Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

নদী

নদী দেখার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে অত্যন্ত স্মরণীয় একটি ঘটনা। আমার নদী দেখার অভিজ্ঞতা অনেক সুন্দর ছিল। প্রথম কিছু সব সময় সুন্দর হয়। নদী দেখার প্রথম সৌভাগ্য হয়েছিল মামার বাড়ি যাওয়ার পথে। মামার বাড়ি পাবনাতে একদম পদ্মার পাড়ে। নৌকায় গিয়েছিলাম। নৌকার প্রথম ভ্রমণ আর প্রথম নদী দেখা। ভয় লেগেছিল কিন্তু খুব মজাও হয়েছিল। পদ্মা নদীতে নৌকায় প্রথম ভ্রমণ-মুহূর্ত ভাবলে এখনও আমার ভাল লাগে। নৌকায় বসে পদ্মা নদীর জল ধরা, এপার থেকে ওপার কিছু না দেখা, বন-গাছপালা ঘেরা নদী এপার থেকে ওপার আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া, সেই অভিজ্ঞতাকে আরও আকর্ষণীয় করে দিয়েছে। ছোট থেকে এখন পর্যন্ত জীবনে আমার অনেক নদী দেখা সৌভাগ্য হয়েছে। ছোটবেলায় দেখা আমার প্রিয় নদী পদ্মা, এমনকি মেঘনা, কীর্তনখোলা, ইছামতি নদীর অপরূপ সৌন্দর্য প্রতিনিয়ত আমাকে মুগ্ধ করে চলেছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি পাখি হতাম তাহলে আরও সুন্দর করে নদীর সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে পারতাম। আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি নৌকার মাঝি হতাম তাহলে হয়তো খুব কাছ থেকে নদীকে দেখতে ও ধরতে পারতাম।

নদী আমার বরাবরই খুব ভাল লাগে। অনেক প্রিয় জিনিসের মধ্যে এটি পড়ে। আমার প্রিয় নদীর মধ্যে একটি-দুটি নয়, অনেক নদীকে ভাল লাগে। তবে গঙ্গা ও পদ্মা নদী যেন আমার সবচেয়ে ভাল লাগে। আমার মনে হয় যে, এই দুই নদীর মধ্যে ঠিক যেরকম সৌন্দর্য ও চোখে দেখার আনন্দ আছে, তা অন্য কোনও নদীর মধ্যে পাই না। অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে গঠিত পদ্মা ও গঙ্গা নদীকে আমি শান্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করি। গঙ্গা ও পদ্মা দুটি নদী হাজার হাজার বছর ধরে সভ্যতার বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। নদী নিয়ে বহু কবিতা ও গান রচনা হয়েছে। অনেক লেখক নদী নিয়ে গল্প উপন্যাস লিখেছেন। সেসব লেখায় নদীপাড়ের মানুষের সম্পর্কের কথাও রয়েছে। যেমন সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’, অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতি’ ইত্যাদি। নদী দেখার মধ্যে দিয়ে আমি এক শান্তি খুঁজে পাই। নদী কখনও থেমে থাকে না। নদী যেমন চলমান, মানুষেরও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রয়েছে চলমানতা। প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হয় সকল দুঃখ-কষ্ট নিয়ে। আমি ভাবি, মানুষের জীবনও তাই।

বিচিত্র এই পৃথিবীর চারিদিকে অজস্র সৌন্দর্যের উপকরণ, যা আমাদের মনকে পুলকিত করে। জীবনের শুরু থেকে প্রাকৃতিক জিনিস দেখে আমরা বড় হই। যেমন, গাছপালা পশুপাখি রাস্তাঘাট আকাশ রোদ বৃষ্টি পুকুর নদী ইত্যাদি। দেখতে পাই, আমাদের চারপাশে বিশাল পৃথিবী ছড়িয়ে আছে। মাথার উপর তাকালেই দেখি আকাশ আর আকাশ ভরা কত যে গ্রহ তারা, বিজ্ঞানীরাও তা হিসেবে করে উঠতে পারেননি এখনও। আবার মাটির দিকে তাকালেই দেখি ছোট ছোট ঘাস থেকে শুরু করে মহামহীরুহু আছে। আছে অসংখ্য কীটপতঙ্গ। আর আছে জল। মাটির তলায়, পুকুরে, দিঘিতে, ঝর্নায়, সমুদ্রে, মেঘে ও নদীতে। এ সমস্ত কিছুর মধ্যেই আমরা আমাদের জীবন অতিবাহিত করি। নদীও নানারকম। কোনওটা পাহাড়ি নদী, কোনওটি আঁকাবাঁকা সরু নদী, আবার কোনওটি পদ্মা মেঘনার মতো বিশাল। জাফলং-এর পিয়াইন নামের যে নদী, সেটা ১০ থেকে ১২ ফুটের বেশি চওড়া নয়। অন্যদিকে মেঘনা কোথাও কোথাও ১১ মাইল চওড়া। আবার ফল্গু নদীর জল উপরের বালি সরিয়ে দেখতে হয়। অন্যদিকে হলদি নদী রোজই জোয়ারের সময় সমুদ্রে চলে যায়, ভাটার সময় জেগে ওঠে।

বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্যের মধ্যে নদীর সৌন্দর্য আমাকে বেশি প্রভাবিত করে। অনেক নদী দেখেছি। নদী দেখে দেখে আরও বেশি করে নদী দেখার ইচ্ছা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশকে নদী মায়ের মতোই আঁচলে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এ দেশে অনেক মানুষ নদীর ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশকে ভরে তোলার পেছনে নদ-নদীর ভূমিকা অপরিসীম। নদীর জলে বয়ে আসা পলি প্রাকৃতিকভাবে আমাদের মাটিকে উর্বর করতে সাহায্য করে। আমাদের কৃষির অগ্রগতিতে তাই নদীর ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিক্ষেত্রে যেমন, তেমনই মিঠা জলের মাছের জন্য নদীর অবদান অনেক। নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন অসংখ্য মানুষ। দেশে প্রয়োজন মিটিয়ে মাছ বিদেশে রপ্তানি হয়। নদী সংক্রান্ত অনেক কাজ করে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন। অন্যদিকে বর্ষাকালে নদীগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে। তখন ভাঙন শুরু হয়। কখনও কোনও গ্রাম ভাঙতে ভাঙতে নদীর মধ্যে সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়। বাংলাদেশে ফি-বছর ১০ লক্ষ মানুষ নদীভাঙনের শিকার হন। এখন অনেক নদী ভরাট করে দেয়াল, কোঠা, ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে। দেখেশুনে অসহায় লাগে। মনে মনে বলি, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’।

নীলনদ, টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস, হোয়াংহো, মিসিসিপি, সিন্ধু, গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি বিখ্যাত নদী ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে মিশরের সভ্যতা সুপ্রাচীন। প্রায় ৫ হাজার বছর আগেই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। নীলনদ না থাকলে এসব সভ্যতা গড়ে উঠতে পারত না। মিশরকে এজন্য বলা হয় নীলনদের দান। যে দেশ যুগ যুগ ধরে পিরামিড, মমি ও মিশরের লিপির জন্ম দিতে সমর্থ হয়েছে। এইভাবে সিন্ধু নদী প্রবাহিত হতে হতে আরও পাঁচে ভাগ বিভক্ত হয়েছে। এবং সেই নদীগুলোর পাশে গড়ে উঠেছে সিন্ধু সভ্যতা। গঙ্গা নদীর তীরেও ভারতের প্রাচীন সভ্যতা গড়ে তুলেছে। প্রতিবছর নদীর পলি অফুরন্ত শস্যের উৎপাদনের মাধ্যমে একদিকে যেমন খাদ্যশস্যের অভাব মিটিয়েছে, অন্যদিকে এই নদীপথে ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে। তাছাড়া এই নদীর পাশে গড়ে উঠেছে শহর। তেমনই প্রাচীন বাংলার করতোয়া নদীকে কেন্দ্র করে আড়াই হাজার বছর আগে বগুড়া জেলায় গড়ে উঠেছে মহাস্থানগড়ের সভ্যতা। বাংলাদেশের অসংখ্য নদী জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নদীর কাছে তাই আমাদের কৃতজ্ঞতা অসীম।

নদী ও নারীর মধ্যে নানাভাবে মিল খুঁজে পেয়েছেন কবি-সাহিত্যিক-চিন্তাবিদরা। নদী ও নারীর মধ্যে মিলটা খুবই পবিত্র। প্রাণের সঙ্গে অবাধ মিল। নদী ও নারী উভয়েই নানাভাবে সৃষ্টির প্রেরণা হিসেবে কাজ করে চলে। নদী যেমন নারীর উপমা তেমন নদীর উপমা নারী। উভয়ের যেন প্রতি পদে পদে মিল। আবার নদী যেমন সমুদ্রে মেশে, একজন নারী হয়ে আমারও মনে হয় একক জীবন থেকে যৌথ জীবনে যাওয়াটা যেন সমুদ্রে মেশা। আমার মনের ভিতর এরকম একটি নদী আছে বলে টের পাই। যে নদীর সুখ দুঃখের মধ্য দিয়ে কুলু কুলু করে বয়ে চলে। তেমনি আমার মনের মধ্যেও মনে হয় সুখ-দুঃখ নিয়ে মনের নদী বয়ে চলে। কোথাও কোথাও নদী অনেক প্রশস্ত, সে রকম নদী দেখলে মনটাকেও সেই নদীর মত প্রশস্ত করে নেওয়ার ইচ্ছে হয়। নদীর যেমন ঢেউ মনের মধ্যে নানান চিন্তার ঢেউ আমি টের পাই। গভীর রাতে পৃথিবীর ঘুমিয়ে পড়লে নদীর ঘুম নেই তেমনি আমার ঘুমের মধ্যেও যেন স্বপ্নটা আমাকে জাগিয়ে রাখে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে, যেন নদীর মতোই। তাই, মাঝে মাঝে নিজেকে যেন মনে হয় কোনও নাম না জানা নদী বা হয়তো নদীর নামই ‘আমি’।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

কাজী তানভীর হোসেন

ধানমন্ডিতে পলাশী, ৫-ই আগস্ট ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কয়েকদিন ধরে যা ঘটেছিল, তা শুরু থেকেই গণআন্দোলনের চরিত্র হারিয়ে একটা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে পরিণত হয়েছিল। আজ আমরা কার্যক্রম দেখেই চিনে যাই ঘটনাটি কারা ঘটাচ্ছে। আগুন আর অস্ত্র নিয়ে রাজনীতি করার স্বভাব রয়েছে বিএনপি-জামাত ও রোহিঙ্গাদের। তারা যুক্তিবুদ্ধির তোয়াক্কা করে না।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য: কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

আমরা বিধানচন্দ্র রায়ের মতো মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছিলাম, যাঁকে খুব সঙ্গত কারণেই ‘পশ্চিমবঙ্গের রূপকার’ বলা হয়। পেয়েছি প্রফুল্লচন্দ্র সেন ও অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বার্থত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী। এবং জ্যোতি বসুর মতো সম্ভ্রান্ত, বিজ্ঞ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রখর কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ। কিন্তু তাঁদের সকলের চেয়ে অধিক ছিলেন বুদ্ধদেব। কেননা তাঁর মতো সংস্কৃতিমনা, দেশবিদেশের শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্র নাটক সম্পর্কে সর্বদা অবহিত, এককথায় এক আধুনিক বিশ্বনাগরিক মানুষ পাইনি। এখানেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনন্যতা।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »