Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

দিবাকর পুরকায়স্থর কবিতা

শুধুই শিলঙ

আমি যখন সাদামাটা একটা আঠেরো উনিশের তরুণতুর্কি
তখন লেগেছিল জাতিবিদ্বেষের আগুন শিলঙ শহরের আনাচেকানাচে
আর আমি তখন অবাক হয়ে বন্ধ ঘরের মেঝেতে বসে
পড়ছি পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ।

যখন আমার মাটি করবার অধিকার কেড়ে নিল ওরা আইনের ফাঁক দিয়ে
তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল শহরে
নিসর্গরা কাঁদছিল হু হু করে
আর সবাই ভীষণ ব্যস্ত শরৎচন্দ্রের জন্মশতবার্ষিকী পালনে।

পাইনের ঘেরাটোপ বেয়ে বেয়ে গাঢ় সবুজের
অন্ধকার নেমেছিল এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায়,
চায়ের দোকানে রোজকার মতো অফিসফেরত
যুবকেরা তর্কের তুফান তুলছিল বিভিন্ন বিষয়ে।
ওদের ওই আলোচনায় কোনও অসুখের ইঙ্গিত ছিল না,
ছিল না ওদের অন্ধকার ভবিষ্যতের কুচকাওয়াজ।

আর আজ বিকেলে যখন সারা শহরের আনাচেকানাচে ভয়াবহ
আগুন জ্বলল
তখন তরুণতুর্কি আমি মনে দিয়ে পড়ছিলাম
পাবলো নেরুদার প্রেমের কবিতা।
ওরা ছড়িয়ে দিচ্ছিল বিষ, ভয়ংকর জাতিবিদ্বেষের
আমাদের প্রিয় শহরের অলিতে-গলিতে,
আর আকাশের লাল বেয়ে চোখের সামনে দিয়ে
ধীরে ধীরে নেমে গেল এক পুরনো সময়।

আমি তখন সাদামাটা একটা আঠেরো-উনিশের তরুণ বিদ্রোহী কবি
মনের আয়না দিয়ে দেখে নিচ্ছি আমার এক অতি প্রিয় বার্নিনির
তাক লাগানো ভাস্কর্য
কারণ আমার রোম ভ্যাটিকান গিয়ে তাঁর সৃষ্টিগুলো
দেখার পয়সা নেই
আমার মুখের লম্বা লম্বা দাড়িগুলো আয়নায় বিশ্রীভাবে এসে পড়েছিল
আর তোবড়ানো আমার গালের ছবি
চোখদুটো ঢুকে গেছিল কোঠরে আর বিষমাখা সময়ের ঝাঁজ যখন নিচ্ছি
আমি হাতের বিড়িতে সুখটান দিয়ে—
ওরা ঠিক তখন মার দিল আমার বাবাকে,
জন্মদাতা পিতাকে ভীষণভাবে।
আমার বাবার রক্তে লাল হল পাইনের ছায়াঘেরা
পিচঢালা রাজপথ।

আমি যখন সাদামাটা একটা আঠেরো-উনিশের
এক ছিলাছেঁড়া রাগী কবি
তখন শিলঙ থেকে বহুদূরে কলকাতা শহরে,
আকাশের রং লাল হয়েছিল রঙিন আবীরে
তাতে না ছিল সহজ কোনও মানবতাবোধ, ছিল না
কোনও বিশ্বভ্রাতৃত্বের রং।

কবিদের কান্না, লেখকের অভিমত বুদ্ধিজীবীদের
দরজায় আটকাল উল্টো করে
যেভাবে আমরা আটকাই ঘোড়ার পায়ের নাল
দরজায় উল্টো করে, সৌভাগ্যের কথা ভেবে।
কলকাতা, দিল্লির দরজা বন্ধ ছিল কবি, সাহিত্যিক আর বুদ্ধিজীবীদের জন্য।

আমি তখন সাদামাঠা একটা আঠেরো-উনিশের এক
ছিলাছেঁড়া রাগী কবি নই
কবিতার সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে রাজপথে নামতেই
মাথায় আমার ঠং করে কারা যেন হাতুড়ি পিটল
হেঁকে বলল
কাব্যের সময় নয় এখন, কাব্যকে দাও ছুটি।

অন্ধ রাগে আমি বার্নিনির হাত থেকে কেড়ে নিলাম
হাতুড়ি আর ছেনি
সময়কে তোমাদের নিয়মের বেড়ি থেকে টেনে বের
করে ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে কুটি কুটি করে
নিজের পছন্দে গড়ে তুলতে এবার চেষ্টা করলাম।
তখন বিষণ্ণ রাজপথে পায়চারী করছিল শুধু উলঙ্গ সময়।

আর আজ মধ্যপঞ্চাশে সাদামাটা কোনও বিদ্রোহী তরুণ নই আমি
পাইনের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে চলে গেছে বহুদূর
এই দুরন্ত সময়
বদলে গেছে নগ্ন নির্জন পাইনের ধুপছায়া রং;
শুধু একঝাঁক স্মৃতি আর এক রাগী যুবকের মুখ ছবি হয়ে
বিশাল পাইন গাছের মগডালে আটকে রয়েছে।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
4 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »