হিন্দুদের সংখ্যাতীত দেবদেবীর মধ্যে দেবী দুর্গার বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য আলাদা করে বিচার্য। শিব, সরস্বতী, কালী বা লক্ষ্মীর আরাধনা একদিনের। অন্যদিকে দুর্গাপুজো চলে পঞ্চমী থেকে বিজয়া দশমী, অর্থাৎ কম করে ছ’-সাত দিন। তিথির স্থায়িত্ব বেশি সময় ধরে হলে পুজোর দিন বাড়ে-কমে। আবার উত্তর-ভারতে নবরাত্রিরূপে যে পার্বণ, তাতে ন’দিনের উৎসব এই দুর্গাপুজো, তবে তা কিছুটা ভিন্ন আকারে।
দুর্গাপুজোর আর এক বৈশিষ্ট্য, দেবী দুর্গা কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী ও সরস্বতী, এই চার পুত্রকন্যা নিয়ে পূজাগ্রহণের জন্য আসেন। অন্য দেবদেবীর পুজোয় এককভাবে সেই দেবতা বা দেবীকেই দেখতে পাই, দেবদেবীকে তাঁদের পরিবারসহ দেখি না।
দুর্গাপুজোর তৃতীয় চমৎকারিত্ব হচ্ছে, পুরাণোক্ত সমস্ত দেবদেবীর নিজস্ব বাহন রয়েছে। সেই বাহন-পরিবৃত হয়েই দেবতাদের গতায়াত। যেমন দেবী দুর্গার সিংহ (কোথাও কোথাও আবার বাঘ), যেমন লক্ষ্মীর পেঁচা, গণেশের ইঁদুর, শিবের ষাঁড়, এইরকম। পুরাণোক্ত দেবতাদের মতো লৌকিক দেবদেবীর-ও বাহন আছে। যেমন, মনসার বাহন হংস, শীতলার গাধা। কিন্তু দেবী দুর্গা যখন পুত্রকন্যা নিয়ে আগমন করেন, তখন সবাই মিলে এক এক বছর এক এক আলাদা বাহনে চড়ে আসেন। কোনওবার হাতি, অথবা অন্যবার দোলা, মহিষ, অশ্ব অথবা নৌকো। তিনি ফিরেও যান এই পাঁচ বাহনের কোনও একটিতে চড়ে। তবে যে-বাহনে চড়ে আসেন, সে-বাহনে কিন্তু সচরাচর ফেরেন না। ফেরেন কদাচিৎ। যেমন ২০২৩-এ দেবী দুর্গার আসা-যাওয়া দুটোই ঘটবে অশ্বপৃষ্ঠে।
দেবী দুর্গাকে, তাঁকে পূজার অনুষঙ্গে, আমরা জানি, তিনি মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। কিন্তু দুর্গাপুজোর সময় যে চণ্ডীপাঠ হয়, তা একটু খেয়াল করলেই দেখব, তিনি মহিষাসুর ছাড়াও নানাসময় বধ করেন চণ্ডমুণ্ড, মধুকৈটভ, শুম্ভনিশুম্ভ ও আরও বহু অসুরকে। আসলে দুর্গাপুজোয় যে অসুরবধ, তা শাশ্বতকালের শুভাশুভ দ্বন্দ্বের-ই সমরেখায় স্থাপিত। এবং এই শুভাশুভের সংগ্রাম কেবল হিন্দুধর্মেই নয়, অন্যান্য ধর্মেও আছে। বৌদ্ধদের মার (বুদ্ধদেবের অপর নাম ‘মারজিত’), খ্রিস্টানদের শয়তান (SATAN, যাকে বলা হয়েছে Beyond redemption, অর্থাৎ অসংশোধনীয়), ইসলাম ধর্মের ইবলিস এই অসুরের-ই নামান্তর।
দুর্গা : উৎসের সন্ধানে
দেবী দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয়পুরাণে, যেখানে রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধিকে দুর্গা-আরাধনায় রত দেখতে পাই। তাছাড়া দেবীভাগবত আর কালিকাপুরাণ গ্রন্থেও দুর্গাপূজার কথা রয়েছে। বাল্মীকি-রামায়ণে রামের দুর্গা-আরাধনার কথা নেই, আছে কৃত্তিবাসে। কিন্তু কালিকাপুরাণে রাবণকে পরাজিত করার আগে রাম যে দুর্গাপুজো করেন, তা বর্ণিত আছে। তাছাড়া আসমুদ্র ভারতের ব্যাপ্ত পরিসরে দেবী দুর্গা যে আরাধিত হতেন, তার বহু প্রমাণ আছে। এবং দুর্গা নিয়ে রয়েছে নানা সত্যি ও অলৌকিক কিংবদন্তি।
এরকম-ই একটি কাহিনি। কুমায়ুনে দেওদার-পাইন বনে আছে কাসার দেবীর মন্দির, যে মন্দিরের ধুনির ছাই ব্যবহারে রোগ নিরাময় হয়। ২০১৩-তে নাসা (NASA)-র বিজ্ঞানীরা এখানে পরীক্ষা চালান। তাঁরা প্রমাণ পান, এই মন্দিরে তড়িত চুম্বক বা ইলেকট্রো ম্যাগনেটের তরঙ্গ কাজ করে বলেই এমনটি ঘটে। উল্লেখ্য, পেরুর মাচুপিচুতেও এমন তড়িত-চৌম্বক রয়েছে।
উত্তরাখণ্ডের অলকানন্দা নদীতীরে আছে দুর্গার অনুরূপ ধারিদেবীর মন্দির। এখানে দেবীর কেবল ঊর্ধ্বাংশ পূজিত হয়। আর নিম্নাংশ পূজা পায় অন্যত্র। আশ্চর্যের ব্যাপার, দিনের শুরুতে দেবীর মুখ শিশুর মতো। বেলা বাড়ে, দেবীর মুখ পাল্টাতে থাকে,— কিশোরী, যুবতী, বৃদ্ধা!
মহাভারতোক্ত কাংড়ার জ্বালামুখে আবার অবিরাম আগুনের মধ্যে পূজা পান দেবী জ্বালামুখী, অন্যতম দুর্গা। বিকানিরের কানিমাতা আড়াই লক্ষ ইঁদুরের দ্বারা সংরক্ষিত।
পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলা। এখানকার বিখ্যাত কনকদুর্গা মন্দির। প্রচলিত বিশ্বাস, মহাষ্টমীর দিন দেবী নিজেই ভোগ রান্না করেন এখানে। এই দেবী অবার অশ্বারূঢ়া, চতর্ভুজা। চিলকিগড়ের সামন্তদের তৈরি এই দেবী অষ্টধাতুনির্মিত। একদা নরবলি হত পুজোয়। তা বন্ধ হয় নাকি দেবীর-ই নির্দেশে।
এরকম নানা জায়গায় নানা বৈশিষ্ট্য-বৈচিত্র্য আছে দুর্গার। যেমন বাঁকুড়া জেলার ওন্দা গ্রামের দুর্গামূর্তি নিমকাঠের। দেবী এখানে দ্বিভুজা। বীরভূমের রামপরহাট-সন্নিকটস্থ মাধবীলতাপাড়ার দুর্গা নাকি সাতশো বছর ধরে পুজো পাচ্ছেন। চতুর্ভুজা এই দুর্গাপুজোয় ভোগ দেওয়া হয় তেরো রকমের ভাজা, চোদ্দো ধরনের তরকারি, কলার মোচাঘণ্ট। মুগডাল, আমসত্ত্বর পায়েস। সন্ধিপুজোয় দুধ, সর, দৈ, মাখন, চাঁছি আর ক্ষীর। দশমীতে চিঁড়ে, দৈ, খৈ।
আগমনী ও বিজয়ার গান
দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বাঙালি কবি-গীতিকাররা বহু কবিতা ও গান রচনা করেছেন। দেবীকে আহ্বান করে যা লেখা হয়েছে, তাকে বলে ‘আগমনী’, আর দশমীর দিন দেবীর চলে যাওয়া-উপলক্ষ্যে রচিত যা, তা হল ‘বিজয়ার গান’। সাধককবি রামপ্রসাদকেই আগমনীগানের প্রথম গীতিকাররূপে পাই। তাঁর বিখ্যাত একটি গান, ‘এবার আমার উমা এলে আর উমায় ফিরাব না/ বলে বলুক লোকে মন্দ, কারও কথা মানব না’। কমলাকান্ত, রামনিধি গুপ্ত থেকে শুরু করে মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পর্যন্ত ব্যাপ্ত এই রচনাধারা। আসলে দুর্গার সঙ্গে বাঙালি তার ঘরের বিয়ে হয়ে স্বামীগৃহে চলে যাওয়া আত্মজাকে মিলিয়ে দিয়েছে। তাই বৎসরান্তে দুর্গার মাত্রই ক’দিনের জন্য এসে কৈলাসে চলে যাওয়াকে মেনে নিতে পারছেন না উমাজননী মেনকা। মধুসূদনের সনেটে মূর্ত হয়ে উঠেছে তাই মেনকার আর্তি— ‘যেও না রজনি! তুমি লয়ে তারাদলে!/ গেলে তুমি, বিধুমুখি, এ পরাণ যাবে’! ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ-ও দেবী দুর্গার আগমনীগাথা রচনা না করে পারেননি, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালি/ নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।/ এসো গো শারদলক্ষ্মী—’। অন্যদিকে নজরুল তো দুর্গাকে নিয়ে কবিতা লিখে জেল পর্যন্ত খেটেছেন, ‘আর কতোকাল থাকবি বেটি মাটির ডেলার মূর্তি আড়াল,/ স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।’ নজরুলের বিজয়ার একটি গানে মেনকা কন্যাকে বিদায় দেবার সময় শোকাহত না হয়ে বলছেন, উমা চলে গেলেও তিনি উমার পুত্রকন্যাদের কিন্তু নিজের কাছে রেখে দেবেন। প্রসঙ্গত, দাশরথি রায়ের একটি গানে চমৎকার একটি চিত্রকল্প আছে,— যেখানে মেনকার কোলে উমা, আর উমার কোলে গণেশ। তাহলেই উমা বুঝবে, সন্তান দূরে থাকার কী কষ্ট! অসাধারণ!
সিংহ ও দেশবিদেশের দেবতা, অধীশ্বর
সিংহ হচ্ছে শৌর্য আর প্রতাপের প্রতীক। সমুচিত কারণেই পশুরাজরূপে আখ্যায়িত ফেলিডি পরিবারের এই প্রাণীটি। বাঘ ও বেড়ালের পরিবারভুক্ত এই পশুটি কেবল দেবী দুর্গার-ই নন, গ্রীক দেবী রিয়ার ( RHEA)-ও বাহন। আবার কারথেজ বা বর্তমান তিউনিশিয়ায় পূজিত হতেন যে দেবী, সেই তানিত (TANIT)-ও। ঈশপ ও বিষ্ণুশর্মা-রচিত পঞ্চতন্ত্রে যেমন সিংহের কথা পাই, তেমনি ইহুদিপুরাণেও। মিশরের ফারাওদের কাছে সিংহবাহিনীরা আরাধ্য ছিলেন। দেবী শেখমেত (SEKHMET) এরকম এক মিশরীয় দেবী। সলোমনের সিংহাসনের দুপাশে ছিল সিংহের মুখ। গ্রীকো-রোমান দেবী সিবিল (CIBYL) সিংহাসনা। তিনি একাধারে মৃত্তিকা ও সমগ্র পৃথিবীর দেবী। রোমান ঈশ্বর-আরাধনায় ‘মহামাতা’ (MAGNA MATER) ধারণাটি এসেছে যেভাবে, আমাদের দুর্গাভাবনার সঙ্গে তার আশ্চর্য মিল পাওয়া যায়। এই দেবীর বাহন-ও সিংহ।
অকালবোধন, নবপত্রিকা
দুর্গাপূজার সঙ্গে এ-দুটি শব্দ অঙ্গাঙ্গী জড়িত। অকালবোধন কেন? দেবতারা পৌষমাস থেকে জ্যৈষ্ঠমাস পর্যন্ত সজাগ থাকেন। আর আষাঢ় থেকে অগ্রহায়ণ মাস, এই ছ’মাস তাঁদের নিদ্রাকাল। দুর্গাপূজা যেহেতু আশ্বিন অথবা কার্তিক মাসে, তাই দেবীকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তুলে আরাধনা করতে হয়। এই জাগানোকেই বলে ‘বোধন’। অকালে জাগানো, অতএব অকালবোধন।
নবপত্রিকার আলোচনায় দেখব, আদিতে এই পুজো ছিল প্রকৃতপক্ষে শস্য-উৎসব। তার রেশ রয়ে গেছে নবপত্রিকা-আরাধনায়। একটি কলাগাছকে আট ধরনের শস্য দিয়ে অপরাজিতার লতার সাহায্যে বেঁধে সংলগ্ন করা হয়। উদ্ভিদগুলি হল কচু (দেবী কালিকার প্রতীক), হলুদ (উমা), জয়ন্তী (কার্তিকী), বেল (শিবা), দাড়িম্ব বা ডালিম (রক্তদন্তিকা), অশোক (শোকরহিতা), মানকচু (চামুণ্ডা) ও ধান (লক্ষ্মী)। মূল যে কলাগাছ, তা হল দেবী ব্রহ্মাণীর প্রতীক। বিভিন্ন শস্যকে এইভাবে বিভিন্ন দেবীর নামে নামাঙ্কিত করে এইভাবে একটি ধ্রুপদী রূপ দেওয়া হল। নবপত্রিকায় সিঁদুর পরিয়ে, দুটি বেল (দেবীর স্তনদ্বয়ের প্রতীক) যুক্ত করে দুর্গা ডানদিকে রেখে পুজো করা হয়। ভুলক্রমে একে গণেশের স্ত্রী ভাবা হয়। আদৌ কিন্তু তা নয়। এইভাবে শস্য-উৎসবের উৎসকে দুর্গাপুজোয় বহাল রাখা হয়েছে। দেবী দুর্গার বহু নামের মধ্যে অন্তত দুটি নাম তাৎপর্যপূর্ণ, অন্নপূর্ণা এবং শাকম্ভরী। এই নামদুটির মধ্যে লুকিয়ে আছে দুর্গার শস্যসংযুক্তি। বনদুর্গা ও সর্বজয়া নামের মধ্যেও আছে। ক্রমে দুর্গা কৃষকদের হাত থেকে এলিট শ্রেণির হাতে স্থানান্তরিত হলেন। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, ‘আনন্দময়ীর আগমনে আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে,/ হৃরো ওই ধনীর দুয়ারে দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে।’
প্রতিমানির্মাণ
প্রাচীনকাল থেকেই নানা সরঞ্জাম দিয়ে প্রতিমা তৈরি হয়ে আসছে। দুর্গা যেমন, তেমনই অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি। পাথরে তৈরি মূর্তি যেমন আছে, তেমনই আছে কাঠ ও তৈজসনির্মিত মূর্তি, বা সোনা, রূপা, পিতল, ব্রোঞ্জ, অষ্টধাতু ইত্যাদি। কাঠের মূর্তির মধ্যে নিমকাঠের মূর্তি প্রসিদ্ধ। একে গাছটিকে পবিত্র বলে মনে করা হয়, তদুপরি পোকা আক্রমণ করতে পারে না গাছটিকে। মুর্শিদাবাদের শিল্পীরা হাতির দাঁত দিয়ে অনবদ্য মূর্তি গড়েন। তাছাড়া আছে শোলার মূর্তি। আগে দেবীমূর্তি ছিল একচালা। পরবর্তী সময়ে এক এক দেবদেবীর আলাদা চালা হয়েছে। তবে দুর্গা, সিংহ ও মহিষাসুরকে একচালা থেকে নড়ানো হয়নি। ‘থিম পুজো’-নামে নানান উদ্ভট জিনিস দিয়ে মূর্তি তৈরি করা হয় আজকাল। সেখানে শিল্পীর কল্পনার অভিনবত্ব-ও বিকশিত হয় কখনও কখনও।
সাধারণভাবে দুর্গা দশহাতের, দশপ্রহরণধারিণী। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে দুর্গার হাতের সংখ্যা একসহস্র, একশত, আঠাশ পর্যন্ত হতে দেখা গেছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর জেলাস্থিত গঙ্গারামপুরে মিলেছে প্রাচীন ষড়ভূজা দুর্গামূর্তি। সিংহবর্জিত দুর্গামূর্তিও আছে। নানাস্থানে দেবীর উচ্চতাও অনেক রকমের, চার হাত থেকে বাইশ হাত। আগেকার মূর্তি (মূলত পাথরের) কেবল একাকী দুর্গার ছিল। পরবর্তীতে পুত্রকন্যারা যুক্ত হয়েছেন। মাটির মূর্তি আসার পর থেকেই সম্ভবত পরিবার-সহ দুর্গামূর্তির প্রচলন।
‘উদ্ভট রামায়ণ’-এ পাই শতভুজা দুর্গার কথা। সেখানে আবার শতমুণ্ড রাবণের কথাও অছে। সেই রাবণ রামের ভয়ে সমুদ্রগর্ভে লুকিয়ে। স্বয়ং সীতাদেবী দুর্গার কাছে শতহস্তের বর পেয়ে রাবণবধ করেন। তাহলে বলা যাক, এই রাবণবধ দুর্গা ও সীতার যৌথ উদ্যোগ।
‘ভারতমাতা’। ১৯০৫-সালে দেবী দুর্গামূর্তির-ই নবনির্মাণ। বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে। সেটি ছিল ছবি। এর বহু পরে ১৯৬২-তে চীন-ভারত যুদ্ধ হয়। সেসময় ওই ভারতমাতার আদলে নির্মিত হয়েছিল মাটির দুর্গামূর্তি, মহিষাসুররূপী ড্রাগন বধ করছেন। অভিনব ভাবনা নিঃসন্দেহে। দক্ষিণ কলকাতার বিজয়গড়ে হয়েছিল সে-পুজো। এখনও হয়। তবে ড্রাগন-বর্জিত, প্রয়োজন ফুরিয়েছে, সেজন্য।
দুর্গাপুজো : ধর্ম, সংস্কৃতি, বাণিজ্য, রাজনীতি
দুর্গাপুজোয় অঞ্জলি দেওয়া এবং বিভিন্ন পূজাস্থানে গিয়ে দেবীদর্শন হিন্দু মহিলাদের কাছে বিশেষভাবে অনুষ্ঠিতব্য। দশমীর দিন দেবীকে বিদায় জানানোর সময় (বিদায় কথাটি উচ্চারিত হয় না, বলা হয় ‘বরণ’) একদিকে দেবীকে সিঁদুর পরানো, অন্যদিকে মণ্ডপে উপস্থিত বিবাহিতা মহিলাদের সিঁথিকে সিঁদুর-রঞ্জিত করা একটি ধর্মীয় প্রথা। অনেকে কালীঘাটের মন্দিরে যান কয়েক ঘণ্টাব্যাপী সিঁদুর খেলতে। সেসময় মন্দিরে পুরুষদের প্রবেশাধিকার থাকে না।
সংস্কৃতিচর্চার একটি বিরাট গতিজাড্য আমরা লক্ষ্য করি শারদীয় পুজোকে কেন্দ্র করে। ছোট বড় মাঝারি অসংখ্য পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয় এসময়। একদা চলচ্চিত্রনির্মাতারা মুখিয়ে থাকতেন পুজোসংখ্যার গল্প-উপন্যাস পড়ে সেসবের মধ্য থেকে তাঁদের পরবর্তী ছবির উৎস-সন্ধানে। একদা নতুন সিনেমা মুক্তি পেত এসময়ে। এখনও একটু-আধটু হয়। রেকর্ড বেরত গানের। পরে ক্যাসেট। আরও পরে সিডি। এসব এখন স্মৃতি। পুজোর সময় এবং পরে পাড়ায় পাড়ায় গানের জলসা, যাত্রার আসর। পাড়ায় পাড়ায় শখের নাটকের দল নাটক করত মাঠে প্যান্ডেল খাটিয়ে। এসব এখন স্মৃতি!
দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়। পোশাক ক্রয়, প্যান্ডেল ও মূর্তির ব্যয়, খাওয়াদাওয়া, পুজোর অবকাশে বাইরে বেড়াতে যাওয়া, আরও নানান খাতে যে অর্থ ব্যয়িত হয়, তাতে অর্থনীতির দিক থেকেও স্বাগত জানাতে হয় দুর্গাপুজোকে।
আর আছে গণসংযোগের দিক, যে কাজে সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের তৎপর হতে দেখা যায়। বিভিন্ন প্যান্ডেলে যাওয়া, কুশলবিনিময়, একত্র আহার, এসবের মধ্য দিয়ে পুজোকে রাজনৈতিক কাজে লাগান তাঁরা।
অবশেষকথা
বছরের পর পুজো আসে পুজো যায়। কিন্তু ওই যে ‘দাঁড়াইয়া কাঙালীর মেয়ে’, সে তো বছরের পর বছর দাঁড়িয়েই থাকে। অপু-দুর্গার কি দুর্গাপুজো আছে? ঈদ আছে মাইমুন-রাসুদের? কঠিন প্রশ্ন।