খবরওয়ালাকে পুলিশি সন্ত্রাসের লাঠি উঁচিয়ে বলে দেওয়া হল— স্বাধীনতার পাঁচ পা দেখেছ? ওসব চলবে না। ভুলে যাও স্বাধীনতা। খবর করার মুক্ত-ভাবনা! ক্ষমতা দিয়েছ। নিয়েছি আমরা। এখন ক্ষমতা আমাদের হাতে খেলবে! তোমাদের হাতে কিছুই নেই! মাথা উঁচু করেছ কী লাঠি পড়বে সেখানে। ক্ষমতা এখন আমাদের হাতে চিরজীবী হয়ে থাকবে। আর কোথাও নড়বে না! খবরওয়ালা তাই সাবধান হও এখন থেকে। কোন খবর করবে আমরা বলে দেব। এখন শুনে নাও আপাতত কোন খবর একেবারেই করবে না ‘স্বাধীনতা’ নামক অপদেবতার উপর ভরসা রেখে—
১. দেশে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে খবর হবে না সে ঘটনা। যেমন, দিল্লিতে ২০২০ সালে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা ভুলে যাও।
২. নাগরিকত্ব সংশোধনমূলক আইন (CAA) বিরোধী প্রতিবাদ-আন্দোলন খবরে ঠাঁই পাবে না।
৩. কৃষকদের আন্দোলন সংবাদ-মাধ্যমে যেন স্থান না পায়। পেলে প্রস্তুত হও স্বাধীনতা-র ঠ্যালা বুঝবার জন্য! মত-প্রকাশের স্বাধীনতা! মস্তকের খাঁচা থেকে উড়িয়ে দাও আকাশে!
এইপ্রকার ফরমান জারি করা হয়েছে একটি নিউজ-পোর্টালের উপর। ‘নিউজ ক্লিক’ সেটির নাম। সর্বদিক থেকে তাদের কোণঠাসা করা হয়েছে। তাদের নিদারুণ হেনস্তার শিকার বানিয়ে সব খবরওয়ালাদের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। দেশবাসী হতভম্ব! খবরওয়ালারা স্তম্ভিত!
একটি জটিল প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের হাওয়ায়— এমন হুকুমনামার লক্ষ্য কি কেবল খবরদাতারা? না কি মূল লক্ষ্য অন্য কিছু? সেটি কি বিদ্বেষের বীজ বপন করে বিপুল কাঙ্ক্ষিত ফসল তোলা নামক দুরাকাঙ্ক্ষা!
একটু ব্যাখ্যা করা যাক। বিদ্বেষটি হল ধর্ম-বিদ্বেষ! একটি নির্দিষ্ট ধর্ম-বিদ্বেষ। দেশের সর্বদিক থেকে পিছিয়েপড়া কেবল ধর্ম-বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকা দুর্ভাগা শ্রেণীভুক্ত দেশবাসী এমন ফরমানের প্রকৃত লক্ষ্য।
আপাত বিচারে খবরওয়ালাদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। একটি সংবাদ-মাধ্যম প্রতীকী হয়েছে বলা যায়। সেটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত অথবা যুক্ত নয় এমন ব্যক্তিদের বাড়ি-ঘর, অফিস, ব্যবহার্য প্রযুক্তি-যন্ত্রাদি সবই পুলিশের নির্যাতনপ্রক্রিয়ার লক্ষ্য হয়েছে— দেখা যাচ্ছে।
হুকুমনামাগুলি একটু বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়— প্রথমত, বিদ্বেষ-বিষ ঢোকানো হয়েছে পুলিশ-মগজে। দ্বিতীয়ত, তাদের কাজে লাগিয়ে সেই বিষ ছড়াতে চাওয়া হয়েছে সাধারণ সর্ব-হারা জনমানসে। তৃতীয়ত, খবরওয়ালাদের মগজ-ধোলাই করে সংবাদ-জগৎ থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির চিহ্নমাত্র না থাকুক এমনভাবে মুছে ফেলতে চাওয়া হয়েছে।
দেশবাসীর জাগরণ ঘটা এখন অত্যাবশ্যক। কোনো দেশে পিছিয়েপড়া দেশবাসী কখনও আক্রমণের শিকার হতে পারে মানবাধিকারের নীতি মেনে অথবা মানবতা ধর্মকে সকল ধর্মের উপরে ঠাঁই দিয়ে? এই প্রক্রিয়ায় দেশোন্নয়ন ঘটা সম্ভব? নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাসী ‘সংখ্যালঘু’ বলে বিশেষিত দেশবাসীরা ‘অপরাধী’ শ্রেণীভুক্ত হল কোন যুক্তিতে? দেশের অঙ্গ থেকে তাদের ছেঁটে ফেলার নানারকম কায়দা-কৌশল অবলম্বন করছে বর্তমান দেশনেতাদের অন্তর্ভুক্ত শাসক-দল। খবরওয়ালার উপর শানিয়ে তোলা আক্রমণ দ্বারা তাঁদের সেই ‘চেতনা’ জাগানোই মূল উদ্দেশ্য। দেশবাসী কি হীন উদ্দেশ্য বুঝবেন না?
এই প্রক্রিয়াতে কি সকল দেশবাসীর ঘরে ঘরে অর্থাভাব, অন্নাভাব, কর্মসংস্থানের অভাব, স্বাস্থ্যপরিষেবার অভাব, শিক্ষাব্যবস্থার হতদ্দশা ইত্যাদি হাঁ-মুখ করা দুরবস্থাগুলি বিলীন হয়ে যাবে? সকল দেশবাসী সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে?
দেশসেবকের ভূমিকায় অবস্থান নিয়ে দেশবাসীর হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে এ কেমন ক্ষমতা প্রয়োগের ভয়াবহ হিংসাত্মক প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করা নামক হীন কৌশল অবলম্বন!
দেশবাসী ভাবুন, সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ বা নির্মূলকরণই সংখ্যাগুরুদের সমান মানবাধিকার পেয়ে বাঁচার একমাত্র পন্থা? এই বিদ্বেষ-বিষ মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের প্রতিজ্ঞাগ্রহণ আজ সমগ্র দেশবাসীর জন্য অবশ্যপালনীয়। অন্যথায় দেশ তথা দেশবাসী মাথা তুলে বাঁচতে পারবে না। স্বদেশকে হারাতে হবে— সেই নিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য প্রতীক্ষায়!