—অনেকক্ষণ থেকে দেখছি কিন্তু! ধাক্কা-মুক্কি সইলাম অনেক! এবার যে একেবারে গায়ের ওপর চেপে পড়লেন প্রায়! বলি হচ্ছেটা কী?
—দেখুন আমার এতে কোনও দোষ নেই। আমার পাশের জন, আমার ওপর চেপে পড়েছে প্রায়।
—থামুন মশাই! আমার দশাটা দেখুন আগে। আমার পাশের জন কেমন সিঁটিয়ে আছে আমার পাশে।
—সবার একই দশা দাদা-দিদি! আমি বলি কী, বরং খবর নেবার চেষ্টা করুন, কত নম্বর চলছে?
—শালা! সারা জীবন লাইন দিতে দিতে ঝলসে গেসলুম। মরেও শান্তি নেই! এখানে রিয়েল ঝলসানোর আগেও লাইনে দাঁড় করাল!
এইসব কথোপকথন চলছিল, বড় শহরের সদ্য ট্রান্সফর্মড শ্মশানে। ‘ট্রান্সফর্মড’ এইজন্য বলা কারণ, এ জায়গাটা আগে পোষ্য প্রাণীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। মানে, এটা পেট ক্রিমেটরিয়াম ছিল। স্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে, এটাকে মানুষের অন্তিম সংস্কারের জায়গার দরজা দেওয়া হল। ব্যাস আর কী! ভিড় লেগে গেছে এখানেও!
—সাতাশ নম্বর চলছে। সামনের দিক থেকে আওয়াজ এল।
—দাদা আপনার নম্বর কত? শুধোল ছেষট্টি।
উত্তর পেল, বত্রিশ।
—যাঃ শালা! এখানেও পেছনের সারিতে আমি? আক্ষেপ শোনা গেল ছেষট্টির।
বাতাসে উত্তেজনার সুর বইছে। ভেতরে ভিড়। বাইরেও খুব কম নয়। উত্তেজনার মাঝে যেন একটা অসম্ভব থমথমে ভাব লুকিয়ে আছে। এত বছর এখানে আছি, এমন আবহাওয়া কখনও দেখিনি। সকাল হলেই উন্মুক্ত ডালপালা মেলে, যত ইচ্ছে সূর্যের আলো নিজের মধ্যে ভরে নিই। আকাশের সঙ্গে গল্প করি, বাতাসের সঙ্গে খুনসুটি, পাখিদের সঙ্গে মাখামাখিতেই সময় চলে যায়। কিন্তু আজকাল যেন অন্য ব্যাপার ঘটছে। তাকালাম নিচের দিকে। মাটির সঙ্গে জুড়ে থাকা, শিরা-উপশিরাদের খবর করলাম সজাগ হতে। আশপাশে কী কী সব হচ্ছে সব তথ্য আমার চাই।
—অত সোজা নয়। সব তথ্য গোপন রাখার চেষ্টা চলছে! ফোড়ন কাটল মূল।
আমি হাল ছাড়লাম না। বললাম, যতটুকু পাওয়া যায়, তাতেই চলবে। একঘেয়েমি কাটাতে ইচ্ছে করছে যে!
মূল হাসল, বেশ তাই হবে। তবে তৈরি থেকো। মনে জোর রেখো যেন।
আমিও তৈরি হয়ে নিলাম। আর তারপর থেকে যা শুনেছি, তা অলরেডি বলে ফেলেছি।
—এই প্লাস্টিকের থলির ভেতরে থাকা সত্ত্বেও দম বন্ধ হচ্ছে না কেন বলো তো? বলল আর একজন।
—দমবন্ধ হয়েছে বলেই ও থলিতে ঢুকেছ তুমি! বোঝনি বুঝি? শুধরে দিল অন্যজন।
—মানে, আমি মরে গেছি বলতে চাইছ?
—হ্যাঁ, আমরা মরে গেছি।
—এই তোমার নাম কী?
—ভুলে গেছি। এখন শুধু নম্বরই মনে রাখতে হচ্ছে কিনা!
আলাপচারিতা চলছিল, তেত্রিশ আর তেতাল্লিশের মধ্যে। একান্ন নম্বর বলে উঠল, বলো দেখি, কোনও যুক্তি আছে? সারা জীবন মাইরি সাবধান হয়ে থাকার জন্যে, চুপ করে থাকলাম! কখনও কোনও কিছুর প্রতিবাদ করিনি। প্রতিবাদ তো দূরের কথা, ‘ভালবাসি’ বলতেও মুখে কুলুপ এঁটেছি, পাছে কোনও এদিক-ওদিক হয়! আর এখনও চুপ করেই আছি, তবে এ অমর্যাদা আর সহ্য হচ্ছে না।
পঞ্চান্ন বলে উঠল, রাখুন মশাই আপনার মর্যাদা! এদেশে কীসে মর্যাদা আছে বলুন তো, যে আপনি মৃত্যুতে মর্যাদা খুঁজছেন?
বাষট্টি ফুট না কেটে আর পারল না। বলল, আমি বলি কী, সারা জীবন যখন চুপ করেই থাকা হয়েছে, আমরা যারা বলেছি, সাহস করেছি, তাদের নিতে হয়েছে ‘বাচাল’ তকমা— এখন যখন সত্যিই চুপ করে থাকার সময়, তখন চুপ করে থাকলেই ভাল হয় না কি?
এই প্রথম বার একান্নর প্রতিবাদ করার ইচ্ছে হল। ইচ্ছে হল, এই প্লাস্টিকের কভারটাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে বাষট্টিকে চ্যালেঞ্জ করে বলে, চুপ করে থাকাটা তখন ছিল চয়েস আর…
—আর এখন হল বাধ্যবাধকতা। ফট্ করে বলল বাষট্টি, জানেন এই বাধ্যবাধকতাটাও যেন চয়েস অনুসারে হয়, তার জন্যও সময় থাকতে মুখ খুলতে হয়!
উনষাট বলে উঠল, ‘দিদি, আপনি তো বললেন, আপনি বলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। তা আপনি এখানে এভাবে কেন?
বাষট্টি বলল, ‘আমি বলার চেষ্টা করেছি, প্রতিবাদ করেছি সময়ে সময়ে। তাই আপনাদের সঙ্গে এক সারিতে এখানে থাকলেও, এক যুক্তিতে আমি এখানে নেই। আমি অন্তত পাল্টানোর চেষ্টা করেছিলাম। আওয়াজ তুলেছিলাম। আমার বরাদ্দ সময় এইটুকুই, এটাই আমার ভবিতব্য, এসব আমি শেষদিন পর্যন্ত মানিনি। বলে এসেছি, সিস্টেম আমাকে বাঁচতে দিল না। শুনছেন না? বাইরে কেমন এই নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে ওরা।
একান্নর এবার কান্না পেল। কান্নার অনুভূতি আর সত্যিসত্যি কান্নার মধ্যে কি তফাত আছে? আছে। অনেক তফাত আছে। সত্যিকারের কান্না হল গিয়ে রক্ত-মাংসে গড়া! বুকের ভেতর কী যেন একটা মোচড় দিয়ে ওঠা। চোখের কোণে জমা জল টসটস করে, গালের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়া! আরও কত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যোগদান থাকে তাতে। একান্ন ভাবল, যখন সত্যি কান্নার সুযোগ ছিল, তখন ভয়ে কাঁদিনি। লোকে দেখে ফেললে কী বলবে? আর আজ, কান্নার জন্য সবচেয়ে জরুরি, নিজস্ব শরীরটাতেই আর প্রাণ নেই।
সরব আওয়াজ এল, আঠাশ নম্বর…। একজন বাড়ির লোক আসবেন। শুধু একজন। আরে এসব অ্যালাউড নেই, তাও আমরা করতে দিচ্ছি। না, না অতসব হবে না। খালি নিয়মরক্ষা করুন। ওই ওপর থেকেই কাঠের আগুনটা মুখে ছুঁইয়ে মুখাগ্নি সারুন! তাড়াতাড়ি! এ বাকি সব হিসাব এনার ক্লিয়ার আছে তো? শেষের লাইনটা নিজের সাগরেদকে উদ্দেশ্য করে বলা।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। জবাব এল।
উনত্রিশ নম্বরকে ‘বাই বাই’ বলে আঠাশ নম্বর চিতায় উঠল। সত্যি কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে, নিজেকে শক্ত করে মুখাগ্নি করল আঠাশ নম্বরের বাড়ির লোক। আগুনের লেলিহান শিখার সঙ্গে মশখরী করতে করতে, আঠাশ নম্বর, দূর আকাশের পথে পাড়ি দেবার আগে, কান্নায় ভেঙে পড়া, তার প্রিয়জনকে একবার মুখ ফিরিয়ে দেখল। মনভরে স্নেহাশীষ ঢেলে দিল প্রিয়জনের প্রতি। তারপর আকাশপথে চটপট রওনা দিল। মনে সংশয়, কে জানে ওপারে আবার ‘সোল লাইন’টা কতটা লম্বা হবে? যে রেটে এখানে ভিড় জমেছে, ওখানেও সিস্টেমে গলদ থাকলে, সব ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হতে বাধ্য! তবে প্রথমবারের পর ওখানে নিশ্চয়ই সচেতনতা বেড়ে থাকবে। এখানে সেকেন্ড ওয়েভের ল্যাক অফ প্রিপারেশন দেখে, নিশ্চয়ই ওপারে ওয়ার্কলোড যে বাড়বে, সে খবর আগেই পৌঁছে গিয়ে থাকবে।
—আরে হলটা কী? ওই চুয়াল্লিশ, ছাপ্পান্ন, ওরে বাবা আরও বেশ ক’জন আছে যে! দেখো, দেখো! ওদের কোথায় যেন আলাদা করে নিয়ে গেসল না? আবার এ লাইনে চেপেচুপে ঢোকাচ্ছে। ব্যাপারটা কী? শুধোল সাতচল্লিশ।
—আর বলবেন না! ভয়ে আধমরা, ছাপ্পান্ন নম্বরের পুরো মরাটা বলে উঠল, আমাদের ওদিকে নিয়ে গেল। মনে ভাবলুম, বিশেষ কোনও ব্যবস্থা বোধহয়! ওমা! ওখানে প্লাস্টিকের কভার থেকে বের করে, আমাদের শরীরের জামাকাপড়গুলো খুলে, তা জমা করছিল। আমার শার্টটা সবে খুলেছে, আর কিছু সমাজ-সংস্কারক না মিডিয়ার লোক জানি না বাপু, তারা এসে হইহই করে, ওই যারা জামাকাপড় খুলে জমা করছিল তাদের ধরল।
চুয়াল্লিশ বলল, আর কী বলব, ভাগ্যিস আমাকে ওদিকে নম্বরের হিসেবে লাইনে আগে রাখেনি, নইলে ছাপ্পান্নর শার্টের আগেই আমার ফ্যাশনেবল টপে হাত পড়ত… জিন্সটি তো বাদ যেতই না। ওই লোকগুলো আমাদের জামাকাপড়গুলোকে একবার ধুইয়ে, তাতে বড় ব্র্যান্ডের সব লেবেল লাগিয়ে, আবার বেচার চক্র চালাচ্ছিল। ওদের কাছ থেকে নাকি আরও একরাশ, আমাদের আগের সঙ্গী-সাথি ওপারযাত্রীদের কাপড়জামা বরামদ হয়েছে।
—কী নির্লজ্জ, কী নির্লজ্জ, আমাদের শরীরটাকে পরিজনদের একবার শেষদেখা দেখতে পর্যন্ত দিল না, অথচ আমাদের পরনের পোশাকটা খুলে নিয়ে, তাকে আবার বেচার ধান্দা করছে? না বলে পারল না সাতচল্লিশ।
খুব বিষণ্ণ মনে ছিল পঞ্চাশ। সে বলল, ভাই নাতিটার কাছ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা চাইল আমাকে জ্বালাবার জন্য। ক’দিন আগেই আমার ছেলেটাও গেছে। আর পনেরো দিনের মাথায় আমি। ছেলের সময় তেরো হাজার নিল। পনেরো দিনের মধ্যেই পঁচিশ হাজার চাইছে। অনেক বলেকয়ে সতেরোতে রফা হল। নাতিটার জন্য বুক ফেটে যাচ্ছে আমার।
তাকে সান্ত্বনা দিল চুয়াল্লিশ, আর কিছুক্ষণ! ব্যাস! আমরা ওপারে রওনা দেব। এদের হিসাব এরাই বুঝুক। এদেরও ওপারে যেতে হবে একদিন। হয়তো এরও বিচার হবে।
—বিচার কি সত্যিই হয়? বলল বাহান্ন, এই দিন সাতেক আগে, খবর পেয়ে দৌড়ে গেলাম নদীর পারে। কী বীভৎস দৃশ্য! একাত্তর জন, কেউ আধজ্বলা, কেউ…। আর বলতে পারল না সে।
—কী বলছ গো! আমি যে আবার সাঁতার জানি না। তরতরিয়ে চিতায় একবার উঠতে পারলে হয়! ভয়-কান্না মেশানো গলায় বলল চল্লিশ।
জবাব এল একশো একের কাছ থেকে, দিদি আপনি লাইনে লিডে আছেন। টেনশন নেবেন না। আপনাকে সাঁতরানোর পর্যায়ে যেতে হবে না। কেস খাবার চান্স আমাদের।
একশো এক, বেচারা, নিজের লাইনে বডি দিয়ে জায়গা ঘিরে, সদ্যপ্রাপ্ত আত্মিক অস্তিত্ব নিয়ে লাইনের আগের দিকের খবর নিতে এসেছিল যে, কী সিচুয়েশন চলছে!
বিয়াল্লিশ গলাখাঁকারি দিল। সে এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি। দৃঢ় স্বরে বলল সে, অনেক হয়েছে। এখন আর কচকচিয়ে লাভ নেই। ওপারে গিয়ে, আবার সুযোগ আদৌ কিছু পেলে, তখন দেখব। আপাতত এ লাইনে চুপ করে শুয়ে থাকাই শ্রেয়। ঠিক যেমন আমাদের শরীর শুয়ে আছে। আমরা সারাজীবন শুয়ে-বসেই তো বেঁচেছি। অযথা মুখ খোলা এড়িয়ে গেছি। আজ সব নিজের মত করে ফেরত এসেছে। তাকে স্বীকার করি, আর যাওয়ার রাস্তা ধরি!
এ বড় কটু সত্য! কিন্তু ওরা সবাই তা এই মুহূর্তে মেনে নিতে চাইল। ‘নিরুপায়’ শব্দটা বড় সরল করে অনেক মানে বুঝিয়ে দেয়। আজ মৃতদেহগুলোও তা বুঝে গেল। আমি ওদের অনেক কথা বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলাম। আকাশকেও বললাম অনেক কথা। সূর্য চটছেন এসব শুনে, ভয়ঙ্কর বেড়েছে তাঁর তেজ এই ভরদুপুরে। পৃথিবীর জীবন্ত মানুষেরা তাতে থোড়াই পরোয়া করে! সূর্যকে বলে, যাও! ডোন্ট কেয়ার! আমরা এসি লাগাব! এক শ্রেণির মানুষ আমাদের কাটে, উপড়ে ফেলে। হায়রে মানুষ!
—কী নীরবদের সরবতা সহ্য হল না বুঝি? মূল বলল।
আমি কোনও জবাব না দিয়ে, আবার আমার মত থাকাতে মন দিলাম। আর হ্যাঁ, শেষ যখন দেখেছি ছেষট্টির নম্বর এসে গিয়েছিল!