শুধুই শিলঙ
আমি যখন সাদামাটা একটা আঠেরো উনিশের তরুণতুর্কি
তখন লেগেছিল জাতিবিদ্বেষের আগুন শিলঙ শহরের আনাচেকানাচে
আর আমি তখন অবাক হয়ে বন্ধ ঘরের মেঝেতে বসে
পড়ছি পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ।
যখন আমার মাটি করবার অধিকার কেড়ে নিল ওরা আইনের ফাঁক দিয়ে
তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল শহরে
নিসর্গরা কাঁদছিল হু হু করে
আর সবাই ভীষণ ব্যস্ত শরৎচন্দ্রের জন্মশতবার্ষিকী পালনে।
পাইনের ঘেরাটোপ বেয়ে বেয়ে গাঢ় সবুজের
অন্ধকার নেমেছিল এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায়,
চায়ের দোকানে রোজকার মতো অফিসফেরত
যুবকেরা তর্কের তুফান তুলছিল বিভিন্ন বিষয়ে।
ওদের ওই আলোচনায় কোনও অসুখের ইঙ্গিত ছিল না,
ছিল না ওদের অন্ধকার ভবিষ্যতের কুচকাওয়াজ।
আর আজ বিকেলে যখন সারা শহরের আনাচেকানাচে ভয়াবহ
আগুন জ্বলল
তখন তরুণতুর্কি আমি মনে দিয়ে পড়ছিলাম
পাবলো নেরুদার প্রেমের কবিতা।
ওরা ছড়িয়ে দিচ্ছিল বিষ, ভয়ংকর জাতিবিদ্বেষের
আমাদের প্রিয় শহরের অলিতে-গলিতে,
আর আকাশের লাল বেয়ে চোখের সামনে দিয়ে
ধীরে ধীরে নেমে গেল এক পুরনো সময়।
আমি তখন সাদামাটা একটা আঠেরো-উনিশের তরুণ বিদ্রোহী কবি
মনের আয়না দিয়ে দেখে নিচ্ছি আমার এক অতি প্রিয় বার্নিনির
তাক লাগানো ভাস্কর্য
কারণ আমার রোম ভ্যাটিকান গিয়ে তাঁর সৃষ্টিগুলো
দেখার পয়সা নেই
আমার মুখের লম্বা লম্বা দাড়িগুলো আয়নায় বিশ্রীভাবে এসে পড়েছিল
আর তোবড়ানো আমার গালের ছবি
চোখদুটো ঢুকে গেছিল কোঠরে আর বিষমাখা সময়ের ঝাঁজ যখন নিচ্ছি
আমি হাতের বিড়িতে সুখটান দিয়ে—
ওরা ঠিক তখন মার দিল আমার বাবাকে,
জন্মদাতা পিতাকে ভীষণভাবে।
আমার বাবার রক্তে লাল হল পাইনের ছায়াঘেরা
পিচঢালা রাজপথ।
আমি যখন সাদামাটা একটা আঠেরো-উনিশের
এক ছিলাছেঁড়া রাগী কবি
তখন শিলঙ থেকে বহুদূরে কলকাতা শহরে,
আকাশের রং লাল হয়েছিল রঙিন আবীরে
তাতে না ছিল সহজ কোনও মানবতাবোধ, ছিল না
কোনও বিশ্বভ্রাতৃত্বের রং।
কবিদের কান্না, লেখকের অভিমত বুদ্ধিজীবীদের
দরজায় আটকাল উল্টো করে
যেভাবে আমরা আটকাই ঘোড়ার পায়ের নাল
দরজায় উল্টো করে, সৌভাগ্যের কথা ভেবে।
কলকাতা, দিল্লির দরজা বন্ধ ছিল কবি, সাহিত্যিক আর বুদ্ধিজীবীদের জন্য।
আমি তখন সাদামাঠা একটা আঠেরো-উনিশের এক
ছিলাছেঁড়া রাগী কবি নই
কবিতার সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে রাজপথে নামতেই
মাথায় আমার ঠং করে কারা যেন হাতুড়ি পিটল
হেঁকে বলল
কাব্যের সময় নয় এখন, কাব্যকে দাও ছুটি।
অন্ধ রাগে আমি বার্নিনির হাত থেকে কেড়ে নিলাম
হাতুড়ি আর ছেনি
সময়কে তোমাদের নিয়মের বেড়ি থেকে টেনে বের
করে ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে কুটি কুটি করে
নিজের পছন্দে গড়ে তুলতে এবার চেষ্টা করলাম।
তখন বিষণ্ণ রাজপথে পায়চারী করছিল শুধু উলঙ্গ সময়।
আর আজ মধ্যপঞ্চাশে সাদামাটা কোনও বিদ্রোহী তরুণ নই আমি
পাইনের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে চলে গেছে বহুদূর
এই দুরন্ত সময়
বদলে গেছে নগ্ন নির্জন পাইনের ধুপছায়া রং;
শুধু একঝাঁক স্মৃতি আর এক রাগী যুবকের মুখ ছবি হয়ে
বিশাল পাইন গাছের মগডালে আটকে রয়েছে।