হাপু গান? না কি খেলা? এ নিয়ে মতের ফারাক বিস্তর। গান যদি হয় তবে অভাব, অনটন, হাহাকারে ভরা সে গানের মোটিভ। আর যদি তা হয় খেলা, তাতে সেরা হয়ে উঠবার প্রয়াস নেই কোনও। আছে কেবল চারপাশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের আকুল আকাঙ্ক্ষা। তার জন্যই যত কসরত, অঙ্গভঙ্গি, সুরের কারিকুরি।
‘হাপু’— মোটে দুটো অক্ষরের ছোট্ট একটা কথা। কতজনে তার কত কথাই না বলেছেন! সঠিক অর্থটি পাওয়া যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ (সাহিত্য আকাদেমি, নতুন দিল্লি) গ্ৰন্থে। সেখানে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন হাপু-র সঠিক অর্থটি— হাঁপ, হাপু (দীর্ঘশ্বাসজনক) দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা, বিপত্তি, কষ্টভোগ করা ইত্যাদি। হাপু শব্দের ব্যবহার হয়েছে এমন উদাহরণ অনেক আছে আমাদের সামনে— বিদ্যাসুন্দর (রামপ্রসাদ সেন)-এ আছে— “(বুড়া) কহে বাপু কেন আপু গণ, যুক্তি আছে…”। ভারতচন্দ্র লিখেছেন— “মালিনী কইছে বাপু, কেন এত ভাবা হাপু, আমি হাট-বাজার করিব।” আবার দাশরথী রায় তাঁর ‘পাঁচালী’-তে লিখেছেন, “আমি ত পাল্লাম না বাপু! এ কষ্টের হাটে গুণতে হাপু।” এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত ‘বঙ্গসাহিত্য পরিচয়’ গ্রন্থেও হাপু সম্পর্কে একটু উল্লেখ পাওয়া যায়— “পেট নিয়ে দ্বারে দ্বারে যদি গুণো হাপু। এমন সন্ন্যাসে তোর কাম কিরে বাপু।” এখানেই শেষ নয়। আধুনিককালের ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এড়িয়ে যেতে পারেননি ‘হাপু’ শব্দটিকে। তাঁর ‘কুহু ও কেকা’-য় দুলাইন লিখেছেন— “হাপু খেলা হ’য়ে হবু মহারাজ, হাপুস-নয়নে চান!”
গানই হোক বা খেলা— হাপুর কুশীলব কারা? এলাকাভেদে বাজিকর, মাল, কাকিমারা, বেদে, পটুয়া ইত্যাদি সম্প্রদায়ের ছেলেরা। তাও আবার শৈশব থেকে কিশোর বয়স পর্যন্ত। পরে ভিন্ন জীবিকায় চলে যায় তারা। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ আর পূর্ব এলাকায় প্রধানত— কাকমারা পরিবারের ছেলেরাই হাপু দেখায়। বহু পূর্বে এদের ঠাকুরদার ঠাকুরদার ঠাকুরদারা এসেছিলেন এবঙ্গে। কলিঙ্গ বা দাক্ষিণাত্য এলাকা থেকে রাজরাজড়াদের যুদ্ধ অভিযানে পদাতিক কিংবা মালবাহক হয়ে। নিম্নবিত্ত আর নিম্নবর্গীয় মানুষজন সব। ভিন্ন এলাকায় এসে একেবারে প্রথম পর্বের দিনগুলিতে গ্রামগঞ্জের বাইরে গাছতলায়, পোড়োবাড়িতে দিনযাপন করতেন।
বাংলা না জানায় ভিক্ষাও জুটত না যখন, শুকনো ভাত ছড়িয়ে কাক শিকার করতেন এরা। রান্না করতেন শ্মশানের আধপোড়া কাঠ জ্বালিয়ে। কয়েকটা দিন কাটিয়ে আবার নতুন এলাকায় পাড়ি দিতেন যাযাবর এই মানুষের দল। কাক মেরে খেতেন তাই নাম হয়েছে ‘কাকমারা’। তাদেরই প্রজন্মান্তরের মানুষ হাপু গায়কেরা।
পরে পরে বাংলা রপ্ত হল একদিন। পুরুষরা হাতে লোহার বালায় বাঁটবিহীন ছুরির আঘাতে শব্দ করে ভিক্ষা করে বেড়াতেন গৃহস্থের দ্বারে দ্বারে। মেয়েরা যেতেন ফিরি করতে। মাথায় চুবড়ি ঝুড়িতে ডাঁই করা কম দামের ছোটখাট জিনিস মূলত গৃহস্থবাড়ির অভাবী মহিলাদের ব্যবহার্য আলতা সিঁদুর আয়না চিরুনি বড়শির ডোর-কাঁটা এইসব। শিশুদের ঘরোয়া টোটকা চিকিৎসায় ভারি পটুত্ব এদের। পুরুষেরা তাবিজ দিতেন।
এদেরই ছোট ছেলেমেয়েরা হাপু খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। ডান হাতে থাকে শক্তপোক্ত একটা লাঠি। বেত কিংবা বাঁশের সেটা। হাত ঘুরিয়ে সপাটে আঘাত করে চলে নিজেরই খোলা পিঠে। সপাং সপাং শব্দ ওঠে দর্শক-শ্রোতাদের চমকে দিয়ে। একই সঙ্গে বাম হাতের চেটো ডান বগলে ঢুকিয়ে বিচিত্র শব্দের উচ্চারণ করতে থাকে তখন। আর মুখে ফোয়ারার মত ঝরতে থাকে গানের কলি। আর মাঝে মাঝে হাপু শব্দের উচ্চারণ। সে এক ভারি অতুলনীয় কৌতুককর পরিবেশ গড়ে ওঠে।
বীরভূম বর্ধমান মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি মধ্যবাংলা এলাকাতেও হাপুর প্রচলন আছে। তবে সেখানে তা নেহাতই ভিক্ষাসঙ্গীত নয়। শিব ও ধর্মের গাজন, মনসার গানের বা বোলান গানের আসরেও হাপু গান পরিবেশিত হয় বলে জানা যায়। বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, সমীরকুমার অধিকারী প্রমুখের রচনা থেকে জানা যায়, সেসব আসরে হাপুগানের সঙ্গে মৃদঙ্গ, খোল, নূপুর, ঘুঙুর ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। কিন্তু নিম্নবঙ্গের জেলাগুলিতে ভিন্ন ছবি। মূলত ভিক্ষার জন্য গৃহস্থের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ানো গায়কেই হাপু পরিবেশন করতে দেখা যায়। তাতে কোনও বাদ্যযন্ত্র থাকে না। গান শুরুর মুখে বিচিত্র শব্দ করে শ্বাস নেওয়া, আর বগল বাজিয়ে শব্দ করা— এই কেবল গানের অনুষঙ্গ।
গ্রামীণ খেলা নিয়ে কাজ করেছেন শংকর সেনগুপ্ত, ওয়াকিল আহমেদ, স্বপনকুমার দাস, পিনাকীনন্দন চৌধুরী প্রমুখ। হাপুর কথা তো তারা কেউ বলেননি। আবার একে গানই বা বলি কেন? যা আমরা শুনি, এগুলো গান কি? আসলে তো এগুলো ছড়া। গানের পদগুলিতে ছড়ার বুনন স্পষ্ট। কয়েকটি গানের গঠন দেখা যাক—
(১)
হাট গেলাম বাজার গেলাম
কিনে আনলাম ওল
ওল খায়া ঘরে আমার
বেজায় গণ্ডগোল।
(২)
হাট গেলাম বাজার গেলাম
কিনে আনলাম নাড়ু
নাড়ু খায়া বউর আমার
পেট হয়েছে গাড়ু।
(৩)
হাট গেলাম বাজার গেলাম
কিনে আনলাম তাল
তাল খায়া বউ আমার
করে গালাগাল।
আরেকটি ছড়াও গ্রামাঞ্চলে বহুল প্রচলিত ছিল—
(৪)
বৌদি তুমি, আম খাবে জাম খাবে
তেঁতুল খাবে না
তেঁতুল খেলে পেট গোলাবে
ছেলে হবে না।
গানের ভাষা, তার গায়কী ও সুর এবং সর্বোপরি পরিবেশনের ঢং এমনই কৌতুকের আবহ তৈরি করত যে শ্রোতারা হেসে লুটোপুটি খেত। কপাট ধরে দাঁড়ানো বউ-ঝিদের আমোদ হত দেখবার মত। হাপুর গায়করা চলে যেত, কিন্তু গানটা অনেক দিন ঘুরে বেড়াত ছেলেপুলেদের মুখে মুখে।
সমাজজীবনের চালচিত্র দেখা যেত হাপুর গানগুলিতে। কৌতুক-কথায় বিদ্ধ করে সমাজকে—
(৫)
জমিদারের লম্বা কোঁচ
মুখজুড়া ঝাঁতুয়া মোচ
সকাল সন্দ্যা হাঁকাডাকা
বাবুর কিন্তু পকেট ফাঁকা।
কিংবা—
(৬)
দাদা চলল সিনিমা
বৌদি রইল ঘরে
পাড়ায় যত চ্যানকামনে
উঁকিঝুঁকি মারে।
ইত্যাদি এরকমই সব গান। যে কালে দুমুঠো চাল, এক-আধটা ছেঁড়া কাপড়চোপড় বা ভরদুপুরে পাতের দুমুঠো ভাতের আশায় গৃহস্থ বাড়ির দরজায় দরজায় পটের গান, যুগির গান, ফকির গান শোনা যেত, গৃহস্থ বিরক্তও হতেন না, গান শুনতেন সাগ্রহে, বিদায় করতেন শিল্পীদের হাতে-পেটে কিছু দিয়ে, বর্তমানে সেই ছবি বদলেছে। তারা নিজেদের রুজিরুটির জন্য ভিন্ন জীবিকায় যুক্ত হয়েছেন।
তবু কিছু অভাবী মানুষ এই কাজে রয়ে গেছে। এরা এখনও পুরনো বৃত্তি আঁকড়ে। গৃহস্থবাড়িতে যেহেতু তেমন একটা আর ভিক্ষে জোটে না, তাই হাপু গানকে সম্বল করে এখন উঠে এসেছে লোকাল ট্রেনের কামরায়। আজও চলন্ত ট্রেনের কামরায় হাপু শোনেন দেখে সকলে দুটো-একটা পয়সাও তুলে দেন তাদের হাতে। কিন্তু তাতে পোড়া পেট ভরে না ভাল করে। পিঠের কালশিটে দাগগুলোই কেবল চওড়া হতে থাকে প্রতিদিন।
খুব ভালো ?
বিষয় টিয়আমার অজানা ছিল , পড়ে ভালো লাগলো