লর্ড কার্জন হরিনাথ দে সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি ভারতে মাত্র আড়াই জন মানুষ দেখতে পান— দুইজন পূর্ণ এবং একজন অর্ধ। এই দুইজনের একজন ছিলেন হরিনাথ দে। স্বল্পায়ু জীবনে হরিনাথ দে ১৮টি ভাষায় এমএ পাশ করেছিলেন এবং ৩৪টি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। এরকম বিস্ময়কর প্রতিভা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কেউ আছেন বলে জানা নেই। অথচ তিনি আজ বিস্মৃতির অতল গর্ভে তলিয়ে গিয়েছেন। বাঙালি সমাজ, ভারতীয় সমাজ এবং পৃথিবীর মানবসমাজ তাঁকে আজ একেবারেই ভুলে গিয়েছে। তাই তো তাঁর নামে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তাঁর মূর্তিও কোথাও চোখে পড়ে না। অথচ এরকম একজন মনীষীর নাম আমাদের প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করার কথা ছিল, এবং তাঁর মহান জীবনকাহিনি পাঠ করে তাঁর জীবনের আদর্শে নিজেদের জীবন গড়ে তোলার কথা ছিল।
আচার্য হরিনাথ দে জন্মেছিলেন চব্বিশ পরগনা জেলার আড়িয়াদহ গ্রামে, ১২ আগস্ট, ১৮৭৭ সালে। পিতা রায়বাহাদুর ভূতনাথ দে, মাতা এলোকেশী দেবী। হরিনাথের বাল্যকাল কেটেছিল পিতার কর্মস্থলে, মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে। রায়পুরের মিশন স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা। তারপর নরম্যাল স্কুল। এখান থেকে আপার প্রাইমারি পরীক্ষায় পাশ করে ভর্তি হন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। এই স্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে মিডল্ স্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। রায়পুর থেকে চলে আসেন কলকাতায়।
কলকাতায় এসে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের স্কুল বিভাগে। এখান থেকে প্রথম বিভাগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন, এবং একই কলেজে এফএ ক্লাসে ভর্তি হলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফএ পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম বিভাগ পেয়েছিলেন। এরপর হরিনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজের তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। তিনি লাতিন এবং ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ পরীক্ষায় এই কলেজ থেকে তিনি লাতিনে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, এবং ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে চতুর্থ হন। এরপর হরিনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাতিনে এমএ পরীক্ষা দেন, এবং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
১৮৯৭ সাল। হরিনাথ বিলাত যাত্রা করলেন, এবং কেমব্রিজের ক্রাইস্ট’স কলেজে ভর্তি হলেন। বিলাতে থেকেই একটি বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিকে এমএ পরীক্ষা দেন, এবং প্রথম শ্রেণিতে পাশ করেন। ১৯০০ সালে হরিনাথ ক্রাইস্ট’স কলেজের স্নাতক হন। এই বছরেই কেমব্রিজের ক্ল্যাসিকল ট্রাইপস, প্রথম ভাগে তিনি প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার সম্মান লাভ করেন। কেমব্রিজের প্রখাত অধ্যাপক জন পিল হরিনাথকে দেওয়া শংসাপত্রে লেখেন— ইংল্যান্ডের শিক্ষাবিভাগে উচ্চপদ লাভের পক্ষেও হরিনাথের যোগ্যতা যথেষ্ট ছিল।
১৯০১ সালে হরিনাথ কেমব্রিজের মধ্যযুগীয় এবং আধুনিক ভাষাবলির ট্রাইপসে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। তিনি শেকসপিয়র এবং চসার-সাহিত্যে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের স্কিট পুরস্কারও লাভ করেন। কেমব্রিজের আর একজন প্রখ্যাত অধ্যাপক, হেনরি জন এডওয়ার্ডস বলতেন— হরিনাথের মত অসাধারণ মেধাবী ছাত্র তিনি আর একটিও দেখেননি।
১৯০১ সালের শেষদিকে হরিনাথ বিলাত থেকে ভারতে ফিরে আসেন। তিনি ঢাকা সরকারি কলেজে ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এর কিছুদিন পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন পরীক্ষার পরীক্ষক এবং প্রশ্নকর্তা ছিলেন তিনি। ১৯০৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে চলে আসেন, এবং ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করতে থাকেন। এরপরে হরিনাথ হুগলি কলেজের অধ্যক্ষের পদও অলংকৃত করেছিলেন। ১৯০৭ সালে হরিনাথ কলকাতা ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির (বর্তমানে ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার) গ্রন্থাগারিক হন। প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই কৃতিত্ব তাঁরই। তাঁকে নিয়ে ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ গ্রন্থে একজায়গায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন, ‘‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে হরিনাথ দে মস্ত ভাষাবিদ, সব ভাষাই তিনি জানতেন শুধু চীনে ছাড়া; বলতেন, ‘এবারে চীনেভাষাটা আমার শিখতে হবে।’’
হরিনাথ দে বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৪ বছর। জীবনের বেশিরভাগ সময়েই পৃথিবীর বিবিধ ভাষা নিয়ে গভীর চর্চা করেছেন। গ্রিক, লাতিন, ফরাসি, জার্মান, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, রুমানীয়, ডাচ, ড্যানিশ, প্রভঁসল, ইতালীয়, অ্যাংলো-স্যাকশন, গথিক, হিব্রু, চিনা, তুর্কি, আরবি, ফারসি, জেন্দ, তিব্বতি, সংস্কৃত, পালি, গুজরাতি, মারাঠি, ওড়িয়া, হিন্দি, উর্দু, বাংলা প্রভৃতি ভাষায় ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তিনি তাঁর সমগ্র জীবনে কুড়িটি ইউরোপীয় এবং চোদ্দোটি ভারতীয় ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে অনেক গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন। বিশ্বের বিদ্বৎসমাজে বহুভাষাবিদরূপে তিনি স্বীকৃতিলাভ করেছিলেন।
১৯১১ সালের ৩০ আগস্ট এই মহাপ্রাণ মানুষটির জীবনাবসান হয়। কবির ভাষায়—
‘‘আজ শ্মশানে বঙ্গভূমির নিবল উজল একটি তারা,
রইল শুধু নামের স্মৃতি রইল কেবল অশ্রুধারা;
নিবে গেল অমূল্য প্রাণ, নিবে গেল বহ্নিশিখা,
বঙ্গভূমির ললাট ’পরে রইল আঁকা ভস্মটীকা।’’
[শ্মশান-শয্যায় আচার্য্য হরিনাথ দে: সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত]
প্রথম এই ব্লগটি পড়লাম।এবং সমৃদ্ধ হলাম।হরিনাথ দে এর মতো পন্ডিতের কথা কখনও কেউ জানায়নি বোধ করি, এমন একজন পন্ডিত, ভাষাবিদ এত অল্প বয়সে চলে গেলেন শুধু এই রহস্যটা অধরা রয়ে গেল এই লেখায়।
থিয়েটার নিয়ে হরিনাথের কোমর আগ্রহ ছিল না অবাক লাগে! ঠাকুর বাড়িতে এত যাতায়াত, ইউরোপের এত দেশেকি থিয়েটার আকৃষ্ট করেনি!
তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।শুধু হরিনাথ দে র মতো মানুষের এমন রহস্য মৃত্যু ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা বিষয়ে একটু আলোকপাত করলে ভালো হতো।