‘শরতে আজ কোন অতিথি এলো প্রাণের দ্বারে।
আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দ গান গা রে।’
এই অতিথি শারদ আকাশ, কাশ ও শিউলি ফুল, এবং অবধারিতভাবে দেবী দুর্গা, যিনি সপুত্রকন্যা চার-পাঁচ দিনের জন্য কৈলাস থেকে মর্ত্যে নেমে আসেন পূজা গ্রহণ করতে। সনাতনধর্মীয়দের কাছে দেবী দুর্গার এই আরাধনা সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। শারদীয় উৎসব বলা হলেও একবছর শরতে, পরের বছর হেমন্তে (অর্থাৎ একবছর আশ্বিন ও পর-বৎসর কার্তিকমাসে) এই পূজা উদযাপিত হয়।
দুর্গাপূজার অনুষঙ্গে কয়েকটি শব্দ উচ্চারিত হতে শুনি, যেমন দেবীপক্ষ, পিতৃপক্ষ, অকালবোধন, মহালয়া ইত্যাদি। এগুলোর তাৎপর্য না জানলে দুর্গাপূজা সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট হবে না।
প্রথমে দেবীপক্ষ নিয়ে আলোচনা করা যাক। পক্ষ মানে চোদ্দ অথবা পনের দিন। পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা বা অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমার সময়কালকে বলা হয় পক্ষ। অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা (সাধারণত চোদ্দ দিনে হয়। তবে চাঁদের একবার করে পৃথিবী-পরিক্রমাকে এক-একটি তিথি ধরা হয় যেহেতু, এবং চাঁদের পৃথিবী-পরিক্রমার পথ যেহেতু কম-বেশি, তাই তিথির স্থিতিকালের মধ্যেও বেশি-কম হয়) হচ্ছে শুক্লপক্ষ, আর পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা কৃষ্ণপক্ষ। শুক্লপক্ষের সময়কাল (আশ্বিন বা কার্তিকের) ‘দেবীপক্ষ’ নামে পরিচিত। দেবী দুর্গার আরাধনার বিশেষ সময় এটি। যার চূড়ান্ত প্রকাশ পঞ্চমীর অকালবোধন থেকে দশমীর দুর্গাবিসর্জন পর্যন্ত।
অকালবোধন কেন? এখানেও একটি হিসেব আছে। উত্তরায়ণ আর দক্ষিণায়ণ। মাঘ মাস থেকে আষাঢ়, এই ছ’মাসকে বলে উত্তরায়ণ। এসময় দেবতারা জেগে থাকেন। আর দেবতারা নিদ্রা যান ছ’মাস, শ্রাবণ থেকে পৌষ। আশ্বিন-কার্তিক দেবতাদের নিদ্রাকাল। সেসময় দেবীকে নিদ্রা থেকে জাগানোই হল অকালবোধন। নিদ্রিত অবস্থায় পূজিত হতে পরিবার নিয়ে দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসবেন কী করে?
এই অনুষঙ্গেই মহালয়া শব্দটি নিয়ে আলোচনা করব। দেবীপক্ষের কথা বলা হয়েছে। তেমনই আছে পিতৃপক্ষ। পিতৃপক্ষ হল দেবীপক্ষের ঠিক আগের কৃষ্ণপক্ষ। অর্থাৎ পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা, এই পক্ষকাল। বলা হয়ে থাকে, এই সময় মৃত আত্মীয়স্বজন আমাদের জীবিত মানুষদের কাছাকাছি চলে আসেন। অর্থাৎ পৃথিবী-পরিক্রমায় তাঁরা আমাদের নিকটতর হন। এই সময়টি তাই তাঁদের স্মরণ, মনন এবং তাঁদের প্রতি পিণ্ডদান করলে তা গ্রহণ করা তাঁদের পক্ষে সহজ হয়।
মহালয়াকে আরও নানান নামে অভিহিত করা হয়, যেমন ষোলা শ্রদ্ধ, কানাগাতা, জিতিয়া, অপরপক্ষ ইত্যাদি। প্রবাদ এই যে, প্রজাপতি ব্রহ্মার নির্দেশে এসময়ে প্রয়াত পিতৃপুরুষেরা মর্ত্যে নেমে আসেন। বংশধরদের তর্পণ ও দানধ্যানের মাধ্যমে প্রয়াতের পাপ খণ্ডিত হয়। স্বয়ং বিষ্ণুর কর্ণমূল থেকে সৃষ্ট পুরাণোক্ত দুই দৈত্য মধু ও কৈটভ-কে বধ করা হয়েছিল দেবীপক্ষের সপ্তমী ও অষ্টমীর সন্ধিলগ্নে।
সূর্য যখন কন্যারাশিতে প্রবেশ করে, তখন শুরু হয় পিতৃপক্ষ। আর সূর্যের বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশে সূচিত হয় দেবীপক্ষ। সেসময় প্রয়াতজনেরা পিতৃলোকে ফিরে যান। পিতৃপক্ষে প্রয়াত তিন পুরুষ স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি বাস করেন। এই সময় তাদের জীবিত বংশধরেরা যদি তর্পণ করেন, তাহলে প্রয়াত তিন পুরুষ স্বর্গবাসের অধিকারী হন। তাই তর্পণ করতে হয় ঊর্ধ্বতন তিন মৃত বংশীয়দের।
তর্পণের আবশ্যিকতা নিয়ে একটি কাহিনি এইরকম। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে নিহত কর্ণ স্বর্গে পৌঁছলে (যুদ্ধে নিহতরা সকলেই স্বর্গবাসের অধিকারী। ‘হত্বা তু লভতে স্বর্গম্’— গীতা। ইসলামেও যুদ্ধে নিহতদের বেহেশত-বাস নিশ্চিত করা হয়েছে।) তাঁকে পরিবেশিত হল স্বর্ণ। যমকে কর্ণ শুধালেন, তাঁকে কোনও খাদ্যবস্তু দেওয়া হচ্ছে না কেন? উত্তরে যম বললেন, জীবিতকালে যেহেতু কর্ণ পিতৃপুরুষের তর্পণ করেননি, তাই দেহান্তে তিনি খাদ্য পাওয়ার অধিকারী নন। কর্ণ সোনাদানা দিতেন প্রার্থীদের। তাই তিনি স্বর্গে সেই স্বর্ণই পাচ্ছেন। কর্ণ এই শুনে জানালেন, পিতৃপুরুষের পরিচয় তিনি জানতেন না বলেই তিনি পিণ্ডদান করতে পারেননি। যমরাজ চিত্রগুপ্তকে আদেশ দিলেন, এক পক্ষকালের জন্য যেন কর্ণকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়, পিতৃপিতামহকে পিণ্ডদান করার জন্য। সেরূপ করা হলে কর্ণের স্বর্গবাস ও আহারাদি জোটে।
পিণ্ড তৈরি হয় তণ্ডুল, অর্থাৎ চাল ও ময়দা, ঘৃত আর কালো জিরে দিয়ে। সাধারণত নদীতীর বা জলাশয়ের কাছে পিতৃপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে পিণ্ড নিবেদিত হয়। এই পিণ্ড যদি কোনও বায়স (কাক) স্বতঃস্ফূর্তভাবে খেয়ে ফেলে, তবে ধরে নেওয়া হয়, পরলোকগত প্রেতাত্মা তা গ্রহণ করেছে। রামায়ণে দশরথকে নিবেদিত পিণ্ড এইভাবে কাক খেয়ে নেওয়ায় পুত্র রাম ও লক্ষ্মণ নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।
মহালয়া। অর্থাৎ মহান আলয়ে, প্রিয় আবাসে প্রয়াতজনদের আগমন। তাই এইসময় হাতে হাতে পিণ্ড গ্রহণ করেন মৃত আত্মীয়-আত্মীয়ারা। সাধারণ মরণান্তিক শ্রাদ্ধের সঙ্গে এর পার্থক্য এইখানেই।
আসলে মানুষ তার প্রিয়জনকে কখনওই হারাতে চায় না। তবু চলে যেতে হয়, তবু চলে যায়! সব ধর্মের মানুষই তাই বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে প্রয়াতদের স্মরণ করে। শবে বরাত, All Soul’s Day-তে তাই যথাক্রমে মুসলমান এবং খ্রিস্টানরা পিতৃপুরুষদের স্মরণ করে থাকেন।
এখন, অর্থাৎ নব্বই বছরের অধিককাল ধরে ‘মহালয়া’ শব্দটি আকাশবাণী কলকাতার দৌলতে অন্যভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠছে। বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং সর্বোপরি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অধ্যক্ষতায় ভোরে পিতৃপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে যে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রচারিত হয়, যেখানে অসংখ্য নামী শিল্পীর কণ্ঠে দুর্গার আগমনী-গীত পরিবেশিত হয়, কেবল কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি নয়, আবিশ্বের বাঙালির কাছে, এমনকি বহু অবাঙালির কাছেও তার আবেদন সর্বব্যাপী। নাটকে আর সিনেমাতেও (উল্লেখ্য, বাংলাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র-পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল তাঁর ‘চিত্রানদীর পারে’ ছবিতে পূর্ববঙ্গের পটভূমিতে আকাশবাণী-প্রচারিত মহালয়ার জনপ্রিয়তা দেখিয়েছেন।) এটি নন্দিত ও জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এর জনপ্রিয়তা এতটাই যে, এখন বাঙালি ‘মহালয়া’ বলতে মূলত ওই অনুষ্ঠানকেই বোঝে। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। শব্দটি ব্যাকরণের পরিভাষায় যোগরূঢ়তে পর্যবসিত আজ।