কতখানি অসৎ এবং সৎ মানুষেরা রাজনীতিতে কেন আসছেন না, সে বিষয়ে এক দীর্ঘ বক্তৃতা ফেঁদে বসলেন।

বেশ চলছিল। হঠাৎ এক প্রমীলা-কণ্ঠের চিৎকারে সকলে চমকে উঠল। মহিলা তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন, খুচরো নেই বলে তুমি এই বারো-আনা-নেই সবুজ কাগজখানা গছাবে? এটা কী আর চলার যুগ্যি আছে?

বাসসুদ্ধু লোক মহিলার দিকে তাকিয়ে। রীতিমত সাজুগুজু করা পালিশ-সুন্দরী, কথার ভঙ্গিতে ঝগড়ায় পিএইচডি-র আভাস।

কন্ডাক্টরও নাছোড়বান্দা। তাঁর সাফ কথা, হয় এই নোটটা নিন, নইলে খুচরো বের করুন। বাড়িতে তো আর টাঁকশাল নেই দিদি যে, খুচরো তৈরি করব?

ব্যোমকেশবাবু কান খাড়া রেখে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরলেন। ঝগড়ার উত্তাপ যত বাড়তে লাগল, বুকের দুন্দুভিটার জোর তত বাড়তে লাগল। প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা, এই বুঝি কন্ডাক্টর নোটখানা তাঁকে ফেরত দিতে আসেন!

কতক্ষণ এভাবে চলত বলা মুশকিল, কিন্তু মাঝখান থেকে এক প্রগতিশীল ছোকরা কন্ডাক্টরের পক্ষ নিয়ে বলল, ‘তুমি’ করে বলছেন কেন? কন্ডাক্টর বলে কি ওঁর কোনও সম্মান নেই?

এতক্ষণ যারা চুপচাপ মজা দেখছিল, ওই ছোকরার কথায় হঠাৎ তাদের বিবেক জাগ্রত হয়ে উঠল। তারাও বলতে শুরু করল, ঠিকই তো! রাজ্যে চাকরিবাকরি নেই, কত ভদ্র পরিবারের শিক্ষিত মানুষ নিরুপায় হয়ে কন্ডাক্টরি করছেন। তাঁকে এভাবে অসম্মান করা আসলে—!

বেগতিক দেখে ভদ্রমহিলা পার্স হাতড়ে এবং ভ্যানিটি ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে অবশেষে খুচরো টাকায় ভাড়া মিটিয়ে চুপচাপ নেমে গেলেন।

ব্যোমকেশবাবু তাঁর রাগে গনগনে মুখখানার দিকে একবার তির্যক তাকিয়েই যোগনিদ্রায় ডুব দিলেন।

ঝগড়া কিন্তু চলতেই থাকল। কেউই নোটখানা নিতে চাইছে না। অথচ কন্ডাক্টর নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল। হয় এই পাঁচটাকার নোটখানি নাও, না হলে খুচরো দাও।

মাঝে মাঝে বাস থামছে, পুরনো প্যাসেঞ্জারদের কেউ কেউ নেমে যাচ্ছেন, একজন দুজন করে নতুন মানুষ উঠছে, কিন্তু ঝগড়ার বিরাম নেই। এ যেন ঝগড়ার রিলে রেস, ব্যাটনটা ক্রমাগত হাতবদল হয়ে চলেছে!

কন্ডাক্টরের দুরবস্থা দেখে একসময়ে ব্যোমকেশবাবুর মনে কিঞ্চিৎ অনুশোচনা হল। সামান্য পাঁচ টাকার একখানা নোট নিয়ে সারাটা পথ ওই বেচারাকে কম ভোগান্তি তো পোহাতে হল না!

তবে মনে মনে কষ্ট পেলেও এত ঘটনার পর সর্বসমক্ষে নোটখানাকে নিজের বলে দাবি করতেও কেমন যেন সংকোচ হল।

তিনি স্থির করলেন, নামার সময় পাঁচ টাকা দিয়ে ওর কাছ থেকে ওই ছেঁড়াখোড়া নোটখানা ফেরত নেবেন। হাজার হোক, এপথে তাঁর নিত্যি যাতায়াত, কন্ডাক্টরও চেনা মানুষ!

শেষ স্টপেজে সব প্যাসেঞ্জার নেমে যাওয়ার পর ব্যোমকেশবাবু অপরাধীর মত মুখ করে কন্ডাক্টরকে বললেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে ভাই। আজ আমার জন্যেই তোমাকে, মানে আপনাকে এত হেনস্থা হতে হল। আমার খুবই খারাপ লেগেছে। আপনি বরং এক কাজ করুন, এই নিন পাঁচ টাকা, ওই ছেঁড়া নোটখানা আমাকে ফিরিয়ে দিন!

ব্যোমকেশবাবুর কথা শুনে কন্ডাক্টর মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললেন, আপনি তো চোখ বন্ধ করে ভিটকি মেরে বসে ছিলেন, আমার হেনস্থা দেখলেন কী করে?

ব্যোমকেশবাবু আমতা আমতা করে বললেন, না মানে ঠিক দেখিনি বটে, তবে কান তো আর বন্ধ রাখা যায় না! যা শুনতে হল সারাটা পথ, তার জন্যে আমি সত্যি লজ্জিত!

কন্ডাক্টর মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এটাই হল আসল কথা। চোখ বন্ধ ছিল বলে আপনি নাটকের ভিতরকার নাটকটা মিস করে গেছেন।

ব্যোমকেশবাবু শঙ্কিত গলায় বললেন, তার মানে? গায়েফায়ে কেউ হাত তুলেছিল নাকি? দেখুন দেখি, কী লজ্জার কথা! আমি সত্যিই দুঃখিত, দিন আমাকে নোটটা।

ফিচেল হেসে বললেন, পাগল, না মাথাখারাপ? এই নোট আর আমি হাতছাড়া করি? দেখুন, আপনার ওই একখানা নোট দেখিয়ে আজ প্যাসেঞ্জারদের কাছে থেকে কত খুচরো বের করেছি!

বলতে বলতে তিনি খুচরো-ভর্তি চামড়ার ব্যাগটা ওঁর চোখের সামনে তুলে ধরলেন।

ব্যোমকেশবাবু ফ্যালফ্যাল করে সেই পূর্ণগর্ভা ব্যাগটার দিকে চেয়ে আছেন দেখে কন্ডাক্টর খুশির গলায় বললেন, খুচরোর যা আকাল, কী বলব মশাই, একশ’ টাকায় দশ টাকা বাটা দিয়ে খুচরো কিনতে হয়। আজ আমার কত টাকা বেঁচে গেল বলুন তো!

সহসা ব্যোমকেশবাবুর বুকের ব্যথাটা যেন দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এল।

নিজের অজান্তে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বাস থেকে নামতে নামতে ভাবলেন, ঠাট্টা করে হলেও রন্টু খাঁটি কথাই বলেছিল! অমন একখানা অমূল্য পরশপাথর, সেটা কিনা হেলায় হারিয়ে ফেললেন!

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

4 Responses

  1. গল্প টা পড়ে , বেশ‌ মজা লাগছিল, পরবর্তী ঘটনার মূহুর্তে টান টান উত্তেজনা

  2. অসাধারণ গল্প। শেষের এন্টিক্লাইম্যাক্সটিও অপূর্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × one =

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আমার স্মৃতিতে ঋত্বিককুমার ঘটক

দুটো‌ জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম তাঁর।‌ এক, তিনি কথা বলার সময় আত্মমগ্ন‌ থাকতেন। কারও দিকে‌ তাকিয়ে‌ কথা বলতেন না। তাকাতেন‌ হয় সুদূরে, আর নয়তো‌ চোখ বুজে‌ কথা বলতেন। আর দ্বিতীয় যা, তা হল‌ ঋত্বিকের চোখ। এত উজ্জ্বল আর‌ মরমী, এক-ই সঙ্গে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আর লুব্ধক নক্ষত্রের মতো দীপ্ত, তা আর কারও মধ্যে দেখিনি। সত্যজিৎ-মৃণালের মধ্যেও না, যদিও ঘটনাচক্রে ওই দু’জনের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল অনেক বেশি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »
মণিকর্ণিকা রায়

অনুগল্প: অর্জন

অসহায় বৃদ্ধের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝেমাঝে গল্পও করত ওঁর সাথে। আদিত্য লক্ষ্য করেছিল এই ব্যাপারটা যেন তার মনে একটা বদল আনছে— যেন রোজ তার শরীর-মন জুড়ে সঞ্চালিত হচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। যেন সে সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

Read More »
মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »